খবরে দেখলাম, প্রয়াত লেখক শেখ আব্দুল হাকিম-কে মাসুদ রানা সিরিজের ২৬০টি এবং কুয়াশা সিরিজের ৫০টি বইয়ের স্বত্বাধিকারী বলে ঘোষণা করেছে দেশের কপিরাইট কর্তৃপক্ষ।
মাসুদ রানা, কাজী আনোয়ার হোসেন এবং শেখ আব্দুল হাকিম, এই সবগুলো নামই বাংলাদেশী পাঠকদের আবেগের সাথে এমনভাবে জড়িত যে, এই মামলা, অভিযোগ এবং তা থেকে আসা সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক রকমের মতামত দেখা যাচ্ছে। কেউ বলছেন শেখ আব্দুল হাকিম-ই বইগুলোর ন্যায্য দাবীদার, আবার কেউ বলছেন কাজী আনোয়ার হোসেন এগুলোর প্রকৃত স্বত্বাধিকারী।
স্বল্পজ্ঞানে যতটুকু বুঝি, কপিরাইট কর্তৃপক্ষের ঘোষণায় কোনও ভুল নেই; আইন অনুযায়ী এগুলোর স্বত্বাধিকারী শেখ আব্দুল হাকিম। আবার একই সাথে আমি মনে করি, এই বইগুলোর স্বত্ব আসলে কাজী আনোয়ার হোসেনের হওয়া উচিত, হাকিমের নয়।
কেন?
সহজ কথায়, যে কোনও সৃজনশীল কাজের কপিরাইট নিজে থেকেই তার স্রষ্টার কাছে থাকে। মানে, কেউ যদি একটা গান তৈরি করে, অথবা নিজের লেখা কোনও বই প্রকাশ করে, তাহলে সেটির কপিরাইট হবে সেই সঙ্গীতশিল্পী কিংবা লেখকের। এই স্বত্ব দাবী করার জন্যে আলাদা করে কোথাও নিবন্ধন করার দরকার পড়ে না। বইয়ে অথবা এলবামের কোথাও কোনও ঘোষণার দরকার হয় না, কোনও © চিহ্ন ব্যবহারেরও প্রয়োজন হয় না।
এরকম ঘোষণা বা প্রমাণপত্রের দরকার তখনই পড়ে যখন কেউ তাঁর কাজের স্বত্ব অন্য কাউকে দিয়ে দেন। সেটা অর্থের বিনিময়ে হতে পারে, বা অন্য যে কোনও কারণে।
মাসুদ রানা-র ক্ষেত্রে আমরা জানি শেখ আব্দুল হাকিম ছায়ালেখক (গোস্টরাইটার) হিসেবে সেবা প্রকাশনী বা কাজী আনোয়ার হোসেনের পক্ষে এই বইগুলো লিখেছিলেন।
গোস্টরাইটিং বিশ্বজুড়েই একটি বহুল প্রচলিত ব্যবস্থা। বহু প্রকাশনী এবং লেখক প্রতিনিয়ত ছায়ালেখকদের সাথে কাজ করেন। সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, ছায়ালেখকদেরকে কাজের শুরুতে চুক্তিবদ্ধ হতে হয় এই মর্মে যে, এই বই লেখার বিনিময়ে তারা পারিশ্রমিক পাবেন তবে বইটির স্বত্ব তারা দাবী করতে পারবেন না। বইয়ের স্বত্বাধিকারী থাকবে প্রকাশনী বা সেই লেখক, যার হয়ে ছায়ালেখক বইটি লিখছেন।
এই সূত্র মেনে বলা যায়, এই বইগুলোর আসল স্বত্বাধিকারী কাজী আনোয়ার হোসেন। তিনি শেখ আব্দুল হাকিমকে তাঁর যথার্থ সম্মানী দিয়েছিলেন কিনা সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ, কপিরাইটের সাথে সম্পর্কিত নয়।
তাহলে এখানে সমস্যা কোথায়?
খবর থেকে যতটুকু বুঝলাম, সমস্যা হচ্ছে চুক্তিপত্রের অনুপস্থিতি।
সেবা প্রকাশনী থেকে দাবি করা হচ্ছে কাজী আনোয়ার হোসেন এবং শেখ আব্দুল হাকিমের মধ্যে মৌখিক চুক্তি হয়েছিল। এই কথাটি অবিশ্বাস করার কোনও কারণ দেখি না, কারণ ১৯৬৬ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত শেখ আব্দুল হাকিম সেবা-র হয়ে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে লিখে গেছেন। কিন্তু মৌখিক চুক্তি কপিরাইট আইনে কাজে লাগে না। ওই বইগুলোর প্রকৃত লেখক যে শেখ আব্দুল হাকিম, সেটা সেবা প্রকাশনীও অস্বীকার করছে না। এবং যেহেতু কাগজপত্রে তিনি স্বত্ব সেবা-কে দেননি, তাই কপিরাইট আইন বলছে এগুলো তাঁরই বই, সেবা-র নয়।
সুতরাং, শেখ আব্দুল হাকিমের পক্ষে এই বইগুলোর স্বত্ব দাবী আসলে বেআইনি নয়। আবার এ কথা সত্যি হলেও আইনের ফাঁক ব্যবহার করে তাঁর এই দাবীর ন্যায্যতা এবং নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়।
অবশ্য আইন এবং মূল্যবোধের বিরোধ আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়, যুগ যুগ ধরে এটা চলে আসছে।
এই ঘটনা আর কতদূর গড়াবে এখনও বুঝতে পারছি না। তবে আমি প্রাসঙ্গিক আরেকটি ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমাদের দেশের লেখক এবং ছায়ালেখকদের কাছে অনুরোধ থাকবে, তাঁরা যেন বই প্রকাশের আগেই তাঁদের প্রকাশকদের সঙ্গে লিখিত চুক্তি করেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, চুক্তির প্রসঙ্গ হাজির হলেই দেশের লেখক-প্রকাশক দুই পক্ষই একটা অস্বস্তিতে ভোগেন, ভাসুরের নাম মুখে না নেয়ার মত অদ্ভুত আচরণ শুরু করেন। দয়া করে এই অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসুন। আপনি লেখক হলে অকুণ্ঠচিত্তে প্রকাশকের কাছে চুক্তিনামা চান। আপনি প্রকাশক হলে একটা সাধারণ চুক্তিনামার নমুনা তৈরি রাখুন; মনে রাখবেন এটা আপনার পেশাদারিত্বের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকবে।
ভবিষ্যতের অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতা এড়াতে সঠিকভাবে দুই পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের সংস্কৃতি আমাদের প্রকাশনা জগতে অবিলম্বে চালু হবে, এমনটাই আশা করি।
মন্তব্য
আমি শুনেছি এরকম ক্ষেত্রে ঘোস্ট-অনুবাদক / ঘোস্ট-রাইটার যদি ১২ বছরের বেশি সময় ধরে বিদ্যমান পরিস্থিতি মেনে নেন বা প্রতিবাদ / মামলা না করে চুপ করে থাকেন, উপরন্তু যদি অপর পক্ষের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে (বেতন বা এককালীণ সম্মানী ইত্যাদ) তার সাথে সহযোগিতা অব্যাহত রাখেন (যেন কিছুই হয়নি), সেক্ষেত্রে তার এই নিরবতাই ১২ বছর পরে বিদ্যমান অবস্থার পক্ষে চুক্তি হিসাবে গণ্য হবে। অর্থাৎ যার নামে প্রকাশিত হয়েছে তার বক্তব্য বা দাবিই চুক্তির মর্যাদা পাবে। এরকম কি যেন শুনেছিলাম ঠিক মনে নাই। এর মধ্যে কি কোনো সত্যতা আছে?
