প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ ক্লিনিকঃ কাঁঠালের আমসত্ত্ব!

নির্ঝর অলয় এর ছবি
লিখেছেন নির্ঝর অলয় [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ২৬/১১/২০১৪ - ১০:১১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাম আমরা সবাই শুনেছি। কিন্তু মেডিকেল কলেজ ক্লিনিক কথাটা কি কেউ শুনেছেন? কথাটা দাপ্তরিকভাবে অস্তিত্বহীন কিন্তু বাস্তবে এই মেডিকেল কলেজ ক্লিনিকগুলো গোটা চিকিৎসাশিক্ষা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে হুমকির সম্মুখীন করে ফেলেছে। এই লেখায় আমরা খুঁটিয়ে দেখব যে, ঠিক কেন একটা বাণিজ্যিক ক্লিনিক কখনোই একাডেমিক হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ বলে পরিগণিত হতে পারে না। এ বিষয়ে বুঝতে গেলে আমাদের প্রথমেই জানতে হবে যে, একটা মেডিকেল কলেজ স্থাপনের প্রাথমিক শর্তাবলী কী কী।

প্রায়ই অনেক ডাক্তারকেও বলতে শুনেছি, “মেডিকেল কলেজ শুরু করতে হাসপাতালের কোন দরকারই নেই। থার্ড ইয়ার পর্যন্ত তো এমনিই পড়ানো যায়।” – এটা হচ্ছে সবচেয়ে মারাত্মক ভুল। চলুন এ সংক্রান্ত সঠিক নিয়মটি আগে জেনে নেয়া যাক। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বেসরকারী মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা নীতিমালা ২০১১ অনুযায়ীঃ

“৫০ শয্যা বিশিষ্ট একটি বেসরকারী মেডিকেল কলেজে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার কমপক্ষে ২(দুই) বৎসর পূর্ব হতে প্রস্তাবিত ক্যাম্পাসে প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামোসহ ন্যুনতম ২৫০ শয্যার একটি আধুনিক হাসপাতাল (৭০% বেড অকুপেন্সী সহ) চালু থাকতে হবে, পরবর্তীতে চিকিৎসা শিক্ষার জন্যে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণ হাসপাতালে রূপান্তর করা যায়। হাসপাতালে দরিদ্র জনগণের জন্য বিনা ভাড়ায় অন্তত ১০% বেড সংরক্ষণসহ ফ্রি চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে হবে। হাসপাতালে সমস্ত আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ সার্বক্ষণিক জরুরী চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম থাকতে হবে।” [২.৫]

কাজেই স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে মেডিকেল কলেজ চালু করতে হাসপাতালের কোন দরকার নেই এটা একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা এবং প্রতারণার উদ্দেশ্যেই মালিকপক্ষ এই ধারণা ছড়িয়েছে। বস্তত মেডিকেল কলেজের পূর্বানুমোদন চাইবার প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে ন্যুন্তম ২৫০ শয্যার একটি আধুনিক হাসপাতাল। শুধু ২৫০ শয্যা থাকলেই হবে না , তাতে ৭০% রোগী অর্থাৎ কমপক্ষে ১৭৫ জন রোগীর ভর্তি থাকা বাধ্যতামূলক। বাস্তবক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই যে, শুধু এই ক্রাইটেরিয়াতেই দেশের ৫২ টি বেসরকারী মেডিকেল কলেজের অধিকাংশই বাতিল হবার যোগ্য। ৯০-১২০ বেডের ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো বুক ফুলিয়ে নীতিমালা লঙ্ঘন করে খোদ রাজধানীতেই মেডিকেল কলেজের অবৈধ ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। নীতিমালার পরবর্তী ধারায় আছে,

