ব্যর্থ অপ্রাকৃত গল্প : কবীর সাহেবের টেনশন

মৃদুল আহমেদ এর ছবি
লিখেছেন মৃদুল আহমেদ (তারিখ: সোম, ০৯/০৬/২০০৮ - ৬:২৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বুড়ো বয়সে মানুষের টেনশন করার স্বভাব বেড়ে যায়।
কবীর সাহেবের বয়স সত্তরের কাছাকাছি। এই বয়সে তাঁর মূল কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে সব বিষয় নিয়ে টেনশন করা।
সকালে খবরের কাগজ আসতে দেরি হলে তিনি টেনশন করেন, ঘরের ফ্যান কটকট আওয়াজ করতে থাকলে তাঁর বুক ধড়ফড় করে, মনে হয় এই বুঝি সেটা খুলে মাথার ওপর পড়ল! আকাশে হালকা মেঘ জমতে দেখলেই তাঁর মনে হয় এইবার বোধহয় সাঙ্ঘাতিক বৃষ্টি হয়ে দেশে বন্যা হয়ে যাবে, তরিতরকারির দাম বেড়ে যাবে, হাঁটুপানি ভেঙ্গে বাজারে গিয়ে আগুনদামে জিনিস কিনতে হচ্ছে--এই দৃশ্য কল্পনা করে তাঁর হার্টবিটের পরিমাণ তিনগুণ হয়ে যায়।
এইভাবেই আকাশ-ফুল-ফল-পাখি-গাছপালা-কাগজ-কলম-তেলাপোকা-হাতি-সার্ট-প্যান্ট-গেঞ্জি-কাপ-পিরিচ-টেবিল-চেয়ার সমস্ত বিষয় নিয়ে তাঁর টেনশন করা স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু টেনশন হলে কোনো ক্ষতি ছিল না, কিন্তু এর অনেকটা দায় পোহাতে হয় তাঁর একমাত্র ছেলে আসিফকে।
কবীর সাহেবের স্ত্রী অনেক আগেই মারা গেছেন। ঘরে আর মহিলা বলতে কেউ নেই, একটা কাজের মেয়ে এসে রোজ রান্না করে দিয়ে যায়। আসিফ একটা এনজিওতে কাজ করে, তাকে কাজের জন্য সারাদিন বাইরে বাইরে থাকতে হয়, মাঝেমধ্যে ঢাকার বাইরেও যেতে হয়। ঢাকার বাইরে যাবার আগে ঘরের সব বাজারটাজার করে দিয়ে যাবার দায়িত্ব তার।
কবীর সাহেব এই নিয়েও টেনশন করেন এবং সারাদিন বকবক করতে করতে আসিফের কান ঝালাপালা করে ছাড়েন। আগামিকালই আসিফের যশোরে যাবার কথা, সেখানে সে দিনদুই থাকবে। যাবার আগে সে যেন অবশ্যই চাল-ডাল-রসুন-পেঁয়াজ রাতে ফেরার পথে ঠিকমতো বাজার করে নিয়ে আসে--কবীর সাহেব এই নিয়ে আজ সকাল থেকেই কটকট করতে করতে আসিফকে অতিষ্ঠ করে ফেলেছেন।
আসিফ তার বাবাকে অন্তত বারপাঁচেক বলেছে--বাবা, কোনো অসুবিধে নেই, আমার খেয়াল থাকবে, আমি ফেরার পথে ঠিকমতোই বাজার করে নিয়ে আসব!
কবীর সাহেব তবু বললেন, না না, এটা খুব ক্রিটিক্যাল একটা ইভেন্ট, ভেবে দেখেছিস, তুই বাজার করে দিয়ে গেলি না, আর তারপর আমি একলা এখানে কী বিপদের মধ্যে পড়ে যাব? কাজের মেয়েটা একটা চোর, তাকে বাজারে পাঠালে একগাদা চুরি করবে, এসে বলবে যে, খালু, বাজারে আগুন লাগছে, সব ট্যাকা খরচা হইয়া গ্যাছে, শেষে আলুর দোকানে ধার করছি! ...আর আমার খাওয়াদাওয়া--আমার খাওয়াদাওয়ারও তো প্রবলেম হয়ে যাবে! না না, তুই কিন্তু ফেরার পথে একদম ভুলে যাবি না, অবহেলা করিস না, বুড়োমানুষটার খাওয়াদাওয়ার দিকে একটু নজর রাখিস, বুড়ো বয়সে একা...
আসিফের খুবই মায়া লাগে। শেষ বয়সে বাবা কীরকম অসহায় আর পাগলের মতো হয়ে গেছেন। একই কথা এর মধ্যে তিনি অন্তত বারদশেক বলে ফেলেছেন, তাঁর খেয়ালও নেই। আর তিনি এটা ভাবেনই বা কেমন করে যে তাঁর ছেলে তাঁর জন্য ভাববে না, তাঁর জন্য বাজার করতে ভুলে যাবে? এটা কি ভুলে যাওয়ার মতো কোনো ব্যাপার? তিনি কি তাঁর জন্য আসিফের ভালোবাসাটা টের পান না?
এরকম একটা অবস্থার মধ্যেই মন খারাপ ভাব নিয়ে আসিফ সকালে বেরিয়ে গেল। তার ফেরার কথা রাত আট-নয়টার মধ্যেই, রোজ এরকম সময়ের মধ্যেই সে ফেরে। কিন্তু সে বেশ রাত করে দশটার দিকে ফিরল। কবীর সাহেব পাশের ঘরেই ছিলেন, প্রতিদিনের মতোই চেয়ারে হেলান দিয়ে খবরের কাগজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছিলেন। চাবি দিয়ে দরজার ইন্টারলক খোলার আওয়াজ পেয়ে তিনি বললেন--কে? আসিফ?
পাশের ঘর থেকে খুব অস্পষ্টভাবে, প্রায় শোনা যায় না এরকমভাবে আসিফ বলল--হ্যাঁ!
