একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন বাঙালির মুক্তির মূলমন্ত্র

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি
লিখেছেন নুরুজ্জামান মানিক (তারিখ: সোম, ০৬/০৩/২০২৩ - ৫:২৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের অবিস্মরণীয় একটি দিন। একাত্তরের এইদিনে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রমনার রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে ঘোষণা করেছিলেন পাকিস্তানের অপশাসন ও নিষ্পেষণ থেকে বাঙালির মুক্তির মূলমন্ত্র। এই ভাষণটির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে স্বাধীনতা যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করা। এটি একটি ভূখণ্ডের মানুষের হাজার বছরের নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ, বঞ্চনার করুণ ও রক্তাক্ত ইতিহাস বর্ণনার মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক পাটাতনের ভিত্তির ওপর রাষ্ট্রীয় জাতিসত্তার উদ্বোধন এবং তার সফল বাস্তবায়নযোগ্য পরিণতির জন্য দিকনির্দেশক মূলমন্ত্র। শত নিপীড়ন-নির্যাতনের মধ্যেও বাঙালি যে বারবার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, বুক চিতিয়ে লড়াই করেছে,নদী নদী রক্ত ঢেলে হাজার বছর ধরে মুক্তি ও স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছে তার এক অসামান্য ভাষ্যই বঙ্গবন্ধু রচনা করেছেন তাঁর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে । কবি নির্মলেন্দু গুণ শেখ মুজিবের সাত মার্চের ভাষণকে বলেছেন একটি মহাকাব্য। আর সেই মহাকাব্যের মহাকবি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কবি গুণের কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে কবি অভিহিত করার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকার মতো কাগজে। কাগজটি বঙ্গবন্ধুকে নাম দিয়েছিল ‘এ পোয়েট অব পলিটিক্স’। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো এই ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।


৭ মার্চ ৩ টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের সভা মঞ্চে এসে উপস্থিত হন এবং তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দেন । এদিন তিনিই ছিলেন একমাত্র বক্তা । বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি ছিল নিম্ন রূপ:

