বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক : অতীত ও বর্তমান

মাহবুবুল হক এর ছবি
লিখেছেন মাহবুবুল হক (তারিখ: শনি, ১৫/১০/২০১৬ - ৮:০৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

২০০৫ সালের এপ্রিলে চীনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও বাংলাদেশ সফর করেছিলেন, বিএনপি তখন ক্ষমতায়। চুক্তি হয়েছিল ৫টি, সমঝোতা স্মারক ২টি, বাকিগুলি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে। ফলাও করে ওই সফরের সার্থকতার কথা প্রচার হলেও শেষপর্যন্ত ফলাফল আশাব্যঞ্জক ছিল না । ২০০২, ২০০৮ সালে বাংলাদেশের তরফ থেকেও সফর হয়েছিল। প্রতিবারই বিপুল বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর উপায় নিয়ে বাংলাদেশ চীনকে অনুরোধ করেছে, সমাধান হয়নি কিছুই। এমনকি ২০০৮ সালে চীন সরকার এমন প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল যে সরকারি সাহায্য দিয়ে হলেও ব্যাবসায়ীদের আগ্রহ সৃষ্টি করা হবে। তবে সেসব কথা কথাই থেকে গেছে। চীন বারবারই বাংলাদেশে পারমাণবিক শক্তি উৎপাদনে সহযোগিতা দিতে চেয়েছে। বাংলাদেশও বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য বাংলাদেশ সরে গেছে রাশিয়ার পারমাণবিক প্রযুক্তির দিকে। স্পষ্টতই সামরিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কৌশলগত কারণে চীন বা রাশিয়ার একক বলয়ে ঢুকতে চায় না। এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। ৭৫-এর ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবকে সপরিবার হত্যার পরপরই ৩১ আগস্ট চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় যা বাংলাদেশ চীন সম্পর্ক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল অনেককাল । চীন-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে, সামরিক শাসক জিয়ার মাধ্যমেই তা স্থাপিত হয় একথা সত্য। তবে অর্ধসত্য। কারণ বাংলাদেশ চীন সম্পর্কের তিক্ততা মুক্তিযুদ্ধের সময় যতটুকু হয়েছিল, তা দূর করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ এর প্রথম দিকে চীনের সাথে বাংলাদেশের চারটি বাণিজ্য চুক্তি হয়েছিল অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে, তৎকালীন বার্মার রেঙ্গুনে বসে। কে এম কায়সার ছিলেন তখনকার পররাষ্ট্র সচিব, ইনাম আহমেদ তাঁর এক লেখায় একথা জানিয়েছেন। সেটি আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক না হলেও এর তাৎপর্য অনেক কারণ বঙ্গবন্ধু এজন্য চিলির সালভাদর আলেন্দের কাছেও অনুরোধ করেছিলেন। ১৯৭৫ এর আগস্ট ট্রাডেজির আগেই চীন পরোক্ষে বাংলাদেশের প্রতি নমনীয় হয়ে উঠেছিল, শুধু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মেরুকরণের কারণে সরাসরি ঘোষণা দেয়া থেকে বিরত ছিল। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান চুক্তির পরই চীন বাংলাদেশের ব্যাপারে সরাসরি বিরোধিতা থেকে সরে আসে। তবে বৈশ্বিক রাজনীতি ও সম্পর্কের ওঠানামার মধ্যে এসব এখন অতীত। যেমন অতীত পাকিস্তান-রাশিয়া ভারত-চীন বৈরিতা।

