যেদিন নরকের পথে হাঁটছি

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি
লিখেছেন মাসুদা ভাট্টি (তারিখ: সোম, ৩০/০৩/২০০৯ - ১১:০৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমরা যেদিন নরকের পথে হাঁটছি, মাথার ওপর পরিষ্কার আকাশ নিয়ে, পায়ের পাশে আগুন জ্বলছিলো তার ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য নিয়ে। ঈশ্বর সুন্দর সব পাখিদের লোহায় বদলে দিয়েছে বলে তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে; বৃষ্টির দিনে খড়ের গাদার মতো।আমাদের মধ্যে যাদের লোভ তীব্র, তারা শেষ সময় পর্যন্ত প্রহর গুনছিলো, এই বুঝি ঈশ্বরের মন বদলে যায়, তাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া হবে স্বর্গের পথে। এখানে সবুজ নেই, তারা পানির মতো রংহীন; আজকে সূর্যও নেই কোথাও, আজকে সেইদিন, যেদিন আমরা নরকের পথে হাঁটছি।পথে কোনও অশরীর দেখা পাওয়া গেলো না। তবে হাসি শুনতে পেলাম, মনে হলো তারা আমাদের কোনও অজানা দুঃখে হাসছে।কোনও এক অতীতে তারা ভবিষ্যতবাণী করেছিল, তোমাদের সব সরকার পড়ে যাবে, সব স্বপ্নেরা হবে কালো পাথরের মতো; প্রতিটি মহৎ পতাকা পুড়ে যাবে, মানুষের চোখ হবে মাটির, যার ভেতর স্বপ্নেরা প্রবেশের দরোজা খুঁজে পাবে না।পোড়া মাংসের উৎকট গন্ধে ভরে যাবে এই পৃথিবী; যদিও মাটির লাভ শুধু মাত্র হাড়গোড়, একসময় যায় সার হয়ে যাবে; দিতে পারে নতুন প্রাণের জন্ম। আমরা এইসব কথা স্মরণ করতে করতে হাঁটি, নরকের পথে।

দুই.
যুদ্ধদিনের মতো, লাইনে লাইনে সৈন্যরা যেমন করে দাঁড়ায়, আকাশের পরতে পরতে তেমন ধোয়া, কালো করে দিলো গোটা দিন। বিগত রাতে বন থেকে ধূসর প্রাণীরা বেরিয়ে এসেছিল, শীত সইতে না পেরে, তাদের কন্ঠে অভিশাপ ধ্বনিত হচ্ছিলো। তারা একসময় আমাদের বন্ধু ভেবেছিল, তারা ভুল করেছিল, বলাই বাহুল্য।

তিন.
- অতীত একাকীত্ব অথবা তার ছায়া যখন দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে ধেয়ে আসে তখন কী করো?
- তখন ঘর আঁধার করে মনের শিরা কেটে রক্ত সব বেরিয়ে যাবার সুযোগ করে দেই।
- তখন কি তোমার নিজের মুখও ভুলে যাও তুমি?
- আমার আয়না আমাকে কিছুই ভুলতে দেয় না; সে বড্ড একরোখা, পিছু হাঁটে আশ্বিনের কুকুরের মতো, পিঠের ওপরে চড়ে বসার আগ পর্যন্ত।
- তাহলে এসো, হাত ধরো, আমরা বিশাল এক ঝাড়বাতির তলে নৃত্য করি, অথবা কোনও গোপন দরোজা খুলে সিঁড়িতে বসে গল্প করি; সবচেয়ে ভালো হয় একে অপরকে জড়িয়ে ধরি।
- চলো; যদিও তোমায় আমি চিনেছি; তুমি আমার সেই বহু পরিচিত আয়না-ই।

চার.
সে প্রথমে গ্রীস্মের রং-এ একটি ছবি আঁকলো। তাদের দরোজা দিলো শীত-রঙা, জানালা বসন্তের; তারপর জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো তার তুলিটি; সে এখন শীত গ্রীস্ম এবং বসন্তকে সামনে নিয়ে বসে থাকবে ততোক্ষণ, যতোক্ষণ না শীত তাকে সম্পূর্ণ ছেড়ে যায়।

পাঁচ.
একটা সমুদ্র ছিল, জল শ্যাওলা কিংবা হাঙড় কিছুই ছিল না সেখানে; সেটা আসলে কিছুরই সমুদ্র ছিল না, শুধুমাত্র নামটি ছাড়া। অথচ সেই সমুদ্র-প্রণালী ধরে একটি জাহাজ চলে গেলো; যার পেছনে ভেঁপুর মতো শুধু কান্নার আওয়াজ পড়ে রইলো বালির ওপর জং ধরা নোংরটির মতো।

