ভাষার আঞ্চলিকায়ন এর সংকট; কথ্যভাষায় লেখার লড়াই

কাজী মামুন এর ছবি
লিখেছেন কাজী মামুন (তারিখ: শনি, ১৬/১০/২০১০ - ৯:৫৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চর্যাপদ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার পূর্বপ্রান্তের ইন্দো-আর্য ভাষা বাংলা এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপি। বাংলাদেশ এর প্রথম এবং ভারতের দ্বিতীয় সর্বাধিক ব্যবহৃত এই ভাষাটি হাজার মাইল দূরে আফ্রিকার কোনো কোনো দেশেও পাচ্ছে অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ এর স্বীকৃতি। ব্যবহার এর দিক থেকে পৃথিবীর চতুর্থ (মতান্তরে সপ্তম) সর্বাধিক ব্যবহৃত এই ভাষাটি পিছিয়েও আছে নানাদিক থেকে, মূল কারণটা হয়তো এ অঞ্ছলের জনগোষ্টির অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা। তবে এটাই যদি একমাত্র কারণ হতো তাহলে জাপানী কে ছাড়িয়ে চীনা ভাষা কিছুতেই জাতিসঙ্ঘের অফিসিয়াল ভাষার স্বীকৃতি পেত না। চর্চার দিক থেকে নানা বিভেদ এবং প্রযুক্তির সাথে সমান তালে হাটতে না পারাও নিসন্দেহে একটি বড় কারণ। না হলে আইসল্যান্ডের ৩ লক্ষ জনগোস্টির জন্য গুগুল যদি অনুবাদ ব্যবস্থা রাখতে পারে, কয়েক কোটি কোরিয়ান দের জন্য মাইক্রোসফট যদি উইন্ডোস বানাতে পারে ৩০ কোটি বাংলা ভাষাভাষীর জন্য নয় কেন! ত্রিশকোটি জনগোষ্টির সুনির্ধারিত কোনো মানভাষা নেই আজও। সংরক্ষনের দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলা একাডেমি এখন পর্যন্ত আমাদের সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি আমাদের বর্ণমালা আসলে ৪৯টি নাকি ৫০টি!

নদীয়া শান্তিপুরের কথ্যভাষাটির লেখ্যরূপই ঐতিহাসিক কারণে বাংলার মানভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে স্কুলে-কলেজে, পাঠ্যপুস্তকে, পত্রিকায়, টেলিভিশনে। এর মধ্যেও আছে ‘আসছে’ ‘আসচে’র মতো সুস্পষ্ট কিছু পার্থক্য পশ্চিম বাংলা এবং বাংলাদেশে। বাংলাদেশে আজকালকার কিছু কিছু সাহিত্যিক, নাট্য নির্মাতারা নানা ভাবে ব্যঙ্গ-বিচ্যুত করে নতুন একটি ভাষা সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এদেরও আবার একে অপরের সাথে কোনো মিল নেই। ‘করেছিলাম’ কে কেউ বানাচ্ছেন ‘করছিলাম’ কেউ বানাচ্ছেন ‘করেসিলাম’, কেউ বা ‘করসিলাম’। ‘দেখছি’ কে কেউ বলছেন, দেখতাছি কেউ বলছেন ‘দেখতেছি’। কেউ আবার আঞ্চলিকায়ন এর কথা বলে অতি প্রাচীন কোনো সাধু ভাষাকে টেনে আনছেন। কোনো নীতিমালা না থাকার কারণে, আজকাল রেডিও টিভিতে ‘RJ’ ‘VJ’ রা যে ভাষায় কথা বলছে তা দেখে-শুনে কিছুতেই বোঝার কোনো উপায় নেই তারা আসলে কি বাংলায় কথা বলছেন নাকি ইংরেজীতে নাকি হিন্দিতে। মিডিয়ার শক্তি অনেক সাভাবিক ভাবেই দর্শক-শ্রোতা ছেলেমেয়েরাও সেই ভাষার চর্চা করতে গিয়ে হোচট খাচ্ছেন। বাংলা একাডেমির অনেক দুর্দশার পর ভাবনা শুরু করলো ভাষা সংরক্ষনের উদ্যোগ নেয়ার, সাথে সাথেই একে বাধাগ্রস্থ করতে এগিয়ে আসলেন আমাদের ফ্যাসিজম-বিশেষজ্ঞ বুদ্ধিজীবিরা। একদিকে অনিয়মের অরাজকতা অন্যদিকে নিয়মের ফ্যাসিজম বলে ‘গেল গেল’ রব!

