অপু আর আমি - ৭

মাশীদ এর ছবি
লিখেছেন মাশীদ (তারিখ: শুক্র, ২০/১০/২০০৬ - ৫:০০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


1998 টা খারাপ হতে হতেও কেমন যেন ভাল'র দিকে মোড় নিল। সেবার জন্মদিনেও খুব সুন্দর একটা কার্ড পেলাম অপুর থেকে। বন্ধুত্ব নিয়ে একটা গানের কিছু লাইন কাগজে ছোট ছোট করে প্রিন্ট করে কার্ডে সেঁটে দিয়েছিল। কথাগুলো এখন ঠিক মনে পড়ছে না - যদিও এককালে ওর প্রায় সব কার্ডের কথা মুখস্থ ছিল। কে বলেছে কার্ড হচ্ছে একটা waste of money? নানা মন খারাপের বা একা থাকার সময় এই কার্ডগুলো আমার মন ভাল করে দিয়েছে। কার্ডগুলো ছিল যেন মন খারাপ রোগের super fast action ওষুধ। আজকে হঠাৎ করেই সেই কার্ডগুলোকে খুব মিস করছি।

বুয়েটে যন্ত্রকৌশলে চানস পেলাম। কেমিক্যালে পড়ার ইচ্ছা থাকলেও মন বেশি খারাপ হল না আর। ক্লাস শুরু হবে সেই বছরের শেষ দিকে। হাতে বেশ লম্বা একটা ফ্রি সময় পেলাম। এসময়ে আমি পাড়ার তিনটা পিচ্চিকে পড়াতাম। ক্লাস থ্রি থেকে ফাইভ পর্যন্ত পড়ত। একেকটা একেক টাইপ। একটা খুব সিরিয়াস তো আরেকটা হাড়ে হাড়ে দুষ্টু। ওদের নিয়ে বেশ মজার সময় কাটে। গল্পের বইও চলছে দুর্দান্ত গতিতে। ছোটকাল থেকে বাসার বুক শেলফে দেখে আসা আম্মার অলটাইম ফেভারিট ইয়া মোটা Gone with the Wind বইটা একদিন সাহস করে পড়া শুরু করেই দিলাম। অসাধারণ একটা বই। এর মধ্যে ভাল গতিতে চলল আমার মেজ বোনের সাথে পাবলিক লাইব্রেরি আর ব্রিটিশ কাউনসিলে সিনেমা দেখার ধুম। মনে আছে, অসম্ভব ভাল লেগেছিল পাবলিক লাইব্রেরিতে The English Patient দেখে। প্রায় এক সপ্তাহ এরপরে ঘোরে ছিলাম। বুকার পাওয়া এই বইটাও আমার মত অতি স্লো রিডার ঐ ঘোরের মধ্যে পড়ে শেষ করে ফেলল। আহা! একটা বই আর তার সেইরকম একটা মুভি বটে।

সেসময় অপু বেশ ক্লাস শুরু করে দিয়েছে ওর ইউনিভার্সিটিতে। স্কুল-কলেজের এক সিলেবাস পেরিয়ে আমাদের দু'জনের হঠাৎ ভিন্ন হয়ে যাওয়া জীবনের গল্প দৈনন্দিন ফোনালাপে কেমন যেন একটা অন্যরকম কিছু এনে দিল। যেন হঠাৎ করে বড় হয়ে যাওয়া। The English Patient দেখে কেমন যেন একটা গভীর অনুভবের মধ্যে ছিলাম সেসময়। অপুকে হাইলি রেকমেন্ড করলাম এই মুভিটা। অপুও পট করে ওটার সিডি কিনে ফেলেছিল মনে আছে। নিজে দেখে আমাকে দিয়ে দিল। সেসময় মুভির সিডি আজকের মত সহজলভ্য ছিল না। সেই সিডি আমি কতবার দেখেছি কে জানে! এত সিনেমা দেখেছি এত সময়, কিন্তু কেন যেন এখনো বুকে নাড়া দিয়ে যাওয়া কোন সিনেমার কথা উঠলে এটার কথাই শুধু মনে হয়। হয়ত সময়ের একটা ব্যাপার আছে। একটা অস্থির সময়ে দেখা বলেই মনে গেঁথে গেছে।

এটা কি আরো পরের ঘটনা, নাকি ঐ সময়েরই? কি জানি। অপুর সাথে এত স্মৃতি যে মাঝে মাঝে স্থান-কাল গুলিয়ে ফেলি। খারাপ লাগে। আবার ভাবি, কি এসে যায়? কোন না কোন সময়, কোন না কোনখানে হয়েছিল তো!

