তৃতীয় পাঠ

মাহবুবুল হক এর ছবি
লিখেছেন মাহবুবুল হক (তারিখ: শুক্র, ০৯/১১/২০০৭ - ১২:১৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্য চিন্তা ৎ প্রবন্ধের আলোকে

ঔপনিবেশিক ও উপনিবেশোত্তর উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত পারিবারিক ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করে গড়ে-ওঠা পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও ব্যক্তিত্বের মধ্যেই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের (১৯৪৩-১৯৯৭) মানসপরিধি নির্মিত। প্রথাগত আয়োজন ও আবরণের বাইরে গিয়ে জীবন-সমাজ ও ব্যাক্তিকে “নির্মোহ দৃষ্টিতে একবারে এর গভীরতম শাঁস পর্যন্ত অশেষ কৌতূহল নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে শিল্পকর্মে তা বেপরোয়াভাবে প্রকাশ করার বিরল ক্ষমতা”১ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নীতিবাদী কথকতা ও ঔচিত্যবোধের তীব্র সমালোচক এবং বুর্জোয়া সমাজকাঠামোজাত সাহিত্য ও শিল্পাদর্শের বিপরীত মেরুতে অবস্থানকারী ইলিয়াস বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার ঐতিহাসিক অসঙ্গতি ও অসম্পূর্ণতাকে শনাক্ত করার চেষ্টা করেছেন গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে, ভাষণে সর্বত্র। এক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী ও সমাজবীক্ষণজারিত দর্শণের প্রক্ষেপ পাওয়া যায় বিশেষত প্রবন্ধগুলোতে, যদিও প্রবন্ধে বিশ্লেষিত অনেক বিষয় আগে বা পরে প্রকাশিত বিভিন্ন সাক্ষাতকার, সম্পাদকীয় অথবা ভাষণে তিনি একাধিকবার উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের মানুষের সাহিত্য-সংস্কৃতির পুরাবৃত্তিক চারিত্র্য অঙ্কনের লক্ষ্যে যে দার্শনিক ভিত্তিতে তিনি উপনীত হয়েছিলেন তার যৌক্তিক এবং ঐতিহ্যিক উত্তরাধিকার সম্পর্কেও ইলিয়াসের বিশ্লেষণী অভিমত পাওয়া যায় প্রবন্ধসমূহে।

বাংলা সাহিত্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭) এর প্রবেশ ও প্রতিষ্ঠা প্রধানত ৩৫টি গল্প ও ২টি উপন্যাসের লেখক হিসেবে। এই সীমিত সৃষ্টিকর্মের অমিত গভীরতা ও আস্বাদের মধ্যেও তার ৪৪টি২ প্রবন্ধের একমাত্র সংকলন 'সংস্কৃতির ভাঙাসেতু' (বাংলাদেশ সংস্করণ, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৯, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা) সাতন্ত্র্যে প্রতিষ্ঠিত। এছাড়া 'অগ্রন্থিত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস' (ফেব্রুয়ারি ২০০৩, ঐতিহ্য, ঢাকা) -গ্রন্থে প্রকাশিত প্রবন্ধ-সম্পাদকীয়-আলোচনা-ঘোষণাপত্র ও ব্যাক্তিগত রচনা সাকুল্যে ২২টি। অর্থাত্ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচিত ও এযাবত প্রকাশিত লেখাসমূহের মধ্যে গল্প-উপন্যাস ও কিছু ছড়া-কবিতার বাইরে ৪৪টি রচনার উল্লেখ করা যায়। এসব রচনার অধিকাংশই উদ্দেশ্যমূলক; আনুষ্ঠানিক অথবা প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজনে লিখিত। এর মধ্যে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বুলবুল চৌধুরী, শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, আসহাবউদ্দিন আহমেদ, অভিজিত্ সেন, আহমদ ছফা-র মত ব্যক্তিত্বের সৃষ্টিকর্ম মূল্যায়ন আবার সংগীত, শিক্ষাব্যবস্থা এমনকি চলচ্চিত্র প্রসঙ্গেও গুরুত্বপূর্ণ অভিমত।এতসব বিচিত্র ক্ষেত্রে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অভিনিবেশ ও তীর্যক অভিক্ষেপকে একসূত্রে সংগ্রথিত করার জন্য অন্তর্বয়ন হিসেবে ক্রিয়াশীল যে চারিত্র্য তা-হল সমাজ ও মানুষের প্রতি তার দায়বদ্ধতার অবিচল সংকল্প। তাই কথাসাহিত্য-চলচ্চিত্র-গণসংগীত যে কোন শাখায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সমান অনুসন্ধিত্সা এবং স্বভাবজাত বিদ্রূপ প্রবণতায় উন্মোচন করেন উপনিবেশোত্তর আর্থ-রাজনীতিক সূচক-বিদ্ধ ব্যক্তিমানস ও সমাজ-পরিমণ্ডলের ক্লীবত্ব, বিষমতা ও টানাপোড়েনের নিহিতার্থ।