কবীর সাহেব বকবক করতে লাগলেন, হ্যাঁ, তুই এরকম রাত করে ফিরলি, আমি তো সেই কখন থেকে টেনশন করছি! আজকাল ঢাকার রাস্তার যে অবস্থা, কার কখন কী হয় বলা যায়? কালকে আবার যাবি ঢাকার বাইরে, তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া করে কোথায় আগে আগে শুয়ে পড়বি, তা না, ফিরলিই রাত দশটা বাজিয়ে! বাজারগুলো করেছিস কিনা কে জানে, তোর তো ভুলে যাওয়ার স্বভাব...
আসিফ কোনো শব্দ করল না। খুব ক্লান্ত হয়ে এসেছে বোধহয়।
কবীর সাহেব ভেতরের ঘরে বসে বসে তার আওয়াজ পেতে লাগলেন। সে টেবিলের ওপর ঝনাত করে চাবির গোছা রাখল, শব্দ করে জুতার তাকের দিকে হেঁটে গেল, জুতো খুলে রাখল, জামাকাপড় খুলে আলনায় রাখল, আলনার সঙ্গে দেয়ালের দেয়ালে হালকা ধাক্কা লাগল, তারপর টেবিলের ওপর জগ থেকে শব্দ করে গ্লাসে পানি ঢালল, পানি খেয়ে টেবিলের ওপর ঠক্ করে গ্লাস রাখার শব্দ হল।
একটু পরেই বাথরুম থেকে হাতমুখ ধোয়ার ছলাত ছলাত শব্দ আসতে লাগল।
এখন বেশ ঠাণ্ডা পড়ে গেছে, বেশি পানি গায়ে লাগালে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে, পরে যশোরে গিয়ে আবার জ্বরে পড়ে যায় কিনা, বকবক করতে করতেই এই নিয়ে কবীর সাহেবের একটা টেনশন হল। তিনি ভাবলেন, আসিফকে গিয়ে মানা করে আসবেন আর বেশি পানি গায়ে লাগাতে...
পেপারটা নিয়ে পাশের ঘরে আসতেই বাথরুমে ছলাত ছলাত শব্দটা থেমে গেল। কবীর সাহেব একটু থমকে গেলেন। তাঁর কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। মনে হল, চারপাশে সবকিছু হঠাত্ কেমন যেন শুনশান হয়ে গেছে। একটা ঘরের ভেতর ভীষণ হই-হট্টগোল করতে করতে সবাই একসঙ্গে চুপ হয়ে গেলে যেরকম লাগতে থাকে।
ঘরের লাইট নেভানো, ঘর অন্ধকার, চারপাশে কেমন ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা। এর মধ্যে কীরকম একটা অদ্ভুত চিন্তা তাঁর মাথায় এল। তাঁর কেন যেন মনে হল সারা বাড়িতে এ মুহূর্তে তিনি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো লোক নেই। একটু আগেও কেউ ছিল না। তাঁর কেন এরকম মনে হল বুঝলেন না। কিন্তু তাঁর একটু ভয় ভয় করতে লাগল!
কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি ডাকলেন দুবার--আসিফ, আসিফ!
কেউ শব্দ করল না। কবীর সাহেব তাড়াতাড়ি বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। বাথরুম অন্ধকার, দরজা বন্ধ। এখানে কেউ আসে নি।
তিনি আবার ছুটে বাইরের ঘরে গেলেন। লাইট জ্বাললেন। না, আলনায় আসিফের খুলে রাখা জামাকাপড় নেই, সে সকালে কী পরে বেরিয়েছে এখনও মনে আছে তাঁর। জুতার তাকে জুতাও নেই--আসিফ কি তাহলে আসে নি? কিন্তু তিনি তাহলে কিসের আওয়াজ শুনলেন এতক্ষণ? স্পষ্ট শুনলেন তার পানি খাওয়ার শব্দ, টেবিলের ওপর গ্লাস রাখার আওয়াজ। টেবিলের ওপর চাবির গোছা রাখার শব্দও তিনি পেয়েছেন। টেবিলের ওপর যথারীতি কোনো চাবির গোছা নেই।
কিন্তু টেবিলের ওপর একপাশে কাগজের প্যাকেটে মোড়া ওগুলো কী?
কবীর সাহেব তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে সেগুলোয় হাত দিলেন। প্যাকেট করা চাল, ডাল, রসুন, পেঁয়াজ। এগুলো এখানে কে আনল? আসিফ কি তাহলে এসব এনে ঘরে রেখে আবার বাইরে গেছে? কখন গেল?
কবীর সাহেব এবার গলা ফাটিয়ে ডাকলেন--আসিফ, আসিফ!
তারপর তিনি পাগলের মতো দরজা খুলে নিচে রাস্তায় নেমে এলেন। শীতের রাত, দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে। অন্ধকার রাস্তার মধ্য দিয়ে তিনি প্রায় দৌড়ে গেলেন। বিশ্বরোডের মাথায় এসে থমকে দাঁড়ালেন। গাড়িঘোড়া বলতে গেলে কিছুই নেই, কোনো মানুষজনও দেখা যাচ্ছে না, শুধু মাঝেমধ্যে প্রচণ্ড শব্দ করে পাগলের মতো ছুটে যাচ্ছে দানবীয় ট্রাক। সেই নির্জনপ্রায় সড়ক ধরে তিনি পাগলের মতো ছুটতে লাগলেন...

