দুঃখিত, শর্মিলা বোস, গ্রহন করা গেলনা (শেষ পর্ব)

জ্বিনের বাদশা এর ছবি
লিখেছেন জ্বিনের বাদশা (তারিখ: সোম, ২১/০১/২০০৮ - ৩:০৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
*****************************************
ড. বোস তাঁর প্রবন্ধে পাঁচজন বাংলাদেশী প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ ব্যবহার করেছেন, এবং এই পাঁচটি বিবরণকে দূর্বল হিসেবে দেখিয়ে তিনি উপসংহার টেনেছেন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস সংকলনে যে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য/বক্তব্য নেয়া হয়েছে তার অধিকাংশেরই বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। এখানে যে বিষয়টি তিনি অপরিস্কার রেখেছেন, তা হলো, ঠিক কিভাবে তিনি এই পাঁচজনের বক্তব্যকে তাঁর প্রবন্ধের সাবজেক্ট হিসেবে নির্বাচন করেছেন। এটা কি এমন যে তিনি স্বাধীনতার ইতিহাসের সংকলন যাবতীয় বই থেকে যেকোন পাঁচটি সাক্ষ্যকে প্রতঃমে বাছাই করেছেন, এবং তারপর সেগুলোকে পরীক্ষা করেছেন? নাকি তিনি কয়েকশ' সাক্ষ্য পড়ে শুধু এই পাঁচটিতেই অসঙ্গতি পেয়েছেন বলে এগুলোকে তুলে ধরেছেন? যেকোনটিই তো হতে পারে। একজন গবেষক এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে ধোঁয়াটে করে উপস্থাপন করেছেন কেন?
ড. বোসের প্রবন্ধে উপস্থাপিত এই পাঁচটি সাক্ষ্যকে মিথ্যে বা সন্দেহজনক প্রমাণ করতে গিয়ে তিনি যে যুক্তিপদ্ধতি অনুসরন করেছেন সেখানেও আমার আপত্তি আছে। আমরা জানি যে লেখক আর পাঠকের মাঝে একটা "পারসেপশন ডিফারেন্স" সবসময়েই থাকে, এবং সেই ডিফারেন্সটুকুর কারণে লেখক যা বুঝিয়েছেন পাঠক তা নাও ধরতে পারেন। সেজন্যই ৩৫ বছর আগে দেয়া এরকম সাক্ষ্যকে বিচার করতে গেলে তাঁর উচিত ছিল এই সাক্ষ্যদাতাদের অথবা সাক্ষ্যগ্রহীতাদের সাথে যোগাযোগ করে ক্রসচেক করে নেয়া। যেজন্য একথাটি বলছি, তা হলো, ডক্টর বোস তার প্রবন্ধে উপস্থাপিত পাঁচটি সাক্ষ্যপ্রমাণে যে অসঙ্গতিগুলো ধরেছেন তার সবগুলোকেই ঐ "পারসেপশন ডিফারেন্স"-জনিত বলে মনে হয়েছে। এটা এজন্যও হতে পারে যে, সত্যিকারের কোন অসঙ্গতি পাননি বলেই তিনি এরকম সুক্ষ্ম অসঙ্গতিগুলোকে তুলে ধরেছেন, যাতে কনফিউশন তৈরী হয়। অনেকটা গায়ের জোরেই এই পাঁচটি বক্তব্যকে মিথ্যে হিসেবে দেখিয়ে তিনি দাবী করে ফেলছেন যে ৭১ এ রেপভিকটিমের সংখ্যা ২ লাখ তো নয়ই বরং কয়েক হাজার মাত্র!
ঠিক কোন লজিকে পাঁচটি মাত্র বিবরণকে দুর্বল হিসেবে (তাও গায়ের জোরে, এই লেখারই পরবর্তী অংশে সে বইষয়ে বিশদ আলোচনা করা হবে) দেখিয়ে একজন এরকম একটি বিশাল ঘটনার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারেন সেটা দূর্বোধ্য।

