পাখিটি মাটির, খাঁচাটি সোনার

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি
লিখেছেন মাসুদা ভাট্টি (তারিখ: সোম, ২৩/০৬/২০০৮ - ৯:১৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এক.
ওহ্ মাগো, আমি টের পাই, আমার মুখের ওপর ঝুর ঝুর ঝরছে মাটি; আমি একটি তরতাজা বিছানা বেয়ে উঠছি ওপরে, যদিও জানি না কোথায় যাচ্ছি ঠিক। একটা সমুদ্রও আমাকে ডাকে, ডাকে একটা ধারালো ছুরি, জানি না কার ডাকটা তীব্র, তুমি আমাকে এ দু’য়ের মধ্যে একজনের কাছে যেতে সাহায্য করতে পারো? মনে আছে, আমার সেই শুভ্র পোশাক, অথচ নেকাবটা ছিল কেমন দুঃখভরা, খসে যাচ্ছিলো বার বার, বেরিয়ে পড়ছিলো সবুজ চোখ আমার; সোনার খাঁচায় প্রবেশের পথটা খুব স্বচ্ছ আর মৌলিক ছিলতো, ছিল নাকি? মনে হয় পথটা শেষ হয়েছে নাকি পথটা আসলে শুরুই হয়নি, আমি নিজেই নিজেকে বলেছিলাম, তুমি একা কেন, এই বৃহন্নলা রাতে তুমি একা কেন? জানি, হাসিটা খুব সহজ, সহজ ঘৃণা করাটাও, ভদ্রস্থ হওয়াটাই আসলে কঠিন, বড্ড কঠিন।

আমি কি তবে একটি কবরের ভেতরে শুয়ে?

দুই.
রাতটা আমার চোখের সামনে খুলছে, দু’ভাগ হয়ে গ্যালো, বেরিয়ে এলো অদ্ভূত এক উষ্ণতা, দু’ঊরু বেয়ে নেমে যাচ্ছে রাত; আমি সুখী নই, আমার দুঃখও নেই।

তিন.
চোখ দু’টো হলুদ হয়েছে বলে স্বপ্নরাও পুরোপুরি হলুদ, অথচ মৃত্যুর আগে আর কোনও স্বপ্ন নেই বাকি, সব দ্যাখা, ছেনে-ঘেঁটে একাকার, নিশ্চুপ এবং ছাই রঙা; একা একা বাড়ি ফেরার কোনও মানে নেই, পথ যদি বেঁকে থাকে, যে কোনও মোড়ে বাড়ির পথ ছেড়ে ভিড়ের দিকে একটু হেঁটে গেলে যদি ভিড় ঠেলে ভালোবাসা আসে, তবে তাকে সাথে নিয়ে নাহয় বাড়ির পথ ধরা যাবে।

চার.
দরোজাটা ভয়ে ভয়ে খুলি, যদি বাইরে থাকে একটি গাছ, একটি বন কিংবা একটি যাদুময় শহর; একটি পথহারা কুকুরও যদি থাকে সামনে; অথবা একটি মুখ, মায়াময়; কুয়াশা কিংবা ধপধপে ভোর; শুধু অন্ধকার থাকলেও ক্ষতি কি, ভৌতিক বাতাসে শূন্যতাও থাকতে পার কিছুটা – আসলে ভুল করেছি, নির্মাণ করেছি তিনটি দরোজা একই সমান্তরালে, ভুলে গিয়েছিলাম সেই কথাটি, কখনও কেটো না তিনটে দরোজা একের পরে এক, হয়তো তার একটি দিয়ে ঢুকে যেতে পারে দুষ্টু দুর্যোগ, তোমার ঘরে এবং তোমার ভেতরেও।

পাঁচ.
তাহারা প্রার্থণারত, বাইরে স্তুপ করে রাখা জুতো, বোঝা যায় এই জুতো পায়ে তারা এসেছে, খুলে রেখে ঢুকে গেছে প্রার্থণালয়ে, এখন তারা চাইছে যার যা চাওয়া তাই, শুধু জুতোগুলো পড়ে আছে প্রাথর্ণালয়ের দরোজায়, যেখানে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, তবু তাদের চেহারায় সুখী ভাব, প্রার্থীর আকুতি নেই বলেই সুখ আছে, শূন্যের দিকে দু’হাত তাক করে কিছু চাওয়ার নীচুতা বাইরের এই জুতোগুলোকে ঠিক মানায় না।

