মানুষ কেমন পাখি, তাই না?

কনফুসিয়াস এর ছবি
লিখেছেন কনফুসিয়াস (তারিখ: মঙ্গল, ২০/০৪/২০১০ - ৯:৫৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তিথির আম্মু এই কথাটা খুব বলতেন। আমাকে সরাসরি বলেন নি কখনও, আমি শুনি নি। পরে তিথির কাছে শুনেছি, মাঝে মাঝেই আনমনে তিনি এই কথাটা বলতেন।

আশ্চর্য হলো- সারাটা জীবন ধরে এই কথাটাই ঘুরে ফিরে ধ্রুবসত্যের মত মাথার উপরে এসে চেপে বসেছে। কানে শুনতে হয় নি কখনও, কিন্তু মনে আর প্রাণে নানা ঘটনায় সেটাই খুব টের পেয়েছি বারবার।
*
এইখানে, হাওয়াই মিঠাইয়ের কোন একটা পর্বে আমি লিখেছিলাম আমার আগের বাসার পেছনের ছোট্ট একটা পার্কের কথা। সেখানে প্রতি বিকেলবেলায় বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে খেলতে আসে বাবা-মায়েরা। মাঝে মাঝে দুয়েকজন বাঙালীও থাকে। আমি প্রায়শই আড়ি পেতে শুনতাম তাদের কথা। এটা পড়ে আলমগীর ভাই লিখেছিলেন, আমি নির্ঘাত তিনি আর তার মেয়ে অপনার কথাই শুনি প্রতিদিন!
সেই থেকে আলাপ।
জানা গেলো, উনি থাকেন আমাদের পাশের স্ট্রিটেই। আমি আর আমার বউ এতই 'মিশুক' যে, বছর ঘুরে গেলেও তাদের সাথে দেখা বা কথা হয় নি কখনো।
তারপরে অবশ্য হলো। ঈদে জন্মদিনে নিমন্ত্রণের দেনা-পাওনা শুরু হলো। এরপর একদিন আমরা আমাদের বাসা ছেড়ে সোজা গিয়ে উঠলাম তাদের ঊপর তলায়।
মাস ছয়েক তুমুল কাটল আমাদের। ইচ্ছে হলেই অনেক রাত পর্যন্ত তিথির গান, আলমগীর ভাইয়ের গিটার, নুশেরা আপুর কী-বোর্ড আর সাথে সাংঘাতিক সব রান্না। আমি আর অপনা মুগ্ধ দর্শক তাদের।

কিন্তু পৃথিবিতে কে কবে কার ভাল চেয়েছে বলুন?
আমাদের বাড়ির মালিক নোটিশ দিয়ে দিলেন, বাড়ি ছাড়তে হবে সবাইকে। ঐ বাড়ি ভেঙে টেঙে ওনারা নাকি শ্বেত পাথরের রাজপ্রাসাদ বানাবেন।
আমাদের এতদিনকার আনন্দ একেবারে টুপ করে ডুবে গেল ইয়ারা নদীতে। বাসা খোঁজা শুরু হলো পুরোদমে। ভেবেছিলাম, এক দালানে না হোক, কাছাকাছিই বাসা নেব। কিন্তু হলো না। অনেক খুঁজে টুজে শেষ মেষ বাসা পেলাম আমরা দুটি পরিবার, মাঝখানে কমসে কম আধা ঘন্টার ড্রাইভের পার্থক্য রেখে।

তারপরেও যোগাযোগ কমে নি।
সপ্তায় অন্তত বার তিনেক আসা যাওয়া হতই। প্রতিবারে গান-বাজনা চলতো খুব। আলমগীর ভাই অসম্ভব এনথুওয়ালা মানুষ। নিজে শুধু বাজানই না, আশপাশের সবাইকে সেখানে অংশগ্রহণ করান। আমার মত হোতকা-গলার মানুষকে দিয়েও তিনি অঞ্জনের গান গাইয়ে ছেড়ে দিলেন। আমি কতবার বলেছি, আমি গান গাইছি শুনলে আমার ইশকুলের পঞ্চাশটা ক্লাসমেটের সবাই এক যোগে আত্মহত্যা করবে, কিন্তু উনি আমার কথা শোনেনই না!

অথবা সেদিন, হিমু ভাইয়ের হঠাৎ নোটিশ, বিজয়দিবসে গান হবে সচলায়তনে, গাইবে দুনিয়ার কয়েক মাথা থেকে নানা লোকে। আমি আর তিথি কাজ থেকে ফিরে অল্প কিছু মুখে দিয়েই দৌড়ে তাদের বাসায়। রাত দেড়টা পর্যন্ত নানা কসরতে, আলমগীর ভাইয়ের পিহেইচডি মাথায় তুলে, আমার ঘুমে কাতর চোখ টানটান করে, অবশেষে রেকর্ড হলো সেই গান।

বাংলা ব্যাকরণে কখনই খুব একটা ভাল নই আমি। সারাজীবনই ক্রিয়া-কাল এসবে ভুল-ভাল করে বসে থাকি। তবু আমি, আজকে, এখন, খুব সতর্কতার সাথে এই লেখাটায় অতীতকাল ব্যবহার করে চলেছি। প্রেজেন্ট পার্ফেক্টও নয়, একেবারে পাস্ট ইনডেফিনিট।

আলমগীর ভাই, নুশেরা আপু, আর ছোট্ট অপনা মামণি, আপনাদের সবাইকে অনেক অনেক মনে পড়বে।

গতকাল রাতে আপনাদের যখন প্লেনে তুলে দিয়ে আসছিলাম, কী আশ্চর্য, অনেক চেনা রাস্তাটায়ও পথ ভুল হয়ে গিয়েছিলো আমার। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় স্ট্রিট-ম্যাপের বইয়ে পথ খুঁজতে খুঁজতে আমার কেবলই মনে হচ্ছিলো, মানুষ কেমন পাখি!