যে যুক্তিগুলো দিয়ে তিনি পাঁচটি বক্তব্যকে খন্ডন করতে বা দূর্বল হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন, সেই যুক্তিগুলো এখানে আলোচনা করব। পাঠকমাত্রেই বুঝতে পারবেন, এধরনের যুক্তি আদালতে বাজে উকিলরা ব্যবহার করেন সাক্ষ্যদাতা/বাদী/বিবাদীকে মানসিকভাবে দূর্বল করে দিতে; এধরনের যুক্তি একাডেমিয়াতে ব্যবহার করলে সেটা শুধু দুর্গন্ধই ছড়াবে।

৫. রাবেয়া খাতুনের বক্তব্যের সাপেক্ষে দুর্বল যুক্তি
প্রথমজন, রাবেয়া খাতুনের বক্তব্যের ব্যাপারে তিনি লিখেছেন,
"I asked an eminent Bangladeshi and a strong supporter of the liberation movement to read this account and tell me what he made of it. He opined that it was a “fabrication”, commenting that the parts about women hanging by their hair from iron rods for days on end “defied the laws of science”.
Being a busy police headquarters in the capital city, whatever happened at Rajarbag would have had many witnesses.
The language is not what would be used either by illiterate sweepers or by educated Bengalis in everyday conversation."

রাবেয়া খাতুন তাঁর সাক্ষ্যে রাজারবাগ পুলিশ কম্পাউন্ডে সংঘটিত নারী নির্যাতনের প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দিয়েছেন, যেখানে তিনি বলেছেন যে কলেজপড়ুয়া বা গৃহবধু ধরনের মেয়েদের ধরে নিয়ে আসা হতো, ধর্ষণ করা হতো এবং দিনের বেলা তাদের সবাইকে বারান্দার রেলিঙে চুল বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হতো। অন্য দুজন পুরুষ প্রত্যক্ষদর্শীও একই বক্তব্য দিয়েছেন। প্রফেসর বোস দাবী করেছেন, যেহেতু একটা মানুষকে চুল রেলিঙে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা যায়না, কারণ তাহলে সে কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যাবে, তাই রাবেয়ার বক্তব্য মিথ্যে! হ্যাঁ, হতে পারে, অতিরঞ্জন এ বক্তব্যে আছে সেটা আমিও স্বীকার করি। কিন্তু ব্যাপারটা কি এমন নয় যে এই চুল রেলিঙে বেঁধে ঝুলিয়ে রেখে মেরে ফেলার ঘটনা কয়েকটি ঘটেছে এবং তা দেখে যে মানসিক আঘাত রাবেয়া খাতুন পেয়েছেন সেই আঘাত থেকেই তাঁর বিবরণে ব্যাপারটা ভয়াবহভাবে অতিরঞ্জিতভাবে উঠে এসেছে? একজন মনোবিজ্ঞানী তো ব্যাপারটা সেভাবেই দেখবেন। এই অতিরঞ্জন কোনভাবেই প্রমাণ করেনা যে রাজারবাগ পুলিশলাইনে অসংখ্য নারী নির্যাতিত হয়নি; বরং এই প্রসঙ্গে ড. বোস যে পাকিস্তানী অফিসারের সূত্র ব্যবহার করেছেন সেই অফিসার রাজারবাগ পুলিশ লাইনে মাত্র একরাত ছিলেন কাটিয়েছেন! আর রাবেয়া খাতুন কাটিয়েছেন নয়মাস। কার বক্তব্যকে আপনি গ্রহন করবেন?