সমাজে প্রচলিত ও প্রচারিত অপসংস্কৃতির স্বরূপ, বুদ্ধিজীবী-রাজনৈতিককর্মী-শিক্ষিতজনগোষ্ঠির আত্মসর্বস্ব উদাসীনতা এবং নিম্নমধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর সাথে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বা প্রগতিশীলতার ধ্বজাধারী রাজনৈতিক আদর্শের ক্রমবর্ধিত দূরত্বের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ইলিয়াস 'চাঁচাছোলা ভাষায়'৩ আঘাত হানেন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ওপর। বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার উপজাত মধ্যবিত্ত তার শ্রেণীঅবস্থান সম্পর্কে সচেতন নয় বলেই শ্রেণীবিভক্ত সমাজের অপরাপর বিভাগ-উপবিভাগের সাথে তার সহাবস্থান অকৃত্রিম হয় না। মধ্যবিত্তের, বিশেষত আমাদের দেশের সমস্যাসঙ্কুল সমাজজারিত মধ্যবিত্তের, সামগ্রিক প্রবণতা ইলিয়াসের গভীর পর্যবেক্ষণে নির্মমভাবে উন্মোচিত হয়Ñ
“আমাদের মধ্যবিত্তের জীবনযাপন কিংবা ঈপ্সিত জীবন যাপন এবং মূল্যবোধ পরস্পরবিরোধী। এদের জীবন তাই নিরালম্ব, এই জীবনের ভিত্তি, বিন্যাস ও তাৎপর্য খুঁজে বের করা খুব কঠিন। এদের সংস্কৃতিও যে নিরালম্ব ও উটকো ধরণের হবে এতে আর সন্দেহ কি? সামন্ত ও গ্রাম্য মূল্যবোধের সঙ্গে বুর্জোয়া জীবন যাপনের এই উৎকট মাখামাখির ফলে যে-সংস্কৃতি গজিয়ে ওঠে তাও অনেকের চোখে উটকো ঠেকে এবং তখন তাকে অপসংস্কৃতি বলে গাল দেয়া হয়।”৪
ইলিয়াসের কাছে অপসংস্কৃতির সংজ্ঞা ভিন্ন বলেই ‘মধ্যবিত্তের রুচিশীলতা’, ‘ভদ্রলোক’, ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ ইত্যাকার বহুব্যবহৃত শব্দসমষ্টির অন্তঃসারশূন্যতা অকপটে তুলে ধরেন। মধ্যবিত্তই শিল্প ও সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় ধারক ও পৃষ্ঠপোষক৫ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েও মধ্যবিত্তের জীবনযাপনের নানা অসঙ্গতি ও কপটাচারকে তীব্র ভাষায় আক্রমন করেন ইলিয়াস। তাঁর মতে শিক্ষিত জনগোষ্ঠির এই উদাসীনতাই নিম্নবিত্তের সংস্কৃতির সাথে প্রচলিত সাহিত্য সংস্কৃতির দূরত্ব সৃষ্টির কারণ।

বাজার-অর্থনীতি প্রসারের ফলে শিল্পের বাণিজ্যিকীকরণ ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে শিল্পীর স্বাধীনতা, সৃষ্টিশীলতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার উপর। তাই দেখা দিচ্ছে অবিমৃষ্যঅনুকার। পুনরাবৃত্তি ও শৈল্পিক অবনমনের উদাহরণ আমাদের সাহিত্যে বেড়েই চলেছে। উপন্যাসকে কেন্দ্র করে লিখলেও ইলিয়াসের এ মন্তব্য মধ্যবিত্তের রুচিবিকৃতির সমস্বর-সহযোগী গল্প-কবিতা-সঙ্গীত-চলচিত্র সবক্ষেত্রে প্রযোজ্যÑ
“এগুলোর বিষয়বস্তু প্রায় একই ধরণেরÑছিচকাদুনে প্রেম ও ধরি-মাছ-না-ছুঁই-পানি মার্কা সেক্সের সঙ্গে উদ্ভট ও অভিনব বিপ্লবী প্রসঙ্গ চটকাবার ফলে এগুলো বেশ আঠালো হয় এবং পাঠক একনাগাড়ে কয়েক ঘণ্টা এর সঙ্গে সেঁটে থাকেন। পাঠকদের সেঁটে রাখার কায়দা লেখকদের বেশ ভালই রপ্ত হয়েছে, এজন্য এদের জাদুগিরি বলে হাততালী দেওয়া যায়, কিন্তু শিল্প বলে মেনে নেওয়া মুশকিল।”৬
শিল্পোত্তীর্ণ সাহিত্যকে হতে হবে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ। তাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-কান্না, ভালো-মন্দের সাথে সাংঘর্ষিক নয় এমন অনুভুতিপুঞ্জের দ্বারাই কেবল সেই প্রতিশ্র“তিপুরণ সম্ভব। এক্ষেত্রে ইলিয়াসের স্পষ্ট উচ্চারণÑ
“সংগরিষ্ঠের রক্তধারাকে ধারণ না-করে কোন দেশের সংগঠিত সংস্কৃতিচর্চা কখনো প্রাণবন্ত হতে পারেনা। এই বিচ্ছিন্নতার ফলে আজ আমাদের সংস্কৃতি রুগ্ণদেহ, তার দৃষ্টি ফ্যাকাশে, তার স্বর ন্যাকা এবং নিশ্বাসে প্যানপ্যানানি।”৭
বলাবাহুল্য আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিম্নমধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত, যাদের অধিকাংশই আবার শ্রমজীবী অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের পরিভাষায় ‘প্রলেতারিয়েত’। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অভিরুচির সংস্পর্শে না থাকলে যে কোন শিল্পই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। ‘ড্রয়িংরুমে’ গণ্ডিবদ্ধ সংস্কৃতির বাইরে এসে শ্রমজীবীর জীবন-জীবিকাকে সংস্কৃতির অংশ বিবেচনা করাতেই প্রাণ পায় সংস্কৃতিচর্চা। কারণÑ
“নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর সংস্কৃতি চর্চার উৎস হল তার জীবিকা।”৮
শুধু তাই নয়, তার শ্রমের প্রেরণা ও ছন্দ পরিবেশ-উদ্ভূত না হলে সেই গান ছবি বা কথায় তার বিশেষ আগ্রহ নেই। শ্লীলতা-অশ্লীলতার, সুরুচি-সুনীতির বচন শ্রমজীবীর জন্য অর্থহীন। কারণ এ মানদণ্ড সৃষ্টির উদ্যোক্তা সে নয়Ñ মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত জনগোষ্ঠী; যাদের অধিকাংশই আবার শ্রমজীবীর জীবনাচারের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল নয়। অথচ মানুষকে মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করাই তার সংস্কৃতিকে জানার পূর্ব শর্ত। এ প্রসঙ্গে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস চিরকালের মানবতাবাদী শিল্পীর মত লিখেছেনÑ
“দারিদ্র্য যতই ভয়াবহ ও প্রকট হোক, কেবল তা-ই দিয়ে কাউকে শনাক্ত করা হলে তাঁকে মর্যাদা দেওয়া হল না। যাকে সম্মান করতে পারি না, তার সমস্যাকে অনুভব করতে পারব না। নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী যত গরিব হোন না, তিনি একজন মানুষ।”৯
এই মর্যাদাবোধ ও ভালবাসার মিথষ্ক্রিয়ায় রচিত হয় কালজয়ী সাহিত্য। কিন্তু যখনই শ্রদ্ধাবোধের অভাব ঘটে তখনই তা কেবল মনোরঞ্জনের উপাদান, রুচিবাগীশের সাজসজ্জা, রুচিশীলতার মেকী আবরণ। সংরক্ষণের বাইরে এর ভিন্ন কোন তাৎপর্য নেই। সন্দেহ নেই যে, সংরক্ষণও আবশ্যক কিন্তু তা শিল্পীর দায়িত্ব নয়। কারণÑ
“সংরক্ষণের দিকে মনোযোগ দিলে সংস্কৃতির বিকাশ ও বিবর্তন ঘটে না, তা হয়ে পড়ে প্রাণহীন, নির্জীব স্থিরচিত্রের মত তা হয়ে থাকে জাদুঘরের সামগ্রী।”১০
তাহলে শিল্পীর দায়িত্ব কি? এমন প্রশ্নের জবাবে ইলিয়াস স্পষ্টই বলেন Ñ
“নতুন মাত্রা দিয়ে একে গতিশীল ও প্রাণবন্ত করে তোলাই তাঁর দায়িত্ব”১১।