গভীর রাতে কবীর সাহেবকে কয়েকজন মানুষ ধরে হাসপাতালে নিয়ে গেল। তিনি রাস্তার একপাশে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলেন। হাসপাতালে জ্ঞান ফিরে পেয়ে তিনি আসিফকে খুঁজতে লাগলেন। বিছানার কাছে পাড়ার প্রতিবেশী যারা বসে ছিলেন, তাঁরা নানা কথা বলে তাঁকে বোঝাতে লাগলেন।
আসল খবরটা তাঁরা আর ভাঙ্গলেন না। আসিফের কলিগরা এসে খবর দিয়ে গেছে, আসিফ অফিসের এনকোয়ারির কাজে বেরিয়েছিল, মগবাজারের মোড়ে অফিসের গাড়িতে বসে থাকা অবস্থাতেই সে মারা যায়, একটা ট্রাক ভয়াবহ ধাক্কা দিয়ে গাড়িটাকে দুমড়েমুচড়ে ফেলেছিল!
তবে যেহেতু অফিসের কাজে থাকা অবস্থায় সে মারা গেছে, সেহেতু সে মারা যাবার পর অফিস তার পরিবারের দায়ভার বহন করবে। কবীর সাহেবের চিকিৎসা বা অন্য কোনো ব্যাপারে সমস্যা হবে না।
অবশ্য শেষপর্যন্ত খবরটা কবীর সাহেবের কাছে চেপে রাখা গেল না।
খবরটা জানার পর তিনি একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কিছুদিন কারো সঙ্গে কোনো কথাই বললেন না, তারপর তাঁর মস্তিষ্কবিকৃতি দেখা দিল। কাউকে দেখলেই তিনি জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা, ঐ যে চাল-ডাল-পেঁয়াজ-রসুন, ওগুলো এল কী করে?
সবাইকে শুধু এই একটাই প্রশ্ন করেন। তাঁর এই চাল-ডাল সংক্রান্ত প্রশ্নের সবাই একটাই মানে করল, সবাই মনে করল তিনি পুরোদস্তুর পাগল হয়ে গেছেন। তাঁকে মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হল।
এরপর কবীর সাহেব আর বেশিদিন বাঁচেন নি। মারা যাবার কিছুদিন আগে সেখানে এক বয়স্ক ডাক্তার নরম গলায় তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, চালডালের কথা কী বলছেন কবীর সাহেব?
কবীর সাহেব এর জবাবে বড় বড় চোখে ফিসফিস করে যা বলেছিলেন, ডাক্তার তার কোনো মানেই খুঁজে বের করতে পারেন নি।
তিনি যে কথাগুলো বলেছিলেন, তা অনেকটা এরকম : টেবিলের ওপর ঝনাত--ঠিক আছে ভুল, বাথরুমে হল ছলাত--ঠিক আছে ভুল, টেবিলের ওপর হল ঠক্--ঠিক আছে ভুল--কিন্তু চাল-ডাল-রসুন-পেঁয়াজ--ওগুলো এল কী করে?