প্রফেসর বোস আরো দাবী করেছেন যে রাজারবাগ পুলিশলাইন শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত, তাই এখানে কিছু ঘটলে অনেকেরই জানার কথা। আসলেই কি তাই? তিনি কি একবার এসে ঘুরে গেছেন? বাইরের রাস্তা থেকে এই কম্পাউন্ডের কতটুকু দেখা যায়? সেনাবাহিনী যখন দখল করে বসে, এই কম্পাউন্ডের ভেতরে সাধারণ জনগনের যখন চলাচল নিষিদ্ধ করে, তখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ভেতর কি হচ্ছে তা জানা খুবই কঠিন। আর সেই মুক্তিযুদ্ধের দিনে সাধারণ নিরীহ মানুষ এরকম স্থানগুলোর ব্যাপারে কৌতুহল না দেখিয়ে বরং এড়িয়েছেই বেশী।

প্রফেসর বোস রাবেয়া খাতুনের টিপসই থেকে ধারনা করেছেন যে কেউ একজন মিথ্যে বিবরণ লিখে তাঁর সই নিয়েছেন। আমি যদি উল্টো প্রফেসর বোসকে জিজ্ঞেস করি যে 'একজন লেখাপড়া না জানা লোক তাহলে কিভাবে সাক্ষ্য দেবে?' অথবা, 'সাক্ষ্যপ্রদান করানোর জন্য একজনের কি লেখাপড়া জানতেই হবে?' -- তখন তিনি কি বলবেন? তাহলে এমন খেলো যুক্তি ব্যবহারের উদ্দেশ্যই বা কি?

সবশেষে তিনি বলেছেন, বাকী যে দুজন পুরুষ একই সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাদের সাক্ষ্য আর রাবেয়া খাতুনের সাক্ষ্যের মাঝে ক্রসচেক করে কোন অমিল না পাওয়া গেলেও, সাক্ষ্যগুলো বলা হয়েছে খুব শুদ্ধ ভাষায়, যেটা সাক্ষ্যদানকারীর কথ্য ভাষার সাথে মিলে যাবার কথা না। ড. বোস, এটা তো সর্বজনবিদিত যে, সাক্ষ্যগ্রহনের পর সেটাকে প্রমিত বাংলায় গ্রহনকারী লিপিবদ্ধ করতেই পারেন। তৎকালীন বাংলাদেশের সরকার বা প্রশাসন তো আর এখনকার কর্পোরেটদের মতো এত টিপটপ ছিলনা যে "সবসাক্ষ্য হেন ফরম্যাটের হতে হবে" টাইপের প্রটোকল ব্যবহার করেছে। যে যেভাবে পেরেছে দিয়েছে সাক্ষ্য, মনের ভালবাসা আর আক্রোশ থেকে, সেটাকে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে সত্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য। আপনি কি পড়তে পড়তে সেটা টের পাননি? আর বাংলাদেশের সরকারী কার্যক্রমে লিখিতভাষার ব্যাপারে একটা কড়াকড়ি এখনও বিদ্যমান, ৩৫ বছর আগে যেটা নিঃসন্দেহে আরো নিয়মতান্ত্রিক ছিল। তাই আমি ধারনা করছি যে সাক্ষ্যগ্রহনকারী সাক্ষ্যদাতাদের বক্তব্যকে শুদ্ধ বাংলায় রূপান্তর করে লিখে রেখেছেন।