“একই ক্যাম্পাসে বিভিন্ন বিষয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাসহ কলেজ একাডেমিক ভবন ও হাসপাতাল ভবন আলাদা থাকতে হবে। কোন অবস্থাতেই দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের ধারণা গ্রহণযোগ্য হবে না। বেসরকারী মেডিকেল কলেজে ছাত্র/ছাত্রীর আসনসংখ্যা অনুসারে হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে। হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ন্যুনতম ১:৫ অর্থাৎ ৫০ জন ছাত্র/ছাত্রী বিশিষ্ট মেডিকেল কলেজে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট একটি আধুনিক হাসপাতাল থাকতে হবে।” [২.৬]

অথচ আমরা বাস্তবে এর কোন প্রয়োগ দেখছি না। দ্বিতীয় ক্যাম্পাস তো এখন একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে! ঢাকার কেন্দ্রবিন্দু তে ১২০-১৩০ বেডের ক্লিনিকগুলোকে শুধু মেডিকেল কলেজ পরিচালনার অনুমোদনই দেয়া হয় নি, তারা এই অযোগ্য কাঠামো নিয়েই বিদেশি ছাত্র-সহ মোট ১০০ ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করছে। অথচ ১০০ শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমোদন পেতে ১:৫ হিসেবে কমপক্ষে ৫০০ বেডের একাডেমিক হাসপাতাল প্রয়োজন। এবার চলুন দেখা যাক যে, একটা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল তথা টিচিং হসপিটাল একটা ক্লিনিকের থেকে কী কী বিষয়ে আলাদা।

১। সকল বিষয়ের পূর্ণকালীন শিক্ষক ও কনসালট্যান্টের উপস্থিতিঃ
একটা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কখনোই ভিজিটিং কনসালট্যান্ট বা খণ্ডকালীন অধ্যাপকদের ওপর বেশি নির্ভরশীল হতে পারে না। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী সার্জারি, মেডিসিন, গাইনী, অর্থোপেডিক্স, কার্ডিওলজি, শিশু ইত্যাদি বিভাগের অধ্যাপক থাকবেন। অধ্যাপকের অধীনে সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, রেজিস্ট্রার, সহকারী রেজিস্ট্রার ও আই,এম,ও নিয়োজিত থাকবেন। এই অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপকদের অধীনেই শুধু রোগী ভর্তি থাকবেন, অন্য কোন কনসাল্ট্যান্টের রোগী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হবার কথা না। যেমন, ঢাকা মেডিকেল কলেজে কখনোই মিটফোর্ডের প্রোফেসারের অধীনে রোগী ভর্তি থাকবে না। এই পদ্ধতিতে সকাল ও সন্ধ্যায় অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপকের নেতৃত্বে সকালে ও সন্ধ্যায় দুইবার রাউন্ড দেয়া হয় এবং সেই রাউন্ডে উপস্থিত থেকে ইন্টার্ন এবং ৪র্থ ও পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থীরা তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করে। তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরাও রাউন্ডে অংশ নিতে পারে, কিন্তু তৃতীয় বর্ষে মূলত রেজিস্ট্রারের সাথেই বেশি ক্লাস থাকে। এই পদ্ধতিতেই রকমফের ঘটিয়ে সারা বিশ্বে ক্লিনিক্যাল সায়েন্স শিক্ষা দেয়া হয়।
বিপরীতে একটা ক্লিনিক হচ্ছে হোটেলের মত। ক্লিনিকে যথোপযুক্ত অর্থব্যয় করে পছন্দসই যেকোন কনসালট্যান্টের চিকিৎসাসেবা নেয়া সম্ভব যদি ওই ক্লিনিকের সাথে উক্ত কনসালট্যান্টের কোন দ্বন্দ্ব না থাকে। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু এই ভিজিটিং কনসালট্যান্ট এবং ক্লিনিক প্যাটার্ন একাডেমিক পরিবেশকে একদম ধ্বংস করে দেয়। কীভাবে? ক্লিনিক হলে কী ক্ষতি? চলুন দেখা যাক,