আগেই লিখেছি, বিগত সফরগুলিতে যেসব চুক্তি আর সমঝোতা স্মারক হয়েছিল সেগুলির অধিকাংশই পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি, চীনা ব্যাবসায়ীরাও সমঝোতা স্মারক, যেটাকে বাংলাদেশ নাম দিয়েছিল ‘আমব্রেলা এগ্রিমেন্ট’, অনুযায়ী আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলো বিনিয়োগে, বাংলাদেশেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও সংঘাত এমন মাত্রায় পৌঁছেছিল যে এসব কথা ভাবারও সময় ছিল না কারো। তারপরও সবমিলিয়ে অসম্পূর্ণ বা পরিত্যাক্ত চুক্তির তালিকাটি দীর্ঘ, ১৭৭টি । ২০০৫ সালের সেসব এগ্রিমেন্ট, এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছিল তন্মধ্যে প্রত্যেক জেলা শহর ও সিটি কর্পোরেশনে ডিজিটাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ স্থাপন, পারমাণবিক ‍শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যাবহারে সহযোগিতা, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও জনপ্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধিতে অর্থ সাহায্য একটি ডাই-ফসফেট সারকারখানা স্থাপন ইত্যাদি বিষয় ছিল। সমুদ্র নিরাপত্তা ও এশিয়ান হাইওয়ের আলোচনাসহ নানা উদ্যোগও তখন নেয়া হয়েছিল দুতরফেই। তখনও বাংলাদেশ ও চীনের পক্ষ থেকে সেই সফরকে ঐতিহাসিক তো বটেই, যুগান্তকারী আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। এমনকি ২০০৫ সালকে “বাংলাদেশ-চীন বন্ধুত্বের বৎসর” ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। মজার বিষয় হল, এক দশক পর আমরা আবার ঠিক অনুরূপ ঘোষণা পেলাম। আসন্ন ২০১৭ সালকে ‘বাংলাদেশ-চীন বন্ধুত্বের বৎসর’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হল । এবারের বন্ধুত্বটিও যদি প্রতিবেশি একটি দেশকে দেখানো আর শেখানোর ব্যাপার হয় তাহলে বাংলাদেশের কপালে শিকা ছিঁড়তে আরো অপেক্ষা করতে হতে পারে। আরও একটি বিষয়, সেই সময়ও ‘এক চীন’ নীতির প্রতি বাংলাদেশের অবিচল সমর্থনের ঘোষণা ছিল, ভুয়সী প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা ছিল চীনের পক্ষ থেকে। এক যুগ পর অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অনেক ওলট পালটের পরও বাংলাদেশ তার চীন-নীতি থেকে একটুও সরে আসেনি - বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিপক্বতার উদাহরণ হিসেবে বিষয়টি ব্যতিক্রমী ও গুরত্বপূর্ণ । তবে চীনের সামরিক ও কৃষি সহযোগিতা কিংবা সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের সাথে ছিল সবসময় । ২০০৮ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাহাজ-বিধ্বংসি মিসাইল স্টেশন স্থাপন এবং উৎক্ষেপনের সফল পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছিল চীনের সহযোগিতায়। বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নেও চীন গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তবে সব প্রত্যাশা ছাড়িয়ে এবারের সফর অনেকদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, এতে সহযোগিতা বাণিজ্য ছাড়িয়ে বহুমাত্রিক রূপ পেয়েছে। শিক্ষা, ভাষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিস্তৃতিই প্রমাণ করে চীন সরকার দীর্ঘ মেয়াদে কী ধরণের সম্পর্ক রাখতে চায় বাংলাদেশের সাথে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সমুদ্র-নিরাপত্তা ও অর্থনীতির দিকে চীনের আগ্রহ ও বাংলাদেশের সতর্ক সম্মতি। এসব বিষয় নিয়ে চূড়ান্ত কথা বলায় সময় এখনও আসেনি, কারণ দক্ষিণ এশিয়ার পারস্পরিক সম্পর্কের পারদ বড়ই অস্থির। তদুপরি যুক্তরাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ এর বলয় থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে নবগঠিত ‘ব্রিকস’ নিয়ে ইঙ্গ-মার্কিন অস্বস্তিও এই সম্পর্কের অন্যতম নিয়ামক হতে পারে। সবই বলবে সময়।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