৬. ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনীর বক্তব্যের সাপেক্ষে দূর্বল যুক্তি
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনীর বক্তব্যেও তিনি আগের মতই দূর্বল কিছু ডিসক্রিপেন্সী বা অসঙ্গতি তুলে ধরার প্রয়াস দেখিয়েছেন। তিনি তুলে ধরেছেন যে ফেরদৌসী যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী সেনাকর্তাদের মন জুগিয়ে চলেছেন, যেটার ফলাফল হয়েছে পাকিস্তানী সেনাকর্তারা ফেরদৌসীকে উপভোগ করেছেন। বক্তব্যের একটি জায়গায় ফেরদৌসী বলেছেন যে আলতাফ করিম (যিনি ফেরদোয়সীকে প্রেম নিবেদন করেন) নামের একজন মেজরই ছিল শুধু ভদ্র, বাকীরা সব নরপশু। প্রফেসর বোস ফেরদৌসীর লেখার সূত্র ধরে আলতাফ করিমের বসের নাম বের করেন, ব্রিগেডিয়ার হায়াত, এবং দেখান যে ব্রিঃ হায়াতকে যখন আলতাফ করিমের নাম বলা হলো, তিনি এই নামের কোন মেজরকে মনে করতে পারলেননা। আমি নিশ্চিত না একজন ব্রিগেডিয়ার যতজন মেজরের সাথে কাজ করেছেন সবাইকেই মনে রাখতে পারেন কিনা? বিশেষ করে, আমি ধারনা করতে পারি যে ৭১ এর সময় ব্রিঃ হায়াত যথেষ্ট বয়স্ক ছিলেন, ৩৬ বছর পর এখনকার বৃদ্ধের পক্ষে এই মনে করতে না পারাটা কিভাবে এতবড় প্রমাণ হিসেবে একটি একাডেমিক পেপারে স্থান পায়?
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনীর বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, অস্তিত্বের সংগ্রামে অনিচ্ছা সত্বেও তিনি পাকিস্তানি সেনাকর্তাদের সাথে সুসম্পর্ক রেখেছেন, অপমান সহ্য করেছেন। এপ্রসঙ্গেই তাঁর আরেকটি বক্তব্যকেও খুব দূর্বলভাবে সন্দেহ করেছেন প্রফেসর বোস, যেখানে তিনি বললেন, (যখন বাংলাদেশ জিতে গেল যুদ্ধে তখনকার কথা)
"She(Ferdousi) was warned by a non-Bengali clerk in her office that she would be killed and should flee. Ferdousi makes much of the threat to her life – but as Bangladesh became independent, only those who were perceived to have willingly fraternised with the Pakistani regime were at risk of the wrath of freedom fighters, not victims of the regime"
এখানে প্রফেসর বোস বলতে চাইলেন যে যদিও স্বাধীন বাংলাদেশে
শুধু স্বেচ্ছায় পাকিস্তানীদের সহায়তাকারীদেরকেই শাস্তি দেয়া হয়েছে, তবুও অনিচ্ছায় পাকিস্তানীদের সাথে থাকা ফেরদৌসী নিজেকে "স্বাধীনতাকামীদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন" হিসেবে দেখিয়েছেন। যেহেতু বাঙালীরা তাঁর কোন ক্ষতি করেনি, সেহেতু তিনি তাঁর বক্তব্যে এই ভয়কে অতিরঞ্জন করেছেন। অতএব এই বক্তব্য গ্রহনযোগ্য না।
এটা কিভাবে সম্ভব?? ফেরদৌসী নিশ্চয়ই সেই মুহূর্তে জানতেননা যে তাঁর বিচার করা হবেনা যেহেতু তিনি অনিচ্ছায় নিরুপায় হয়ে পাকিস্তানীদের সাথে ছিলেন। তাই তিনি তো ভয় পাবেনই, তাঁর এই ভয়ের কথা তো তিনি লিখবেনই। এতে সমস্যা কোথায়?

