একজন কবির অপমৃত্যু

ঝরাপাতা এর ছবি
লিখেছেন ঝরাপাতা (তারিখ: মঙ্গল, ১৪/০৮/২০০৭ - ৫:২৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

______
কবিতা একটি বিমূর্ত সাহিত্যকর্ম। এমেন অনেক অধরা বোধ আছে যা কবিতার একটি মাত্র লাইনের মধ্যে দিয়ে সহস্র বীণার ঝঙ্কার হয়ে বর্ণিল আলোকছটায় ছড়িয়ে পড়ে অন্তরের নিভৃতকোণে। সেই কবিতার জন্মদাতা অর্থাৎ যিনি কবি তাঁরও কিন্তু দায় অনেক। কবির দায় সমাজের কাছে, দেশের কাছে, সর্বোপরি অগনিত পাঠকের কাছে। তাই কবিকে হতে হয় সত্যানুসন্ধানী, এমনকি প্রয়োজনে প্রতিবাদীও। কিন্তু কবি যখন সত্য থেকে বিচ্যুত হন তখন কি তাঁর মৃত্যু ঘটে না। অবশ্যই ঘটে। তেমনটি ঘটেছে কবি আল মাহমুদের ক্ষেত্রে।

আমি একসময় কবি আল মাহমুদের একনিষ্ঠ ভক্ত, পাঠক ছিলাম। 'পানকৌড়ির রক্ত' গল্পের মধ্যে দিয়ে তাঁর সাহিত্যকর্মের সাথে আমার পরিচয়। এরপর সম্মোহিতের মতো এক এক করে পড়ে গেছি কালের কলস, লোক-লোকান্তর, সোনালি কাবিন, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে এমন অনেক কবিতা সম্ভার। তাঁর কবিতায় বিদ্রোহী সত্ত্বা, ভিন্ন প্রকাশভঙ্গি, বর্ণনার সাবলীলতা মুগ্ধ করে সবসময়। এখনো স্মৃতিতে উজ্জ্বল সোনালি কাবিনের সেই অসাধারণ লাইনগুনি -

সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিনী,
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু'টি,
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি,
আহত বিক্ষত করে চারিদিকের চতুর ভ্রুকুটি;
....................................................

সেই আত্মবিক্রয়ে আপোষহীন কবি আল মাহমুদ একদিন হয়ে গেলেন চরম আস্তিক। তাতে আমার তাঁর প্রতি ভালোবাসার কোন ব্যতয় ঘটেনি। মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন হতেই পারে। এতোদিন তিনি যেটা করে এসেছিলেন সেটা হয়তো সময়ের ব্যবধানে তাঁর কাছে ভুল বলে প্রতিভাত হয়েছে। কিন্তু যখন তাঁকে দেখলাম দেশদ্রোহী, রাজাকারদের সাথে একই মঞ্চে কলহাস্যরত তখনই আমার বুক ফেটে গেল। আমি সত্যানুসন্ধানী কবির ছায়াও খুঁজে পেলাম না কোথাও। অস্ত্র হাতে পাক-হানাদার আর তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে জীবন-পণ যুদ্ধ করা কবি এখন জামাতের রোল মডেল। এখন তাঁর বক্তব্য আর সাঈদীর ওয়াজের মধ্যে বিষয়গত কোন পার্থক্য নেই শুধু প্রকাশভঙ্গির ভিন্নতা ছাড়া। আরো অবাক লাগলো টিভিতে তাঁর এক সাক্ষাতকার দেখে। তিনি জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে অনেক ভুরি ভুরি বিশেষণের আদিখ্যেতায় ভাসিয়ে দিলেন, এমনকি জিয়াউর রহমান যে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে তের জন আর্মি অফিসারকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সামান্যতম সুযোগ না দিয়ে নির্লজ্জভাবে ফাঁসি দিয়েছিলেন সেটাকেও এক বাক্যে জায়েজ করে দিলেন এই বলে, 'জিয়াউর রহমান সাহেব কোন ভুল করেননি, সেসময় এর বিকল্প ছিলো না।' একজন কবির এমন নির্লজ্জ তৈলমর্দন আমাকে চরম বিস্মিত করেছিল। হায়রে আমার এক সময়কার চরম সাহসী, লোকধর্ম আর ভেদাভেদ ঘুচে দেয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ী চিরচেনা কবিও কেমন অচেনা হয়ে গেলো।

সেই ঘটনার পরেই আমার পাঠক মনে মৃত্যু ঘটছে শৈশব থেকে মুগ্ধ বিস্ময়ে লালন করা কবির যার নাম আল মাহমুদ, তেমন কি আরো অনেকের নয়?