ভায়েরা আমার,আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার আত্মঅধিকার চায়।কী অন্যায় করেছিলাম ? আপনারা নির্বাচনে গিয়ে,নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে আপনারা ভোট দেন। আমরা ভোট পাই। আমরা দেশের একটা শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো এবং এই দেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস-এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আয়ুুব খান মার্শাল ল জারি করে ১০ বৎসর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ এর আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন এহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন- আমরা মেনে নিলাম। তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। আপনারা জানেন। দোষ কী আমাদের? আইজকে তিনি আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সাথে দেখা করেছি। আপনারা জানেন আলাপ আলোচনা করেছি। আমি শুধু বাংলা নয় পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসেবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রæয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দ্যান। তিনি আমার কথা রাখলেন না। তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। তিনি মাইনে নিলেন। মাইনে নিলেন। তিনি তারপরে, আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলিতে বসবো। আমরা আলাপ-আলোচনা করবো। আমি বললাম, বক্তৃতার মধ্যে, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো। এমনকি আমি এ পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেবো। তারপরে জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন, বলে গেলেন যে আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরো আলোচনা হবে। তারপরে পশ্চিম পাকিস্তানের জমায়েত ইসলামের নেতা নুরানি সাহেবের সঙ্গে আলাপ হলো, মুফতি মাহমুদ সাহেবের সঙ্গে আলাপ হলো, তারপরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ তাদের সঙ্গে আলাপ করলাম। আসুন বসি। জনগণ আমাকে ভোট দিয়েছে, ছয় (৬) দফা এগারো (১১) দফার মাধ্যমে শাসনতন্ত্র করতে। একে পরিবর্তন পরিবর্ধন করার ক্ষমতা আমার নাই। আপনারা আসুন বসুন। আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে আমাদের আমাদের উপরে তিনি দোষ দিলেন। এখানে আসলে কসাইখানা হবে এসেম্বলি। তিনি বললেন, আমি ডাবল হোস্টেজ হতে চাই না। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলা দেওয়া হবে। যদি কেউ এসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। তার পরেও যদি কেউ আসে তাকে ছন্নছাড় করা হবে। আমি বললাম, এসেম্বলি চলবে। তারপরে হঠাৎ ১ তারিখে এসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হলো। এহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেম্বলি ডেকেছিলেন।আমি বললাম যে আমি যাবো।ভুট্টো সাহেব বললেন তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তানের থেকে এখানে আসলেন। তারপরে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো। দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে। দোষ দেওয়া হলো আমাকে । যে আমার অনমনীয় মনোভাবের জন্য তিনি তা করতে পারলেন না।তারপরে বন্ধ করে দেয়ার পরে এদেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠলো। আমি বললাম শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সব কিছু বন্ধ করে দ্যান। জনগণ সাড়া দিলো। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হল। কী পেলাম আমরা ? আমাদের যাদের অস্ত্র নাই আমাদের হাতে,যা আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রæর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য। আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরীব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে-তার বুকের ওপরে হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু- আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু। আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি যখনই এদেশের মালিক হবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তারা আমাদের ভাই। আমি বলেছি তাদের কাছে একথা । যে আপনারা কেন আপনার ভাইয়ের বুকে গুলি মারবেন ? আপনাদের রাখা হয়েছে যদি বহিঃশত্রু আক্রমণ করে তার থেকে দেশটাকে রক্ষা করার জন্য। তারপরে উনি বললেন যে আমার নামে বলেছেন আমি নাকি বলে স্বীকার করেছি যে ১০ই তারিখে রাউন্ড টেবল কনফারেন্স হবে। আমি উনাকে একথা বলে দিবার চাই আমি তাকে তা বলি নাই। টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাকে আমি বলেছিলাম,জনাব এহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট । দেখে যান, ঢাকায় আসেন, কিভাবে আমার গরীবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে, কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তার পরে আপনি ঠিক করুন। আমি এই কথা বলেছিলাম। তিনি বললেন আমি নাকি তাকে, তিনি নাকি খবর পেয়েছিলেন নাকি যে আমি তাকে আরটিসিতে বসবো। আমি তো অনেক আগেই বলেছি কিসের আরটিসি ? কার আরটিসি ? কার সঙ্গে বসবো ? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসব? আপনি আসুন, দেখুন,জাতীয় পরিষদের জন্য আমার নেতারা রক্ত দিয়েছে সত্য কথা। কিন্তু তা কি আপনারা দেখেছেন তারপরে তিনি আজকে আজকে আমার দেশ এসেম্বলি এসেম্বলি তিনি পঁচিশ তারিখে এসেম্বলি, এর পরে আপনারা জানেন, আমি গ্যালাম। আমি গ্যালাম পল্টন ময়দানে। আমি বললাম সব কিছু বন্ধ। সরকারি অফিস বন্ধ,আমি বললাম, আমার কথা সকলে মানলো। সকলে আমাকে বলল, এবং আপনারা আমার যে নেতৃত্ব দিয়েছেন,আপনারা আমি বললাম কোন সরকারি অফিস চলবে না, কোন কিছু চলবে না। আমি কিছু কিছু জনগণের কষ্ট হয় সেটা ¯øাক করলাম,যে এই এই জিনিস চলবে, ঠিক সেই ভাবে চলল।হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে, বা আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে, ৫ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন এবং যে বক্তৃতা করে এসেম্বলি করেছেন সমস্ত দোষ তিনি আমার উপরে দিয়েছেন। বাংলার মানুষের উপরে দিয়েছেন। আমরা গুলি খাই, দোষ আমাদের।