হাটবার বলে সন্ধ্যা হয়ে গেলেও পুরো হাট জনশূন্য হয়ে যায় না। বিভিন্ন পসারি যার যার পসরা নিয়ে তখনো বসে আছে কেউ কেউ। পসরা গুটিয়ে ফেলবার আগে দুএকটা খদ্দের পাওয়া যায় কি না। কিছুটা দূরে দোনলা কুপি বাতি জ্বালিয়ে এক বেদেনী তার পসরা নিয়ে বসে আছে। রহিমুদ্দি দূর থেকে বেদেনীর পসরা দেখে। চুড়ি, ফিতে, পুতির মালা, তাবিজ-কবজ সহ আরো অনেক নাম না জানা জিনিস। সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। এক সময় হয়ত নিজেরই অজান্তে এগিয়ে যায় সম্মোহিতের মত।
মাটিতে বিছিয়ে রাখা বেদেনীর পসরার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বেদেনী বলে, 'কোনডা নেবা, যাবার সোমায় দাম কম নেবানে!'
একগাছি লাল কাচের চুড়ি রহিমুদ্দিকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। সে উবু হয়ে চুড়িগুলো হাতে নেয়। চুড়ির মসৃন আর পিচ্ছিল গায়ে নিজের অজান্তেই হাত বুলায়। তারপর চুড়ির বেড়ের ভেতর চার আঙ্গুলের মাথা ছুঁইয়ে ভাবে, আয়শার হাতে লাল চুড়ি খুবই সুন্দর দেখাত। গায়ের রঙের কারণে লাল রঙটা আরো গাঢ় হয়ে ফুটে উঠতো যেন। আয়শার হাত খুব নরম ছিল বলে মাপের চেয়ে কিছুটা ছোট চুড়িও গলে যেত অনায়াসে।
রহিমুদ্দি আয়শার মুখটা মনে করতে চেষ্টা করে। কিন্তু স্পষ্ট মনে করতে পারে না। লাল রঙের প্রতি তার আকর্ষন ছিল খুব। এ রঙের যাই হোক না কেন, তার কখনোই অপছন্দ হত না। খুশিও হত। এখন রহিমুদ্দির ঘরে এ চুড়ি হাতে পরবার মত কেউ নেই। তবুও কেন জানি হঠাৎ সে বলে ওঠে, 'এক মুঠ কত চাও?'
বেদেনী বলে, 'লাও! সাতট্যাকা দিয়ে দিও!'
রহিমুদ্দি চুড়ি নেবে না। কিনবার ইচ্ছে নেই। তবুও যেন মুখ ফসকে বলে ফেলে, 'তিন টাহা দেবানে!'
'না। এই গিলান রেশমি চুড়ি। তিন-চার ট্যাকায় এই চুড়ি বিকোয় না।'
বেদেনীর মুখে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠলে রহিমুদ্দি আবার উবু হয়ে চুড়িগুলো রেখে দেয়। যেন একটু শব্দ হলেই তারা ব্যথা পাবে। তারপরও চুড়িগুলোর প্রতি সে তাকিয়ে থাকে।
বেদেনী বলে, 'লাও, দাম তো বেশি চাইনি!'
রহিমুদ্দি কিছু বলে না।
'চুড়ি নেবা না?'
'নাহ!'
বেদেনী চুড়িগুলো হাতে নিয়ে রহিমুদ্দির দিকে বাড়িয়ে ধরে আবার বলে, 'লাও, পাঁচ ট্যাকা দিও!'
রহিমুদ্দি রাজি হয় না। সে ফিরে যাবার মনস্ত করে।
বেদেনী কাগজ দিয়ে চুড়িগুলোকে মুড়িয়ে বলে, 'আচ্ছা, তিন ট্যাকাই দ্যাও! রাইত হইয়ে গেছে বইলে দিলাম!'
