রক্তের ধারাপাত

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি
লিখেছেন মাসুদা ভাট্টি (তারিখ: শনি, ২৮/০৩/২০০৯ - ৯:০৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সুতরাং, তুমি শুনতে চাইলে শোনো, তোমার ইচ্ছে
আমি আমার বলার স্বাধীনতা সম্পূর্ণটুকুই প্রয়োগ করতে চাই। আমি সন্ত নই, আমি তাই কোনও বয়ান দিচ্ছি না।আমি বলছি, আমি যথার্থই চিৎকার করে বলবো, যাতে তোমার কানের ভেতরে তা পৌঁছে যায়।কারণ, অনেকেই বলে থাকেন যে, তারা আসলে কিছুই শোনেননি, আর শোনেননি বলেই, তারা জানেন না। এটা এক ধরনের দোহাই। বন্দুকের মতো, নিজেকে কয়েকটি ঝাঁকুনি দিয়ে আমি প্রস্তুত করেছি; আমাকে থামানোর কথা ভুলেও ভেবো না। গুলি একবার ভরা হলে তা বের হয় কাউকে হত্যারই জন্য। কারো হয়তো আমার কথা ভালো লাগবে না, ঠিক আছে, ভালো না বেসেও মানুষ সন্তান জন্ম দেয়, কি দেয় না? মানবিকতাকে উপছে যায় অশ্লীলতা; তখনতো চুপ থাকো, পৃথিবী ভরে গেছে এখন এই ভালোবাসাহীন সঙ্গমের ফসলে।আজ তারাই দাঁড়িয়ে তোমার-আমার ঘাড়ের ওপর, বোমা গ্রেনেড অথবা কালাশনিকভ হাতে।

২.
সেই-ই একমাত্র জানতো, তারাহীন আকাশের ওপাশে আসলে কি আছে। এবং
সেই-ই একমাত্র দাঁড়িয়েছিল, রক্তাক্ত প্রান্তরে, অসংখ্য খুনের পর নিজেও খুন হয়েছিল, এটা জেনে যে সে কেন লড়ছে; সে যা বিশ্বাস করতো তাকে প্রতিষ্ঠার জন্যই লড়েছে; তাকে কেউ শেখায়নি, পড়ায়নি, কেউ তাকে বলেনি যে, পড় তোমার প্রভূর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন; এই সব বুলি তারা জানা ছিল না।
কিন্তু এই-ই তিনি, যিনি এই পৃথিবীকে শব্দ দিয়েছেন, তাতে কোনও আবেগ ছিল না; কিন্তু সেই শব্দের অর্থ ছিল গভীর এবং ব্যাপক; এই বিশালত্ব ধারণ করার ক্ষমতা যার নেই, সে দয়া করে এসো না; লোকটিকে এগিয়ে যেতে দাও তারই মতো।

৩.
সৈন্যগণ, অস্ত্র নামিয়ে রাখো। অথবা ওগুলো ফেলে দাও সমুদ্রে। তোমাদের ওই অস্ত্রের প্রয়োজন নেই আর। এমনকি তোমরাও এখন অপ্রয়োজনীয়। যেহেতু আমাদের পরমাণু বোমা আছে, আছে পৃথিবীর আরেকপ্রান্তে নিশানা ঠিক করে আঘাত হানার শক্তিশালী মিসাইল। তোমাদের চেয়ে তারা দ্রুত। আসলে তোমাদের পোষা এখন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে; খাওয়ানো, পরানো, মৃত্যুর পর সৎকার করা; পাগল নাকি? এতোকিছু অসম্ভব। যাহোক, অস্ত্রগুলো ওখানে জমা করো; আমরা ওগুলো পাঠাবো জারদারি কিংবা কারজাইয়ের কাছে।না না আমরা পাগল নই, আমরা আমাদের স্বার্থ দেখছি কেবল। তোমাকে মাঝে মাঝে কঠিন হতেই হয়, প্রয়োজনটা যখন বাঁচা কিংবা মরার।

৪.
সেই তরুণ, যার ঠোঁটে বিপ্লবের কথা শুনেছিলাম, তার ফাঁসি কার্যকর হলো আজ। রজ্জু দেখেনি কেউ, যারা দাঁড়িয়েছিল তার বেদির পাশে।তবে হ্যাঁ, আশেপাশের বাতাসে মানুষেরা অসুস্থ আঁশটে গন্ধ পেয়েছিল, লালশার। কাঁচা সড়ক ধরে আসার পথে মানুষ ভাবছিলো, অহং আর মিথ্যের আড়ালে সত্যসব এভাবেই হাড়গোড় জাগিয়ে থাকে, যেমন করে আছে এই কাঁচা সড়কের ভেতর অতীত ইতিহাসের ভাঙা সব পোড়ামাটির টুকরো।
মানুষেরা বলে, আমরা স্বাধীনতা চাই; পুরোনো প্রার্থণা সঙ্গীতের মতো শোনায় এই চাওয়া।মানুষকে তখন আশাবাদী মনে হয় খুব। কিন্তু আমরা তখনও তরুণের ঠোঁটে, বিপ্লবকে ঝুলতে দেখি; সত্য জীবন আর আশার কথা বলা বিপ্লব; যাকে আসতেই হবে; রজ্জুহীন ফাঁসিতে ঝোলার আগে তরুণের ঠোঁট থেকে যা ছড়িয়ে পড়েছিল পথে, পথে, পথে।