ভাষার আঞ্চলিকায়নে উৎসাহী সাহিত্যিকরা বলছেন- “উচ্চারণ বিষয়ে বাংলা একাডেমীর চিন্তার আবশ্যিক ফল হবে মাত্রাওয়ালা স্বরলিপিসহ পুরা বাংলাভাষার অভিধান প্রকাশ”, আমার প্রশ্ন আপনারা যে নানাবিধ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে লিখছেন তা আমাদের বোধগম্য করে তোলার জন্য অভিধান কোথায়?

অধ্যাপক আশরাফ হোসেন তাঁর 'বাঙালীর দ্বিধা' প্রবন্ধে বলছেন- "পুরো পাক- আমলে বাঙালি মুসলমানকে বোঝানো হয়েছে, তুমি বাঙালি নও, মুসলমান। আয়রনিটা হলো,
বিভাগপূর্ব বঙ্গদেশেও হিন্দুরা মুসলমানকে বলেছে, তুমি মুসলমান, বাঙালি নও।"
এমন দ্বিধাগ্রস্ত বাঙালীর ভাষা প্রসঙ্গে স্যার বলছেন-

"সুলতানি আমলে বিকশিত হয়েছে বাংলা ভাষা। তৎসম-তদ্ভব শব্দভাণ্ডারের সঙ্গে এসে মিশেছে তুর্কি-আরবি শব্দাবলী। বাঙালির প্রকাশক্ষমতাপেয়েছে পরিসর এবং ‘যাবনী মিশাল’ ভাষার উত্থানে সৃষ্ট হয়েছে এক ভাষিক দ্বৈরথ যা আবার দ্বিধাভক্ত করেছে বাঙালিমানসকে। একদল নিজেদের ধর্মপরিচয়ের সূত্র ধরে আত্যন্তিক সংরক্ষণশীলতায় নিক্ষিপ্ত হয়েছে নদীয়ার নিমাইয়ের ঊর্ধ্ববাহু যতোই সংকীর্তনে উৎক্ষিপ্ত হয়েছে ততোই তথাকথিত প্রেমের নদী সম্প্রদায়বিশেষের চোরাখালে প্রবেশ করে হয়েছে রুদ্ধগতি।অন্যদিকে অন্য দল বহুকাল-পূর্বে ফেলে আসা ইরান-তুরানকে পিতৃভূমি ভেবে মশগুল হতে চেয়েছে খর্জুরবীথির স্বপ্নবিলাসে; প্রকাশের ভাষা হিসেবে অবলম্বন করতে চেয়েছে অবিমিশ্রবৈদেশিকী ভাষা।"

একদল আইন দিয়ে করছে জোড় করে গেলানোর প্রচেষ্টা । অন্যদল স্বাতন্ত্রের প্রশ্নে তথৈবচ ভাবে কৃত্রিম এক ভাষা সৃষ্টির এবং প্রমোটের নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছে। শোনা দরকার এই দ্বিধাগ্রস্ত স্বাতন্ত্র রক্ষাকারীদের যুক্তিগুলোও-

"যেহেতু বাংলা এখনো মরে নাই আর মমি করার জন্য মৃতদেহ দরকার তাই বাংলাভাষাকে সংসদ মৃত্যুদণ্ড দিতে যাইতেছে, মৃতদেহের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পাইতেছে একাডেমী।"

যুগ পাল্টেছে- ভাষা এমিবা নয়, বিভাজনে এর নিকাশ হয় না মৃত্যুই হয়। স্বাতন্ত্রের কথা বলে বিভাজনে কি করে বিকাশ ব্যহত হয় এর উদহারণ অহরহ, মাইক্রোসফট বাংলা নিয়ে কাজ করার সময় ঢাকা নাকি কলকাতা কোন বাংলা কে বেছে নেবে এমন দ্বিধাদ্বৈততায় কাজটিই বাতিল হয়ে যায়, বিকাশ হয় না বাংলা ভাষার ব্যবহার এর।
ইংরেজী কেন আজ বিশ্বজনীন ভাষা, সংস্কৃত কেন আজ মৃতপ্রায় অথবা সিলেটি কেন আজ ভাষা ছেড়ে উপভাষার মর্যাদায় আসীন এই বিষয়গুলো বিশ্লেষন প্রয়োজন।ভাষা পরিবর্তিত হবে তাঁর সাধারণ নিয়মে, এক্ষেত্রে প্রকাশের ক্ষমতাকে জোর করে চাপিয়ে দেয়া বা রাষ্ট্রায়ত অতি-রক্ষনশীলতা দুটোই বর্জন অনিবার্য ভাষার টিকে থাকার স্বার্থে।
নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণা বলে, প্রতি ২২ কিলোমিটার অন্তর অন্তর মানুষের মুখের ভাষা পরিবর্তিত হয়। তাহলে কি প্রতি ২২ কিলোমিটার অন্তর অন্তর ভিন ভিন্ন সাহিত্যগোষ্ঠী গড়ে উঠবে! যদি গড়ে উঠেও ভেবে দেখেছেন তার ব্যাপ্তি বা স্থায়িত্ব কতোটা হবে?

