অপু আর আমি - ৬

মাশীদ এর ছবি
লিখেছেন মাশীদ (তারিখ: মঙ্গল, ১৯/০৯/২০০৬ - ২:২৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


এইচ এস সি দিলাম 1997-এ। এরপরে অনেকদিন বেশ ফ্রি একটা সময় কেটেছে। বুয়েট ভর্তি কোচিং এ ক্লাসে গিয়েও ফাঁকি দিয়ে মাঝখানের কিছুদিন কাটল। বুয়েটের ক্লাস শুরু হল সেই 1998 এর ডিসেম্বরে। এর মধ্যে ঘটে গেল অনেক কিছু।সেসময় আমার দিন কিভাবে কাটত, আজ এতদিন পরে সেটা ভেবে বেশ অবাক লাগছে। বেশ লম্বা ছুটির মধ্যে ভর্তির জন্য পড়াশোনা আর তারই ফাঁকফোকড়ে পাড়ার পিচ্চিদের পড়ানো। সাথে গল্পের বই তো আছেই। পড়া বাদে বাকি সব নিয়ে বেশ মজার একটা সময়ের মজার কিছু অভিজ্ঞতা। কলেজের বন্ধুদের মধ্যে রওনক, নাঈমা আর তানজিমা ছিল আমার সবচেয়ে কাছের। আমরা সবাই সবকিছুই শেয়ার করতাম। ওরা সবাই জানত আমার স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে অপু ছাড়াও জারির আছে, সনি আছে, জাবের আছে। আমরা সবাই কার্ড আদান-প্রদান করি যেকোন বিশেষ দিনে। সেগুলোয় অপু আর জাবের হয়তো লিখেছে খুব কাব্যিক কোন মেসেজ আর জারির হয়তোবা আমি ওকে যেই কার্ড পোস্ট করেছি সেটার খরচ বাবদ পাঁচ টাকার একটা ব্যাংক চেকই পাঠিয়ে দিয়েছে (আসলেই ইসলামী ব্যাংকের পাঁচ টাকার চেকটা আমার কাছে এখনো আছে। পরেরবার পাঠিয়েছিল পাঁচ টাকার কয়েন, কার্ডের ভিতর পোস্ট করে। ওর সেনস অফ হিউমারের জুড়ি নেই।) রওনক, নাঈমা, তানজিমাকেও দেখাই। সবাই মজা পায়। তানজিমা ছাড়া সবাই কো-এড থেকে এসেছি, ছেলে বন্ধু সবারই আছে - তাই এটা এমন কোন আশ্চর্য ঘটনা না। তেমন দাগ ফেলেনা ঠিক ওদের মনে। আমারো হয়তো সেভাবে ফেলত না। কিন্তু শুধু আমিই '96 এর ঐ ঘটনার পরে অপুর কার্ডের আরো অন্য কোন গভীর অর্থখুঁজে বেড়াই।এরপর থেকে শুরু হল ঝগড়া। কথা নেই বাতর্া নেই হুটহাট লেগে যায়। কেন এটা বললে বা কেন এটা বললে না - ব্যস লেগে গেল। আমিও যেন এত বন্ধুদের মাঝে শুধু ওকেই বেছে বেছে বাজে কথা বলি। মাঝখানে মনে আছে একবার খুব ঝগড়া লাগল আমাদের এইচ এস সি'র রেজালটের পরপরই। আমি ওকে খুবই কুটনির মতই খোঁটা দিলাম যে ও আমার থেকে 121 নাম্বার কম পেয়েছে। আর যায় কোথায়! এমনিতে ঠান্ডা অপুকে যেন ঠিক পয়েন্টে হিট করলাম। ফলস্বরূপ কিছুদিন কথা বন্ধ। এই 121 নাম্বার নিয়ে ঝগড়ার রেশ এবং রেফারেনস চলল অনেকদিন। শুধু যে ঝগড়া চলল তা নয়। আমরা যেন দুই এক্সট্রিমে চলা শুরু করলাম। হয় খুব খাতির - গান শুনছি আর শোনাচ্ছি ফোনের এপ্রান্ত থেকে সে প্রান্ত আর না হয় কুৎসিত কোন ঝগড়া আর তার পরবতর্ী কিছুদিনের ব্রেক। এর মধ্যে একটা জন্মদিনের কার্ডের মেসেজ পড়ে আমি প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে এ ছেলের আসলেই ফিলিংস আছে। কি লিখেছিল ঠিক পুরোটা মনে নেই, তবে শেষটুকু ছিল এরকম কিছু - '...... শুধু একটা মানুষের জন্য মন খারাপ করা মুহূর্তগুলো দীর্ঘ হয় না। এই মেয়েটা মনে হয় কোনদিনই আমাকে মন খারাপ থাকতে