প্রথমত, মেডিকেল কলেজ যদি ক্লিনিকের মত পরিচালিত হয় তবে সেখানে ভিজিটিং কনসালট্যান্টরাই সর্বেসর্বা হয়ে পড়েন। দেখা যায় যে, কনসালট্যান্টরা নিজেদের সময় ও সুযোগমত তাঁদের অধীনে থাকা রোগীদের ভিজিটে আসেন। এতে করে হাসপাতালের আর,এম,ও তথা আই,এম,ও দের একাডেমিক কাজকর্ম ও স্নাতকোত্তর পড়াশোনা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়। দেখা যায় ৫ মিনিট পর পর বিভিন্ন বিখ্যাত কনসালট্যান্টের সাথে ভিজিটে যেতে হচ্ছে। দুপুরের পর ঢাকার যেকোন মেডিকেল কলেজ ক্লিনিক পরিদর্শনে গেলে ডাক্তারদের এই করুণ ছুটোছুটি দেখা যাবে। এই পরিবেশ কোন টিচিং হসপিটালে কাম্য নয়।

দ্বিতীয়ত, আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে, বেশ তো! এভাবে অনেক বিখ্যাত অধ্যাপকের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়ে শেখা যাবে অনেক কিছু। কিন্তু বিষয়টা এমন নয়। বিখ্যাত অধ্যাপক যতক্ষণ তাঁর নিজের শিক্ষকতার প্রতিষ্ঠান তথা বি,এস,এম,এম,ইউ, ডি,এম,সি, এন,আই,সি,ভি,ডি ইত্যাদিতে থাকেন ততক্ষণই তাঁরা শিক্ষাদান করেন। ক্লিনিকে রোগী দেখেন তিনি চাকরীর বাইরে কিছু প্রয়োজনীয় বৈধ রোজগারের উদ্দেশ্যে, একটা ভিজিটে এক হাজার টাকা। তখন তিনি ব্যস্ত থাকেন সব রোগী দেখে যেতে। কাজেই ওই ১০-১৫ মিনিট সময়ে কোন একাডেমিক কার্যক্রম একেবারেই অসম্ভব। তাছাড়া নির্দিষ্ট সময় থাকে না বলে এই ভিজিটে উপস্থিত থাকা শিক্ষার্থীদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।

তৃতীয়ত, এইসব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালরূপী ক্লিনিকে সিংহভাগ বেডই কেবিননির্ভর। এসব কেবিনের ভাড়া সাধারণত সিঙ্গেল হলে চার হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা বা তার বেশি আর ডাবল শেয়ারড কেবিন হলে দুই হাজারের বেশি। এত অর্থ ব্যয় করে ভর্তি হওয়া রোগীরা কিছুতেই শিক্ষার্থীদের শারীরিক পরীক্ষা তথা ফিজিক্যাল ইগজামিনেশন এর অনুমতি দেয় না। ওয়ার্ডের বেড থাকে ২০-৩০ টা। সেখানেও একই অবস্থা। ২৫টার মত ফ্রি বেড থাকলেও একমাত্র মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, বিশ্ববিদ্যালয় ও বি,এম,এন্ড ডি,সির পরিদর্শনের সময় ছাড়া ফ্রি বেডে কোন রোগী থাকে না। মাঝে মাঝে সাজানো ভাড়া করা রোগী দিয়েও পরিদর্শনের বৈতরণী পার হয় মালিকপক্ষ। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে, ১৬-২৫ লক্ষ টাকা ব্যয় করে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা রোগী না দেখেই ডাক্তার হচ্ছে। এরা পরবর্তী জীবনে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হবে। বিপুল অর্থ নিয়ে শিক্ষার্থীদের রোগী দেখার সুযোগ না দেয়া একটা ঘৃণ্য প্রতারণা।