প্রতিযোগীতার ক্ষেত্র যতটা বড় হয়, এর ফলাফলও ততটা মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য হয়।আমার কানাডিয়ান বন্ধু 'ইয়েন'(native English speaker) ইংলেন্ডে যাওয়ার পর এক ইংরেজ তাকে বলছে- "what are you speaking! try to speak some English"(কি বলছো তুমি! ইংরেজী বলার চেষ্টা করো!)।
কিন্তু এর আগে ওরা যখন ই-মেইলে কথা বলছিল লেখ্যভাষায় তখন কিন্তু কেউ কাউকে বুঝতে কোনো সমস্যা ছিল না! একই ভাবে স্কটিশরা পাশাপাশি দেশ হলেও ওদের কথ্য ইংরেজী ইংরেজদের বোধগম্য নয়! সিঙ্গাপুরের কথ্য ইংরেজীর আলাদা নামই হয়ে গেছে 'সিংলিশ'।

কিন্তু কথ্যভাষার স্বাধীনতার পাশাপাশি লেখ্যভাষার ঐক্যর কারনে ইংরেজীর বিস্তার বাড়ছে, কমছে না! পৃথিবীর তাবৎ সেরা সাহিত্যের ৮০ ভাগই রচিত হচ্ছে হয় ইংরেজীতে অথবা ইংরেজীতে অনুবাদের পরই মিলছে সেরার স্বীকৃতি। একবার কি ভেবে দেখেছেন সয়ং রবীন্দ্রনাথকেও কেন নোবেল পুরষ্কার এর জন্য গীতাঞ্জলী ইংরেজীতে অনুবাদ করতে হয়!

মানুষ এখন বিশ্বগ্রাম এর বাসিন্দা, এখানে গর্তবদ্ধ হয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই।
কুমিল্লা শহর থেকে আমার গ্রামের বাড়ি মাত্র ১২ মাইল পশ্চিমে। অথচ এই ১২ মাইল দুরত্বেই 'যাব-খাব' পরিবর্তিত হয়ে 'যাইতাম-খাইতাম' এবং 'যায়াম-খায়াম' দুটি ভিন্নরুপে আবির্ভুত হয়! এখন আমার গ্রামের ৫ বর্গমাইলের জনগনের দায়িত্ব কে নেবে? সমগ্র বাংলা ভাষাকে অনুবাদ করে 'যাব-খাব' কে 'যায়াম-খায়াম' কে করে দেবে! অথবা এই ৫ বর্গমাইলের ২/৪ জন সাহিত্যিকের 'যায়াম-খায়াম' কে অনুবাদ করে কে সমগ্র বাংলায় পৌছাবে!

বন্ধু পলাশ আল মনসুর বলছিলেন “যদি এই ভাষা(আঞ্ছলিক ভাষা) পরীক্ষার খাতায়ও লিখা হয়, তাহলে যদি চট্টগ্রামের কিংবা সিলেটের কোন পরীক্ষার খাতা-টাঙ্গাইল কিংবা গাজীপুরের কোন পরীক্ষকের হাতে পড়ে, তাহলে উপায় কি? উনারা খাতা মুল্যায়ন করবেন কিভাবে? ব্যাপারটা হাস্যকর হলেও সত্যি।“