দেবে না!' এটা পড়ে আমার বড়বোন তো মুগ্ধ! আহা! কি কিউট! (আমার বড়বোন আমার থেকে বেশ বড় আর ছোট থেকে আমাকে রেখেছে বলে এখনো কোন বাচ্চার উদাহরণ দিতে গেলেই আমার উদাহরণ দেয়। আমাদের যেকোন কিছুই ওর কাছে খুব কিউট।) ও অপুর বেশ ফ্যান হয়ে গেল। আম্মার রিঅ্যাকশান এতটা আশাজনক হল না। আম্মা এই মেসেজ দেখে আর ফোনের ঝগড়া দেখে আমাদের আগেই টের পেল ঘটনা মোটেও সুবিধার দিকে যাচ্ছে না। মেজবোনও মোটামুটি সেই দলেই। কিন্তু এই কার্ডটায় আমি বুকে পানি পেলাম। যাক, বরফ তবে গলছে! সাহস হচ্ছে তবে!এখন যদি খুব খুঁটিয়ে ভেবে দেখি, তবে অপুর জন্য বোধ করি ব্যাপারটা ততটা সহজ ছিল না। আমি বরাবরই সিভিয়ার মারদাঙ্গা। একটা বেফাঁস কিছু বললেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠি। যা ইচ্ছে তাই বলে ফোন রেখে দেই এবং এরপর ফোন করলেই রেখে দেই। আমার মনেও যে অন্য কিছু খেলা করছে - সেটা ও-ই বা বুঝবে কিভাবে? একবারের ঘটনা মনে পড়ছে। তখন The Corrs ব্যান্ডটার গান বেশ চলছে। অপু কি মনে করে জানি একদিন ফোনে কথা বলার ফাঁকে The Corrs এর 'What can I do to make you love me?' গানটা ছাড়ল। আমিও কম বদমাইশ না। আমি বললাম, এ গানটা ভাল, তবে আমার কিন্তু যাই বল The Corrs এর এই অ্যালবামের 'I never really loved you anyway' গানটা বেশি ভাল লাগে। অপুর আশার বেলুন বোধ করি সেবার বেশ নিষ্ঠুরভাবেই ফাটিয়ে দিয়েছিলাম। যা হোক, এভাবেই দিন যাচ্ছিল। হঠাৎ করেই আবার একদিন কেন যেন ঝগড়া লেগে গেল। আশ্চর্য! সেসময়ের লাইফ এন্ড ডেথ মাকর্া ঝগড়ার কারণগুলো যেন কবেই ধুলোয় মিশে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারছি না। অনেকদিন কথা বন্ধ। ভাব হল ওর জন্মদিনের দিন। ফোন করব করব না করেও করে ফেললাম। অপুও বেশ ভাব নিয়ে কথা বলল। আবার কিছুদিন ভাল গেল। কিন্তু এরপর আবার যেন কি নিয়ে আরেকদিন লেগে গেল। এবার বিচ্ছেদটা প্রায় ছয় মাসে গিয়ে দাঁড়াল। মাঝখানের এই ছয়মাসে অনেককিছু ঘটে গেল। অপুর ইউনিভার্সিটির ক্লাস শুরু হয়ে গেল। হঠাৎ করেই চানস পেয়ে পড়া শুরু। ওর যে ওখানে পড়ার ইচ্ছা সেটা জানতামও না। কমন বন্ধুদের থেকে খবর পাই। আর ভাবি আহা! ঝগড়াটা না করলেই হত। কিন্তু তারপরেও ফোন করা যাবে না। দুর্বলতা শো করার মানেই হয় না। আমার মারদাঙ্গা ভাব বজায় রাখা তো চাই at any cost! কিন্তু শুধু কি আমি? অপুও কেমন যেন নিষ্ঠুর হয়ে গেল। আমার থেকে শিখেই হয়তো। ফোনই করেনা। আমার কোন ফোন আসলেই খুব আগ্রহ নিয়ে ধরি। ভাবি, সেই প্রিয় গভীর গলাটা হয়তো শোনা যাবে। কিন্তু তা আর হয় না। আমিও না না প্ল্যান করি। একবার ভাবি ফোন করে অঞ্জন দত্তের 'একটা বন্ধু হতে কি পারবে তুমি আমার' শোনাই - আবার ভাবি, না থাক। ভুলেই থাকি - কিন্তু হুটহাট হঠাৎ আবার মনে পড়ে মন খারাপ হয়ে যায়। ইস্টার্ণ প্লাজায় যাওয়ার পথে হাতিরপুল বাজারের উলটা দিকের 'অপু জেনারেল স্টোর'টাও যেন অপুকে ফোন করার কথা মনে করিয়ে দেয়। এর