অনিচ্ছা সত্ত্বেও রহিমুদ্দি চুড়িগুলো নেয়। এগুলো নিয়ে সে কী করবে জানে না। এমন কেউ নেই যাকে সে চুড়িগুলো দিয়ে দিতে পারে। তবু সে ওগুলো নিয়ে নৌকায় ফিরে আসে। তারপর গলুইয়ের নিচে খুব যত্নে রাখে, যাতে ওগুলোতে কোনোমতেই পানি লেগে না যায়।
কাদায় গেঁথে রাখা লগি থেকে দড়ির গিঁট খুলে সে লগি টেনে উঠিয়ে নেয়। তারপর বদর বদর বলে আস্তে ধীরে নৌকা ছাড়ে। চারিদিক ঘোর অন্ধকার দেখা যায়। কেবল হাটের দিকে দুএকটা আলো এখনো জ্বলছে। অবশ্য কিছুক্ষণ পর চাঁদ উঠলেই সব পরিষ্কার দেখা যাবে। অন্ধকারে কেবল পানির উপর দিয়ে অনুমান করে এগিয়ে যাওয়া। তা ছাড়া বাইরের খোলা জায়গার অন্ধকার যতই গাঢ় হোক খালের পানি আবছা মত প্রায় সবটাই দেখতে পাওয়া যায়।
গোঙ্গার হাট পেছনে ফেলে মাইল খানেক এগিয়ে যাবার পর খালের পাড় ধরে দু'জন মানুষকে এগিয়ে যেতে দেখে রহিমুদ্দি। নৌকার গায়ে লগি ঘষা লাগবার শব্দে বা পানি কেটে নৌকা এগিয়ে যাবার শব্দে দু'জন থামে হয়ত। একটি পুরুষকন্ঠ বলে, 'নৌকা যাবে কোহানে?'
রহিমুদ্দি লগিতে ভর দিয়ে বলে, 'সিদ্দিশ্বরী।'
'আমাগেরে পঞ্চবটি নামায়ে দেতে পারবা?'
'তালি তো নৌকা অনেকটা পথ ঘুরাতি হবি!'
'আমাগের খুবই বিপদ! তোমার কষ্ট পোষায় দেবানে!'
পুরুষ কন্ঠটা বেশ পরিচিত মনে হলেও রহিমুদ্দি অনুমান করতে পারে না যে লোকটা কে! তবুও রাত-বিরেতে অচেনা যাত্রী তোলাটা অত সহজ কাজ নয়। কার মনে কি অভিসন্দি থাকে বলা মুশকিল! সে পাড়ের কাছ ঘেঁষে নৌকা নিয়ে এগোবার সময় সতর্ক হয়ে দেখতে চেষ্টা করে। সঙ্গে একজন মেয়ে মানুষও রয়েছে। পাড়ে নৌকা ভিড়িয়ে সে বলল, 'সঙ্গে মেয়ে-ছাওয়াল রয়েছে দেখছি। তা এত রাইত হইয়েছে ক্যান?'
লোকটি নৌকার মাথিতে পা দিয়ে বলে, 'সে অনেক কতা!'
তারপর সঙ্গের মেয়ে মানুষটাকে হাত বাড়িয়ে নৌকায় তুলে লোকটা বলল, 'এডা আমার বেটি। এরে নিয়ে নিজের বাড়ি পলায়ে যাচ্ছি!'
রহিমুদ্দি কন্ঠস্বরের সাথে মিলিয়ে তার সকল পরিচিতদের মাঝে মনেমনে অনুসন্ধান চালায়। কিন্তু ঠিক মত ধরতে পারে না। সে বলে, 'আপনেরা ঠিক মত বইসেছেন তো?'
'হয়!'
'তালি নৌকা ছাড়ি!'
'ছাড়ো!'
সামনের দিকে পাড়ে লগি ঠেকিয়ে রহিমুদ্দি নৌকাটাকে একবার পিছিয়ে এনে ঘুরিয়ে খাল বরাবর করে। তারপর পাশে লগি ফেলে ভর দিতেই নৌকা সামনের দিকে এগিয়ে যায়। চাঁদ উঠতে এখনো বেশ কিছুটা দেরি। তবুও খালের পানিতে কেমন একটা আবছা আলো ফুটে আছে বলে মনে হয়। রহিমুদ্দি চাঁদ উঠবার অপেক্ষায় থাকে। চাঁদের আলোতে সে দেখতে চায় পুরুষ চড়নদারটি কে? কন্ঠস্বর যার অতি পরিচিত মনে হয়।
(চলবে...)
মন্তব্য
আবেশে পড়ে চলছি.... কই নিয়ে যাচ্ছেন কে জানে!
আপনার কাঙ্ক্ষিত যায়গায়।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
অসাধারণ জুলিয়ান ভাই!! অসাধারণ!! তিন পর আবার এক সাথে পড়লাম। প্রথম পর্বেই পাঠক হিসেবে আমাকে কিনে নিয়েছেন! দ্বিতীয় পর্বটাতে ঘটনা একটু কম ছিল। সেই হিসেবে এই পর্ব পড়ার পর মনে হল- 'আরে!! আর কই?!!'
