ছোটগল্প: একদিন তুমিও দেখা পাবে তার (প্রথম অংশ)

জ্বিনের বাদশা এর ছবি
লিখেছেন জ্বিনের বাদশা (তারিখ: মঙ্গল, ২৮/০৮/২০০৭ - ৪:০৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.
কাউন্টারের দেয়াল বেয়ে কালো পিঁপড়াটাকে আবারও উঠে আসতে দেখে 'দি নিউ বিসমিল্লা হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টে'র ম্যানেজার-কাম-মালিক কবুলের মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে দলাপাকানো কাঠির মতো জিনিসটা দিয়ে এই নিয়ে সে চতুর্থবার পিঁপড়াটাকে নিচে ফেলেছে, এবারেরটা হবে পঞ্চমবার, তবে হাতে কোন কাজ না থাকায় দিনের এরকম সময়ে এই পিঁপড়াকে মেরেই ফেলবে না আবার নীচে ফেলে দেবে তা নিয়ে ভাববার যথেষ্ট সময় কবুলের আছে। যেকোন কারণেই হোক তার হৃদয় ইদানিং তরল হয়ে আছে, জীবে প্রেম অনুভব করছে খুব বেশী, যদিও তার সাথে ইদানিং সে গৌতম বুদ্ধের উপর জীবনী পড়ছে এমন কোন ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবুও মানুষের জীবনে জোয়ার-ভাটার মতো সময় আসে, কখনও সে ভীষন হিংস্র, কখনও অভাবনীয় রকমের তরল।

একই সাথে কবুলের মাথায় আরেকটা ব্যাপার ঘুরপাক খাচ্ছে; 'বুইড়ামতো কাস্টমারটা আর কতক্ষণ থাকব?' মনে মনে বিড়বিড় করে কবুল। দিনের এসময়টা, অর্থাৎ দুপুর এগারোটা থেকে বারোটা, তেমন কোন কাস্টমার আসেনা দোকানে, মাঝেমাঝে মোটরবাইক হাঁকিয়ে কিছু সাংবাদিক গোছের লোক আসে, তারা মফস্বলের লোকাল পত্রিকায় কাজ করে, কবুলের সাথে তেমন একটা কথা এদের হয়না, আসে, বসে চা আর পুরী খেয়ে চলে যায়। আর তাছাড়া মাঝেমাঝে যে দুই একজন কাস্টমার এসময়ে আসে তারা এখানে ঘুরতে আসা লোকজন, ঢাকা বা দেশের অন্যান্য জায়গা থেকে দেখতে আসে এজায়গাটা, যদিও এমন খটখটে নিরামিষ মফস্বলে ঘুরে দেখবার কি আছে তা কবুলের মাথায় ঢোকেনা।

কিন্তু প্রতিদিনের নিয়ম ভেঙে আজ বুড়োমতো লোকটা এসে ঢুকল প্রায় এগারোটার আগে আগে, এখন বারোটার কাঁটা পেরিয়ে গেছে, অথচ লোকটার বিদায় হবার কোন সম্ভাবনা নেই। একটার পর একটা খাবার অর্ডার দিয়েই যাচ্ছে, আর আয়েশ করে তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে। কবুল জানে তার দোকানের খাবার এত মজা না, তবুও লোকটার খাওয়ার ভঙ্গি দেখে তার ভাবতে ইচ্ছা হয়, 'না এক্কেবারে খারাপ রান্দেনা দিলু', দিলু এই "হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টে"র একমাত্র "শেফ"। এছাড়া আছে একজন বেয়ারা, নাম বদরুল, আর একটা পিচ্চি যেমনটা প্রায় এই এলাকার সব দোকানেই থাকে। পিচ্চির নামটা অবশ্য কবুল এখনও জানেনা।

বদরুল এসে ফিসফিসিয়ে বলে, 'কবুল ভাই, আবারও দুইটা সিঙ্গারা অডার দিছে, বুইড়ায় এত খায় কিমনে?'