যা হোক, এভাবেই দিন কাটতে লাগল।

সেসময় বাসায় একটা মজার ব্যাপার হল। আব্বা ঠিক করল কম্পিউটার কেনা হবে। আমার আর আমার বোনেদের খুশি দেখে কে! অপু বরাবরই কম্পিউটারে বিশেষ ভাল। ইন্টারনেট বহুদিন ধরে ব্যবহার করছে। ওকে দিয়ে এককালে আমার ছোটমামা আর মামাতো ভাইকে ই-মেইল পাঠাতাম আর ইচ্ছা করে ছোট ছোট চিঠি লিখতাম আর ভাবতাম, আহা! দু'টো লাইন বড় হলে নিশ্চয়ই বেশি পয়সা খরচ হবে! সেসব ভেবে আজকাল প্রায়ই হাসি পায়। তো সেসময় ওর থেকে কম্পিউটারের কনফিগারেশান জেনেছিলাম। কম্পিউটার বাসায় ডেলিভারির সময়ও এসেছিল। কম্পিউটার আর ইন্টারনেটে আমার (এবং আমার থেকে বাসার সবার) হাতেখড়ি হল ওর কাছেই। এরপর থেকে কম্পিউটার আর কম্পিউটারের নানা সমস্যা অপুকে আমার বাসায় নিয়ে এসেছে বহুবার।

ঐ সময়টার কথা ভাবতে গিয়ে একটা ব্যাপার অনুভব করছি খুব। আমি খেয়াল করতাম, আমার যখন কোনকিছুর দরকার হত, এত বন্ধুকে বাদ দিয়ে কেন জানি অপুকেই বলতাম হেল্প করতে। আমি আগেও বলেছি আমার আরো অনেক বন্ধু ছিল, খুব কাছের অনেক বন্ধু। কিন্তু যে কোন দরকারে আমি অপুর কাছেই গেছি বারবার - সে মন খারাপের দিনে কোন সাপোর্টের জন্যই হোক বা আমার বোনের গায়ে হলুদের 25টা কার্ড এঁকে দেয়া জন্যই হোক বা এক্সফাইলসের কোন ছবি প্রিন্ট করে দেবার জন্যই হোক। কেন যেন সব সময়ই মনে হত এই ছেলেটার কাছে কিছু চাইবার আমার অধিকার আছে। এই ছেলেটা আমার।

যা হোক, ইন্টারনেট সেসময় একটা অদ্ভুত জগতে নিয়ে গেল। বন্ধু তানজিমার থেকে অনেক শুনেছি চ্যাটের কথা। অপুকে বললাম চ্যাট করতে চাই। সে আমাকে ইয়াহুতে চ্যাট করার পথ বলে দিল। আমি কিন্তু তানজিমার বদৌলতে আই আর সি'র খবর জানি ততদিনে। অপুকে সেটা দেবার জন্য খুব গুঁতালাম। ভীষণ অনিচ্ছার সাথে একদিন ইনস্টল করে দিয়ে গেল।

এভাবেই চলছিল। মাঝখানে স্কুলের অন্য বন্ধুগুলো জানি কি এক খেলা শুরু করে দিল। বেশ হঠাৎ করেই। অপুর সাথে ওদের সেসময় কেন যেন একটু যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। আমার সাথেই বেশি ছিল। অন্য বন্ধুরা সেসময় একে-ওকে নিয়ে টিজ করা শুরু করল। আমার সাথে হয়ত অপু বা জাবের বা অন্য কাউকে নিয়ে ঠাট্টা। আমিও অপুকে আবার সেই কথা রিলে করি। সবসময়ই ঠাট্টার মধ্যেই থাকে। যেন নতুন কিছু না, স্কুলের কোন ঠাট্টারই কনটিনিউয়েশান।