এত বড় গল্প লেখার ধৈর্য মনে হয় কোন দিনই হবে না আমার।সাত পর্ব হবে বুঝলেন কি করে? পুরো গল্প টা কি আপনি অলরেডী লিখে ফেলেছেন? তাহলে দয়া করে এ মেইল করে দেন। !
কি করব বেশি দেরি সহ্য হয়না!
....................................................................................
অতঃপর ফুটে যাবার ঠিক আগে হীরক খন্ডটা বুঝলো, সে আসলে ছিল একটা মামুলি বুদবুদ!
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
সব লেখকের ওস্তাদ বঙ্কিম সাহেব বলেছেন- লেখার পর তা কিছুদিন রেখে দিতে। তাই অনেক লেখাই এভাবে রেখে দিয়েছি। এটাও এমনি একটি। একটু একটু ঘষামাজা করছি আর ছাড়ছি।
তবে বেশি অস্থির হয়ে পড়লে একই সঙ্গে (৪-৫) ও (৬-৭) ছেড়ে দেবো। (৬-৭) এর সঙ্গে pdf জুড়ে দেবো ভাবছি।
অনেক ধন্যবাদ।
পাদটীকা:
মেইল করে পাঠালে আপনার মন্তব্য থেকে বঞ্চিত হতে পারি। সেই আশঙ্কায় মেইলে পাঠালাম না।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
ঠিকাসে তাইলে!!!
আমার অবস্থা বঙ্কিমের উলটা! মানে 'ডিম' একটা পাড়লেই ! চারিদিকে ডাকা ডাকি জুড়ে দিই সবাইকে পড়ানোর জন্য। রেখে দেবার দেরী সহ্যই হয়না !! তবে এই কথাটা মাথায় থাকলো! ইদানিং কিছু কিছু লেখা পোস্ট করার পর মনে হয় একটু ঘষা মাজা করলে মনে হয় ভাল হত।
....................................................................................
অতঃপর ফুটে যাবার ঠিক আগে হীরক খন্ডটা বুঝলো, সে আসলে ছিল একটা মামুলি বুদবুদ!
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
পড়ছি ....
কি মাঝি? ডরাইলা?
ধন্যবাদ দ্রোহী। তবে পাঠোত্তর অনুভূতি অনুপস্থিত বলে ঠিক প্রতিক্রিয়া কি বুঝতে পারছি না।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
জায়গা মতো এনেই বিরতি দিয়েছেন তাহলে ! কাজটা ভালো হয় নাই।
-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’
মন্তব্যর জন্য ধন্যবাদ। ভাবছি পরের দুই কিস্তিতে পোষায় দিবো।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
কিছ্ছে মজা ধইরেছে।
**********************
কাঁশ বনের বাঘ
**********************
ছায়াবাজি পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনি নাচাও তেমনি নাচি, পুতুলের কী দোষ!
!কাশ বনের বাঘ!
আপনেগের কতায় তা ঠিকই বুইজতে পারিছি। তার জন্যিই একটা ধন্যাবাদ দিয়ে দেলাম।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
ভালো লাগছে। চলুক।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল
আছি এখনো। মজা লাগতাছে।
------------------------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।
ধন্যবাদ। বাকি ৪-৫ এক সঙ্গে দিয়ে দিলাম।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।
___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!
- চুড়ির ব্যাপারটা দারুণ। আমি একবার কক্সবাজার থেকে ঝিনুকের খুব সুন্দর চুড়ি দেখে কিনে ফেলেছিলাম রহিমুদ্দীর মতোই বাটে পড়ে। দেয়ার কেউ ছিলো না আমারও। পরে কী ভেবে চুড়িগুলো আমার এক ফ্রেণ্ডকে দিয়ে দিলাম। তারপর থেকে ওর সঙ্গে দেখা হলেই একটা করে চুড়ি খুলে দিতে বলতাম। তারপর সেটা মনের আনন্দে ভাঙতাম!
কয়েকবার আমার এই আউলা কারবার দেখে বলে, "এতোই যদি ভাঙার শখ থাকবে তাহলে দিলা কেনো?"
তার হাত থেকে কাঁচের চুড়ি নিয়েও ভেঙেছি অনেকবার।
রহিমুদ্দীর সঙ্গেই আছি আপাততঃ। দেখি কই যায়!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কর্মকাণ্ড । বিএসএফ ক্রনিক্যালস ব্লগ
নতুন মন্তব্য করুন