****************************************
থাকতেও পারে, তবে আমি কখনও শুনিনি। মানে ‘১২ বছর’ বা ‘চুক্তি না থাকলে কী আইন’- এগুলো।
কিন্তু উপরে লেখায় যেটা বলেছি, এত দীর্ঘসময় ধরে যেহেতু বইয়ের ‘লেখক’ হিসেবে কাজী আনোয়ার হোসেনের নাম ছাপা হয়েছে, তার মানে হাকিম নিজের ভূমিকা যে ‘ছায়ালেখক’—অন্তত মৌখিকভাবে হলেও—সেটা মেনে নিয়েছিলেন বলে ধারণা করা যায়। পরবর্তীতে কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে এখন এত কিছু হচ্ছে সেসব সঠিক জানা নেই।
আসলে কাগজে কলমে একটা বইয়ের writer এবং ghostwriter এর মধ্যে আসল পার্থক্যই হচ্ছে স্বত্ব থাকা এবং না-থাকা। একই মানুষ একটি বইয়ের যুগপৎ লেখক এবং ছায়ালেখক হতে পারেন না।
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
বাই দা ওয়ে, সেবা প্রকাশণী তাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেইজে এই বক্তব্য দিয়ে এই প্রসঙ্গে --
এ ব্যাপারে আপনার মত কি?
****************************************
এই বক্তব্য অস্পষ্ট লাগছে। স্বাভাবিক যুক্তিতে কপিরাইট বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তো কপিরাইট অফিসেরই নেয়ার কথা। সেই সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে দেশের আইন অনুযায়ী আদালতে যাওয়া যায়, এটা সিভিল সোসাইটি-র অন্য যে কোনও dispute এর মতই ব্যাপার, আলাদা কিছু না।
আমার কাছে এই পুরো ঘটনাটাই সেবা প্রকাশনীর জন্যে দুর্ভাগ্যজনক মনে হয়েছে, বোকামির খেসারতও বলা চলে। লিখিত চুক্তি না থাকলে কপিরাইট অফিসের আসলেই কিছু করার থাকার কথা না। তবে আদালতের কথা আলাদা। মৌখিক চুক্তি যে ছিল, সে ব্যাপারে আদালতকে সন্তুষ্ট করা গেলে ব্যতিক্রমী কোনও রায় বের হয়ে আসা হয়তো অসম্ভব কিছু না।
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
কাজী আনোয়ার হোসেন যেদিন 'ধ্বংস পাহাড়' লিখে প্রকাশ করেছেন সেদিনই 'মাসুদ রানা'র কপিরাইট তাঁর হয়ে গেছে, কারণ সেটি 'অরিজিন্যাল' রচনা। এর পরে তাঁর অনুমতি নিয়ে যে কেউ 'মাসুদ রানা' লিখতে পারেন, কিন্তু তাতে 'মাসুদ রানা'র মালিকানা কাজী আনোয়ার হোসেন ভিন্ন অন্য কারো হবে না। একমাত্র তিনি পরলোকগমন করলে এর মালিকানা তাঁর বৈধ উত্তরসূরীদের ওপর বর্তাবে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
বইগুলো কাজী আনোয়ার হোসেন লিখে থাকুন আর শেখ আবদুল হাকিম লিখে থাকুন সেখানে প্রথমেই কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন হয়েছে। কথাটা শুনতে যেমনই শোনাক, এটি সত্যি। যেহেতু আইনের লঙ্ঘন করে লেখা তাই সেবা শেখ আবদুল হাকিমের সাথে এই ব্যাপারে লিখিত চুক্তিতে যায়নি। বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস তাদের পর্যবেক্ষণে এই বিষয়টি আনেননি। 'বিদেশী গল্পের কাহিনী অবলম্বনে' বলে ডিসক্লেইমার দেয়া, আর 'সূত্রঃ ইন্টারনেট' বলা একই জিনিস। সেবা বা কাজী আনোয়ার হোসেন এই কাজ করায় আমাদের মতো পাঠকের কী উপকার হয়েছে সেটা কপিরাইট অফিস বা আদালতের দেখার বিষয় নয়। বাংলাতে বইগুলো লেখাতে মূল লেখকদের স্বার্থ নষ্ট হয়েছে, এটা মানতে হবে।
----------------
বাংলাদেশে কতো জন প্রকাশক লেখকের সাথে চুক্তি করেন সেটা আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে। আমার কোন বই আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি, কিন্তু বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে আমার নিকটজন যাদের বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁদের কারো সাথে প্রকাশকের চুক্তি হয়েছে বলে দেখিনি। কালেভদ্রে এক-আধজন এক দফা অল্প রয়্যালটি পেয়েছেন, বাকিদের কপালে লবডঙ্কা। এমনকি যাঁরা সম্পূর্ণ নিজেদের টাকায় কোন প্রকাশনী থেকে বই প্রকাশ করেছেন তাঁরা প্রকাশিত বইয়ের হিসাব ঠিকমতো পেয়েছেন বলে দেখিনি। আমার পরিচিতদের বাইরে বৃহত্তর বাজারের অবস্থা এরচেয়ে বিশেষ উন্নত কিছু না।