কবুল খানিকটা চিন্তিত বোধ করে, তার কপালের চামড়া কুঁচকে ভাঁজ হয়ে আসে, ধীরে ধীরে বলতে থাকে, 'বদরুইল্যা, ভাল কইরা বুজিছ! ব্যাডার কাছে ট্যাকাপয়সা আছে তো, নাইলে কইলাম তোরে ধরুমনি।'

'হেইডা জিগাই ক্যামনে, তয় পুশাক দেইখা মুনে হয়, আছে। আর বিল অইছেই বা কত? এই পর্যন্ত, ছয়ডা সিঙ্গারা, তিনডা আলুর চপ, দুই কাপ চা,...' হিসেব মেলাতে গিয়ে বদরুল নিজে ভ্যাবাচ্যাকা খায়, তালগোল পাকিয়ে বলে, 'আরে! দুইকাপ না তিনকাপ খাইল'

চোখমেলে তাকাতেই দেখে কবুলের রক্তচক্ষু, কবুল নিষ্ঠুর শীতল স্বরে বলে 'তরে না কইছি, হিসাবে গন্ডগুল করবিনা!' বলেই কবুল পিচ্চির দিকে তাকায়, 'পিচ্চি, বুইড়ায় কয় কাপ চা খাইছেরে?' কবুল এমনভাবে জিজ্ঞেস করে যেন পিচ্চি সবই জানে।

পিচ্চি কিছু না বুঝেই বলে ওঠে 'তিন কাপ মনে অয়।'

কবুল আবারও রক্তচক্ষু করে তাকায় বদরুলের দিকে, চোখের ভাষায় বলে দেয়, 'তোর বদলে আরেকটা পিচ্চিরে রাখলেও তো আমার লাভ।'

এর মধ্যে পিঁপড়াটা কোথায় যেন চলে গেছে! কবুল কিছুটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে, কারণ পিঁপড়াটাকে মেরে ফেলবে না বাঁচিয়ে রাখবে তা নিয়ে একটু দ্বিধায় ছিল সে আসলেই। পিঁপড়াটা নাই হয়ে যাওয়ায় ভালই হয়েছে ভাবতে ভাবতে কবুল আবারও বুড়ো কাস্টমারের দিকে তাকায়, নির্লিপ্তভাবে গভীর তৃপ্তির সাথে খাচ্ছে, এমন তৃপ্তির সাথে কতদিন কাউকে খেতে দেখেনি কবুল।
'কত ট্যাকার আর খাইছে? বিশ ট্যাকা অইব না হয়, আইজকা এই বুইড়ার থিকা পয়সা লমুনা।' কবুল মনে মনে ঠিক করে ফেলে।

এমন সময়েই কবুল শুনতে পায় বুড়োলোকটা বেয়ারা বদরুলকে ডেকে বলছে, 'বাবাজী, তোমগোর এইখানে দুপুরের খাওন কি কি পাওয়া যায়।'

২.
এই মুহুর্তে কবুল ভাবতে পারছেনা তার কি করা উচিত। এই বুড়ো এত খাচ্ছে কি করে! সত্যিসত্যিই খানিকটা চিন্তিত বোধ করে সে, কারণ, লোকটা একটার পর একটা অর্ডার দিয়েই যাচ্ছে। কৈমাছ খেল দুইটা, ইলিশভাজা খেল, তারপর মুরগীর রান-থান খেল, এখন চিবুচ্ছে খাসির মাংসের সাথে ডাল মাখা ভাত। এরমধ্যে বুড়ো বদরুলকে জিজ্ঞেস করেছে এখানে দই বানানো হয় কিনা। বদরুল বলতে যাবে 'না' এমন সময়েই পাশের টেবিলের রেগুলার কাস্টমার আমিনউদ্দিন পন্ডিতি করে বলে উঠে, 'আরে পাওন যাইবনা ক্যা? দিলুর দই এই এলাকায় স্যারা। বদরুল মুরুব্বীর লাইগা ফাস্টকেলাস দেইখা এককাপ দই নিয়া আয়।'

আমিনউদ্দিনের কান্ড দেখে কাউন্টারে বসে কবুল, আর কাছাকাছি দাঁড়ানো বদরুল দুজনেরই মেজাজ খিঁচড়ে যায়, বদরুল মনে মনে বলে 'বিলটা আমিনুদ্দিন মিয়া বাই আফনে দিয়েন', মুখ ভেঙে বলার সাহস পায়না। বুড়োর দিকে একনজর তাকিয়ে বদরুল দেখে অদ্ভুত তৃপ্তচোখে বুড়ো তার দিকে চেয়ে আছে, যেন স্বর্গের অমৃতের অপেক্ষায় বুড়ো, আর সেই অমৃত বদরুল ছাড়া আর কেউ আনতে পারবেনা।
'বালামতো বকশিশ দিলেই অয়' ভাবতে ভাবতে বদরুল রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়। ঘড়িতে তখন বেলা তিনটা।