মন্তব্য

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আধা ঘন্টার ড্রাইভের দুরত্ব, তাহলে প্লেনে তুলে দিলেন ক্যান?
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

কনফুসিয়াস এর ছবি

বাংলাদেশে ফিরে গেছেন ওনারা। মন খারাপ

-----------------------------------
আমার জানলা দিয়ে একটু খানি আকাশ দেখা যায়-

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

আলমগীর ভাইয়ের "পিহেইচডি" শেষ? দেশে ফিরে গেলেন? প্রিয় এই মানুষটার জন্য হ্যাটস অফ এবং শুভকামান।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

কনফুসিয়াস এর ছবি

হুম। শাহজালাল ভার্সিটিতে গেলে গিটার কাঁধে ওনাকে সিএস-এর ক্লাসে ঢুকতে দেখা যাবে এখন। হাসি
-----------------------------------
আমার জানলা দিয়ে একটু খানি আকাশ দেখা যায়-

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

সবজান্তা এর ছবি

আপনার লেখার হাতকে আমি ঈর্ষা করি কনফুসিয়াস ভাই, সিরিয়াসলি।

লেখাটা দারুণ লাগলো হাসি


অলমিতি বিস্তারেণ

কনফুসিয়াস এর ছবি

লেখা, নাকি লেখার খবর, কোনটা?
( নতুন কী কী পড়লেন? কায়েস আহমেদ সাজেস্ট করার জন্যে অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।)
-----------------------------------
আমার জানলা দিয়ে একটু খানি আকাশ দেখা যায়-

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

ওয়েলকাম ব্যাক! এইবার কনফু-তিথিকে রেখে বাংলাদেশের সচলেরা শুনবে আলমগীর-নুশেরার বাজনা। ইয়াহু!!



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

কনফুসিয়াস এর ছবি

পাণ্ডবদা,
দেশে কত কত গায়েন আর বায়েন। আমাদের শুধু এই দুজনই ছিলেন, সবেধন নীলমণি, তাদের নিয়াও আপনার টানাটানি?
আপনাকে দিদিক্কার। মন খারাপ
-----------------------------------
আমার জানলা দিয়ে একটু খানি আকাশ দেখা যায়-

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- খালি দোয়া করেন, জোর তদবীর চলছে, পীরের কাছ থেকে পড়া পানিও খাওয়ানো হৈছে, এখন খালি বিয়েটা হওয়া বাকি!

বলছিলাম, হিমু'র বিয়ের কথা। খালি বিয়েটা হৈতে দেন। তারপর দেখেন। আমার কীবোর্ড নিয়ে আমিও হিমুর বউয়ের কোলে উঠে কেমন সব বাদ্য উৎপাদন করি, আর সেই বাদ্যে হিমু কেমন চন্দ্রবিন্দু সুরে মন পাগল করা গীত উৎপাদন করে আপনাদের জন্য। অবশ্য বদ্দাও থাকবেন, কিন্তু তিনি ঠিক কী বাজাবেন, সেটা এখনও ঠিক হয় নি। তবে জোর গুজব চলছে তিনি তবলায় ঠিকা দিবেন আর মাঝে মাঝে কাওয়ালীওয়ালাদের মতো চোখ বুজে, হাত দুলিয়ে "ওয়াহ, ওয়াহ" করবেন!

আর মন খারাপ কইরেন না বস। আমরা সবাই পাখি। অন্তত আমি এই কথাটা শুনে আসতেছি সেই ইশকুল পাশ দেয়ার পর থেকেই। আমার মা সবসময়ই বলে, আমি নাকি মানুষ না, যাযাবর পাখি!
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

কনফুসিয়াস এর ছবি

হা হা হা। ধুগো, সেই বিয়ের একটা ভিড্যু দেকতে এখুনি মঞ্চায়! হাসি

-----------------------------------
আমার জানলা দিয়ে একটু খানি আকাশ দেখা যায়-

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

অতিথি লেখক এর ছবি

মানুষের দু পায়ের নিচে নাকি সরষে দানা থাকে,তাই সব সময় ঘুরতে থাকেন।আণ্টির কথা একে বারে ঠিক।

মিতু
রিফাত জাহান মিতু

নিবিড় এর ছবি
সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ওয়াও, বাংলাদেশে চলে আসছে? গুড। এবার আপনারাও চলে আসেন। চোখ টিপি
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

প্রবাসিনী এর ছবি

একটা গানের কয়েকটা লাইন মনে পড়ে গেলঃ

কেউ না জানিল, কেউ না দেখিল,
কেমনে পাখি দিয়াছে ফাঁকি
উইড়া গেল হায় চোখের পলকে
পাখিটি ছাড়িল কে।।
________________________________________________

হইয়া আমি দেশান্তরী, দেশ-বিদেশে ভিড়াই তরী রে

________________________________________________

হইয়া আমি দেশান্তরী, দেশ-বিদেশে ভিড়াই তরী রে

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

মানুষ কেমন পাখি... মন খারাপ

-----------------------------------------------------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে আমার প্রাণের কাছে চলে আসি, বলি আমি এই হৃদয়েরে; সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।