(গল্পটি বেশ আগে লেখা। বছর সাত-আট হবে। বোনদের বিয়ে আর বড় ভাইয়ের ট্রান্সফার হয়ে যাবার পর তিনরুমের বেশ বড়সড় একটি বাড়িতে থাকতাম আমি আর আমার নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ পিতা। আমি সারাদিনের জন্য বাসা থেকে বেরিয়ে যাবার পর সেই বৃদ্ধের সময় কাটানোর জন্য দৈনিক পত্রিকা, টিভি এবং টেবিলের ওপর রাখা ঠাণ্ডা খাবার ছাড়া আর কিছু থাকত না। সেই সময় এই গল্পটির প্লট আমার মাথায় আসে। গল্পটি পড়লে কোনো ধরনের অপ্রাকৃত আবহের বদলে যেটি তৈরি হয়, সেটি হচ্ছে কবীর সাহেবের প্রতি একটি অস্থির মমতা। গল্পটি এখন পর্যন্ত যতবার পড়েছি, ততবারই আমার একই অনুভূতি কাজ করেছে। আমার ধারণা, কবীর সাহেবের ভেতরে আমার বাবাকে খুঁজে পাই বলেই এ ব্যাপারটি ঘটে।
এই ব্যাপারটা ভালো করে জানার জন্য আপনাদের মতামত শোনার অপেক্ষায় রইলাম।
বাবার প্রসঙ্গ আসায় আরেকটু বলতে ইচ্ছে করছে। ৯৬-৯৭-এর দিকে ঢাকা ক্লাব আর রমনা পার্কের মাঝামাঝি রাস্তার পাশে একটি বিশাল গাছ দেখতে পেতাম, যার ফুল আমি চিনি না। কিন্তু সেই রাস্তা দিয়ে আমি যখনই যেতাম, বিকেল অথবা দুপুরের রোদে ঝলমলে সেই গাছ দেখে মুগ্ধ হতে তাকিয়ে থাকতাম। মনে মনে নমস্কার জানাতাম তাকে। সারাজীবনে এত রূপবান ফুল ফোটা গাছ আমি কখনো দেখি নি। সে এতই মুগ্ধতা জাগিয়েছিল যে, আমি কখনো কাউকে জিজ্ঞেস করে জেনেও নিই নি সেটা কী ফুল। অচেনার দূরত্ব দিয়ে তাকে মহান করে রাখতে চেয়েছিলাম।
কয় বছর বাদেই দেখি সেই গাছটি নেই। কে বা কারা তাকে কেটে ফেলেছে।
অসীম মুগ্ধতার সেই গাছটির মতো আমার বাবাও একদিন দেখি আমার পাশে নেই। তিনিও ছিলেন ঐ গাছটির মতো আমার সমস্ত মুগ্ধতা এবং মমতা কেড়ে নেয়া এক পুরুষ। সব পুত্রের কাছেই তার পিতা একজন অসামান্য মানুষ। কিন্তু তিনি ছিলেন তারও বেশি। অসম্ভব প্রতিভাবান এই মানুষটি অনেক বড় সামাজিক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠা পেতে পারতেন। কিন্তু তিনি জীবন পার করেছেন সাধকসুলভ ঔদাস্য দিয়ে। উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি একটি জিনিসই দিয়ে গেছেন আমাদের চার ভাইবোনকে, মানুষকে ভালোবাসার যে প্রদীপ জ্বালিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের বুকের ভেতরে, অন্তত আমি টের পাই আজও তা টিমটিম করে জ্বলছে আমার মনের মন্দিরে। তার কাছ থেকেই আমি শিখেছি কী করে আকণ্ঠ ভালোবাসতে হয়।
কোনো মানুষই একবারে মারা যায় না, তাদের একটু একটু করে মৃত্যু ঘটে প্রিয়জনদের মৃত্যুদর্শনের মধ্য দিয়ে।
আমার সুবিশাল একটি মৃত্যু ঘটেছে আমার বাবার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।
তিনি নেই, আছে শুধু স্মৃতিটুকু। আর আছি আমি এবং আমার এই হাস্যকর আধিভৌতিক গল্প।)


