অপু আর আমি - ৪

মাশীদ এর ছবি
লিখেছেন মাশীদ (তারিখ: শুক্র, ১১/০৮/২০০৬ - ৮:০১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


স্কুলের পর্ব শেষ হয়ে গেল 1994-এ। স্কুল জীবনের সব অসাধারণ বন্ধুর জন্য তখন মন খারাপ লাগত। অবশ্য এর-ওর সাথে দেখা হত স্যারদের বাসায়। শুধু অপুর সাথেই যেন দেখা হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। ক্লাস নেই, ক্লাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকানো উদাস কোন ছেলেও নেই।

সে যা হোক, 1995 এর শুরুতে ভারী গলার উদাস কোন ছেলেকে নিয়ে ভাবার খুব একটা সময় ছিল না। এস এস সি পরীক্ষা সামনে। পরীক্ষার পড়া তো আছেই, তার সাথে আছে বিটকেলে গোল্লা পূরণ। মাঝখানে পরীক্ষার আগে আগে চিকেন পঙ্ হল। সব মিলিয়ে মহা যন্ত্রণা!

এই বছরটায় অপুকে ঘেরা স্মৃুতি বলতে আমার জন্মদিন। কোন এক অজ্ঞাত কারণে জন্মদিন মানেই অপুর কাছে বিশাল কিছু। পুরনো সব কার্ড দেশে ফেলে এসেছি দেখে ঠিক ট্রেইস করতে পারছি না ঠিক কবে শুরু হয়েছিল, কিন্তু at least এই 1995 এর জন্মদিন থেকে মোটামুটি সব জন্মদিনেই he never falied to make me feel special.

তো সেবার জন্মদিনে আমার কিছু প্রিয় স্কুলের বন্ধুকে বাসায় দাওয়াত দিলাম। আমাদের বাসায় এটাই প্রথম এত বড় একটা আড্ডা। প্রায় 20 জন। অতি মজার কিছু মেয়ে যাদের প্রত্যেকটা কথায় হাসি পায় আর কিছু মজার ছেলে। সবাই দূরে চলে যাওয়ায় তখন সবাইকেই খুব ভাল লেগে যায়। সবাই খুব হই-হুল্লোড় করেছিলাম সেদিন। শুধু একজনই চুপচাপ ছিল সেটা হচ্ছে অপু। ওর স্বভাবসুলভের চেয়েও বেশি। মনে একটু খটকা লেগেছিল - পাত্তা দেইনি। (অনেক পরে একদিন বলেছিল, অন্য কোন ছেলে বন্ধুর পাশে আমার বসে থাকাই নাকি ওরকম নীরবতার কারণ ছিল সেদিন।) সেসময় আমার soft toys খুব ভাল লাগত, কিন্তু ঢাকায় তখন সেটা এত পাওয়া যেত না। অপু কোথেথকে জানি আমার জন্য একটা ছোট্ট হলুদ রঙের টেডি যোগাড় করেছিল। কার্ডে খুব অদ্ভুত মেসেজ ছিল। হুবুহু মনে নেই, যা লেখা ছিল সেটা কিছুটা এরকম -

'হাজারটা পনেরই জুলাই যাক, এই মেয়েটা সবসময় ছোটই থাকুক। ছোটবেলার সব বন্ধুকে কি বড় বেলায় বড় হতে হয়?'

আমি এর আগা-মাথা কিছুই বুঝলাম না। তবে বেশ ভালই লেগেছিল মনে আছে। এই লেখা আমার বোন আর মা'কে বেশ চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল।

12 বছরের (প্লেগ্রুপ থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত) পুরনো বন্ধুরা সব হুট করে ছিটকে গেলাম এদিক-সেদিক। আমি ভর্তি হলাম ভিকারুনি্নসা নুন কলেজে, বিজ্ঞান বিভাগে আমার স্কুল থেকে আমিই একা। স্কুলের সব প্রিয় বন্ধুরা কেউ নটরডেম, কেউ বদরুন্নেসা, কেউ ঢাকা কলেজ আর কেউ হলিক্রসে। পুরো জীবন কো-এডে অভ্যস্থ আমি হঠাৎ করে ন্যাকা মেয়েদের সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে শুরু করলাম। সেবার একগাদা স্ট্যান্ড করেছিল, তাদের মধ্যে মেয়েদের প্রায় সব স্পেসিমেনই আমাদের কলেজে। তাদের নিত্য নতুন আঁতলামী দেখে আর ল্যাব রিপোর্ট লিখে জীবন কাটতে থাকল। বুয়েট ক্যাম্পাসের চিরচেনা স্কুল থেকে আরেকরকম জীবন শুরু হল।