-----------------
বাংলাদেশে প্রকাশনা শিল্প এক আদিম অন্ধকার যুগে পড়ে আছে। এখানে বিপণন, পরিবেশন, বিতরন বলে সুগঠিত কিছু নেই। বই প্রকাশের উপকরণ, ছাপাখানা, বাঁধাই, কম্পোজ, অলঙ্করণ সব কতিপয় গ্রুপের আওতায়। পাঠ্যপুস্তক ছাড়া বাংলাদেশে বইয়ের মোট বাজারটি খুবই ছোট। তারওপর পাঠ্যপুস্তকের বড় অংশ আবার রাষ্ট্র নিজ অর্থায়নে করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে বিতরণ করে থাকে। সব প্রকাশক মিলিয়ে একুশের বইমেলায় মোট বিক্রির পরিমাণ গ্রামীণফোনের একদিনের রেভিনিউ'র সমান হবে না। এই কারণে এখানে বৃহৎ পুঁজি আসে না, উদ্যোক্তারা সহসা এখানে বিনিয়োগ করতে চান না।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
লিখিত চুক্তি হলে কি সেখানে "অমুক লেখকের তমুক বইয়ের কপিরাইট লঙ্ঘন করিয়া এই বই লিখা হইতেছে" ধরনের কোন ক্লজ সেই চুক্তিতে থাকত। প্রকাশক আর লেখকের মধ্যে লিখিত চুক্তিতে কি কি থাকে, আপনার কি আদৌ কোন স্পষ্ট ধারনা আছে? আমার মনে হয় নাই, কারন আপনি নিজেই বলছেন আপনার যেমন কোন বই চুক্তিতে প্রকাশিত হয় নাই, আপনার পরিচিত কারুরও হয় নাই।
কপিরাইট অফিস কিসের ভিত্তিতে এই পর্যবেক্ষন দিবে? মাসুদ রানার বইগুলি যেসব বইয়ের কাহিনি অবলম্বন করে লিখা, সেই বইগুলির মূল লেখকগন কি কাজী-হাকিমের কাজিয়ার পক্ষভুক্ত? তারা কি উপযুক্ত প্রমানসহ তাদের স্বার্থ নষ্ট হওয়ার কথা বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসকে জানাইছে? কপিরাইট লঙ্ঘন হয়েছে কি হয় নাই, কপিরাইট অফিস তা অভিযোগের ভিত্তিতে বিবেচনা করে। আজকে আপনি আরেকটা মাসুদ রানা লিখলে কি কপিরাইট অফিস নিজে থেকে আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে, নাকি কাজী আনোয়ারের অভিযোগের জন্য অপেক্ষা করবে?
কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন হয়েছে কি হয়নি সেটা আমি-আপনি জানি, আদালত বা কপিরাইট অফিস জানে না। আমি-আপনি জানা আর আদালত জানা বোধহয় এক জিনিস না। আইনের চোখে সেটা সত্যি আইনের লঙ্ঘন হয়েছে কিনা তা আদালত বা কপিরাইট অফিসে এগ্রিভড পার্টির সাক্ষ্য-প্রমাণ সহ দায়েরকৃত অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাদের দেয়া রায়ের উপর নির্ভর করে মনে হয়। এখানে মূল লেখকরা কোনো মামলা করেন নাই, কপি অফিসের সামনে এই মর্মে কোনো অভিযোগ বা সাক্ষ্য-প্রমাণও কিছু নাই বলে মনে হয়। সুতরাং সেরকম কোনো রায় বা সিদ্ধান্ত ছাড়া আইনত সেবার এসব বই মনে হয় এখনো বে-আইনি না বা আইনত কপিরাইট আইনের লঙ্ঘনকারী না বলেই মনে হয়।
এরকম কাজ যে আদতেই করা হয়েছে সেটাই কি কপিরাইট অফিস বা আদালতের দেখার বিষয় - মূল এগ্রিভড পার্টি সাক্ষ্য-প্রমাণ সহ অভিযোগ / মামলা দায়ের না করা পর্যন্ত? আমি জানি না কপি অফিস বা আদালতের যেচে পড়ে এসব দেখার কোনো দায়িত্ব আছে কিনা।
আসলে আমার মনে হয় এই প্রসঙ্গটা কাজি আনোয়ার হোসেন - শেখ আব্দুল হাকিম বিরোধের ক্ষেত্রে আইনত প্রাসঙ্গিক না। নৈতিক ভাবে হলেও হতে পারে।
****************************************
আপনার পরের দুই প্যারায় বলা কথাগুলি আরও অনেকের মুখেই শুনেছি। বড় লেখকদের মুখেও শুনেছি। একবার নাট্যকার এবং সাবেক সংস্কৃতি (?) সচিব সাঈদ আহমদ সাহেবকে রাগে-দুঃখে প্রায় কেঁদে ফেলতে দেখেছিলাম প্রকাশকদের ঠকাঠকির জ্বালায়!