ইলিয়াসও বিশ্বাস করেন সংস্কৃতি শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাপন ও জীবনধারণের সাথে অবিচ্ছিন্ন হলেও সাহিত্যের নির্মাতা তারা নয়; শিক্ষিত জনগোষ্ঠির হাতেই সাহিত্য সৃষ্টি হয়।১২ লেখক শিল্পীর যথার্থ পরিচর্যায় শ্রমজীবীর সংস্কৃতি প্রাণ পায়, শিল্পে পরিণত হয়। তাই শ্রমজীবীর সাথে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ব্যবধান যত কমবে সাহিত্য-শিল্প ততই প্রাণবন্ত ও সার্থক হয়ে উঠবে। ইলিয়াস যখন বলেন, ‘শ্রমজীবী মানুষ ইতিহাসের নির্মাতা’১৩ তখন তাতে অনুরণিত হয় কার্ল মার্কস-এর প্রবাদপ্রতিম উক্তিÑ‘শ্রমই সকল সংস্কৃতির উৎস’। বস্তুত সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে ইলিয়াসের উপলব্ধি ও বিশ্লেষণ সমাজতান্ত্রিক আদর্শ তথা মার্কসীয় দর্শণ পরিশ্র“ত। তবে কমিউনিজমের উপর ইলিয়াসের আস্থা নিরঙ্কুশ বা প্রশ্নহীন নয়। বামপন্থিকর্মীর জনবিচ্ছিন্নতা, তত্ত্বময়তা ও হতাশার কারণ শনাক্ত করতেও ইলিয়াস সংস্কারমুক্ত। ইলিয়াসের সংস্কৃতি-ভাবনার সাথে লিও টলস্টয়ের শিল্পাদর্শের সাযুজ্য লক্ষ করা যায়। টলস্টয় শিল্পের সার্বজনীনতা ও মানবিকতার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের শক্তিই সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করবে এমন বিবেচনায় টলস্টয় বলেছিলেনÑ
“অধিকাংশ শ্রমিকশ্রেণীর নিকট শুধুমাত্র উচ্চমূল্যের জন্যই আমাদের শিল্প যে দুরধিগম্য তা নয়, প্রকৃতির দিক থেকেও সে শিল্প অদ্ভূত। এই শিল্পের সাহায্যে এমন সমস্ত অনুভূতি সঞ্চার করে দেওয়া হয় Ñযা শ্রমনির্ভর জীবনপরিবেশ থেকে বহু দূরবর্তীÑ যে শ্রমসাধ্য জীবন বৃহত্তর মানব সমাজের পক্ষে খুবই সহজ ও স্বাভাবিক। বিত্তবান সম্প্রদায়ের নিকট যা উপভোগ্য অনুভূত হয়, একজন শ্রমিকের পক্ষে সে আনন্দ অনধিগম্য। সে উপভোগ্য বস্তু তার মনে হয়ত কোন অনুভূতিই সঞ্চার করে না, অথবা একজন অলস ও ভোগতৃপ্ত মানুষের মনে তা যে অনুভুতির সঞ্চার করে, শ্রমিকের মনে ঠিক তার বিপরীতটিই সৃষ্টি করে।”১৪
টলস্টয় মার্কসবাদী ছিলেন না কিন্তু ম্যাক্সিম গোর্কির মত তার সাহিত্যও বলশেভিক বিপ্লবের অনুপ্রেরণা হয়ে শ্রমজীবী মানুষের কাছে পৌঁছেছিল।

