মানুষের জন্যে কবিতা-

কনফুসিয়াস এর ছবি
লিখেছেন কনফুসিয়াস (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৭/১১/২০০৮ - ১০:২২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মানুষের জন্যে লেখা- আমার খুব প্রিয় একটি কবিতা " আমার বন্ধু নিরঞ্জন', ভাস্কর চৌধুরির।

আমার বন্ধু নিরঞ্জন
- ভাস্কর চৌধুরি
------------------------

অনেক কথা বলবার আছে আমার
তবে সবার আগে নিরঞ্জনের কথা বলতে হবে আমাকে।
নিরঞ্জন আমার বন্ধুর নাম
আর কোন নাম ছিল কি তার ?
আমি জানতাম না।
ওর একজন বান্ধবী ছিল
অবশ্য কিছুদিনের জন্য সে তাকে প্রীতম বলে ডাকত।

ওর বান্ধবীর নাম ছিলো জয়লতা।
নিরঞ্জন জয়লতা সম্পর্কে আমাকে কিছু বলেনি তেমোন।
জয়লতাকে কখনো কোন চিঠি লিখেছিলো কিনা
সে কথাও আমাকে সে বলেনি।
তবে জয়লতার চিঠি আমি দেখেছি
একটা চিঠি ছিল এরকম -
প্রীতম,
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। তুমি বলেছ , এখন দু:সময় -
কিন্তু আমি জানি , সব সময়ই সুসময় , যদি কেউ ব্যবহার করতে জানে তাকে।
আমি বুঝি বেশি দিন নেই।
যদি পার এক্ষুনি তুলে নাও
নইলে অন্য পূরুষ ছিবড়ে খাবে আমাকে -

আমার ঘরে বসে সিগারেট টানতে টানতে
নিরঞ্জন চিঠিটা চুপ করে এগিয়ে দিয়ে বলেছিল
"বিভূ, চিঠিটা পড়ুন ।"
আমি প্রথমে পড়তে চাইনি।
পরে ঐটুকু পড়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম --
না - ঐ সিগারেটের ধুয়ায়
আমি কোন নারী প্রেম-তাড়িত মানুষের ছায়া দেখিনি -
ভয়ানক নির্বিকার!
কিছু বলছেন না যে ?- আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম
কি বলব ?
এই ব্যাপারে!
কোন ব্যাপারে ?
এই যে জয়লতা।
বাদ দিন ।

আমি বাদ দিয়েছিলাম।
নিরঞ্জন আমার ঘরে বসে অনেকক্ষণ সিগারেট
টেনে টেনে ঘরটাকে অন্ধকার করে চলে গিয়েছিল সেদিন।

জয়লতার সংগে অন্য পূরুষের বিয়ে হয়েছিল।
আমি জয়লতা এবং অন্য পূরুষটিকে দেখেছি বহুবার
বিশ্ববিদ্যালয়েই।
জয়লতা আরো দেমাগী আরো সুন্দরী হয়ে উঠেছিল।
অন্য পূরুষ ছিবড়ে খেলে মেয়েরা বুঝি
আরো সুন্দরী হতে থাকে !

এ কথার সূত্রে নিরঞ্জন আমাকে বলেছিল ,
" মানুষকে এত ক্ষুদ্রার্থে নেবেন না ?
মানুষ এত বড় যে ,
আপনি যদি 'মানুষ ' শব্দটি একবার উচ্চারণ করেন
যদি অন্তর থেকে করেন উচ্চারণ
যদি বোঝেন এবং উচ্চারণ করেন ' মানুষ' -
তো আপনি কাঁদবেন!
আমি মানুষের পক্ষে , মানুষের সংগে এবং মানুষের জন্যে।

হ্যাঁ , মানুষের মুক্তির জন্য নিরঞ্জন মিছিল করতো
আমি শুনেছি নিরঞ্জন বলছে
তুমি দুস্কৃতি মারো , বাঙগালী মারো ,
হিন্দু-মুসলমান মারো , গেরিলা - তামিল মারো ,
এভাবে যেখানে যাকেই মারো না কেন
ইতিহাস লিখবে যে এত মানুষ মরেছে।
বড়ই করুণ এবং বড়ই দু:খজনক
শক্তির স্বপক্ষে তুমি যারই মৃত্যু উল্লেখ করে
উল্লাস কর না কেন
মনে রেখো মানুষই মরেছে!
এই ভয়ংকর সত্য কথা নিরঞ্জন বলেছিল
মিছিলে হাত উঠিয়ে বলেছিল ,
এভাবে মানুষ মারা চলবে না !
মানুষকে বাঁচতে দাও!