কিন্তু 1998 এর অক্টোবরের 22 তারিখে কেন জানি আমাদের দৈনন্দিন ফোনালাপ এই পুরনো টিজিং এর বাঁক ধরেই বেশ সিরিয়াস হয়ে গেল। কি কি কথা হচ্ছিল পরে অনেকবার ভেবে দেখার চেষ্টা করেছি - কিন্তু আশ্চর্য! মনেই পড়ে না। আমার তখনো মনে অনেক দ্্বন্দ্ব ছিল আসলেই অপুর মনের ভাব কি সেটা নিয়ে। ভুল ভাবছি না তো - এরকম মনেই হত। তাই ঠাট্টাগুলোও ঠাট্টাই ছিল। কিন্তু সেদিন হঠাৎ করেই অপু কি জানি বলে ফেলল হুট করে। 'সবাই টিজ করছে অন্য ছেলেদের নিয়ে? behind my back? নাহ! এখন তো কিছু করতেই হয়!' আমি সেটাতেও হাসছি - 'হা হা ! করলেই তো পারো!'

কিন্তু তারপর, তারপর হঠাৎ করেই দু'জনেরই হাসি বন্ধ হয়ে গেল সেদিন। এখন ভাবতে অবাক লাগছে, এতদিনের এত ঘটনা, ঘটনার ভিতরে লুকিয়ে থাকা না থাকা কোন ঘটনা আর সেটা নিয়ে ভাবতে থাকা, এত ঝগড়া, এত গান - কি করে ঐদিনের ঐ মুহূর্তে এসে থেমে গেল! সত্যি বলছি, ব্যাপারটা ঐদিন আমরা কেউই এক্সপেক্ট করিনি একদম। এত বড় একটা ব্যাপার - কত মানুষ শুনেছি কত কিছু করে- চিঠি লেখে, বন্ধুকে পাঠায় মনের খবর জানাতে, ভালবাস কি বাস না - সেই আলটিমেট প্রশ্নের উত্তরের জন্য সারা বিশ্বে প্রতি মুহূর্তেই কারো না কারো কত প্রস্তুতি! আর আমরা? সেদিনের ঠাট্টার মাঝেই যেন একসাথে হঠাৎ উপলব্ধি। খুব অনানুষ্ঠানিকভাবে। খুব গভীর কোন ভালবাসার প্রতিশ্রুতিমাখা ডায়ালগ ছাড়া। এতদিন ধরে বিচ্ছিন্নভাবে ঘটে যাওয়া ছোট ছোট টুকরো ঘটনা আর অবসরে শোনা গানে হয়তো ছিল সেইসব প্রেমপত্র, সেইসব প্রতিশ্রুতি, সেইসব ভালবাসা। তাই হবে।

কিন্তু মেমরি এভাবে বিট্রে করছে কেন? কি কি কথা হয়েছিল আর? এত খুঁটিনাটি মনে আছে কিন্তু এরকম একটা জীবন বদলে দেয়া কথোপোকথন কেন মনে পড়ছে না? না কি ঘোরে ছিলাম সেসময়? হয়তো। যতদূর মনে পড়ে, নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে অপু হঠাৎ প্রশ্ন করেছিল,'আমাদের সম্পর্ক কি আরো বেশিদূর যেতে পারে না?'

কয়েক বছরের দ্্বন্দ্ব যেন এক মুহূর্তে উড়ে গেল সেদিন। আমি তার উত্তরে কি বলেছিলাম মনে নেই। ফোন ছাড়ার আগে বলেছিলাম,'এবার বুঝতে পারো, অন্য কাউকে না নিয়ে কেন তোমাকে নিয়েই শুধু এত চিন্তা? কেন তোমার কিছু হলেই আমার এসে যায়?'

22 শে অক্টোবরেই একটা happy ending এর সূচনা হতে পারত। কিন্তু হল না। মাথাচাড়া দিয়ে উঠল বাস্তবতা।

এরপরের চারটা দিনের ঘটনা ভাবলেও ঠিকমত মনে পড়ে না। ভালবাসার বিহবলতা আর বাস্তবতার নিষ্ঠুরতায় ঘেরা অদ্ভুত এক ঘোরের ক'টা দিন।

সেসময়টুকুর কথা আরেকদিন।


মন্তব্য

কুবের [অতিথি] এর ছবি

সিরিজ টা শেষ করেন না মাশীদ আপু :‌-( । খুবই আগ্রহ নিয়ে পড়তে ছিলাম।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।