যে-কোন মহৎ শিল্পীর সৃষ্টিকর্মই ব্যাপক জনগোষ্ঠির গভীরে প্রোথিত করে শেকড়। সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্বকারী শোষিত জনগণের সংগ্রামী তৎপরতা, উৎসাহী সক্রিয়তা, আশাবাদ এবং অগ্রগামিতার প্রতিফলনও সাহিত্যে প্রত্যার্শিত। সেই জনগোষ্ঠী কোন-না-কোন শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে, শ্রেণিবিভক্ত সমাজব্যবস্থায় এটাই সত্য। মার্কসীয় শিল্পদর্শণে অস্তিত্বই চেতনাকে নির্ধারণ করে। এ অস্তিত্ব অবশ্যই মানুষের সামাজিক অস্তিত্ব। অস্তিত্বের প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে উৎপাদনপ্রণালী। আবার সামাজিক উৎপাদন পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের সামাজিক জীবন, তার রাজনৈতিক তথা বৌদ্ধিক জীবনও। সুতরাং এটি স্পষ্ট যে, কোন যুগে সামাজিক উৎপাদন ও প্রধান বিনিয়োগ পদ্ধতি ঐ সমাজের সৃষ্টিশীল সত্ত্বার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। শিল্প-সাহিত্য ঐ সৃষ্টিশীল সত্ত্বারই অংশ। তাই মার্কসীয় সাহিত্য বিচারে শিল্পী বা সাহিত্যিক যা কিছু সৃষ্টি করবেন তার সার্থকতা ও ব্যর্থতা ঐ নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক বলয়ের মাপকাঠিতেই বিচার্য। আবার উৎপাদন-সম্পর্কের পরিবর্তনের সাথে সাথে উপরিকাঠামোর অংশ হিসেবে শিল্পও পরিবর্তিত হয়। কারণ শিল্প ও বস্তুগত ভিত্তি, শিল্প ও উৎপাদন সম্পর্কের সামূহিকতার মধ্যে একটি সুনির্দিষ্ট যোগাযোগ থাকে। একটি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শিল্পের স্বরূপ কি তার স্মরণীয় ব্যাখ্যা দিয়েছেন লেনিনÑ
“অৎঃ নবষড়হমং ঃড় ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব. ওঃং ৎড়ড়ঃং ংযড়ঁষফ নব ফববঢ়ষু রসঢ়ষধহঃবফ রহ ঃযব াবৎু ঃযরপশ ড়ভ ঃযব ষধনড়ঁৎরহম সধংংবং. ওঃ ংযড়ঁষফ নব ঁহফবৎংঃড়ড়ফ ধহফ ষড়াবফ নু ঃযবংব সধংংবং. ওঃ সঁংঃ ঁহরঃব ধহফ বষবাধষব ঃযবরৎ ভববষরহমং, ঃযড়ঁমযঃং ধহফ রিষষ. ওঃ সঁংঃ ংঃরৎ ঃড় ধপঃরারঃু ধহফ ফবাবষড়ঢ় ঃযব ধৎঃ রহংঃরহপঃং রিঃযরহ ঃযবস.”১৫ [ঠ.ও. খবহরহ, ঙহ খরঃবৎধঃঁৎব ধহফ অৎঃ, গড়ংপড়,ি ১৯৭৫, চ. ২৩০.]
লেনিনের এই বিশ্লেষণও মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের আলোকে প্রণীত। বলাবাহূল্য, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্য ও সংস্কৃতিভাবনার সারসত্য এই বোধের বাইরে নয়। তবে শ্রেণিচিন্তার সাথে প্রযুক্ত উপনিবেশোত্তর সমাজব্যবস্থার জটিলাবর্ত তাকে তাড়িত করেছে এই ভূখন্ডের মানুষের ঐতিহাসিক অবস্থান ও অস্তিত্বকে শনাক্ত করার প্রতি মনোযোগী হতে। তাই গল্প-উপন্যাসে চরিত্র নিয়ে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যপৃত হন ইলিয়াস, প্রবন্ধে তার-ই দার্শণিক ভিত্তি ও কাঠামো নির্মাণের প্রয়াস লক্ষ করা যায়। এক্ষেত্রে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঐতিহ্যিকসূত্রে প্রাপ্ত আদর্শ বিবেচনা করে ইলিয়াসের মূল্যায়নÑ
“সাহিত্যচর্চার শুরুতেই তিনি ব্যক্তির ক্ষয়কে একটি দুরারোগ্য রোগ বলে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। সমাজের অবক্ষয় ও ব্যক্তির অবক্ষয় কোন বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। তবে এর ফলে ব্যক্তি ও সমাজ দ্রুত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।”১৬