****************************************
একমত। কপিরাইট আইনে লিখিত চুক্তিপত্র উপস্থাপনের বাধ্যবাধকতা থাকা দরকার।
@নাসিমঃ
‘চুক্তি আইন ১৮৭২ (১৮৭২ সালের নবম আইন)’ একটি জেনেরিক জিনিস। বস্তুত অধিকাংশ আইনই জেনেরিক। বই লেখার জন্য চুক্তি আইন, ছবি আঁকার জন্য চুক্তি আইন, চলচ্চিত্র বানানোর জন্য চুক্তি আইন বলে কিছু নেই। সুতরাং বাংলাদেশে সম্পাদিত যে কোন চুক্তি এই আইনে নির্দেশিত ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে হতে হবে। এর বাইরে ‘পণ্য বিক্রয় আইন ১৯৩০ (১৯৩০ সালের তৃতীয় আইন)’ নামে কাছাকাছি আরেকটি আইন আছে। চুক্তি আইন ১৮৭২-এর আওতায় বেশ কয়েক প্রকারের চুক্তি সম্পাদনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে। সুতরাং আমি যা বলছি সেটি অনুমানপ্রসূত নয়। সেবা প্রকাশনী শেখ আবদুল হাকিমের সাথে চুক্তি করলে সেখানে কী ক্লজ থাকতো সেটা বোঝার জন্য চুক্তি আইনটা জানতে হবে।
সৃষ্টিকর্মের জন্য চুক্তি হতে গেলে যিনি সৃষ্টি করবেন তাঁকে হলফনামা দিতে হয় যে এটি ‘অরিজিন্যাল’। এই ব্যাপারেও আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে। সেবা প্রকাশনীর সাথে চুক্তি করতে গেলে শেখ আবদুল হাকিমকে তাঁর রচনাকর্মটি যে অরিজিন্যাল সেই ঘোষণা দিতে হতো। সেটা যে সম্ভব নয় তা উভয় পক্ষ জানেন বলে কোন চুক্তি হয়নি।
@নাসিম/ মন মাঝিঃ
উপরে যে হলফনামার কথা বললাম সেটি আবশ্যিক বলে কপিরাইট অফিসে যখন কেউ কোন সৃষ্টিকর্ম নিজের বলে দাবি করেন তখন তাঁর পক্ষে এই হলফনামাটি দেয়ার বাধ্যবাধকতা চলে আসে। শেখ আবদুল হাকিম কি সেটি দিতে পারতেন? একটি ফৌজদারী অপরাধ ঘটলে সাথে সাথে রাষ্ট্র সেখানে বাদীপক্ষ হয়ে যায়। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে কখনো কখনো পুলিশের কেউ যে বলে থাকেন, ‘এই ব্যাপারে এখনো কেউ লিখিত অভিযোগ করেননি, আমরা অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবো’ – এই কথাটি আইনানুগ নয়। সুতরাং কপিরাইট অফিস শেখ আবদুল হাকিমকে গোড়াতেই এই প্রশ্নটি করতে পারত।
শেখ আবদুল হাকিম কপিরাইট অফিসে যখন অভিযোগ দায়ের করেন তখন আলোচ্য সৃষ্টিকর্মের ব্যাপারে কপিরাইট অফিস ‘অরিজিন্যালিটি’র হলফনামা দাবি করলে বিষয়টি তখনই শেষ হয়ে যেত। তাছাড়া প্রতিটি বইয়ে যখন ‘বিদেশী গল্পের কাহিনী অবলম্বনে’ উল্লেখ করা থাকে তখন কপিরাইট দাবি করাটাই ভিত্তিহীন হয়ে যায়।
কেউ কোন ব্যাপারে সংক্ষুব্ধ হয়ে কোন আদালতে অভিযোগ দায়ের করলেই বিচার শুরু হয়ে যায় না। আদালত মামলাটির গ্রহনযোগ্যতাও বিচার করে। গ্রহনঅযোগ্যতার কারণে প্রচুর মামলা প্রথম শুনানীতেই খারিজ হয়ে যায়। এই মামলাটিও প্রথম শুনানীতে খারিজ হয়ে যেতে পারতো।
এই প্রকার আলোচনায় অনেকে বিদেশে বহুল চর্চ্চিত ‘ঘোস্টরাইটার’ পদ্ধতির কথা বলছেন। তাঁদের আলোচনায় যে কথাটি অগ্রাহ্য করা হচ্ছে সেটি হচ্ছে, সেখানে ঘোস্টরাইটাররা কিন্তু ‘অরিজিন্যাল’ লেখার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে থাকেন, কেবল প্রকাশের সময় লেখকের নামটি পালটে যায়। সেবার ক্ষেত্রে ঘোস্টরাইটার যা লিখছেন সেটি ঠিক ‘অরিজিন্যাল’ নয়। তাই এখানে বাইরের ঘোস্টরাইটারের উদাহরণ কতটুকু প্রযোজ্য তা বিবেচনা করে দেখা উচিত।
বাংলাদেশে প্রকাশিত বইয়ের বড় অংশ –
(ক) প্রয়াত লেখকের রচনা বা রচনাসমগ্র বা সংকলন যার কপিরাইটের সময়সীমা শেষ হয়নি কিন্তু বৈধ উত্তরাধিকারদের কাছ থেকে অনুমতি নেয়া হয়নি বা তাঁদেরকে রয়্যালটি দেয়া হয়নি।
(খ) জীবিত লেখকের রচনা পুনর্মুদ্রণ বা সংস্করণ যা লেখকের অনুমতিবিহীন বা তাঁকে রয়্যালটি দেয়া হয়নি।
(গ) মৃত প্রকাশনী (যথাঃ প্রগতি, রাদুগা, মীর, বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়, ফ্র্যাঙ্কলিন বুকস্ ইত্যাদি) কর্তৃক অতীতে প্রকাশিত বই।
(ঘ) অন্য দেশে (যথাঃ ভারত) প্রকাশিত বাংলা ভাষার বই যা লেখকের অনুমতিবিহীন বা তাঁকে রয়্যালটি দেয়া হয়নি।
(ঙ) বাংলা ভিন্ন অন্য ভাষায় লেখা বিদেশী লেখকের বইয়ের অনুবাদ লেখকের অনুমতিবিহীন বা তাঁকে রয়্যালটি দেয়া হয়নি।
উপরোক্ত সবগুলো ঘটনাতে আইনের লঙ্ঘন হয় এবং এই বইগুলো অবৈধ হয়। এই ব্যাপারে কেউ উদ্যোগী হয়ে কোন মামলা করেন না বলে অথবা ‘সুয়া স্পন্তে’ বা ‘সুয়ো মোতু’ মামলা হয় না বলে এগুলো এখনো নির্বিঘ্নে চলছে।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
১। আচ্ছা!!! তাহলে তো কাজি-হাকিম কারোরই বাংলা কাহিনিগুলির কপিরাইট নাই আসলে এবং পাওয়ার যোগ্যতাও নাই!! সেক্ষেত্রে কপিরাইট অফিস একজন থেকে নিয়ে বা না নিয়ে আরেকজনকে কপিরাইট দিল কি করে? এই সিদ্ধান্তই তো অবৈধ হয়ে গেল?? উপরন্তু, যে কেউ তাদের বাংলা এডাপ্টেশনের কাহিনিগুলি থেকে "মাসুদ রানা" টাইটেল বা ক্যারেকটারটার নাম বদলে নিয়ে (কারন এই নামটার কপিরাইট আছে আপনার উপরে আগের একটা কমেন্ট অনুযায়ী) বাকি কাহিনিটুকু হুবহু কপি-পেস্ট করে ছাপিয়ে দিতে পারে, তাই না??? এদের কেউ কিছু করতে পারবে না তাতে!!! আমিও পারি, তাই না? হা হা --
২। উপরের পয়েন্টটা ঠিক থাকলে এই পুরো কপিরাইট যুদ্ধটাই তো অর্থহীণ মনে হচ্ছে??!!