খাওয়া দাওয়া শেষে বুড়োটা একটা পত্রিকা বের করেছে তার গাট্টি-বোঁচকা থেকে, আর দাঁত খিলাল করার একটা সরু শলার কাঠি। রেস্টুরেন্টের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁত খিলাল করতে করতে নিবিষ্টমনে সে যখন পত্রিকার পাতায় ডুবে আছে, তখন কবুলের কন্ঠ শোনা যায় পাশে। কাঁচুমাঁচু হয়ে কবুল বলে, 'মুরুব্বী, দুপুরে দোকান বন্ধ করার সময় তো হইয়া গেছে, এখন বিলডা যদি দিয়া দিতেন।'
বুড়ো পত্রিকা সরিয়ে চোখ তুলে তাকায়, চোখে বেশ খানিকটা বিস্ময়, যেন সে বুঝতে পারছেনা সে কোথায় এসেছে, অথবা কেন তার কাছে বিল চাওয়া হচ্ছে, অথবা কেন তাকে পরোক্ষভাবে জায়গাটা ছেড়ে দিতে বলা হচ্ছে। আস্তে আস্তে ধাতস্থ হয় লোকটা, তারপর পত্রিকাটা ভাঁজকরে ব্যাগে ঢুকিয়ে, ব্যাগহাতে উঠে পড়ে, কবুলকে পাশ কাটিয়ে বের হয়ে যায়।

'সর্বনাশ! বুইড়ায় কি বিল না দিয়াই যাইবগা নাকি' ভাবতেই কবুল দেখে যে বৃদ্ধ হেঁটে গিয়ে কাউন্টারের পাশে দাঁড়ায়, যেন কিছু বলবে এভাবে ম্যানেজারের খোঁজ করে। কবুল দৌড়ে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসে, হুন্কার ছোড়ে, 'বদরুল! মুরুব্বীর বিল কতরে?'

'দুইশ চল্লিশ, দুইশ চল্লিশ' বলতে বলতে ছুটে আসে বদরুল, পাছে তার নিজের বকশিশ হাতছাড়া হয়ে যায়।

বুড়ো করুণ চোখ করে বলে, 'বাবাজী, আমার কাছে তো এই দুইটাকা ছাড়া আর একটা পয়সাও নাই। এই দুই টাকা দিয়া একটা সিগারেট খাব বলে ইরাদা করেছি। এমন ভালো আহার আল্লাতালা কতদিন পর ভাগ্যে লিখেছেন!'

বদরুল প্রায় মারমুখী হয়ে উঠে, 'এইডা কি কইলেন আফনে? দেখতে তো বালা মানুষ মনে অইছিল!' রাগে ফোঁসফোঁস করতে থাকে বদরুল, সরাটাদিন বুড়োর প্রচুর সেবাযত্ন সে করেছে, তার মনে মনে আশা ছিল বুড়ো অন্ততঃ তাকে দশটা টাকা দেবে। অথবা বুড়োর বিল থেকে পাঁচ টাকা সে কবুল ভাইর কাছ থেকে চেয়ে নিবে। অথচ বুড়ো বলে কিনা তার কাছে দুইটাকা ছাড়া আর কিছু নেই!

বুড়োর কথা শুনে আমিনউদ্দিনও বাজখাঁই গলায় এগিয়ে আসে, সে নেতাগোছের মানুষ মনে করে নিজেকে, এর সাতে বা ওর পাঁচে না থাকলে তার ঠিক পেটের ভাত হজম হয়না। এগিয়ে আসতে আসতে বলে, 'মুরুব্বী, কামটা তো ইনসাফের অইলনা। আপনে এতকিছুর অর্ডার দিলেন, আমি দেখলাম, আবার আপনেরে দই দিতে বল্লাম, এখন তো আপনি আমারেও পাপী করলেন। আপনে আসছেন কোথা থেকে?' আমিনউদ্দিন শুধু বাজখাঁই গলার জোরেই ঘটনার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