ব্যক্তির স্বতন্ত্র সারবত্তা নিয়ে পাশ্চাত্যে যে আধুনিক সাহিত্যের উদ্ভব ঘটেছিল মধুসূদনের কাল থেকে বাংলা সাহিত্যের সকল শাখায় তারই জয়-জয়কার। পাশ্চাত্যের ‘ব্যক্তি’ যতটা স্বাধীনভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিল উপমহাদেশে ততটা নয়। ‘ব্যক্তি’র বিকাশপ্রক্রিয়া সম্পর্কে ইলিয়াসের ব্যাখ্যা তাই বুর্জোয়া সমাজকাঠামোসৃষ্ট সাহিত্যাদর্শের বিপরীত। ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ থেকে ব্যক্তিসর্বস্বতা এই স্তর বিন্যাস উত্তরণের নয় অবক্ষয়ের।১৭ এ অবক্ষয় প্রক্রিয়ার সাথে উপমহাদেশের স্তরবহুল রাজনীতির ধূম্রজাল প্রলেপনে বিশেষত এ ভূখণ্ডের ‘ব্যক্তি’র যে রূপ পাওয়া যায় “সেই লোকটি ঔপনিবেশিক শাসনে বামন, বর্ণপ্রথার চোখ-রাঙানিতে জড়সড়, শ্রেণীশোষণে ক্লিষ্ট এবং আপোসকরা-রাজনীতিতে সন্তুষ্ট ও কাতর।”১৮ ‘ঔপনিবেশিক শক্তির উপহার এক খঞ্জব্যক্তি’১৯ এখানে সমস্ত দুর্বলতা ও বিকলাঙ্গতা নিয়ে উপস্থিত হয়। অস্তিত্বের গভীরে অনুসন্ধানী না হলে এই দুর্বলতাকে চিহ্নিত করে তা-থেকে উত্তরণের উপায়সন্ধান অসম্ভব। এই ‘মহৎ খোঁড়াখুড়ি’র মধ্যদিয়ে ‘অবাঞ্চিত সমাজ কাঠামো’ ভেঙ্গে ব্যক্তিকে তার সমস্ত সম্ভাবনাসহ পুনরুদ্ধারের প্রয়াসই ছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য সাধনা।২০

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাধনার সমস্ত প্রক্রিয়াকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন ইলিয়াস। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণ তত্ত্বের মাধ্যমে ‘ব্যক্তি’র ক্ষয় ও রোগনির্ণয়ের প্রয়াস আংশিক সফলতা পেলেও মানিকের আস্থা ছিল মার্কসবাদে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, এই ক্ষয়ের উৎস সমাজ। তাই নিরাময় হিসেবে গ্রহণ করলেন মার্কসবাদকে। কিন্তু যে সমাজকাঠামো ‘ব্যক্তি’র এ ক্ষয়কে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করতে পারে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে তা ছিল অনুপস্থিত। তাই কল্পনার আশ্রয়ে ‘ব্যক্তি’কে বিনির্মাণের জন্য ব্যস্ত-অন্বেষণ অসম্পূর্ণই থেকে যায়। ইলিয়াস যেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই অসম্পূর্ণতাকে পূর্ণতা দানের দায়িত্ব নিলেন। তাই ‘ঔপনিবেশিক ব্যক্তি’র অবক্ষয়কে বারবার প্রদর্শন না-করে, কিম্ভুতকিমাকার সমাজব্যবস্থার রুগ্নতায় নিমজ্জিত না থেকে তিনি একজন ‘শক্ত-সমর্থ ব্যক্তি’র সন্ধান করেন। তাঁর এই অনুসন্ধান পরিব্যাপ্ত সৃজনশীলতার সর্বক্ষেত্রে। ইলিয়াসের ভাষ্যÑ
“ঔপনিবেশিক শাসন ও শিক্ষার ফলে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে যে মাথা তাকে আবার যথাস্থানে স্থাপনের উপায় বের করার দুরূহ কাজে ব্রতী হতে হয় সৃজনশীল কর্মীকে। শরীর ও মাথার, জনজীবন ও শিল্পের এই সুষম পুনর্বাসনের চেষ্টায় শিল্পী কেবল সূক্ষ্মবিচারী দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজের নেতিবাচক দিক উদ্ঘাটন করেন না; বরং এই নেতিবাচক অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য সম্ভাব্য নতুন ও উন্নত সমাজব্যবস্থার ইঙ্গিত দেন।”২১

ঔপনিবেশিক সমাজ-কাঠামোলালিত মানুষের সমস্ত খর্বতা, নেতি ও দুর্বলতার মধ্য থেকেই একটি সম্ভাবনাময় মানুষের নির্মাণ আবশ্যক। আর শক্ত সমর্থ মানুষের অন্বেষায় নিয়োজিত ইলিয়াস ঠিকই সন্ধান পেয়ে যান উপযুক্ত জনগোষ্ঠিরÑ
“এই শক্তি সবচেয়ে বেশি ধারণ করে নিম্নবিত্তের শ্রমজীবী মানুষ। উপনিবেশের ব্যক্তিবাদের বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে তারা মুক্ত, তারা ব্যক্তিতে পর্যবসিত হয়নি, হাজার দুর্বলতা নিয়েও তারা মানুষই রয়ে গেছে এবং মানুষ মানেই অনেক মানুষ, ঐক্যবদ্ধ মানুষ। সচেতনভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ক্ষমতাও তাদের একটু বেশি।”২২
ইলিয়াস নিজেও তাঁর গল্প-উপন্যাসে ঔপনিবেশিক মানুষের মধ্যে ‘প্রাণ’ খুঁজেছেন, ‘ড়ৎমধহরুবফ’ প্রাণ।২৩ দস্তয়ভস্কির মত সমস্ত নেতিবাচকতার মধ্যেও তিনি ‘মানবতার একটা ঃড়ঃধষরঃু, একটা ঐক্য’২৪, মানুষের অসীম সম্ভাবনার দিগন্ত আবিষ্কার করতে চেয়েছেন।