৩। তবে "মাসুদ রানা" নামটা বাদ দিয়ে বাকি কাহিনি কপি-পেস্ট করে ছাপালে কি কোনো লাভ হবে হাকিম (তার সাক্সেসরদের) বা অন্য কারও বা কোনো ক্ষতি হবে কাজি-সেবার?? এই ঘরাণার পাঠকমহলে "মাসুদ রানার" যে ব্র্যান্ড এক্সেপ্টেন্স ও ব্র্যান্ড লয়ালটি আছে - সেটা তো আর এইভাবে ট্রান্সফার হবে না অন্য নামের বইতে!!! হাকিম এই চেষ্টা আগেও করেছিলেন অন্যভাবে। "জাকি আযাদ" নামে ঠিক মাসুদ রানার মত একটা সিরিজ চালানোর অনেক চেষ্টা করেছিলেন এক সময়, কিন্তু সেটা চলেনি!!! ঐ সিরিজে মাসুদ রানা ছাড়া কমবেশি সবকিছুই মনে হয় একই রকম ছিল - একই অনুবাদক, একই ধরণের কাহিনি এবং সম্ভবত একই কোয়ালিটি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তাহলে কি দাঁড়ালো শেষমেশ? কাজি কি তাহলে এই যুদ্ধে জিতেই গেলেন প্র্যাক্টিকালি, নাকি গেলেন না? সেবা তাহলে এখনো মাসুদ রানা নাম দিয়েই ঐ বইগুলি ছাপতে পারবে, কিন্তু হাকিমকে ঐ নাম ছাড়াই ছাপতে হবে (যাতে তার আশানুযায়ী কোনো লাভ হবে না শেষমেশ)? কোর্ট বোধহয় তাদের রায়ে নামটার উপর কাজির দাবি বহাল রেখেছে। সুতরাং সেবা এখন আর কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকলেই তো হয়???
৪। আরেকটা সমস্যা আছে অবশ্য। হাকিম মনে হয় কয়েক কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ বা ব্যাকপে চেয়েছিলেন। তার নামে কপিরাইট হলে তো এই টাকা তাকে দিতে হবে সেবার। সেক্ষেত্রে কি সেবাকে আবার আদালতে যেতে হবে কপিরাইট তাদের দাবি করে বা "হলফনামার" পয়েন্টে কপিরাইট অফিসের রায় ভুল এই দাবিতে? এটা করতে গেলে একই যুক্তিতে এবং আইন ভঙ্গের কারনে তারা নিজেরাও কি ফেঁসে যাবে না?
৫। আমার উপরের বোঝাতে কি কোনো ভুল আছে? মজাই লাগছে এই উদ্ভট সমস্যাটা নিয়ে ভাবতে। দুই আইনভঙ্গকারী বেআইনি লাভালাভের ভাগাভাগি নিয়ে আইনের কাছেই দ্বারস্থ হয়েছেন!!! অথচ দুই পক্ষের কেউই এই বিষয়ে কি কোর্টের কাছে কি পাব্লিকলি ঝেড়েও কাশতে পারছেন না ঠিকমত, খালি ঝোপে-ঝাড়ে পিটিয়ে যাচ্ছেন!!! কি যে বিদঘুটে হাস্যকর অবস্থা। হা হা হা!!!
****************************************
পুরো ব্যাপারটার সারাংশ আসলে এরকমই। আপনি ঠিকই ধরেছেন।
আসলে 'ছায়া অবলম্বনে' বলে যে-বইগুলো ছাপা হয়েছে, সেগুলো কপিরাইট আইন ভেঙ্গে করা হয়েছে। হাকিম বাংলাদেশের কপিরাইট অফিসে কীসের ভিত্তিতে আবেদন করেছেন আমি নিশ্চিত নই। তবে ধারণা করতে পারি, সম্ভবত মূল বইগুলোর প্রসঙ্গ উল্লেখ না করে বাংলা ‘কন্টেন্ট’-এর বইগুলো যে ওনার লেখা- হয়ত সেই দাবী করেছেন।
সত্যি কথা হচ্ছে- এখনও যে আমাদের দেশে হরহামেশা যে কোনও বইয়ের বাংলা অনুবাদ ছাপা হয়, স্বত্ব না কিনে, সেগুলো সবই বেআইনি। “মূল লেখকের সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না" অথবা "অনুবাদ-স্বত্ব কিনতে অনেক টাকা লাগে" এগুলো কোনোটাই শক্ত যুক্তি নয়। দেখে অবাক লাগে, দেশের অনেক বড় বড় প্রকাশনীই নির্দ্বিধায় এখনও এভাবে অনুবাদ প্রকাশ করে চলেছে।
আরেকটা মজার ঘটনার কথা মনে পড়ছে। উইলবার স্মিথের 'ক্রাই ওলফ' বই 'অবলম্বনে' লেখা হয়েছে মাসুদ রানা-র 'মুক্তবিহঙ্গ'। পরবর্তীতে স্মিথের মূল বইয়ের অনুবাদ হিসেবে মখদুম আহমেদ নামের একজন অনুবাদকের করা বাংলা বই হাতে নিয়ে দেখি, সেই ভদ্রলোক মুক্তবিহঙ্গ-ই প্রায় পুরোটা টাইপ করে তুলে দিয়েছেন, নতুন করে অনুবাদের কষ্টও করেননি!