৭. আখতারুজ্জামান মন্ডলের বক্তব্যের সাপেক্ষে দূর্বল যুক্তি
প্রফেসর শর্মিলা বোস এরপর আরেকজন সাক্ষ্যদাতা আখতারুজ্জামান মন্ডলের সাক্ষ্যকে ব্যবচ্ছেদ করেছেন। জনাব মন্ডল তাঁর বিবরণে তাঁদের ভুরুঙ্গামারী যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে ভুরুঙ্গামারি ক্যাম্পের পাকসেনাদের সাথে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর আড়াইদিনের যুদ্ধের পর জায়গাটি মুক্ত হয়। জনাব মন্ডল তাঁর বিবরণে লিখেন যে ক্যাম্প দখলের পর সিও অফিসের পাশের বাংকারে পাকিস্তানী গ্রুপের প্রধান আতাউল্লাহ খানের লাশ পাওয়া যায়, এবং চরিত্রহীন আতাউল্লাহ মৃত্যুর সময়ও একজন বাঙালী নারীকে জড়িয়ে ছিল।
ড. বোস তাঁর সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, আতাউল্খাহ খানকে জনাব মন্ডল আগে চিনতেন কিনা সেকথা তিনি কোথাও উল্লেখ করেননি, কাজেই জনাব মন্ডল কিভাবে আতাউল্লাহ খানের লাশ চিনলেন? এই প্রশ্নটি শিশুসুলভ এই জন্য যে, জনাব মন্ডল না চিনলেও শত্রুপক্ষের পতনের পর তাদের প্রধানকে সনাক্তকরণের অনেক উপায় আছে। হয়ত আখতারুজ্জামান মন্ডল অন্যকারো মাধ্যমে জেনেছেন, অথবা হয়ত আরো পরে জেনেছেন যে ঐ লোকটিই আতাউল্লাহ খান। আখতারুজ্জামান মন্ডল আতাউল্লাহ খানকে আগে দেখেননি বলে তার লাশ সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেননা, এ কেমন যুক্তি?
একইসাথে ড. বোস বিভিন্ন পাকিস্তানী সেনাদের বরাত দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে আতাউল্লাহ খান একজন চরিত্রবান লোক ছিলেন, নারীর সম্ভ্রম নিয়ে পাশবিকতা করার মতো মানুষ তিনি না। আমার কথা হলো, নয়মাস ধরে হেন অপরাধ নেই করেনি এরকম একটি বাহিনীর সদস্যদের বরাত কতটুকু গ্রহনযোগ্য? প্রফেসর বোস আরো বলেছেন যে আড়াইদিন একটানা চলা যুদ্ধে একজন নারীর দেহ আঁকড়ে ধরে মারা গেছেন আতাউল্লাহ খান -- এটা ভাবা অসম্ভব (বেগার'স বিলিফ!!)। কথা হলো, প্রফেসর বোস কি জানেননা, একটানা যুদ্ধের মানে হলিউড মুভির সিন নয় যেখানে দুই আড়াইদিন ধরে ননস্টপ ফায়ারিং হয় আর সবাই নিজের জান বাঁচানো নিয়ে ব্যস্ত থাকে; অবশ্যই দুই পক্ষ অবস্থান নিয়ে সময় সুযোগমতো আক্রমণ করেছে। চরিত্রহীন পাকিস্তানী সেনাকর্তাদের পক্ষে সেরকম মুহূর্তে নস্টামি করা একশ ভাগ অসম্ভব -- এটাই বরং মানা কঠিন।

৮. সংখ্যাতাত্বিক ম্যানিপুলেশন
প্রফেসর বোস তাঁর সদ্য আবিস্কৃত থিওরীটিকে প্রমাণ করতে চেয়েছেন এভাবে --
ড. নীলিমা ইব্রাহীমের "আমি বীরাঙ্গনা বলছি" বইটিতে ড. নীলিমা সাতজন বীরাঙ্গনার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এঁদের সবাইকে কোন না কোন সেনাক্যাম্প থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁরা সাতজনই বলেছেন যে তাঁদের সাথে আরো বেশ কিছু বীরাঙ্গণা সেনাক্যাম্পে ছিলেন, যেখানে সংখ্যাটা ৫-৬ থেকে ২০-২৫ পর্যন্ত ছিল। প্রফেসর বোস এঁদের বক্তব্যে কোন উকিলীয় খুঁত ধরতে পারেননি, কিন্তু এই তথ্যগুলো দিয়ে এক চমৎকার অংক কষে ফেলেছেন। সাতজন সাক্ষ্যদাতার ক্ষেত্রে তিনি এই সংখ্যা (মোট নারীবন্দীর সংখ্যা) গড় করেছেন ১৩-১৪ জনায়। অর্থাৎ ৭ পূরণ ১৪ সমান প্রায় একশ' জনের হদিস তিনি স্বীকার করেছেন। তারপর তাঁর বিখ্যাত উপসংহার টানলেন এই বলে যে এই ১০০ জন যদি মোট ধর্ষিতার ১০ পার্সেন্ট হয়, তাহলে মোট ধর্ষিতা ১০০০, যদি ১ পার্সেন্ট হয় তাহলে মোট ধর্ষিতা ১০০০০, কিন্তু কোনভাবেই দুই লাখ সংখ্যাটাকে স্বীকার করে নেয়া যায়না। আমি বলি, এই সংখ্যাটা কেন ০.১ পার্সেন্ট নয়, ড. বোস? সেটা হতে বাঁধা কোথায়, সংখ্যাটা লাখের ঘরে চলে যায় -- এটাই কি বাঁধা?