‘শক্তসমর্থ ব্যক্তি’ গঠনের প্রচেষ্টা বাংলা উপন্যাসের আদিপর্বে যাদের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অনুসন্ধান শুরু হয় তাদের থেকেই। বাংলা কবিতার প্রকরণগত অর্জনে সন্তুষ্ট হলেও কথাসাহিত্যের লক্ষ্যবিহীন চর্চা তাকে ব্যথিত করেছে। বাংলা উপন্যাসের উদ্ভবপর্বে যাঁর অবদানকে প্রবাদতুল্য গণ্য করা হয় সেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উদাসীনতা ও ব্যর্থতাকে তীক্ষè ভাষায় আক্রমন করে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেছেন, সমাজবাস্তবতার নির্যাসপুষ্ট কাক্সিক্ষত অবয়ব নিয়ে বাংলা উপন্যাস যাত্রা শুরু করলেও বঙ্কিম তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিলেন ‘কেচ্ছা’তে২৫। ‘ব্যক্তি’ ও সমাজের বিকাশকে রুদ্ধ করে প্রকারান্তরে বাংলা উপন্যাসের উন্মেষপর্বকে শেকড়বিচ্ছিন্ন করেছেন বঙ্কিমÑ এমন অভিযোগ ইলিয়াসের। এক্ষেত্রে প্রবন্ধ ও কথা সাহিত্যে বঙ্কিমের সমাজসচেতনার স্ববিরোধী অবস্থানকেও চিহ্নিত করেছেন তিনি। অথচ বঙ্কিমের অপচয়িত সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলোতে রবীন্দ্রনাথের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। ইলিয়াসের বিশ্লেষণÑ
“রবীন্দ্রনাথই জীবন ও মানুষ তৈরী করেন যাদের গড়ে-ওঠা আছে, যাদের জীবনে বিকাশ আছে এবং যারা সমস্যায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রেডিমেড সমাধান খুঁজে পায়না।”২৬
কিন্তু তারপরও উপযুক্ত প্রেক্ষিত না-পেয়ে সে-ব্যক্তিও অসম্পূর্ণ থেকে যায়। অর্থাৎ যে সমাজ-কাঠামোয় শক্ত-সমর্থ বুর্জোয়া মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ পাওয়া সম্ভব সেই সমাজ কাঠামো অনুপস্থিত বলেই রাজনৈতিক-মনস্তাত্ত্বিক নানা দ্বন্দ্ব-জটিলতায় আলোড়িত হলেও রবীন্দ্রনাথের ‘ব্যক্তি’ ‘আইডিয়া’র সমষ্টি হয়েই বিচরণ করে। পরবর্তীকালে শরৎচন্দ্র সেই ‘ব্যক্তি’র শেকড়সন্ধানে ব্যাপৃত হলেও সমাজকাঠামোতে ধর্মীয় বিধি-বিধানের আংশিকতায় বৃত্তাবদ্ধ থেকে তদূর্ধ্বে উত্তরণের পথ হারিয়ে ফেলেন তিনিও। ঔপনিবেশিক সমাজবাস্তবতার গভীরে প্রোথিত এ শেকড়ের সন্নিকটবর্তী হয়েছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। মধ্যবিত্তের অবয়বকে সমাজ বিবর্তনের ধারায় চিহ্নিত করে ঔপনিবেশিক সমাজকাঠামোর বহুভঙ্গবাস্তবতায় শ্রেণিচরিত্র নির্মাণের চেষ্টাও তিনি করেছিলেন। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ অবক্ষয়কে অবলোকনের সামর্থ্য তার ছিলো না, যা ছিলো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে। সমাজবাস্তববোধ ও সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাকে সংগ্রথিত করার প্রজ্ঞা ও সৃজনক্ষমতা তাঁর ছিলো। তিনি তার বিষয় ভাবনাকে সার্থক রূপ দিতে উপন্যাসের নতুন প্রকরণ সন্ধানেও মনোযোগী হয়েছিলেন। ইলিয়াস তাই মনে করেনÑ
“মানুষ ও সমাজের মার্কসবাদী বিশ্লেষণের চেষ্টা উপন্যাসে তিনিই প্রথম করেন।”২৭