আমি মজা দেখার জন্যে অনেকদিন অপেক্ষা করে ছিলাম। কিন্তু সেবা থেকে এই বিষয়ে কোনও উচ্চাবাচ্য চোখে পড়েনি।
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
আমি মাসুদ রানার ছায়ানুবাদকদের ‘ঘোস্টরাইটার’ না, "ঘোস্ট-ট্রান্সলেটর" বা "ঘোস্ট-এডাপ্টার" বলি!!
****************************************
ঘ্যাচাং
****************************************
(১) মনে করে দেখার চেষ্টা করুন তো মাসুদ রানার কোথাও © প্রতীকটি কি কখনো দেখেছেন? অথবা কপিরাইট সংক্রান্ত কোন ডিসক্লেইমার? আমার মনে পড়ে না, আপনি কি মনে করতে পারেন? ধরে নিলাম, সেবা প্রকাশনী বা কাজী আনোয়ার হোসেন বইগুলোর কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন করিয়েছিলেন কিন্তু প্রকাশকালে ডিসক্লেইমার দেননি। তাহলে তাঁরা কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন আবেদনে ‘বিদেশী গল্পের কাহিনী অবলম্বনে’র ব্যাখ্যা কী দিয়েছিলেন? ‘অরিজিন্যাল’ না হলে তো আবেদনই করতে পারার কথা না।
যদি এমন অবস্থায়ও কপিরাইট আবেদন করা যায় তাহলে আপনার বলা নাম বদলে কপি-পেস্ট মাসুদ রানারও কপিরাইট রেজিস্ট্রেশন হবার কথা।
(২) এই কপিরাইট যুদ্ধটা কী করে হচ্ছে সেটা ভেবে আমি নিজেও অবাক।
(৩-ক) এই আইনী লড়াইটি সম্ভবত কাউকে কোনভাবে লাভবান করবে না। শেখ আবদুল হাকিম এখন প্রয়াত। তাঁর উত্তরাধিকারদেরকে এখন আদালত থেকে ঐ ২৫০টি বইয়ের মালিকানার সাকসেশন বের করতে হবে। সাকসেশন বের করার পরেও কাজী আনোয়ার হোসেন ও সেবা প্রকাশনী – এই দুই নাম উল্লেখ না করে বই ছাপতে হবে। তাতে সে বই কেউ কিনবেন বলে মনে হয় না। তাছাড়া ‘মাসুদ রানা’ নাম/ব্রান্ডটি শেখ আবদুল হাকিম বা তাঁর সাকসেসররা পেতে পারেন না। তাহলে হাকিম পক্ষ আসলে লাভবান হতে পারলেন না। আবার সেবা প্রকাশনী বা কাজী আনোয়ার হোসেন আইনী বাধ্যবাধকতার কারণে ঐ বইগুলো প্রকাশ করতে পারবেন না। তার মানে তারাও ক্ষতিগ্রস্থ হলেন। এই বইগুলো পুনঃপ্রকাশ হতে পারবে না বলে সাধারণ পাঠক বঞ্চিত হবেন।
(৩-খ) ‘জাকি আজাদ’ যদি পঞ্চাশ বছর আগে লেখা হতো তাহলে হয়তো মাসুদ রানার প্রতিদ্বন্দ্বী হতো। জাকি আজাদ যখন লেখা হয়েছে ততদিনে রানা’র দিনই শেষ হতে চলেছে। পাঠক ভিন্ন নামে মাসুদ রানা পড়তে রাজী হয়নি, ফলে জাকি আজাদ হালে পানি পায়নি। ব্রান্ডিং খুব সহজ ব্যাপার নয়।
(৪) হাকিম পক্ষ এখন ক্ষতিপূরণের মামলা করলে বিশেষ কোন লাভ হবে না। মামলাতে তারা কয়েক কোটি টাকার দাবির সপক্ষে প্রমাণ দাঁড় করাতে পারবে বলে মনে হয় না। ইন ফ্যাক্ট, ‘বিদেশী গল্পের কাহিনী অবলম্বনে’ পয়েন্টে এখন কাজী আনোয়ার হোসেন, সেবা প্রকাশনী বা অন্য যে কেউ হাকিম পক্ষের বিরুদ্ধে কপিরাইট খারিজের মামলা করলে জিতে যাবার সমূহ সম্ভাবনা আছে।
(৫) আপনার পর্যবেক্ষণ সঠিক। আসলেই সকল পক্ষ এখানে ঝোপঝাড় পিটিয়ে যাচ্ছেন। কারণ, এটি নিয়ে ঝেড়ে কাশার তাদের উপায় নেই।
(৬) ‘মাসুদ রানা’র ক্ষেত্রে ‘ঘোস্ট-এডাপ্টার’ বলাটা ঠিক হয়।
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
মূল পোস্টের সাথে প্রাসঙ্গিক মনে হওয়ায় 'কিশোর আলো'-তে ছাপা হওয়া রকিব হাসান-এর একটি সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ এখানে তুলে দিলাম।
------
কিশোর আলোঃ ওই দিন কি কোনো লেখার প্রস্তাব পেয়েছিলেন?