চতুর্থত, ভিজিটিং কনসালট্যান্টরা প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক পরিবেশের প্রতি প্রায়ই শ্রদ্ধাশীল থাকেন না। প্রায়ই অযৌক্তিকভাবে নিজের পদ্ধতি ও মতের অনুকূল না হলেই কর্তব্যরত চিকিৎসকদের জঘন্য ভাষায় রোগী ও তার পরিজনের সামনে অপমান করেন। এই অহেতুক অপমানের গ্লাণি রোগীর সেবাকে ব্যাহত করে এবং চিকিৎসকদের মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্থ করে তোলে।
কাজেই স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কখনোই ভিজিটিং কনসালট্যান্টের ওপর নির্ভরশীল ক্লিনিক হবে না। ঠিক এ কারণেই নীতিমালাতে ভিজিটিং প্রোফেসারের সংখ্যা মাত্র ২৫% এ সীমাবদ্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। বাস্তবে আমরা প্রায়ই দেখছি যে, অনেক তথাকথিত মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা ক্লিনিকেই ৯০% ই আসলে ভিজিটিং কনসালট্যান্ট।

২। বিভাগের অস্তিত্বঃ
চূড়ান্ত বৃত্তিমূলক এম,বি,বি,এস পরীক্ষা সঞ্চালনা করতে ন্যুনতমভাবে মেডিসিন, পিডিয়াট্রিক্স, সাইকিয়াট্রি, সার্জারি, অর্থোপিডিক্স, আই, অটোরাইনোল্যারিঙ্গোলজি এন্ড হেড নেক সার্জারি (নাক-কান-গলা) এবং অবস্টেট্রিক্স এন্ড গাইনেকোলজি- এই ৮টি বিভাগ থাকতেই হবে। নইলে পরীক্ষা সঞ্চালনাই অযৌক্তিক হয়ে পড়ে কারণ ইন্টারনালই থাকবে না এই বিভাগগুলো না থাকলে। বিপুল অর্থব্যয় করে এই অপরিহার্য বিভাগবর্জিত মেডিকেল কলেজে অধ্যয়ন পিতা-মাতার অর্থের করুণ অপচয় ছাড়া কিছু নয়। কাজেই ব্যবসাদারদের ফাঁদে পা না দেয়াই উত্তম।
এছাড়া আরো অন্যান্য বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে যেগুলো চূড়ান্তভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। এনাটমিতে পর্যাপ্ত মরদেহ এবং ভিসেরা নেই। ৫-৬ বছর ধরে একই ছেঁড়া-খোঁড়া বডি ও ভিসেরা দেখানো হয়, যাতে আসলে কোন কিছু চেনা অধ্যাপকদের পক্ষেও প্রায়ই কঠিন হয়ে পড়ে! বেসিক ও প্যারাক্লিনিক্যাল বিষয়গুলোর উপযুক্ত ল্যাব, সমৃদ্ধ লাইব্রেরী, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কিংবা উপযুক্ত ক্রস ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা, অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা ইত্যাদি ছাড়াই মেডিকেল কলেজ হয়ে যাচ্ছে যা চূড়ান্তভাবে অনৈতিক। কিন্তু এই ব্যাপারগুলো পরে। আলোচ্য লেখার বিষয় শুধু এটাই যে, মেডিকেল কলেজ স্থাপনের যে সবচেয়ে মৌলিক শর্ত অর্থাৎ ন্যুনতম ২৫০ বেডের আধুনিক হাসপাতাল- সেটাই একদমই মানা হচ্ছে না। এমনকি স্থাপনার ৫ বছর পরও অনেক তথাকথিত মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই মাত্র ১২০-১৩০ টা শয্যা আছে যা দুঃখজনক এবং প্রতারণামূলক। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নামে ক্লিনিক ব্যবসা যদি নৈতিক কিছুই হত এবং শিক্ষার অনুকূলই হত- তাহলে পৃথিবীর সব টিচিং হসপিটালকেই ক্লিনিকে রূপান্তর করা হত। কারণ এখানে রয়েছে অর্থের বিনিময়ে পছন্দসই কনসালট্যান্ট বাছাইয়ের সুযোগ, ছাত্ররা পারবে বিখ্যাতদের কাছে শেখার সুযোগ। কিন্তু এটা নেহাতই প্রতারণা। এটা সম্ভব নয় বলেই পৃথিবীর কোথাও এমনকি আমাদের দেশেও টিচিং হসপিটালগুলো ক্লিনিক নয়। প্রথম সারির বেসরকারী মেডিকেল কলেজগুলো কখনোই ক্লিনিক ছিল না, এখনো নেই। তারাও কিন্তু চাইলে ক্লিনিক ব্যবসা করে নিজেদের লাভ আরো বহুগুণে বাড়াতে পারত। তারা সেটা করেনি বলে অবশ্যই কৃতিত্বের দাবীদার। তাই প্রবল জনমত গড়ে তুলতে হবে যাতে আর কোনভাবেই মেডিকেল কলেজের নামে ক্লিনিক ব্যবসা করে সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রতারণা না করা হয়।