আমার বন্ধু কপাল বরাবরই ভাল। অসম্ভব বোরিং কলেজে ন্যাকাদের সমুদ্রের মধ্যেই কি করে যেন সমমনা কিছু খুব ভাল বন্ধু পেয়ে গেলাম। ওদের গল্প আরেকদিন।

অপু ভর্তি হল নটরডেমে। ও এলিফ্যান্ট রোড থেকে নটরডেম, আমি বুয়েট ক্যাম্পাস থেকে ভিকারুনি্ননসা। রিকশা দিয়ে মাঝখানের পূর্ত ভবন পার হওয়ার সময় হঠাৎ হঠাৎ রাস্তার উলটা দিকে একটা চেনা মুখ দেখি। সেই চেনা এক্সপ্রেশান, যেন রিকশা নয়, ক্লাসের বেঞ্চে বসে আছে। শুধু জানালাটা নেই। রাস্তার কোন কিছুই যেন স্পর্শ করছে না।

আমি বরাবর গলাবাজ। একবার বোধ হয় রিকশা থেকে মুখ বের করে চিৎকার করে ডেকেছিলাম নাম ধরে। বেশ অবাক হয়েছিল মনে আছে।

কলেজ জীবনের সময় কাটছিল ভীষণ পড়ার চাপে। কিন্তু এর মাঝে ফোনে যোগাযোগ চলত বেশ রেগুলারলি। স্কুল ছাড়ার পরে লম্বা তিন বছরের ভাটা আর পড়ল না। তবে হুটহাট যেকোন বিষয়েই তুচ্ছ কারণে ঝগড়া লেগে যেত। একেকবার ঝগড়া হয় আর সেটা ভাব হতে হতে মাসখানেক বা তারো বেশি হয়ে যায়। মাঝখানে ফোন আসলে ইচ্ছা না করলেও দড়াম করে ফোন রেখে দেয়া চলত হর-হামেশা। একবার রেখে দেয়ার পরে আবার না করলে আরো মেজাজ গরম। এর মধ্যে বিশেষ বিশেষ দিনে কার্ড-গিফট চলত। এটা শুধু ওর-আমার না, আরো বন্ধুদের মধ্যেও ছিল। তখন কারো সাথে কারো দেখা হয় না বলে ডাক-কুরিয়ারের তুমুল ব্যবহার শুরু হল। খুব মজা হত তখন। কুরিয়ার বা ডাকে কিছু পাওয়ার মজাটাই অন্যরকম ছিল। এর মধ্যে অপুর একেকটা কার্ড মেসেজের ভাব আরো বাড়তে থাকল।

ঝগড়া করতে করতেই কিভাবে যেন দু'জনের বন্ধুত্ব অনেক গভীর হয়ে গেল। ঠিক কবে থেকে জানিনা - আমরা দু'জন এক পযর্ায়ে প্রাত্যহিক জীবনের সব কিছু শেয়ার করা শুরু করলাম। দুই ভিন্ন কলেজের গল্প, নোটপত্র, গান আর গোপন সব সুখ-দুঃখ।

এভাবেই চলছিল দিন। বন্ধু-বন্ধু খেলা। বন্ধু থেকে বেস্ট ফ্রেন্ডের মত। পড়া দিয়ে প্যাকড জীবনে তখন অন্যকিছু ভাবতামও না। অপুখুব ফোন করত, কার্ডে জটিল ভাবের কথা লিখলেও ফোনে সেটা প্রকাশ পেত না। তাই হঠাৎ হঠাৎ ওকে নিয়ে মনে খটকা জন্মাত। ও কি শুধুই বন্ধু, না কি আরো বেশি কিছু? আমি কি একাই ভাবছি, না কি ও-ও ভাবছে? ওর সাথে কথা হলে মনে হত যেন আমিই বেশি ভাবছি। আমার ভাবনাও খুব একটা সিরিয়াস মনে হত না আর। তাই এরকম ভাবনা সেসময় কখনই বেশিদূর যেত না।

কলেজের দ্্বিতীয় বর্ষের একটা ছোট্ট ঘটনা আমার চোখ খুলে দিল। অনেকটা।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।