মন্তব্য

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

মৃদুল ভাই, কি বলব বুঝতে পারছি না। একটা কথা ঠিকই বলেছেন, গল্পটা পড়ে ভয় পাবার বদলে কবির সাহেবের প্রতি একরকম মমতা জাগছিল। গল্পে নতুন মাত্রা যোগ করেছে আপনার লেখা শেষ অংশটুকু।
বছর তিনেক আগে আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর বাবা মারা যান। আমার এখনো মনে আছে, আমি এতই কাঁদছিলাম যে কিছু লোক ভেবেছিলেন যে আমিই মৃতের ছেলে! এই কথাটা বললাম কারণ আপনার কষ্টটা মনে হয় কিছুটা বুঝতে পারছি। আপনার লেখার বৈচিত্র আমাকে রীতিমত মুগ্ধ করেছে। আরো অনেক চমৎকার লেখার প্রত্যাশায়...

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

ধন্যবাদ। আমরা আসলে বড় নরম মনের মানুষ। এত ভালোবাসা এবং মমতাভরা মন নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকা উচিত নয় মানুষের।
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

লুৎফুল আরেফীন এর ছবি

আমাকে লোক হাসানোর ঠিকাদারী নিতে বলে আপনি কি কাঁদানোরটা নিলেন নাকি?!