ভক্তি ও বিশ্বাসকে সংশয়ের দৃষ্টিতে পরীক্ষা করার যে প্রবণতা আধুনিক মানুষের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে তার পরিচয়। তাঁর সাহিত্যাদর্শে সংস্কৃতি-ব্যক্তি-ব্যক্তিত্ব-মানুষ যে পরম্পরায় অগ্রসর হয় তাতে কেবল কথাসাহিত্য নয়, নৃত্য-চলচিত্র-সঙ্গীত তথা শিল্প-সাহিত্যের সব শাখায় তার প্রভাব পড়ে। তাই ‘গান্ধী’ চলচিত্রে পরিচালক রবার্ট এ্যাটেনবরো-র ব্যর্থতা এবং ‘সূর্যদীঘল বাড়ি’ চলচিত্রে পরিচালক শেখ নিয়ামত আলী-মসিহউদ্দিন শাকের-এর সাফল্যের মূলানুসন্ধান করতে গিয়েও সেই ব্যক্তি ও সমাজ বাস্তবতাবোধের সূত্র অপরিবর্তিত থেকে যায়। এমনকি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সীমাহীন ব্যর্থতা ও বিশৃঙ্খলার পিছনেও ইলিয়াস একইভাবে ‘অযোগ্য ও আত্মসম্মাবোধশূন্য ব্যক্তি’ এবং ‘মেরুদণ্ডহীন’ ও ‘প্রতিক্রিয়াশীলদের পদলেহনে তৃপ্ত’ শিক্ষাবিদদের অগ্রাধিকার দেয়াকে প্রধান কারণ বলে চিহ্নিত করেন।২৫
আবার রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানে ভাববাদী আচ্ছন্নতার উত্তুঙ্গ সমাবেশ এবং ভক্তি-সিঞ্চিত প্রাবল্য থাকলেও তাঁর গানে ‘ব্যক্তির একান্ত অনুভব সবচেয়ে বেশি সাড়া পায়’২৫ বলে ইলিয়াস মনে করেন। এ প্রেক্ষিতেই তাঁর অভিমতÑ
“রবীন্দ্রনাথের গান মানুষকে বিপ্লবের দিকে উদ্বুদ্ধ করবে না। কিন্তু শক্তসমর্থ ব্যক্তি গঠনে রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষমতা অসাধারণ।”২৬
এই ক্ষমতার উৎসও চিহ্নিত করে দিয়েছেন ইলিয়াসÑ
“যেখানে ব্যক্তিবাদ সবচেয়ে প্রবলভাবে দেখা দিয়েছেÑ এটা রবীন্দ্রনাথের গানে যেরকম আছে আর বাংলা কোনো গানে সেরকমভাবে আসে নি। ... ...। এবং এজন্য আমাদের সমাজে যতই বুর্জোয়া বিকাশ ঘটছে যেভাবেই হোক, পঙ্গুভাবে হোক, খোঁড়াভাবে হোক, লুট করে হোক, চুরি করে হোক, সেটা ঘটার সাথে রবীন্দ্রসঙ্গীতের জনপ্রিয়তা যে বাড়বে তাতে কোন সন্দেহ নেই।”২৭
কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতের এই ক্ষমতা তাহলে বুর্জোয়া মধ্যবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ; বুর্জোয়া মানসিকতার বিস্তৃতির মধ্যেই এর প্রসার ও সাফল্য; ব্যক্তিকে স্পর্শ ও পুলকিত করার মধ্যেই এর সার্থকতা। মধ্যবিত্তের রুচি ও আবেগের সংকট থেকে মুক্তির জন্য হলেও রবীন্দ্রসঙ্গীতকে সমস্ত সীমাবদ্ধতার পরও গ্রহণযোগ্যতার ছাড়পত্র দিয়েছেন ইলিয়াস। কিন্তু গনসঙ্গীতের সাথে তুল্যমূল্য বিচারে দ্বিতীয়টিকেই উপযোগী মনে করেন তিনি, কারণ Ñ
“গণসঙ্গীতের বাণী ও সুর মানুষের ব্যক্তিগত আবেগকে ছাপিয়ে ওঠে। ব্যক্তিগত আবেগকে অতিক্রম করে বা পাশ কাটিয়ে তা হৃদয়কে এমনভাবে স্পর্শ করে যে শ্রোতা একজন সামাজিক প্রাণী হিসেবে আর দশজনের সঙ্গে একাত্বতা অনুভব করেন। ... ... গণসঙ্গীত মানুষকে বিষাদে আচ্ছন্ন করে না বা সুখে বিভোর করে তোলে না। বরং জেগে উঠে আরো মানুষের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উৎসাহ দেয়।”২৮

একই ধারাবাহিকতায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র নামও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন ইলিয়াস। সমাজে ও সাহিত্যে ব্যক্তির বিকাশের লক্ষ্যে অপরিহার্য এই উপাদান সম্পর্কে দার্শনিক প্রজ্ঞা ইলিয়াসের মন্তব্যÑ
“সংশয়ের ভিত্তিতে দাড়িয়ে মানুষের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত দেখতে না-পারলে মানবাত্মার এই মহৎ ঐকতান উপলব্ধি করা শিশুর ইচ্ছাবিলাস হয়ে থাকে। এই ভিত্তি থেকে বিচ্যুত হওয়া মানেই মানুষের সামগ্রিক রূপ দেখা থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া।”৩২
বুর্জোয়া সমাজ ও শিল্প সাহিত্যের অবদানকে অস্বীকার না করলেও৩৩ সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা ও তৎজাত সামাজিক মানুষই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অন্বিষ্ট। তার ঐতিহ্য পরিমণ্ডলে এমন অনুপ্রেরণার বীজ সন্ধান করতেই তিনি প্রবন্ধের যুক্তি ও বিশ্লেষনের আশ্রয় নিয়েছেন।

ব্যক্তিত্ববান মানুষই দায়িত্বশীল। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সমাজে দায়িত্বশীল মানুষ দেখতে চেয়েছিলেন। তাই সমাজে ‘ব্যক্তি’কে প্রতিষ্ঠার আমৃত্যু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি প্রকারান্তরে একটি কল্যাণমুখী, শোষণমুক্ত, জনগণচিত্তবিহারী ও ঐক্যবদ্ধ সমাজের প্রত্যাশামগ্ন ছিলেন বললে অত্যুক্তি হয়না। একজন ‘দায়বদ্ধ স্রষ্টা যখন গদ্যে তার দায় সম্পন্ন করেন তখন তার বক্তব্য বিষয় ও ভাষা ঋজু, স্পষ্ট ও অপার জীবনময়তার প্রতিরূপ হয়’।৩৪ আর ইলিয়াসের ক্ষেত্রে এমন দায়িত্ববোধের সাথে কৌতুক ও ক্রোধের রসায়ন যুক্ত হয়ে পাঠককে বারবার সমাজসত্য ও সমাজসত্তার দ্বান্দ্বিক অবস্থানে বিমুঢ় করে রাখে। নিজের সমগ্র সৃষ্টিকর্মের অন্তরাত্মায় যে স্পন্দনের উপলব্ধি তিনি করতে চেয়েছেন তার দু®প্রাপ্যতাও তাঁর অজানা ছিলো না Ñ
“নায়ক হওয়ার যোগ্যতা এখন কেবল থাকতে পারে কোনো জনগোষ্ঠীর। জনগোষ্ঠীকে আমূল স্পর্শ করার জন্য হাতড়ে বেড়াচ্ছি, আঙুল ব্যথা হয়ে গেল, এখন পর্যন্ত ধরতে পারি নি।”৩৫
এই সরল স্বীকারোক্তির মধ্যেই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সহিত্যচিন্তার সারসত্য নিহিত।