বৃদ্ধ আরো মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে, 'ভাই, আমি আসলাম ঢাকা থিকে। একটা কাজে আসলাম এখানে, আজ সকালে বার হবার পর দেখি হাতের সব টাকা গায়েব। এখন কি করব বলেন? বেইনসাফ কাজ তো আমারও করতে ইচ্ছা করেনা।'

'টাকা হারাইছেন তো এত খাওয়া দাওয়া করলেন ক্যান।' আমিনউদ্দিনকেই বেশী চিন্তিত মনে হয়।

'কি করব বাবা! খিদা তো এইসব মানবেনা, খিদা লাগলে তো কিছু করার নাই।' বুড়ো খানিকটা বিরক্ত স্বরে বলে।

'কিন্তু আপনার কারণে তো আমার নিজেরেই এখন অপরাধী মনে অইতাছে, আপনেরে দই দিবার কইলাম!' আমিনউদ্দিন বচসা চালিয়ে যেতেই আগ্রহী।

'তাইলে আপনেই আমার খাবারের বিলটা দিয়া দেন, কয়টা আর টাকা?' বুড়ো অদ্ভুতভাবে বলে।

যদিও বুড়োর কথার কোন যুক্তি ছিলনা, তবুও আমিনউদ্দিন তার কথায় অসহায় বোধ করে, খানিকটা রাগ ঝেড়েই 'আমি দিমু ক্যা' বলতে বলতে আমিনউদ্দিন বের হয়ে যায়।

কবুলের ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল, সাধারণত দুপুর তিনটার সময় দোকান বন্ধ করে সে দোকানের কর্মচারীদের নিয়ে খেতে বসে। তারপর খাওয়া শেষে একটা গোল্ডলীফ টানে আয়েশ করে, তারপর একটু ভাতঘুম। আজ সাড়ে তিনটা বেজে গেছে, একটু আগে দিলু চিৎকার করে বলেছে 'আমি খাইয়া ফালাইলাম', খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। কবুল বুঝতে পারছেনা কি করা উচিত। লোকটার থেকে কি কিছু রেখে দেবে বন্ধক হিসেবে, নাকি লোক ডাকিয়ে হেনস্থা করবে, নাকি বিশ্বাস করে বলবে 'আবার যখন এইদিকে আসবেন তখন বিলটা দিয়া যাইয়েন।'

কবুল খানিকটা দ্বিধাগ্রস্থবোধ করে, পিঁপড়া মারবে না ফেলে দেবে ভেবে যেরকম সেই একইরকম সমস্যা সে বোধ করে মাথার ভেতর। হঠাৎই তার মনে পড়ে যায় সকালের নিয়তের কথা, মনে মনে সে নিয়ত করেছিল লোকটার থেকে আজ সে কোন পয়সা নেবেনা। কবুল উদার গলায় বলে উঠে,
'ঠিক আছে চাচা মিয়া, আপনের থেকা আমি আজকে কোন পয়সা নিবনা। আর আপনে গোল্ডলিফ খাইলে নেন, এখান থেকা দউইটা গোল্ডলীফ নিয়া যান।'

'আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, বাবাজী', বৃদ্ধ কাঁদোকাঁদো হয়ে বলে।

'চাচামিয়া, টাকাপয়সা হারাইছেন ক্যামনে? কেউ ছিনতাই করছে নি? তাইলে কন, দেখি কিছু করা যায় নিকি আপনের জইন্য।' কবুল চাচামিয়ার অসহায় চেহারা দেখে আরো আর্দ্র হয়।

হঠাৎ বৃদ্ধ খানিকটা রহস্যময় চেহারা করে বলে, 'সেইটা বলা যাবেনা, বাবাজী। সেইটা আমাকে জিজ্ঞাস করিয়েননা।'

অন্যপাশে দাঁড়ানো বদরুল সাপের মতো ফোঁসফাঁস করতে থাকে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে।

(চলবে ...)


মন্তব্য

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

নাহ! গরীব মাইনসেরে লসে ফালাইলেন।
তবে ঘটনা জমে উঠেছে। এগিয়ে নিয়ে যান। শুভস্ব শীঘ্রম।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

জ্বিনের বাদশা এর ছবি

ধন্যবাদ, বলাইদা। যেইহারে গরীবমানুষের পিছনে লাগছি, আমার তো বদনাম হয়ে যাচ্ছে!মন খারাপ
========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

========================
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে,ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।