তার উদ্যত হাতে লেগেছিল
মানুষের হাতে বানানো বন্দুকের গুলি।
বুকেও লেগেছিল-
যেখান থেকে " মানুষ ' শব্দটি
বড় পবিত্রতায় বেরিয়ে আসতো।
সে লাশ --
আমার বন্ধু নিরঞ্জনের লাশ -
আমি দেখেছি -
রক্তাক্ত ছিন্ন ভিন্ন লাশ ,
মানুষ কাঁধে করে
তাকে বয়ে এনেছিল মানুষের কাছে।

জয়লতা সে লাশ দেখেছিল কিনা
সে প্রশ্ন উঠছে না ।
দেখলেও যদি কেঁদে থাকে সে প্রকাশ্যে অথবা গোপনে ,
তাতে নিরঞ্জনের কোন লাভ হয়নি ।
মানুষ কেঁদেছিল
আমি জানি , তাতে নিরঞ্জনের লাভ ছিল ।
নিরঞ্জন প্রমাণ করতে পেরেছিল
গতকাল মিছিলে
আইন অমান্যের অভিযোগে
যে দুস্কৃতি মারা গিয়েছে
তার নাম নিরঞ্জন --

সে আসলে " মানুষ"!

--------------------

বড় অসহায় লাগে, অসহ্য রাগ হয়, ক্রোধ হয়, ঘেন্না হয়। আবার কান্না পায়, অক্ষম কান্নায় মন ডুবে যায়।
প্রতিদিন, বাংলাদেশে, মুম্বাইয়ে, ইরাকে, টুইনটাওয়ারে, লন্ডনে- প্যালেস্টাইন অথবা লেবাননে- হাজার হাজার মানুষ মরছে। ওরা মুসলিম, হিন্দু, ইহুদী কিংবা খ্রিষ্টান- কিন্তু ওরা মানুষ।
মারা যাচ্ছে যারা- তারা প্রত্যেকেই মানুষ।
বোমায়, গুলিতে, ছুরি কিংবা তলোয়ারে- এবং তারো বেশি মরছে মনের ভেতর, মননে- প্রতিনয়ত মরছে মানুষ।
মানুষদের এই মৃত্যু বড় বিষন্ন করে দেয় আমাকে। বড় অসহায় করে দেয়।
মানুষ শব্দটি আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, বুঝতে ইচ্ছে করে, অন্তরের গভীর থেকে বড় ভালোবেসে উচ্চারন করতে ইচ্ছা করে- 'মানুষ"।


মন্তব্য

তারেক এর ছবি

.................................
..................................

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

স্নিগ্ধা এর ছবি

ধন্যবাদ, কনফুসিয়াস! সারাদিন ধরে সি এন এন এ রক্তমাখা, বন্দুকওয়ালা, আগুনে পোড়া ছবি দেখতে দেখতে সন্দেহ হচ্ছিলো - আসলে হয়তো মানুষ ততটা দামী কিছু নয়, হলে কি আরো কিছু 'মানুষ' এরকম করতে পারতো?? আপনার দেয়া কবিতাটা পড়ে কেন যেন একটু স্বস্তি পাচ্ছি -

নজমুল আলবাব এর ছবি

এইসব সময়ে কবিতা ছাড়া আশ্রয় নেয়ার মতো আর কিছু খুজে পাওয়া যায় না।

ভুল সময়ের মর্মাহত বাউল

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আমাদের অন্তর্গত বোধগুলো আমাদের বাঁচিয়ে রাখুক
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

মানুষের দাম নেই আজ মানুষেরই কাছে, তাদের পবিত্র (!) বিশ্বাসের কাছে।

রানা মেহের এর ছবি

কী অদ্ভুত কবিতা
কী বিষন্ন অনুভুতি
আসলে 'মানুষ' মেরে ফেলা কত সহজ
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

তুলিরেখা এর ছবি

কে যেন বলেছিলো-"মানুষ তবুও ঋণী মানুষেরই কাছে" ?
ঝাপসা ধূসর দিনগুলো, রাতগুলো গুমোট---বিশ্বাস শব্দটা ছুঁতে পারিনা, ভয় লাগে, এত বেশী অবিশ্বাসের কাঁটা চারপাশে! মনে হয় থাক সে দূরে, তাকে ছুঁয়ে নষ্ট করবো না।
আশা করতে ইচ্ছে করে একদিন কাঁচা সোনার মতন রোদ মেখে সোনালী সকাল আসবে।
সত্যিকার "মানুষ" আসবে।
-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

মুজিব মেহদী এর ছবি

যারা এরকম নিধনযজ্ঞ চালাতে পারে তাদের কাছে মানুষ খুবই তুচ্ছ, সস্তা।
মানুষ এত হিংস্র কীভাবে হয!
..................................................................................
দেশ সমস্যা অনুসারে
ভিন্ন বিধান হতে পারে
লালন বলে তাই জানিলে
পাপ পুণ্যের নাই বালাই।

... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী

সব্যপ্রিয় এর ছবি

অদ্ভূত সুন্দর

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।