৫.
আমাদের শরীর থেকে চামড়া পঁচা গন্ধ বের হয়, কেউ কি টের পান? পুরোনো অসংলগ্ন গানের মতো ছায়ারা যখন চোখের ঔজ্জ্বল্য সম্পূর্ণ কালো করে দেয়;মূর্খতার প্রতিধ্বনি ফিরে আসে দুর্গন্ধের মতো, পিছলে যায় মন থেকে মগজে। নোংরা বাঁদুড় যেনো বা রাতভর রক্ত চুষে ভোরের বাসি মুখ দিয়ে কথা বলছে, পাখা খুলে পা লাগিয়ে ওরা হাঁটে চেতনা জুড়ে। ফিসফিস করে ওরা প্রশ্ন করে, রক্ত চাই তোমার? পঁচা দুর্গন্ধময় রক্ত? এসো, এসো না! আমি পায়ে পায়ে হাঁটি, রক্তগন্ধ আমায় টানে খুব।

৬.
আমি বৃষ্টিকে ঝরতে দেখি, শিশুদের গাইতে শুনি, “ও বৃষ্টি আজ যা, আরেকদিন আসবি না হয়”। হঠাৎ দেখি ভয় পাওয়া শিশুরা দৌঁড়ে আসছে, জানতে চাই কী হলো?ওরা বলে, রক্তপাত হচ্ছে, বৃষ্টি নয়, এই প্রথম ভাবি বৃষ্টিপাত আর রক্তপাতে বেশ একটা মিল আছে। আমার গাইতে ইচ্ছে করে, “ও বৃষ্টি, ও রক্তময় বৃষ্টি, আজ যা, আরেকদিন না হয় আসবি”। শিশুরা ফিরে যায়; রক্তের ধারাপাত তবু থামে না।


মন্তব্য

কুঙ্গ থাঙ এর ছবি

... মুগ্ধতা রেখে গেলাম


প্রান্তিক জনগোষ্ঠিগুলোর ভাষা ও জাতিগত অস্তিত্বের সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও সমমর্যাদা দাবী করছি

তুলিরেখা এর ছবি

কী অসাধারণ লেখা!!!
শুভেচ্ছা রইলো।

-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

জেবতিক রাজিব হক এর ছবি

চমৎকার

ফারুক ওয়াসিফ এর ছবি

এই হলো লেখা, যা পড়লে বাংলা ভাষার শক্তি বোঝা যায়।

হাঁটাপথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে। হে সভ্যতা! আমরা সাতভাই হাঁটার নীচে চোখ ফেলে ফেলে খুঁজতে এসেছি চম্পাকে। মাতৃকাচিহ্ন কপালে নিয়ে আমরা এসেছি এই বিপাকে_পরিণামে।

নুরুজ্জামান মানিক এর ছবি

এই লেখার প্রতি ভাল লাগা প্রকাশ করার ভাষা খুজে পাচ্ছি না । ফারুকের সাথে তাল মিলিয়ে বলি 'এই হলো লেখা, যা পড়লে বাংলা ভাষার শক্তি বোঝা যায়। '

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

নুরুজ্জামান মানিক
*******************************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

শামীম রুনা এর ছবি

এক নি:শ্বাসে পড়ে ফেললাম। খুউব ভালো লাগলো।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

হাসান মোরশেদ এর ছবি

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

শক্তিশালী লেখা।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অতিথি লেখক এর ছবি

হৃদয়ের পরতে পরতে যে বোধের বসত,সেখানে সূচালো ঘায়ের আঘাত পেয়ে শিহরিত হলাম।

নীড় সন্ধানী [অতিথি] এর ছবি

গদ্যের পরতে পরতে কবিতার সুবাস। কবিতাই পড়লাম, নাকি? দারুনস!


অনেকেই বলে থাকেন যে, তারা আসলে কিছুই শোনেননি, আর শোনেননি বলেই, তারা জানেন না।

অনেকেই শোনে না। শোনেনা কারন তাদের ভেদবুদ্ধি বলে দ্যায় কোনটা শোনা উচিত কিংবা অনুচিত! পরম সুবিধাজনক শ্রোতা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।