লেখা জাঁদরেল হয়েছে। আপনার বাবার প্রতি ভালোবাসা।

___________________________
বুড়োরা সবাই সমস্বরে বললো, "নবজন্ম", আমি চাইলাম "একটা রিওয়াইন্ড বাটন"

ক্যামেলিয়া আলম এর ছবি

এখন আমার বাবার প্রতি জন্মদিনে উইশ করাটা আমার কাছে এক ভয়ংকর শব্দ বলে মনে হয় _
অনেক ভাল লিখেছেন আপনি------
.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........

.....................................................................................
সময়ের কাছে এসে সাক্ষ্য দিয়ে চ'লে যেতে হয়
কী কাজ করেছি আর কী কথা ভেবেছি..........

অনিন্দিতা এর ছবি

এত মমতা দিয়ে কিভাবে লিখেন বলেন তো?

স্নিগ্ধা এর ছবি

মৃদুল - আপনার লেখনী নিয়ে কিছু বলা আমি ছেড়ে দিয়েছি আগেই, কারণ নতুন করে আর কিছু বলার নেই। বরং আপনার লেখার বিষয় নিয়ে আজকাল কথা বলি।

আমার চোখের সামনে আমার মা বাবাকে আস্তে আস্তে বয়সের কাছে নুয়ে যেতে দেখেছি - তাঁদের প্রাণপণ যুদ্ধ সত্ত্বেও। আমার যে মা আমাকে নিয়ে বলা যায় 'অন্ধ' ছিলো, সে মা তাঁর শেষের একবছর আমাকে চিনতে পারেনি। আমার দেশে যাওয়ার প্রধান আকর্ষণ ছিলো আমি আম্মাকে দেখবো আর আমাকে দেখে আম্মার উজ্জ্বল হয়ে ওঠা চেহারাটা দেখবো। সেবার দেশে গিয়ে 'ঐ আম্মা'কে দেখে আমার মনে হয়েছিলো আমার সমস্ত শৈশব, আমার অনেকখানি আমিত্ব, আমার জীবনের একটা বড় অংশ চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল।

তবে জীবন ব্যাপারটাই বেশ মজার। যখন মনে হয় - "এত দুঃখের একটা ঘটনা আমার জীবনে কি করে ঘটলো!" তখন দেখা যায় সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত দিক থেকে জীবন এমন একটা 'টোকা' দিয়ে যায়, যে আর কিছু করার না পেয়ে আমি হাসি! সত্যি হাসি। আর 'মৃত্যু' কে এখন আমি অন্যভাবে দেখি - এটাকে আর কিছুতেই 'খারাপ' একটা ব্যাপার বলে মনে হয় না! আত্মা বলে কিছু না থাকুক, পরকাল বলে কিছু না থাকুক, আমাদের এত এত প্রিয়জন যে পরিণতির মধ্য দিয়ে গেছে তাকে 'শেষ' না ভেবে বরং আপন ধরনের একটা পারিবারিক get together ভাবতেই আমার বেশী ভালো লাগে হাসি

আপনাকেও তাই বলি - আপনার বাবা রয়ে তো গেছেনই, আপনাদের মধ্যে?

আমি সবসময়ই মনে করি - চলে গেলেই কি আর চলে যাওয়া হয়?? এতই সোজা ?

সৈয়দ আখতারুজ্জামান এর ছবি

কী বলবো! ভাষা নেই।

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি একটি জিনিসই দিয়ে গেছেন আমাদের চার ভাইবোনকে, মানুষকে ভালোবাসার যে প্রদীপ জ্বালিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের বুকের ভেতরে, অন্তত আমি টের পাই আজও তা টিমটিম করে জ্বলছে আমার মনের মন্দিরে।

এর চেয়ে বড়ো সম্পদ আর কী হতে পারে, মৃদুল?