রকিব হাসানঃ পাঁচ-সাত দিন পরে কাজী সাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন। সেদিন বিকেলে দেখা করতে বললেন। ভাবলাম, কিছু অপমান-টপমান আছে কপালে। কারণ, বড় বড় কথা বলেছি তো! বয়স কম, আত্মবিশ্বাসের কিছুটা অভাব আছে। তারপরও হঠাৎ করে শক্ত হয়ে গেলাম। কাজী আনোয়ার হোসেন, শেখ আবদুল হাকিম, শাহাদত চৌধুরী, সাজ্জাদ কাদির, জ্ঞানে-গুণে বড় বড় সব মানুষ—আমার তাতে কী? আমার মতো ইংরেজি বই তো তাঁরা পড়েননি (হাসি)। সবাই আমার চেয়ে কম পড়ছেন। তখনো জানি না, ওঁরা কোনো অংশেই আমার চেয়ে কম পড়া মানুষ নন। আমার চেয়ে বেশি শিক্ষিত, বয়সে বড়, অভিজ্ঞ। আমি ভাবলাম, হতে পারেন কেউ বড় কবি, কেউ পত্রিকার সম্পাদক, কেউ লেখক; কিন্তু আমার মতো এত ইংরেজি থ্রিলার কেউ পড়েননি। এসব ভেবে নিজেকে বোঝালাম আরকি, সাহস সঞ্চয় করলাম। গেলে আর কী হবে? বড়জোর বলবেন, আপনার বই দিয়ে মাসুদ রানা হবে না। তখন চলে আসব।
তারপর গেলাম সেবায়। আমাকে বসতে বলা হলো। হাকিম শুরুতেই বললেন, ‘ভাই, এত পড়লেন কী করে? এত অল্প বয়সে?’ বললাম, ‘একটা বই পড়তে দু-তিন দিন লাগে, কত বই-ই তো পড়া যায়!’ তিনি বললেন, ‘আপনার বইগুলো প্রায় সবগুলোই হবে।’ কাজী সাহেব একটু নাটক করে বলতে চেয়েছিলেন, হাকিম তাঁকে সেটা করার সুযোগ দিলেন না, প্রথমেই আসল কথাটা ফাঁস করে দিলেন। আমি বললাম, ‘ওই দিন আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি দোকানে...’ বাধা দিয়ে হাকিম বললেন, ‘ধুর সাহেব, কবে ভুলে গেছি সে কথা! আপনি আমাকে বাঁচিয়েছেন, এতগুলো মাসুদ রানা দিয়েছেন। আমি তো প্লট পাচ্ছিলাম না, লিখতে পারছিলাম না।’ তখন আমি চিন্তা করলাম পড়তে পারি, লিখতে অসুবিধে কী? আমি একটা মাসুদ রানা লিখব। একটা বই পড়লাম, খুব ভালো একটা বই ছিল। সেটা পড়ে মনে হলো, এটা মাসুদ রানা হয়েই আছে। কাজী সাহেবকে গিয়ে বললেই হয়। তারপরে গিয়ে কাজী সাহেবকে বললাম যে এই বইটা মাসুদ রানা হয়। তিনি বললেন, ‘যেগুলো দিয়েছেন, ওগুলোর চেয়ে ভালো?’ বললাম, ‘হ্যাঁ, ওগুলোর চেয়ে ভালো।’ তিনি রসিকতা করে বললেন, ‘এটা আগে না দিয়ে নিজে রেখে দিলেন কেন?’ বললাম, ‘হাতের কাছে যা পেয়েছি তা-ই নিয়ে ছুট দিয়েছিলাম।’ কাজী সাহেব বললেন, ‘তো, লিখতে পারবেন?’ বললাম, ‘আমি পারব কি না আপনি বলেন।’ তিনি বললেন, ‘পারবেন।’ আমি বললাম, ‘কী করে বুঝলেন পারব?’ তিনি বললেন, ‘কারণ, আপনি পড়তে পারেন। লিখতে পারার মূলে হলো পড়া। আপনার বাংলাও পড়া আছে, ইংরেজিও পড়া আছে।’ সেই প্রথম একটা মাসুদ রানা লিখলাম। ভুল-ভাল হয়েছিল অনেক। কাজী সাহেব বইটা পড়লেন। পড়ে আবার ডেকে পাঠালেন। গেলাম এবার ভয়ে ভয়ে। পাণ্ডুলিপিটা আমার সামনে ছেড়ে দিলেন। দেখলাম যে অনেক লাল কালির দাগ, বানান ভুল, কাটাকুটি। ভাবলাম, আমাকে দিয়ে হবে না। উনি বললেন, ‘না, হবে। হয়েই আছে। খুব ভালো লিখেছেন।’ আমি একটু সাহস পেলাম। তিনি বললেন, ‘এই এই জিনিসগুলো একটু মেরামত করে নিয়ে আসেন। তারপর হাকিমকে দিয়ে সম্পাদনা করাব। সবশেষে আমি দেখব।’ সেসব করার পর বেরিয়ে গেল মাসুদ রানার বই। খুব সহজেই বলতে হবে। তখন সাহস পেয়ে গেলাম। বললাম এরপর কী লিখব? উনি বললেন, ‘মাসুদ রানা আর লিখতে যেয়েন না। কারণ এটা লিখতে অভিজ্ঞতা দরকার, অনেক কঠিন কাজ। আপনি সহজ কোনো কাজ দিয়ে শুরু করেন।’ পরে চিন্তা করলাম যে কী দিয়ে শুরু করতে পারি? জুল ভার্ন আমার খুব ভালো লাগত। বললাম যে জুল ভার্ন অনুবাদ করলে কি চলবে? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, চলতে পারে। আপনি চেষ্টা করেন।’ বললাম, ‘মাসুদ রানা তো লিখলাম কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে, জুল ভার্ন-এর অনুবাদটায় কী হবে?’ হাকিম আমাকে সাবধান করল, ‘রকিব! খবরদার! নিজের নামে লিখতে যেয়েন না! কাজী সাহেবকে রাজি করান। কাজী আনোয়ার হোসেনের নামে অনুবাদ করেন।’ বললাম, ‘কেন?’ বলল, ‘ওই নামে লিখলে ভুল হলেও বই চলবে।’ তো কাজী সাহেব বললেন, ‘না, জুল ভার্ন-এর অনুবাদ ওর নিজের নামেই বের হবে। আপনার সাহস নাই। যদি ওর সাহস থাকে লিখুক।’ আমি কিন্তু আমার নামে লিখতে রাজি আছি। কিন্তু হাকিম আমাকে কিছুতেই ছাড় দিল না। তারপর কাজী সাহেব বললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, একটা ছদ্মনামে লিখেন, শামসুদ্দীন নওয়াব নামে লিখেন।’ শামসুদ্দীন নওয়াব হচ্ছে কাজী সাহেবেরই আরেক নাম। তখন থেকেই শুরু হলো অনুবাদ। প্রথম অনুবাদ করলাম শামসুদ্দীন নওয়াবের নামে পাতাল অভিযান, তারপর সাগরতলে, তারও পর রহস্যের খোঁজে। তিনটা লিখলাম, এর মধ্যে একদিন সাজ্জাদ কাদির এনে হাজির করলেন বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নামে একটা বই। সাজ্জাদ কাদির খুব প্রশংসা করতে লাগলেন বইটার। বললেন, অসাধারণ সব গল্প আছে। আমি বইটা পড়িনি। উল্টেপাল্টে দেখলাম। বললাম, ‘এ তো পড়ি নাই।’ সাজ্জাদ হো হো করে হাসলেন। বললেন, ‘রকিব পড়ে নাই, এমন বই আমরা পড়েছি! তো রকিব, কী করবা?’ আমি বললাম,‘এটা আমাকে দিয়ে দেন। আমি এটার অনুবাদ করব।’ তিনি বললেন, ‘এটা তো আমি অনুবাদ করব ভেবে কিনেছি। এই জন্যই কাজী সাহেবকে দেখাতে এনেছি।’ তিনি যে খেপাচ্ছেন আমাকে, উত্তেজনায় সেটাও বুঝতে পারলাম না। আমি বললাম, ‘না, এটা আমাকে দিয়ে দেন।’ তিনি বললেন, ‘তুমি কী করে বুঝলা এটা ভালো হবে?’ আমি বললাম, ‘ব্যাককাভার পড়েই বুঝেছি।’ কাজী সাহেব বললেন, ‘আচ্ছা এটা নিয়ে যান। দেখি, কী করে আনেন।’ করে আনলাম এবং ওইটাও শামসুদ্দীন নওয়াবের নামে ছাপা হলো। এবং এটা হলো এখন পর্যন্ত আমার ছদ্মনামে লেখা সুপারহিট বইগুলোর একটা। শামসুদ্দীন নওয়াব নামে লেখা। তারপরই এল জঙ্গল! তখন আমার সাহস হয়ে গেছে। তখন আমি বলেছি, আমি আমার নামেই লিখব। হাকিমের বাধা আর মানলাম না। রকিব হাসানের জন্ম হলো। জঙ্গল হচ্ছে ক্যানেথ অ্যান্ডারসনের শিকারকাহিনি।
-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ ।
ধ্বংস পাহাড় যখন লিখলনে, তখনই কাজী সাহেব মাসুদ রানা নামে একটি ব্র্যান্ড সৃষ্টি করলেন। যেমন কেউ একজন নাবিস্কো ব্রান্ডে নাবিস্কো গ্লুকোজ বিস্কুট নামে একটি বিস্কুট বাজারে ছাড়লেন এবং সেটি হিট খেল। এরপর অন্যান্য ফ্যাক্টরী থেকে বিস্কুট বানিয়ে এনে তিনি, নাবিস্কো পাইন এ্যাপেল বিস্কুট, নাবিস্কো ব্যানানা বিস্কুট ইত্যাদি আরও নানান বিস্কুট বাজারে ছাড়লেন। তো সেই সব বিস্কুট ফ্যাক্টরিওয়ালারা কি নাবিস্কোর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনতে পারেন যে বিস্কুটগুলো আসলে আমরাই বানিয়েছি, এগুলোর স্বত্ব আমাদের নামে দেয়া হোক? বইয়ের কপিরাইটের ক্ষেত্রে যে তা করা যায়, তা কিন্তু প্রমানিত।
কাজী সাহেব ধ্বংস পাহাড়, ভারতনাট্যম, সাগরসঙ্গম বইগুলি লিখে মাসুদ রানা সিরিজের জন্ম দিয়েছেন। জানি না তিনি মাসুদ রানা ব্র্যান্ডের স্বত্ব সংরক্ষণ করেছিলেন কি না। যদি নাও করে থাকেন, বিদ্যামান পরিস্থিতিতে পরবর্তীতে হাকিম সাহেব কিংবা অন্য কারও পক্ষে নতুন করে মাসুদ রানা ব্র্যান্ডের স্বত্ব পাওয়া সম্ভব নয়। মাসুদ রানা সিরিজের যে বইগুলো হাকিম সাহেব লিখেছেন এবং কপিরাইট স্বত্ব লাভ করেছেন, তিনি সেগুলো মাসুদ রানা সিরিজের অধীনে আর ছাপতে পারবেন না, কিন্তু নতুন করে ছাপানোর জন্য তার নামে স্বত্বের জন্য কপিরাইট অফিস থেকে অনুমোদন নিয়ে বইগুলোর নাম (যেমন প্রমান কই, পিশাচ দ্বীপ ইত্যাদি) কি তিনি ব্যবহার করতে পারবেন? নাকি নামগুলোও পরিবর্তন করতে হবে?
সব কথার শেষ কথা, এভাবে কপিরাইট স্বত্ব লাভ করলেও শেখ আব্দুল হাকিমের বৈষয়িক কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না। অন্য কোন প্রকাশক মাসুদ রানা ছাড়া অন্য কোন সিরিজ হিসেবে কিংবা একক বই হিসেবে বইগুলো প্রকাশ করার জন্য অর্থ খরচ করবেন বলে মনে হয় না। কিন্তু (কাজী সাহেবের ভাষ্য মতে) শেখ আব্দুল হাকিম কাজী আনোয়ার হোসেনকে যে হুমকিটি দিয়েছিলেন- আমি আপনার ঘুম হারাম করে দেবো, সেটি যে তিনি সার্থকতার সাথে করতে পেরেছেন, তাতে কোন সন্দেহ নাই।
যেখানে টাকাকড়ি জড়িত সেখানে সবকিছু লেখাজোকা থাকাই ভাল। মৌখিক বোঝাপড়ার ঝুকি হলো মানুষের সময়, পারষ্পরিক সম্পর্ক, ইত্যাদি চিরকাল একরকম যায় না। ফলে শেষমেষ সমস্যা দেখা দেবেই।
ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...
নতুন মন্তব্য করুন