কেউ কি আমাকে বলতে পারেন শি জিনপিং-এর এই সফর থেকে বাংলাদেশ কী পেলো বা কী পেতে যাচ্ছে? বাংলাদেশী কোম্পানীর সাথে চীনা কোম্পানী/সরকারের বাণিজ্য চুক্তিগুলো এই পাওয়ার হিসেবে আসতে পারে না। কারণ, ওগুলো বিশুদ্ধ ব্যবসায়িক ডিল যেগুলো প্রতিনিয়ত এই দুই দেশের ব্যক্তি/কোম্পানীগুলোর মধ্যে হচ্ছে। বিভিন্ন খাতে প্রতিশ্রুত ঋণও এই হিসাবে আসতে পারে না। কারণ, সুদের হার, ঋণের শর্ত, ঋণের বদলে সুবিধা প্রদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে চীন খুব ভালো 'মহাজন' নয়। আর বাংলাদেশ চীনের কাছে ঋণের জন্য ধর্ণা দিয়েছে বলেও আগে শুনিনি। তাছাড়া প্রতিশ্রুত ঋণ প্রায় সময়েই দেখা যায় আর কপালে জোটে না। আমরা কি চীনের কাছ থেকে কোন অর্থ সাহায্য, বিনামূল্যে যন্ত্রপাতি/কারিগরী সাহায্য ইত্যাদি পেতে যাচ্ছি? অথবা চীন স্রকারীভাবে বাংলাদেশে কোন শিল্পোদ্যোগ বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে - এমন কিছু আমি শুনতে পাইনি। আপনাদের জানা থাকলে দয়া করে জানাবেন।

কেনাবেচার ক্ষেত্রে ক্রেতা সবসময়ে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকার কথা। অন্তত দরাদরি করার ক্ষেত্রে। যে দেশটা থেকে সবচে' বেশি কেনা হয় তার সাথে কেনাবেচার ডিলে আমরা কী দরাদরি করতে পারলাম? না কি পদধূলি পেয়েই আমরা বর্তে গেলাম?

আমরা একটা বিষয়ে কথা বলতে শরম পাই। সেটা হচ্ছে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা, ধর্ষণ, হামলা, লুটতরাজ, ধ্বংসসাধন ইত্যাদির জন্য একমাত্র দায়ী রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ১৯৭১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত চীন একচেটিয়া সমর্থন করে গেছে। নিরাপত্তা পরিষদে চীন পূর্ণ সদস্য পদ পাবার পর প্রথম যে ভেটোটা দিয়েছিল সেটা বাংলাদেশের বিপক্ষে। খোদ পাকিস্তান ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু খুন হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। পাকিস্তান বাংলাদেশে কী কী গণবিরোধী, মানবতাবিরোধী কাজ করেছে চীন তার সবই জানতো। কিন্তু চীন কখনো এসবের দায়ে পাকিস্তানকে দোষারোপ করেনি বা বাংলাদেশকে সহানুভূতি জানায়নি।

বলতে পারেন ১৯৭১-১৯৭৫-এর চীন আর আজকের চীন এক নয়। সে কথা সত্য। কিন্তু অতীতের ভুলের জন্য ১৯৭১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত চীন কি একবারের জন্যও দুঃখিত হয়েছে? কেউ কি দেখাতে পারবেন? এটাও কি কেউ দেখাতে পারবেন চীনের এমন অবস্থান নেবার ব্যাপারে চীন সরকার কোথাও কি আনুষ্ঠানিকভাবে অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে? কেউ কি দেখাতে পারবেন?