অসিদের দেশে দেশান্তরী বন্ধু ফারুক চৌধুরী বলছিলেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা- “আমি যখন প্রথম অসিতে আসি ,ক্লাসে , জবে সবাই hi! মাইট বলে উইশ করত , যে খানেই যাই মাইট বলে । ঘটনা কি ? আই ই এল টি এস করার সময় তো দূরের কথা আমার জীবনে এই এক্সেন্ট (মাইট) শুনি নাই । কারোরে যে জিজ্জাসা করবো ---, পাছে ইন্রেজীতে দূর্বল ভেবে যদি উপহাস করে তাই নেট বই পত্র ঘাটতে থাকলাম । পরে যে শব্দ টা পেলাম সেটা আসলে Mate(মেট)। কিন্তু অসিরা বলে মাইট , স্পেলিং একই । এখন এই মাইট কে যদি Mite লিখে উইশ করে ইংল্যান্ডের কোন বন্ধু কে মেইল করি , আমি সাহিত্যে নুবেল পাবো জানিয়ে একটা বিশাল নোট সে ফেসবুকে লোড করে দিতে পারে ”

আশরাফ স্যার এর ‘বাঙালীর দ্বিধা’ প্রবন্ধের আলোচনায় নৃবিজ্ঞানী নোভেরা হোসেন নেলী আপা মানতে নারাজ বাঙালী মাত্রাতিরিক্ত দ্বিধাগ্রস্থতার কথা, অথবা বাঙালীর হিন্দু মুসলমান এর চেয়ে বেশি মানুষ না হয়ে ওঠতে পারার কথা। মুজিব মেহেদী ভাই তাঁর অভিজ্ঞতায় বলছিলেন- “আমার এক সিনিয়র কলিগের বাড়ি বদলানো জরুরি হয়ে পড়েছে। পরিবারটির সদস্য সংখ্যা মাত্র চারজন। স্বামী-স্ত্রী দুজনই উচ্চশিক্ষিত, সংস্কৃতিবান। ছেলেমেয়ে দুজনই কলেজে পড়ে। দু'মাস ধরে তাঁদের জন্য সুবিধাজনক এলাকায় (ঢাকার শুক্রাবাদ, সোবহানবাগ, কলাবাগান) বাড়ি খুঁজে হন্যে হচ্ছেন তাঁরা। পাচ্ছেন না। তাঁদের অযোগ্যতা একটাই, তাঁরা হিন্দু। কয়েকজন তো আপত্তিকর টোনে মুখের সামনেই বলে দিচ্ছেন, “ও আপনারা হিন্দু আমরাতো হিন্দুদের বাড়ি ভাড়া দেই না!”

এমন দ্বিধাগ্রস্ত বাঙালীর ভাষার ব্যবহারিক বৈশ্বিক স্বীকৃতি দেখলেই প্রমান মিলে ফলাফল এর। প্রমান মিলে ৩০ কোটি জনগোষ্টির ভাষার আন্তর্জাতিক দুরাবস্থার চিত্রের। কানাডা প্রবাসী সাহসী কিছু বাঙালীর একীভুত প্রচেষ্টা ছাড়া কোনোদিনই হয়তো মিলতো না ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবষ’ এর স্বীকৃতি। তবুও আমাদের বিভাজন প্রয়োজন স্ব-স্ব ২২ কিলোমিটার এর চর্চার স্বাতন্ত্র প্রয়োজন!অথবা আপনার প্রয়োজন উৎসের বিচারে নদীয়া শান্তিপুরের ভাষা বলে সর্বসাধারনের স্বীকৃত শ্রুতিমধুর এবং সহজপাঠ্য, সহজবোধ্য মানভাষা ছেড়ে ঢাকাইয়া’র নামে ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, সিলেটের মিশ্রনে নতুন এক জগাখিচুরী ভাষার সৃষ্টি এবং সেক্ষেত্রে নীলফামারী দিনাজপুরের লোকজনের উপর ওটা চাপিয়ে দেয়াটা কিছুতেই আপনার কাছে ‘ফ্যাসিজম’ নয়। খিচুরি যদি বানাতেই হয়, এবং আপনার সাহস থাকে তাহলে প্রতিটি ২২ কিলোমিটার এর ভাষাকে সমানভাবে নিয়েই নয় কেন! কুমিল্লা, ময়মনসিংহের মানুষগুলোর মতো কুড়িগ্রামের অধিবাসীরা ঢাকায় এসে আপনার মতো পত্রিকায় লিখতে পারে না বলে, আপনার মতো নাটক বানাতে পারে না বলে তাঁর ভাষার কোনো অংশগ্রহন থাকবে না!