তথ্যনির্দেশ ও টীকা ঃ
১। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সংস্কৃতির ভাঙা সেতু, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ফেব্র“য়ারি ১৯৯৮,
২। আনু মুহাম্মদ (সম্পাদিত), অগ্রন্থিত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ঐতিহ্য, ঢাকা, ফেব্র“য়ারি ২০০৩,
৩। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচনা সমগ্র-১, ভূমিকা, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ফেব্র“য়ারি ১৯৯৯,
৪। খলিকুজ্জামান ইলিয়াস, সংস্কৃতির ভাঙা সেতু, ভূমিকা, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ফেব্র“য়ারি ১৯৯৮,
৫। সমীরণ মজুমদার (সম্পাদিত), আখতারুজ্জামান ইলিয়াস স্মারক গ্রন্থ, অমৃতলোক সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা, আগস্ট ১৯৯৭
৬। লিও টলস্টয়, শিল্পের স্বরূপ, দিজেন্দ্রলাল নাথ (অনুদিত), পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, জুলাই ১৯৮৮
৭। ঠ. এ. অভধহধংুবা, গধৎীরংঃ চযরষড়ংড়ঢ়যু, চৎড়মৎবংং ঢ়ঁনষরংযবৎ, গড়ংপড়ি ১৯৮০
৮। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ‘বুলবুল চৌধুরী’, সংস্কৃতির ভাঙা সেতু, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ফেব্র“য়ারি ১৯৯৮,
৯। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ‘গণসঙ্গীত’, সংস্কৃতির ভাঙা সেতু, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ফেব্র“য়ারি ১৯৯৮,
১০। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের শক্তি’, সংস্কৃতির ভাঙা সেতু, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ফেব্র“য়ারি ১৯৯৮,
১১। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ‘উপন্যাস ও সমাজ বাস্তবতা’, সংস্কৃতির ভাঙা সেতু, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ফেব্র“য়ারি ১৯৯৮,
১২। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ‘সংশয়ের পক্ষে’, সংস্কৃতির ভাঙা সেতু, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ফেব্র“য়ারি ১৯৯৮,
১৩। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ‘লেখকের দায়’, সংস্কৃতির ভাঙা সেতু, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ফেব্র“য়ারি ১৯৯৮,
১৪। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাগী চোখের স্বপ্ন’, সংস্কৃতির ভাঙা সেতু, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ফেব্র“য়ারি ১৯৯৮,
১৫। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ‘সৃজনশীলতায় মুক্তির অঙ্গীকার’, অগ্রন্থিত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ঐহিহ্য, ঢাকা, ফেব্র“য়ারি ২০০৩,
১৬। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ‘রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে’, সংস্কৃতির ভাঙা সেতু, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ফেব্র“য়ারি ১৯৯৮,
১৭। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ‘আমার প্রথম বই’, সংস্কৃতির ভাঙা সেতু, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ফেব্র“য়ারি ১৯৯৮,
(পূণাঙ্গ উদ্ধৃতি- ইলিয়াস একজন দায়বদ্ধ স্রষ্টা এবং এই দায় যখন তিনি গদ্যে সম্পন্ন করেন তখন তাঁর বক্তব্য বিষয় ও ভাষা ঋজু, টানটান, স্পষ্ট, বিশ্বস্ত ও অপার জীবনময়তা থেকে উঠে আসা হতে বাধ্য। শোয়েব শাহরিয়ার, ইলিয়াস ও খন্ডিত চেতনার নান্দীপাঠ, ‘ভাঙা সংস্কৃতির বন্ধনসেতুঃ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস’, নিসর্গ, বগুড়া, ২০০৪, পৃ. ১২৩।)
(একথা মানতেই হবে যে, সামন্তব্যবস্থার কবরের ওপর গড়ে-ওঠা বুর্জোয়া ব্যবস্থা সভ্যতার ইতিহাসে বড় রকমের অবদান রেখেছে। নতুন প্রকরণ ও নতুন ভাবনার সৃষ্টি বুর্জোয়া শিল্প সাহিত্যকে অস্বীকার করা মানে মানুষকে বড় অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। উপন্যাস ও সমাজবাস্তবতা, পৃ. ৪৮)
(বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাস প্রসঙ্গে ইলিয়াসের মন্তব্যÑ উপন্যাসটি পড়ে মনে হয় বঙ্কিমচন্দ্র শুধু কেচ্ছার প্রতিই আকৃষ্ট হয়েছিলেন, কাহিনীকে চলমান সমাজ জীবনের দলিলে পরিণত করার আকাক্সক্ষা তার হয়নি। উপন্যাস ও সমাজ বাস্তবতা, পৃ. ৪০)
(পূর্ণ উদ্ধৃতি Ñ প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে জড়িত এবং দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকদের কখনোই গণনার মধ্যে ধরা হয় না, প্রবীণ শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষা প্রশাসকদের সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে চলা হয়, আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ দাতাদের প্রভুত্ব সহ্য করবেন না বলেই এই ব্যবস্থা। রাষ্ট্রীয় কাঠামোই এমনভাবে তৈরী হচ্ছে যে, যে কোন গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগের সময় অযোগ্য ও আত্মমর্যাদাবোধশূন্য ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। যাতে প্রভুদের যে-কোনো স্বেচ্ছাচারিতাকে প্রশ্ন করার প্রবণতা না থাকে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ‘সমাজের হাতে রাষ্ট্রের খাতে প্রাথমিক শিক্ষা’, সংস্কৃতির ভাঙা সেতু, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ১৯৯৭, পৃ. ১৭৬)


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।