মাহবুবুল হক এর ছবি

ধন্যবাদ ৷ তবে ১৯৭৩ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল কি!! তারিখটি তো ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ জানতাম

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি একটু ভুল বলেছিলাম। পাকিস্তান বাংলাদেশকে ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৪-এ স্বীকৃতি দেয়। পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার পরেই বঙ্গবন্ধু ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে লাহোরে যান। বঙ্গবন্ধু এই সম্মেলনে যোগ দেবার পূর্বশর্ত হিসেবে পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছিলেন। তার পরেও চীন আর মধ্যপ্রাচ্য স্বীকৃতি দেয়নি। তারা সবাই বঙ্গবন্ধু খুন হবার পরে স্বীকৃতি দিয়েছে।

মাহবুবুল হক এর ছবি

ঠিক, ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪। তবে ১৬ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখটি খুব বেশি প্রচারিত, যদিও ভুল। ধন্যবাদ।

--------------------------------------------------------
দেয়ালে দেয়ালে মনের খেয়ালে/ লিখি কথা ।
আমি যে বেকার, পেয়েছি লেখার/ স্বাধীনতা ।।

অতিথি লেখক এর ছবি

এই সাইটটা দেখুন। এখানে তারিখ অনুযায়ী স্বীকৃতিদাতা দেশের তালিকা আছেঃ
https://en.wikipedia.org/wiki/International_recognition_of_Bangladesh

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

তাহলে আপনি আশা করেন যে কোন একটি রাষ্ট্র একেবারে সুদমুক্তভাবে যদি বিশ তিরিশ বিলিয়ন ডলার দিয়ে যায়, তখনই শুধু বলা যায় যে কিছু একটা পাওয়া গেল। কিংবা আপনি আশা করেছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট সম্পূর্ণ অনুদান হিসেবে ঐ পরিমান অর্থ দানের একটা ঘোষণা দিয়ে যাবেন, এবং তাহলেই আমরা বলতে পারতাম যে কিছু একটা পাওয়া গেল! ভাইরে, ভাগ্য ভাল যে রাষ্ট্রের কর্তা ব্যাক্তিরা আপনের মত ভাবেন না, না হলে ইহ জনমে আর .............।
আপনাকে যদি আপনার বিশেষ কোন নিকট আত্মীয় আহ্লাদীত হয়ে দু চার কোটি টাকা দানছত্র করে দেন, সেটা হতে পারে অতীব সুখের বিষয়। কিন্তু যে অভাগার সেইরুপ উপকারী আত্মীয় স্বজন নাই, তাদের জন্য ব্যাংকের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া তো আর কোন উপায় নাই। সুবিধাজনক ভাবে উপযুক্ত পরিমানে ব্যাংক ঋণ না পেলে আধুনিক অর্থ ব্যাবস্থায় আপনার পক্ষে কোন কিছু করা কি আদৌ সম্ভব? এই বিপুল পরিমান টাকায় যে বিপুল কর্মযজ্ঞ হবে, টাকা না হলে আমরা কি ভাবে সেটা করতে পারতাম? এর চেয়ে সুবিধাজনক আর কোন উপায় আপনার জানা ছিল নাকি? কি সেটা?

আর যুদ্ধকালীন ভূমিকার জন্য চীন যদি ক্ষমা প্রার্থনা কিংবা দুঃখ প্রকাশ করতো, তাহ্ললে খুবই ভাল হত। কিন্তু চীন তো সরাসরি আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারন করে নি, এমতাবস্থায় তারা যদি তাদের অবস্থান থেকে সরে আসতে পারে, তাহলে আমরা কি তাদের সে ভূমিকা ছোট করে দেখতে পারি না?