তিনি বাঁধা দিলেন যে আসতে পারবানা। গোলমাল হোলনা পশ্চিম পাকিস্তানে। গুলি করে মারা হোল আমার বাংলার মানুষকে। আমি পরিষ্কার মিটিং-এ বলেছি যে এবারের সংগ্রাম আমার মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ভায়েরা আমার ২৫ তারিখে এসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি যে, ওই শহীদের রক্তের ওপর দিয়ে পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারেনা। এসেম্বলি কল করেছেন, এসেম্বলি কল করেছেন,আমার দাবি মানতে হবে। প্রথম, মিলি সামরিক আইন- মার্শাল ল উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত দিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে, এর পূর্বে এসেম্বলিতে বসা, আমরা এসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না। জনগণ সে অধিকার আমাকে দেয় নাই। ভায়েরা আমার,তোমরা আমার উপর বিশ্বাস আছে ? আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আপনারা জানেন, আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই , যে আইজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্টকাচারি, আদালত ফইজদারি, এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের, গরিবের যাতে কষ্ট না হয়,যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সেইজন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে,সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা ঘোড়াগাড়ি চলবে, রেল চলবে, সব চলবে, লঞ্চ চলবে। শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, তারপরে আর কি? সেমি গভার্মেন্ট দপ্তরগুলো,ওয়াপদা কোনও কিছু চলবেনা। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপরে যদি বেতন দেওয়া না হয়,আর যদি একটা গুলি চলে আর যদি আমার লোকের উপর হত্যা করা হয় তোমাদের উপর কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো। আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই। তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। ভালো হবেনা। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবানা। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবেনা। আজ, আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে,আমরা আওয়ামী লীগের থেকে, আমাদের আওয়ামী লীগের অফিসে রিলিফ কমিটি করা হয়েছে, যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিকে সামান্য টাকাপয়সা পৌঁছিয়ে দেবেন। আর এই সাত (৭) দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইরা যোগদান করেছেন,সান্ধ্য আইনের জন্য যোগদান করে পারেন নাই, প্রত্যেকটা, প্রত্যেকটায় শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছায়ে দেবেন। মনে রাখবেন। আর সরকারী কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। কাউকে যেন সেক্রেটারিয়েটে, হাইকোর্টে বা জজকোর্ট এ দেখা না হয়। দ্বিতীয় কথা, যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হল, কেউ দেবেনা। আপনারা আমার উপর ছেড়ে দ্যান আন্দোলন কী করে করতে হয়। শোনেন মনে রাখবেন, একটা অনুরোধ আপনাদের কাছে,শত্রু বাহিনী ঢুকেছে, ছদ্মবেশে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান, বাঙালি-নন বাঙালি, যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে। আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন দ্বিতীয় কথা হোল এই, যে যদি আবার কোনো রকমের কোন আঘাত আসে,আমি যদি হুকুম দেবার না পারি,আমার সহকর্মী যদি হুকুম দেবার না পারে,মনে রাখবেন। আর একটা কথা অনুরোধ করছি রেলওয়ে চলবে সত্য কথা, কিন্তু সামরিক বাহিনীর লোকদের কোনো জায়গায় থেকে এক জাগার থেকে অন্য জাগায় নেবার চেষ্টা করবেন না। তাহলে দুর্ঘটনা ঘটলে আমি দায়ী হবোনা। প্রোগ্রামটা বলছি আমি শোনেন, রেডিও টেলিভিশন নিউজ পেপার, মনে রাখবেন রেডিও টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে, তাহলে কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেননা। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোনো বাঙালি টেলিভিশনে যাবেননা। রেডিও যদি আমাদের নিউজ না দেবার দেয়, কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশন এ যাবেন না। টেলিভিশন যদি আমাদের নিউজ না দেওয়া হয়, কোনো বাঙালি টেলিভিশন অফিসে যাবেন না।দুই (২) ঘণ্টার মতো ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়নাপত্র নেবার পারে। কিন্তু পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবেনা। টেলিফোন টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ববাংলায় চলবে, এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এই দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে শুনে কাজ করবেন। আমার কিছু বলার থাকবেনা। দরকার হয় চাকা বন্ধ করে দেয়া হবে। ভায়েরা আমার,আমার কাছে এখন-ই শুনলাম আমার এই বক্তৃতা রিলে করা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি, আপনারা আমার প্লেয়ার চালায় দেন। কারো হুকুম মানতে পারবেন না। তবে আমি অনুরোধ করছি। আপনারা আমাদের ভাই। আপনারা দেশকে একেবারে জাহান্নামে ধ্বংস করে দিয়েন না। জীবনে আর কোনোদিন আপনাদের মুখ দেখাদেখি হবেনা। যদিও আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের ফয়সালা করতে পারি তাহলে অন্ততপক্ষে ভাই ভাই হিসেবে বাস করার সম্ভাবনা আছে। সেইজন্য আপনাদের অনুরোধ করছি আমার এই দেশে আপনারা মিলিটারি শাসন চালাবার চেষ্টা আর করবেন না। দ্বিতীয় কথা, প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় প্রত্যেক ইউনিয়নে প্রত্যেক সাবডিভিশনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম । এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ভায়েরা আমার,যেভাবে আপনাদের আপনারা ঠান্ডা হবেন না। ঠান্ডা হয়ে গেলে জালেম আর তার লোক আসবে আক্রমণ করতে। আপনারা হুঁশিয়ার থাকবেন, এবং প্রস্তুত থাকবেন। পজিশন চলবে কিন্তু মনে রাখবেন ডিসিপ্লিন সোলজার ছাড়া, ডিসিপ্লিন ছাড়া কোন জাতি জিততে পারেনা। আপনারা আমার উপরে বিশ্বাস নিশ্চয়ই রাখেন। জীবনে আমার রক্তের বিনিময়েও আপনাদের সঙ্গে বেইমানি করি নাই। প্রধানমন্ত্রীত্ব দিয়ে আমাকে নিতে পারে নাই। ফাঁসি কাষ্ঠে আসামী দিয়েও আমাকে নিতে পারে নাই। যে রক্ত দিয়ে আপনারা আমাকে একদিন জেলের থেকে বাইর করে নিয়ে এসেছিলেন এই রেসকোর্স ময়দানে আমি বলেছিলাম, আমার রক্ত দিয়ে আমি রক্তের ঋণ শোধ করবো। মনে আছে? আমি রক্ত দেবার জন্য প্রস্তুত। আমাদের মিটিং এইখানেই শেষ। আসসালামু আলাইকুম। জয় বাংলা।