ছয়.
দুঃখিত আমি মিথ্যে বলেছিলাম, এখানে কোনও সমুদ্র নেই, নেই মুক্তার দ্বীপ, নাই চকচকে চাঁদও; নুলিয়ারা এখানে ফিরে আসে খটখটে শুকনো জমি থেকে, অবশ্যই শিকারবিহীন; দুঃখিত আমি মিথ্যে বলেছিলাম বলে।

সাত.
আমার পূব চলে গেলো, পশ্চিমও গ্যালো, সামনেটা এমনকি পেছনটাও, চাঁদ গ্যালো, গ্যালো সূর্য, তারপর ধীরে ধীরে হারিয়ে গ্যালো ঈশ্বর; এখন আমার ভুরুর ওপর হাত রাখো, টের পাবে মস্তিস্কের উষ্ণতা, এখন আমি গাছ, একদম ওপরের ডাল হতে আমি স্পষ্ট দেখি, তোমার পায়ের চিহ্ন; আমার কোথাও যাওয়ার নেই, পৃথিবীর সমস্ত ঘড়ি এখন স্লথ, সময়ের সাথে দৌঁড়ে ওরা ক্লান্ত খুব; এখন খুব দেরি হয়ে গেছে আলাদা হওয়ার, হৃদয় ছেড়ে আলাদা হলে প্রাণে প্রাণের চিহ্ন থাকে না; তাকে শবদেহ বলে।

আট.
এখানে চুমো খাও, এখানে মেরেছিলেন মা; এখানে আদর করো, এখানে একদিন পড়ে গিয়ে পেয়েছিলাম ব্যাথা; এখানে চেটে দাও একটু, এখানে একটা লাল পিঁপড়ে কামড়েছিল; এখানে উষ্ণ শ্বাস ফ্যালো, একদিন নষ্ট রাত এখানে নোংরামি করেছিল একটুখানি; এখানে একটু ডলে দাও, এক ভয়ংকর জন্তু এখান থেকে খুবলে নিয়েছিল একতাল মাংস; আমার ওপর বিছিয়ে দাও তোমার শরীর, পুড়ে তামাদি হওয়ার আগে সবুজ করো, কীটনাশক ছিটিয়ে ছিটিয়ে আমাকে ওরা বন্ধা করে দিয়েছে প্রায়।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

এখন খুব দেরি হয়ে গেছে আলাদা হওয়ার, হৃদয় ছেড়ে আলাদা হলে প্রাণে প্রাণের চিহ্ন থাকে না; তাকে শবদেহ বলে।

অনেক ভাল লাগল।
-ইনান

কীর্তিনাশা এর ছবি

আমারো ভালো লাগলো খুব।

------------------------------------------
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে !

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

শ্যাজা এর ছবি

কেমন যেন লাগল। ধরা-অধরার মাঝখানে থেকে গেল যেন কিছু কথা, বার্তা..

একটু মন খারাপও হল। খারাপ ঠিক নয়.. যেন উদাসী এক বাতাস বয়ে গেল কম্প্যুটারের স্ক্রীন জুড়ে আর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে.. অনেক না বলা কথারা যেন একসাথে গুনগুন করতে শুরু করেছে কানের পাশে, মাথার ভিতরে..

দুরে কোথাও কী শোনা যায় কোন বাঁশীর করুণ সুর.. জানি না .. জানি না ..


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

ক্ষরণ! ক্ষরণই বুঝি একে বলে। লেখাটায় তাপ আছে।
শেষ অনুচ্ছেদটা অন্যরকম। থ্যাংকস।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

শেখ জলিল(ফিরে এসে) এর ছবি

লেখাটা মিস করেছিলাম। ফিরে এসে পড়লাম।
খুব ভালো লাগলো।

স্নিগ্ধা এর ছবি

মাসুদা - চমৎকার! এর চেয়ে বেশি কি বলা যায়, জানি না!

রণদীপম বসু এর ছবি

নিজস্ব ভাবনাগুলো অস্থির কষ্টকর হয়ে ওঠলে বোঝা আর না বোঝার মাঝামাঝি এমন আধো অস্পষ্টতায় মাখামাখি হয়ে যায় হয়তো।
মাত্র একবার পড়ে যা হজম হবার নয়।
ধন্যবাদ।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।