অতিথি লেখক এর ছবি

চীন কেন পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল , তা জানতে হলে স্নায়ুযুদ্ধের ইতিহাস জানা জরুরি। চীন আর রাশিয়া সমাজতান্ত্রিক দেশ হলেও তাদের সীমান্ত নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। কেবল আদর্শগত অংশে মিল থাকলেই যে মৈত্রী গড়ে তোলা সম্ভব না, তার একটা গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ ছিল চীন-রাশিয়া দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বকে কাজে লাগাতে চায় মার্কিনিরা। তারা এশিয়ায় রাশিয়ার আধিপত্য কমানোর জন্য চীনের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে। আর তাই জাতিসংঘে এতদিন চীনের মূল ভূখণ্ডের দাবিদার তাইওয়ানকে ১৯৭১ এর আগ পর্যন্ত মার্কিনরা সমর্থন দিয়ে গেলেও তারা পরে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে আর এক-চীন নীতি গ্রহণ করে এবং তাইওয়ানকে জাতিসংঘ থেকে বাতিল করে সেখানে চীনকে আসন দেয়। মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়া বাংলাদেশের পক্ষে থাকায় চীন তাদের বিরোধিতা করার জন্য পাকিস্তানের সমর্থন দেয়। এতে একদিকে যেমন মার্কিনদের সাথে তাদের সখ্যতা বাড়ে , আরেকদিকে রাশিয়াকে দুর্বল প্রতিপন্ন করার একটা ভালো সুযোগও তারা পেয়ে যায়।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যুদ্ধে পক্ষ নেওয়ার কারণে কেউ কখনো স্বেচ্ছায় দুঃখ প্রকাশ করেনা, এটা আশা করাও বোকামি। আমরা যদি চীনের থেকে শক্তিশালী রাষ্ট্র হতাম, তাহলে চাপ দিয়ে হলেও এই দুঃখ প্রকাশটা আদায় করে নেওয়া যেত। কিন্তু বর্তমান ভূ-রাজনীতিতে এটা আশা করার কোন কারণ আমি দেখি না।

--- বোকা তেলাপোকা

মনসুর এর ছবি

মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়া বাংলাদেশের পক্ষে থাকায় চীন তাদের বিরোধিতা করার জন্য পাকিস্তানের সমর্থন দেয়।

আপনি সম্ভবত ভুল জানেন।

ফকির সৈয়দ আইজাযুদ্দিনের "The White House and Pakistan: Secret Declassified Documents, 1969-1974 (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস) এর ১২৯ পৃষ্ঠায় ১৯৭১ এর এপ্রিলে আইয়ুব খানকে লেখা চীনের প্রধান মন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের একটি চিঠি (এ চিঠি পাকিস্তানি গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছিল) তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে চৌ এন লাই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের "নাক গলানোর" নিন্দা জানিয়ে আশ্বাস দিয়ে লিখেছিলেন, "ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালালে চীনের সরকার ও জনগণ বরাবরের মতোই পাকিস্তানের সরকার ও জনগণকে তাদের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে সহায়তা করবে।"

আর বাংলাদেশ প্রসঙ্গকে সামনে রেখে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে চুক্তির আলাপ শুরু হয় ১৯৭১ এর জুনে, চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় আগস্টে।

এর আগে ১৯৬৩ সালে চীন আর পাকিস্তান সীমান্ত চুক্তি করে, যেখানে কাশ্মীরের দখলকৃত অংশের খানিকটা চীন পাকিস্তানকে ফিরিয়ে দেয়, বিনিময়ে চীনের দখলে থাকা বাকি অংশকে পাকিস্তান চৈনিক ভূমি বলে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময়ও চীন পাকিস্তানকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছিল।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ মনসুর সাহেব। আপনি যেসব তথ্য দিয়েছেন, সেগুলো আমার জানা ছিলনা। আমি এ ব্যাপারে আরো পড়াশোনা করে মতামত দেওয়ার চেষ্টা করব।

-- বোকা তেলাপোকা

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

সময়টা অদ্ভুত! ইউএস প্রিমিয়ার যান হিরোশিমা মেমোরিয়ালে, চীনা প্রিমিয়ার যান বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধে। কেউই মুখ ফুটে পূর্বসূরীদের অতীত স্বীকার করেন না, আগের মত অস্বীকারের জোরও কমিয়ে আনেন। কে জানে, একদিন হয়ত তাও হবে। "...You may say I'm a dreamer/But I'm not the only one/I hope someday you'll join us/And the world will live as one ..."

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।