__________________________________
সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ।


মন্তব্য

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

কবির অপমৃত্যু?
আর কবিতার?
-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

ঝরাপাতা এর ছবি

কবিতার মৃত্যু নেই, কবিতা অবিনশ্বর।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

কবিতা যদি আমার সামষ্টিক অস্তিত্বের চেয়ে জরুরী হয়,আজকের আলমাহমুদ সে অস্তিত্বের জন্য অনেক ভয়ংকর ।
তাই তার ভালো লাগা কবিতাও আমাকে চেপে থাকতে হবে । কি আর করা মন খারাপ

জুবায়ের ভাইয়ের এই পোষ্টে আরেকটু বিস্তারিত লিখেছিলাম ।

-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

ঝরাপাতা এর ছবি

হ্যাঁ আপনাদের আলোচনাটা পড়েছি। সেটা পড়েই পোস্টটা দেয়ার প্রেরণা পেয়েছি। আল মাহমুদের কবিতা বাংলা সাহিত্যে উচ্চাসনেই থাকবে কিন্তু আমার মতো অনেক ভক্তের মনের আসনে ঠাঁই মিলবে না আর। আর একজন মানুষকে শুধুমাত্র একসময়ের ভূমিকাকে আশ্রয় করে মূল্যায়ন করা চলে না, সামগ্রিক জীবনে তার অবস্থানকে বিবেচনা করতে হয়।

একজন রাজাকার সবসময়ই রাজাকার কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা সবসময় মুক্তিযোদ্ধা নন।

(ব্লগে কোথায় যেন পড়েছি মনে পড়ছে না) এই কথাটাই বড় বেশি সত্যি।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

বহু কবিই কিন্তু হাড়বজ্জাত ।
নিজেরা লিখতে জানেতো,তাই লিখে টিখে নিজেদের বেশ উচচমার্গীয় আদর্শমোকাম বানিয়ে ফেলে ।

রাজারাজড়ার যুগে বেশীরভাগ কবিই রাজবন্দনা করতো । পাকিস্তানী শাসকদের বন্দনাকারী কবির সংখ্যা ও কমছিলোনা । এরশাদের কবিসভা তো আর আমাদের স্মৃতিতেই ।
অধূনা বহু কবিও প্রগতির আড়ালে প্রতিক্রিয়াশীলদের মদদ যোগান ।

অবশ্য অনেক উদারপাঠকই কবিতার প্রতি ভালোবাসা থেকে ব্যক্তিকবির বদমায়েশীকে ক্ষমা করে দেন ।

পাঠকইশ্বরের অসীম দয়া ।।
-----------------------------------
'আমি ও অনন্তকাল এইখানে পরস্পর বিস্ময়ে বিঁধে আছি'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

এই জিনিসটা আসলেই শকিং ,,, হতভম্ব হয়ে যাই ভেবে ,,, কতবড় কবি সেটা ব্যাপারনা ,,,
কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা কিভাবে রাজাকারদের সাথে মিলে যায়!!!

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

আরিফ জেবতিক এর ছবি

মানুষ পচেঁ গেলে গন্ধ ছড়ায়,
কবি পচেঁ গেলে বিভ্রান্তি ছড়ায়।

-----------------------------------
কিস্তিমাতের যুদ্ধ শেষে,সাদাকালো ঘুটিগুলো এক বাক্সেই ফেরত যাবে...

নজমুল আলবাব এর ছবি

কবিতাগুলো যে অস্বিকার করতে পারিনা। এখনওযে নিবিষ্ট হয়ে পড়তেই হয়, না পড়ে ঠিক শান্তি পাইনা।

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

ঝরাপাতা এর ছবি

ধন্যবাদ জ্বিনের বাদশাহ, জেবতিক ভাই ও নজমুল ভাইকে। সত্যি কবিতাগুলো অস্বীকার করার উপায় নেই। তবুও আর আগের মতো সেগুলো অনুভবে জীবন্ত হয়ে ওঠে না।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

অতিথি এর ছবি

ঝরা,

একজন বন্ধু , যে কিনা বাংলাদেশের শিল্প সাহিত্য জগতের বিশাল কর্ণধারদের কাছাকাছি হওয়ার এবং ব্যক্তিগত জীবন দেখার সুযোগ পেয়েছিলো , সে আমায় বলেছিলো , কাউকে বিশ্বাস কোরো না। এদের বেশির ভাগই যেই সব নীতির কথা বলে , তা নিজেরাই মানে না কখনো । বন্ধুকেই বিশ্বাস করিনি , "বললেই হলো ! আমি কান কথায় মান রাখিনে।"

কিন্তু , জীবনে যেই সব ডিরেক্টর , নাট্যজনকে প্রচন্ড শ্রদ্ধা করে এসেছি তাদের একজনের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েই প্রথম যেই প্রশ্নটা শুনেছিলাম ," আপনি কি রাত ১১টার পরে বাইরে থাকতে পারবেন?প্রথমে ভেবেছি , হয়ত অভিনয়ের কথা বলছেন। কথাটার মানে বোঝার পরে ............

তসলিমা নাসরিন এর অনেক কাজে আমিও বিরক্ত হই , কিন্তু সেই "বেশরম নারী বড় বেশি করে লিখে রেখে গেছে শরমের কথা গুলো ।" ও সব সত্য , যত বেশি করে দেখছি , লাভের গুড়ের কাড়াকাড়ি , মেয়ে মানুষ নিয়ে টানাটানি - জানছি , ও সব বড় বেশি সত্য।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।