“সাধারণ ভাষা দিয়া এখন পাঠ্যপুস্তক লেখা হইতেছে, রাষ্ট্রকর্ম চলতেছে; এইটা ধইরা নেওয়া, রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীনদের খেয়ালবশবর্তীতা। এই ভাষাটা কাদের—তা নিয়া বহু আলাপ আছে, কলিকাতা, নদীয়া ইত্যাদি আলাপ। আমার আলাপটা আরো পরে—যখন সম্ভাব্য সাধারণ বাংলাকে আদর্শ বাংলা বা মান বাংলা দাবি করে কেউ, তখন এই বাংলার অধিকতর ইজ্জত হয় অপরাপর বাংলার বিপরীতে; এমনকি অপরাপর বাংলাকে অশুদ্ধ বা আঞ্চলিক বাংলা কইরা তোলে। সাধারণ থাকবার শর্ত অনেক থাকা, অনেক নাই তো সাধারণের প্রশ্নও আসে না। সাধারণ যখন আদর্শ হয় তখন তার শর্তকে অস্বীকার করতে চায়, সবাইকে চাপ দেয় আদর্শ হবার—এইটা সাধারণের ‘একমাত্র’ হইতে চাওয়া, স্বাতন্ত্র্যকে অস্বীকার—এই অর্থে ফ্যাসিজম।“

অর্থাৎ লেখক ব্রাত্য রাইসু এবং রেজাউল করিমরা মেনে নিতে চাচ্ছেন না যে আমাদের প্রচলিত ভাষাটি সাধারণের পছন্দকৃত সাধারন মানভাষা, সেক্ষেত্রে আছে লেখকের জন্য আছে পাঠ-প্রতিকৃয়া- “আপনার লেখাটি পড়তে ভীষণ কষ্ট হয়েছে। বাববার আটকে যাচ্ছিলাম। কারণটা তো আপনি জানেন। এরকম বিদঘুটে, সামঞ্জস্যহীন শব্দ দিয়ে বাক্য দিয়ে লেখা এত বড় একটা মন্তব্য যদি কেউ লিখতো, আর আপনি যদি পড়তেন, তাহলে আপনার কত কষ্ট হত, একবার ভাবুন।” প্রতিকৃয়া জানাচ্ছিলেন পাঠক মাকসুদ-উন-নবী। এক’র প্রতিকৃয়া বলে লেখক ছুড়ে ফেলে দিতেই পারেন- “আমি কেন চৈনিক ভাষায় লিখলাম না–এইটা কি একটা বৈধ অভিযোগ মনে করেন? আমি মনে করি না। আপনি যদি পড়তে না পারেন, তার মানে সেই লেখা আপনার জন্য লেখা না; আপনার জন্য লিখতে বাধ্য করবার জন্য বেতন দিয়া বা ছাড়া যেমনে পারেন, লেখক রাখেন। আপনি তো আমারে কিনেন নাই, আমার কেন আপনার জন্য লিখতেই হবে?”

লেখক অবশ্যই পাঠকের বেতনভুক্ত কর্মচারী নন, তিনি স্বাধীন, লিখতেই পারেন নিজের খেয়ালখুশি মতো। কিন্তু যখনই প্রকাশের পর্যায় আসে তখন তাকে গুনতে হয় তাঁর বিবেচনার পাঠকগোষ্ঠীকে, পরোক্ষভাবে হলেও তাদের পছন্দ অপছন্দকে গুরত্ব দিতে হয়। লেখকের কথা বাদ দিয়ে বেতনভুক্ত কর্মচারিরাও কিন্তু আছেন যারা মান ভাষা ব্যবহারে দায়বদ্ধ, একজন লেখকের যেমন খুশি লেখিবার মাত্রাতিরিক্ত অধিকার থাকলে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের নয় কেন? তিনি পড়াতেই পারেন তাঁর সাচ্ছন্দের আঞ্চলিক কথ্যভাষায়, সেক্ষেত্রে বেতন দিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বা সিলেটে পড়তে যাওয়া ছাত্রটির কি দশা হবে ভাবুন দেখি! ছাত্রের স্বার্থ দেখা ছাড়া শিক্ষকের কাজ কীবা! লেখকও কি নিজেকে ভাবতে পারেন পাঠকদের ছাড়া!

প্রশ্ন আসে জাতীয় কোনো সম্প্রচারে কেন মানভাষা ব্যবহার করতে হবে! রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার আছে যে কোনো অনুষ্ঠান শোনার, দেখার এবং আনন্দ লাভ করার, হোক তা ব্যক্তিমালিকানাধীন কিম্বা রাষ্টায়ত্ব। এই অধিকার রক্ষা না করে টাকার জোড়ে নিজস্ব আঞ্চলিকতাকে চাপিয়ে দিতে গেলেই বরং তা ফ্যাসিজম হয়। যুগ পাল্টেছে চার্চ, সরকার, সেনাবাহিনী’র পর ফ্যাসিজম এর দায়ভার এখন টাকার হাতে মিডিয়ার হাতে। এই সুক্ষ পরিবর্তনটুকু যারা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন তারা খামোকাই ‘ফ্যাসিজম’ খুজে দেখেন এখানে ওখানে!