মুগ্ধতা জানিয়ে গেলাম।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মৌমাছির জীবন কি মধুর? চিন্তিত

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব কষ্টেরও একটি প্রতিদান আছে।
অধিক শোকে পাথর।
তার আরেকদিক হচ্ছে সে নিজের অজান্তেই একটি গোছানো মানসিকতার অধিকারী হয়ে উঠে। ধন্যবাদ।
-জুলিযান সিদ্দিকী

নুশেরা তাজরীন এর ছবি

প্রথম কয়েকলাইন পড়েই কেন যেন মনে হচ্ছিল নিজের বাবার ছবিই আঁকছেন লেখক। পরম মমতায়।
এমন বাবা আর ছেলেকে অসীম শ্রদ্ধা।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনি খুব ভালো লেখেন মৃদুল। কদিন ধরে আপনার পেছনের লেখাগুলোও পড়েছি। সচলে আমি হয়ত অতিথি আছি কিন্তু সাহিত্যে তো আর তা নই, অসংখ্য লেখা পড়েছি এই বয়সের ভারে নুয়ে পড়তে পড়তে। আপনার পেশা কি, আমি জানি না। তবে আপনার এক মাত্র পেশা কি হওয়া উচিত - সে আমি চোখ বুজে বলে দিতে পারি।
আপনার জন্য শুভাশীষ।

পরশ পাথর

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

ধন্যবাদ সবাইকে। গল্পটি নতুন করে পড়তে গিয়ে খুব আবেগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম। বাবার কথা লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছিল, তাঁকে কতটা ভালোবাসি সেটা না বোঝাতে পারলে এই লেখা অর্থহীন। কারো যদি মন খারাপ করে দিয়ে থাকি, সেজন্যে দুঃখিত। তবে আমি জানি, আমার বন্ধুরা এই লেখা পড়েছেন অপরিসীম ভালোবাসা নিয়ে। যে ভালোবাসার উত্তাপ আমি টের পাচ্ছিলাম লেখা পোস্টের আগেই। আসলে যা আমি সবসময়েই টের পাই...
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

আকতার আহমেদ এর ছবি

আপনার লেখাটা কয়েকবার পড়েছি বস । কিন্তু কী মন্তব্য করবো বুঝতে পারছিলামনা বলে করা হয়নি । আপনার লেখার শক্তি সম্পর্কে নতুন করে কিছুই বলার নাই । নিয়মিত লিখবেন - এই দাবী থাকল!
ভালো থাইকেন বস !

রানা মেহের এর ছবি

অদ্ভুত সুন্দর।
বোধহয় আমাদের সবার বাবা - মায়ের গল্প
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

অতিথি লেখক এর ছবি

সাধারণতঃ বাবা-মাকে নিয়ে লেখা যেকোন লেখাই বড্ড স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে। পড়লেই চোখের কোণা ভিজে আসে। কিন্তু আপনার লেখাটি এবং পরের বর্ণনাটি বড় গভীর হয়ে বুকের মাঝে আটকে রইলো। অনেকদিন আগে আর একজনেরএমনই একটি লেখা পড়েছিলাম।
আপনার মন এবং লেখার হাতটি বড় মায়াময়। কষ্ট পাবেন অনেক এই জীবনে। শুভেচ্ছা রইলো।

মৃদুল আহমেদ এর ছবি

আপনার নামটা কিন্তু বললেন না! ভালো থাকবেন।
---------------------------------------------
বুদ্ধিমানেরা তর্ক করে, প্রতিভাবানেরা এগিয়ে যায়!

--------------------------------------------------------------------------------------------
বললুম, 'আমার মনের সব কপাট খোলা ভোজরাজজী। আমি হাঁচি-টিকটিকি-ভূত-প্রেত-দত্যি-দানো-বেদবেদান্ত-আইনস্টাইন-ফাইনস্টাইন সব মানি!'

তিথীডোর এর ছবি

এই গল্পের কথা নেক্সট অনেকদিন মনে থাকবে!

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

দেবদ্যুতি এর ছবি

কবীর সাহেবের জন্য ভালোবাসা, আপনার জন্যও। আমাদের গ্রামের বাড়িটায় আমার বাবা আর মা থাকে শুধু, মার চাকুরির কারণে বাবা প্রায় সারাটাদিন একাই। কবীর সাহেবকে বোঝা তাই আমার জন্য একটু সহজ।

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।