শুনুন প্রফেসর বোস, আপনার ভুরুঙ্গামারীকে স্যাম্পল হিসেবে ধরেই হিসেব করুন, যদি ৯০ জনের মতো পাকসেনা থাকে সেখানে তাহলে সারা বাংলাদেশ জুড়ে প্রায় হাজারখানেক সেনাক্যাম্প ছিল। স্বাধীনতার প্রাকমুহূর্তে ভুরুঙ্গামারী ক্যাম্পে পাওয়া যায় ২০ জনের মতো বীরাঙ্গনাকে, অর্থাৎ ঠিক স্বাধীনতার সময়েই শুধু গড়ে বিশ হাজারের মতো নারীকে উদ্ধার করার কথা। সারা নয় মাসজুড়ে এভাবে তারা অসংখ্য বাঙালী নারীকে ক্যাম্পে এনেছে, মেরে ফেলে দিয়েছে। একইরকম অত্যাচার করেছে গ্রামে গ্রামে তাদের দোসর রাজাকার/আলবদর/শান্তিকমিটি -- এরা সবাই। তারওপর, পাকিস্তানী বাহিনী অনস্পট রেপ করেছে অসংখ্য, যেমন মানুষের বাড়ীঘর রেইড করে। মোট সংখ্যাটা দুই লাখ পেরিয়ে যেতে পারে বলেই অধিকাংশ বিষেশজ্ঞের ধারনা।
আপনি আবার পরিস্কার ভাবে বলবেন কি, ঠিক কোন তথ্য বা ক্লু'র ভিত্তিতে আপনি এমন একটি সংখ্যাকে "কয়েক হাজার মাত্র" বলতে চান?

প্রফেসর বোসের প্রবন্ধটির যেকথাটার সাথে আমি পুরোপুরি একমত সেটা হলো এই যে, ধর্ষিতার সংখ্যা বাড়িয়ে বললে আসলে সত্যিকারের ধর্ষিতাদের অপমান করা হয়, কারণ তাতে এমন একটা নির্দেশনা থাকে যে আমাদের আরো ভিকটিম চাই, নাহলে ঠিক জমবেনা। কিন্তু, ৭১ এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাপেক্ষে একথাটা কতটুকু খাটে? ড. বোস, উল্টো করে যদি বলি, ধর্ষিতার সংখ্যা দু লাখ হবার পরও আমরা যদি লজ্জায় চোখ ঢেকে সংখ্যাটাকে "কয়েক হাজার" বলে প্রলাপ বকি, তখন কি ধর্ষিতাদের অপমান করা হয়না? তখন কি তাঁদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে এটাই বলা হয়না যে "তোমার ক্ষতি হয়েছে তাতে আমার কি, আমার তো কোন ক্ষতি হয়নি!"?


মন্তব্য

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

যে গবেষণার সিদ্ধান্ত পূর্ব-নির্ধারিত, তা নিয়ে আলোচনা করে লাভ কিছু নেই। আপনার যুক্তি ও বক্তব্যগুলি এই মহিলার কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা যায়? তাতে বদলাবে না কিছুই, অন্তত প্রতিবাদের কণ্ঠস্বরটা পৌঁছানো দরকার।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

সেটাই ,,,
তবে অনেকেই গবেষণায় পূর্বনির্ধারিত একটা রেজাল্ট কল্পনা করে সেটার পক্ষে সাপোর্ট বা প্রমাণ খোঁজেন ,,, এটাও রিসার্চ ,,, কিন্তু ইনি গায়ের জোরে কিছু প্রমাণ হাজির করতে চাইচেন ,,,

আমি ভাবছি উনাকে মুনতাসীর মামুনের লেখাটা মেইল করব ,,, তথ্যের সমাহারে অনবদ্য একটা লেখা

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।