ছয়.
তারা ঋতুর মতো বদলায়, আমি আকাশের মতো, যেখানে সকালের সূর্য ধীরে ধীরে বুড়ো হয়, দাঁড়ি-জঙ্গলে দুপুর থেকে বিকেল হয় তারপর সন্ধ্যের একটু পুরে বুড়ো সূর্যের পুনর্জন্ম হয় নারীতে; সে হয়ে যায় চাঁদ- তারা আমায় তখনও ভালোবাসার কথা বলে, আমি তাদের সরিয়ে দিয়ে বলি – পাখি একাই থাকে, সঙ্গীরা তার নিস্তরঙ্গতায় কেবলই আঘাত করে।

সাত.
ছেড়ে দাও তাকে, সে ফিরে যাক গন্তব্যে, সে হয়ে যাক আকাশের কিংবা বাতাসের। পৃথিবী থেকে দূরে যাক সে কিংবা মৃত্যু থেকেও, অনাগত কাল সে পড়তে থাকুক, নভোমণ্ডলে যেমন তারা ছোটে অনন্তকাল ধরে; থেমে থাকা তাকে মানায় না, এই ক্ষুদ্রতা এই নীচুতা সব ছাপিয়ে সে – এই বিশ্বভরা বাতাস তার জন্য পর্যাপ্ত নয়; তাকে যেতে দাও এখানে সে বড্ড বেপথু। এখানে সৈন্যরা হুকুম তামিল করে, এখানে কুকুর খেয়েদেয়ে ফুলেফেঁপে ওঠে, সব যন্ত্র স্বপ্ন দ্যাখে মানুষ হওয়ার, শুধু মানুষ আর আকাশের মাঝে দূরত্ব কেবলই ছোট হয়, সোজা হয়ে দাঁড়ানোর জো থাকে না আর; এই ক্রমাগত ছোট হওয়া আর সহ্য হয় না।

আট.
প্রথমে আমায় দেখলে, আমিত্বকেও; তার পরে আমি যেভাবে দেখি, তা; কে জানে হয়তো আমার গভীরতাও দেখলে; আরও পরে যখন আমার ছবিটি শেষ হলো, তখন দেখলে এ আমি নই, অন্য কেউ, যাকে তুমিও চেনো না। তোমার নির্মাণের আমি আর এখন বৃষ্টির ঘ্রাণ পাই না; আমি তোমা থেকে ফেরার পথে আঁচলে ঢেকে মুখ ভেবেছি, দুঃখবোধ বলতে আসলে কিছুই নেই।

নয়.
তারা শষ্যের জন্য, একটি দুগ্ধবতী উটনীর জন্য, অথবা কেবলমাত্র একটি রুটির জন্য অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটিয়ে হত্যা করতো; নেকড়ের মতো তারা একে অপরের নারীদের গোপনাঙ্গ বিদীর্ণ করতো; তাদের দীর্ঘ চুল দিয়ে কিংবা ঘোড়ার লেজ থেকে চুল ছিড়ে নিয়ে বেহালার ছড় বানাতো ওরা; পুরোনো সেই বইয়ে লেখা আছে এরকম বহু কাহিনী; কোনও এক ধূর্ত প্রেরিত পুরুষ তাকে ঐশ্বরিক-এর মিথ্যা দরোজা দেয়।

দশ.
এনে দিতে পারো ম্যাগনোলিয়ার রেণু, ফল হলেও হতে পারতো যা, আজ ইউফোরিয়ার কথা বলেছিলাম, তাও নীল শিশি ভরে রেখে দেবো ম্যাগনোলিয়ার সঙ্গে, আত্মার মতো; আমার নগ্ন শরীরে হাত বুলোতে বুলোতে কোনও এক শরতে বাদামী রোম-এ ম্যাগনোলিয়ার আরক তোমার চুমুতে উঠে আসবে, জিভ ভরে উঠবে ভালোলাগার মিষ্টিতে; এনে দাও ম্যাগনোলিয়া – এখন তা খুবই সহজপ্রাপ্য।


মন্তব্য

তুলিরেখা এর ছবি

অসাধারণ লেখা! সেলাম জানিয়ে যাই।

-----------------------------------------------
কোন দূর নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

-----------------------------------------------
কোনো এক নক্ষত্রের চোখের বিস্ময়
তাহার মানুষ-চোখে ছবি দেখে
একা জেগে রয় -

সুমন সুপান্থ এর ছবি

বার কয়েক পড়লাম মাসুদা আপা ।
আবার সেই রশ্মি ছড়াতে লাগলো ! যেন পড়ছি আরেকটা 'গোডাউন' !
ভালো লাগা জানিয়ে গেলাম ।

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

---------------------------------------------------------
তুমি এসো অন্যদিন,অন্য লোক লিখবে সব
আমি তো সংসারবদ্ধ, আমি তো জীবিকাবদ্ধ শব !

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

মাই গড !
দুর্দান্ত এই লেখার প্রতিক্রিয়া জানানোর ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।
আমার প্রণতি...

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।