উল্লেখ্য, বক্তৃতাকালে জনতার কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছিল স্লোগান,“জাগো জাগো বাঙালি জাগো”, “পাঞ্জাব না বাংলা, “তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা”, “তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব”, “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর-বাংলাদেশ স্বাধীন করো” । ঢাকা বেতারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রিলে না করার প্রতিবাদে বেতারে কর্মরত বাঙালি কর্মচারীরা কাজ বর্জন করেন এবং বিকেল থেকে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সকল অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ হয়ে যায় । বঙ্গবন্ধুর গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ রিলে করা হবে-এ ঘোষণার পর সারা বাংলায় শ্রোতারা অধীর আগ্রহে রেডিও সেট নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন । শেষ মুহূর্তে সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়ার প্রতিবাদে বেতার কেন্দ্রটি অচল হয়ে পড়ে তখন কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েই অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন । গভীর রাতে সামরিক কর্তৃপক্ষ ঢাকা বেতারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ প্রচারের অনুমতি দিলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দিয়ে ঢাকা বেতার কেন্দ্র পুনরায় চালু হয় ।

৭ মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সরকারের শাসন কার্যত বিলুপ্তই হয়ে যায়। সবকিছুই পরিচালিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশক্রমে।বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি যথার্থই ছিল গ্রিন সিগন্যাল কিন্তু সরাসরি একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা নয় । উত্তাল মার্চে অনেক রাম শ্যাম যদু মধু স্বাধীনতা ঘোষণা ও নানা হঠকারী বক্তব্য দিলেও একমাত্র বঙ্গবন্ধু সেই চোরাবালিতে পা রাখেননি । বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে অনেকে বলে থাকেন তিনি কেন একতরফাভাবে সেদিন স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন না ? তা যদি তিনি করতেন তাহলে তা হতো একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, মুক্তিসংগ্রাম নয় । তখন এমন একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নাইজেরিয়াতে চলছিল যা ব্যর্থ হয়েছিল । বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের পাতা ফাঁদে পা না দিয়ে দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন । ২৫মার্চ দিবাগত রাতে প্রথম গুলিটা পাকিস্তানের অস্ত্র থেকে ছোড়া হয়েছিল বলেই বাঙালির সশস্ত্র সংগ্রামটি মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নয় । সমসাময়িক ইতিহাসে কোনো একজন রাজনৈতিক নেতার একটি বক্তৃতা একটা জাতির ইতিহাসের গতি পরিবর্তন করে দিয়েছে তেমন দ্বিতীয় নজির নেই।

রেফারেন্স:

১) নুরুজ্জামান মানিক,মুক্তিযুদ্ধের প্রতিদিন মার্চ-ডিসেম্বর;
২) রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, ৭১ এর দশমাস;
৩) ডঃ কামাল হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ কেন অনিবার্য ছিল ;
৪) রফিকুল ইসলাম, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে ;
৫) ডেটলাইন ৭ মার্চ, ১৯৭১: সিবিজিআর- এর চোখে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ,বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম,১৭ মে, ২০১৯; ;
৬) নাজিমুদ্দীন মানিক,একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলো;
৭) যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধ গবেষক জালাল ভাই ।

ছবি: 
18/12/2007 - 12:39অপরাহ্ন

মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।