মধ্যে বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা হয়ে গেল। কোচিং এ ফাঁকি মারার ফল পেলাম। আমার বাবার যেখানে ধারণা ছিল আমি প্রথম 50 এর ভিতরে থাকব (কেন কে জানে!) সেখানে আমার সিরিয়াল দেখা গেল 599! বাসায় বেশ একটা কাল ছায়া নেমে এল যেন। কেমিকেলে পড়ার যে ইচ্ছাটা ছিল সেটা মনে হয় না হচ্ছে। মন-টন খুব খারাপ সেসময়। এরকমই একটা দিনে হুট করেই একদিন অপুর ফোন এল। কোন এক বন্ধুর কাছে শুনেছে। আমার কড়া বাবার কথা ও খুব ভাল করেই জানে। সব মিলিয়ে আমার যে বেশ মন খারাপ এটা জেনেই যেন ফোন করা। আমার খুব খারাপ একটা সময়ে ওর এই ফোনটা আমার জন্য খুব বড় একটা ব্যাপার ছিল। Like so many other occasions, I was touched by something Apu did...again.এরপর কেন জানিনা, আমরা হঠাৎ করেই বেশ বড় হয়ে গেলাম মনে হয়। ঝগড়া পুরো বন্ধ হয়ে গেল তা ডেফিনিটলি নয় কিন্তু সেরকম বিশাল লম্বা বিচ্ছেদ আর হল না। আমার ক্লাস শুরু হতে তখনো অনেক দেরি। বেশ ফ্রি সময়। অপু ক্লাস করে আর আমি ওর গল্প শুনি প্রতিদিন। গান শুনি আর শোনাই খুব। আমি অঞ্জন দত্তের ফ্যান আর ও সুমনের। এই নিয়েও এককালে খুব ঝগড়া হত। আমি অঞ্জন বলতে অজ্ঞান - আর ওর তখন ভালই লাগেনা। সুমনের জন্যও ফিলিংস vice versa. এর মধ্যে একদিন হুট করে অঞ্জন ঢাকায় চলে আসল। আমার বোনেরা শেষ শো'র টিকেট কিনল - তিন বোন মিলে যাব। প্রথম শো'র আগে কুরিয়ারে আমি সেই শো'র দু'টো টিকেট পেলাম। অপু পাঠিয়েছে। আমার মন ভাল করার জন্য। ওর সাথে যাবার উপায় ছিল না তখন। আমার বড়বোনকে দিয়ে দিলাম। But that will always remain the best gift anyone had ever given me. আমার বড়বোন শো শেষে টিকেটের ছেঁড়া অংশগুলো নিয়ে আসল। এখনো সেগুলো আমার কাছে সযত্নে রাখা আছে। অনেকদিনের বিচ্ছেদের পরে বুকের ভিতর এবার অপু র জায়গাটা যেন আরো অনেক পোক্ত হল। অঞ্জন আর নিমা রহমানের 'গানে গানে ভালবাসা' সেসময়ে আমাদের ফোনের কনভার্সেশানে ফিরে ফিরে আসত। ওটার ঢাকা আর কলকাতা - দুই ভার্সানের দুইটা গান 'তোমায় দিলাম' (পরশপাথরের গাওয়া এখানে, পরে মহীনের ঘোড়াগুলিরটা শুনি) আর 'আজ বসন্ত' মনে হত আমাদের গান। কথাগুলো যেন আমাদেরই - 'আজ হোক না রঙ ফ্যাকাশেতোমার আমার আকাশে চাঁদের হাসি যতই হোক না ক্লান্ত-বৃষ্টি নামুক নাই বা নামুকঝড় উঠুক নাই বা উঠুকফুল ফুটুক নাই বা ফুটুকআজ বসন্ত।'বৃষ্টি হলেই অপুকে ফোন করা চাই। ফোন কোলে নিয়ে বৃষ্টি দেখা আর গান শোনা। বৃষ্টি আর গানের মধ্য দিয়ে আরো কাছাকাছি আসা। আহ! সেটা একটা সময় ছিল বটে!(অনেকক্ষণ ধরে স্মৃতি হাতড়াচ্ছি আর লিখছি। এখন দেখি মাথা ঝিমঝিম করছে। এ পার্টে শেষ করব ভেবেছিলাম, কিন্তু ভাবতে ভাবতে আর লিখতে লিখতে দেখি এখনো শেষ হচ্ছে না। কি আর করা.....)


মন্তব্য

ভেড়া এর ছবি

অসাধারণ কিছু সুন্দর সময়ের ভাল লাগাটা আমার মধ্যেও চলে আসছে । এত সুন্দর লেখার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।