আপনার হাতে মিডিয়া আছে, পরিচিত সম্পাদক আছে, প্রযোজক আছে, ব্যবসা সাফল্য আছে, আপনি লিখছেন, আপনি নাটক বানাচ্ছেন, আপনি গুরত্ব দিচ্ছেন না সাধারণকে। আপনি বলছেন “পাবলিক খাচ্ছে” এর মানে আসলে ‘ব্যবসা হচ্ছে’ এই ‘ব্যবসা হওয়া’কেই আপনি সাধারণের পছন্দে চাপিয়ে দিচ্ছেন এবং এখানে ‘ফ্যাসিজম’ এর কিছু খুজে পাচ্ছেন না। রাষ্ট্র যদি সর্ব সাধারনের জন্য সাধারন কোনো নিয়মের কথা ভাবে তাহলে তা আপনার কাছে ‘ফ্যাসিজম’ কিন্তু আপনার হাতের ক্ষমতা, সম্পাদক, প্রযোজক এবং ব্যবসা সাফল্য ব্যবহার করে আপনি যখন আপনার গোষ্টিবদ্ধ ভাবনা সর্ব-সাধারণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন তখন তা আপনার কাছে হয় স্বাতন্ত্র বা স্বাধীনতা!


মন্তব্য

মনমাঝি [অতিথি] এর ছবি

সমাজভাষাতত্বে একটা বিখ্যাত লাইন হচ্ছে ম্যাক্স ওয়েইন্রাইখের (Max Weinreich) সেই বহুল উদ্ধৃত উক্তি "A language is a dialect with an army and navy"। আমার মনে হয় আমরা এই ক্ষেত্রে এখন আর্মি ও নেভিকে 'টাকা' ও 'মিডিয়া' দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার যুগে পৌঁছে গেছি।

কাজী মামুন এর ছবি

হতাশ লাগে যখন কতিপয় সাহিত্যিকেরা তাদের হাতের মিডিয়াকে ব্যবহার করে মনগড়া ভাষাকে মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে!

=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"

=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"

নিঃসঙ্গ গ্রহচারী [অতিথি] এর ছবি

বানানগুলো একটু খেয়াল করুন,বস! মন খারাপ
পড়তে গিয়ে বার বার হোঁচট খেতে হলো।

কাজী মামুন এর ছবি

কিছু বানান লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর চোখে পড়লো!
এখন এডিট করতে গেলে আবার উধাও হয়ে যাবে, আর কিছু বানান আমার জানাই নেই! মন খারাপ

=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"

=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

উইলিয়াম কেরির অভিধানের প্রথমদিকের কয়েকটি সংস্করনে তৎসম শব্দের সংখ্যা ছিল মাত্র বিশ ভাগের মতো। তখন তিনি কলকাতার বাইরের লোকদের সাথে চলতেন। পরে, তিনি যখন কলকাতায় এসে পণ্ডিতদের সাথে মেলামেশা শুরু করেন, এবং অভিধানের চতুর্থ সংস্করণ প্রকাশ করেন তখন তৎসম শব্দের সংখ্যা আশি ভাগের বেশি হয়ে যায়। এ ঘটনা উল্লেখ করা এই কারণে যে, কেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ সবকিছু। তা যদি গুটিকয় ভাগ লোকেরও হয়।

কাজী মামুন এর ছবি

এই নিয়ন্ত্রকদের সাথে যুক্তি দিতে গিয়ে দেখেছি, শেষমেষ তারা তালগাছটা আমার বলে সটকে পড়ে অথবা জ্ঞান গড়িমা দেখিয়ে এড়িয়ে যায়।
তবে গুটিকতক হলেও এরা শক্তিশালী, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"

=================================
"রঙিন কাফনে মোড়া উৎসুক চোখে
ছায়া ছায়া প্রতিবিম্ব দেখি
মানুষ দেখি না।।"

কুলদা রায় এর ছবি

অত্রন্ত গুরুত্বপূর্ণ রেখা। সাবলিল যুক্তি। এটা নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার।
...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

...............................................................................................
'এই পথ হ্রস্ব মনে হয় যদিও সুদূর'

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।