একটা মানসম্মত মেডিকেল কলেজ চেনার বেসিক উপায়গুলো শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সুবিধার উদ্দেশ্যে দেয়া হলঃ

১। মেডিকেল কলেজ সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে ২৫০ শয্যা এবং তাতে কমপক্ষে ১৭৫ জন রোগী ভর্তি আছে কিনা?
২। ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগণ অর্থপ্রদানের আগে অবশ্যই দেখে নিন সকালবেলায় অধ্যাপক, জুনিয়র চিকিৎসক ও ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতিতে রাউন্ড দেয়া হচ্ছে কিনা। যদি এই সদলবলে রাউন্ড এর ব্যবস্থা না থাকে বুঝতে হবে সেটি একটা ক্লিনিক এবং আপনারা প্রতারিত হচ্ছেন।
৩। মানহীন মেডিকেল কলেজগুলো দেশের বাইরে স্বীকৃত নয়। কাজেই এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষালাভের পর বিদেশে উচ্চশিক্ষা বা চাকরীর কোন সম্ভাবনাই নেই। এমনিতেও ডাক্তারদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা বা চাকরী অত্যন্ত কঠিন বিষয়। কাজেই ইন্টারনেটে International Medical Education Directory (IMED)- এ দেখে নেয়া উচিত যে, এই তালিকায় সংশ্লিষ্ট মেডিকেল কলেজটির নাম আছে কিনা। যদি না থাকে তবে বিদেশে উচ্চশিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও চাকরীর সম্ভাবনা চিররুদ্ধ। [দেখুনঃ http://www.faimer.org/resources/imed.html]

মেডিসিনের কিংবদন্তী অধ্যাপক স্যার উইলিয়াম অসলার বলেছেন, “To study the phenomenon of disease without books is to sail an uncharted sea, while to study books without patients is not to go to sea at all.” কাজেই রোগীর সাথে সম্পৃক্ততা না থাকলে ভালো ডাক্তার হওয়ার কথা চিন্তাও করা যায় না। বেসিক ও প্যারাক্লিনিক্যাল বিষয়ও অবশ্যই ক্লিনিক্যালি সম্পৃক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। বর্তমানে পৃথিবীর প্রতিটি উন্নত মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থায় প্রথম দিন থেকেই বেডসাইড এনাটমি, বেডিসাইড ফিজিওলজি ও বায়োকেমিস্ট্রির শিক্ষা প্রদান করা হয়। এ প্রসঙ্গে নবগঠিত সরকারী মেডিকেল কলেজগুলোর সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতার কথা আসতেই পারে। উল্লেখ্য যে, নবগঠিত সরকারী মেডিকেল কলেজগুলোতে মূলত বেসিক ও প্যারা-ক্লিনিক্যাল বিষয়ে শিক্ষক-স্বল্পতা থাকলেও এগুলো সবগুলোই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সবচেয়ে মৌলিক শর্ত অর্থাৎ ২৫০ বেড, বিভাগ এবং কনসালট্যান্টের উপস্থিতি ইত্যাদি পূরণ করে। এসব প্রতিষ্ঠানে বেসিক সায়েন্সের প্রভাষক ও অধ্যাপক পদায়ন সমস্যা ধীরে ধীরে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। কাজেই মানহীন ও ক্লিনিকসর্বস্ব বেসরকারী মেডিকেল কলেজগুলো প্রাথমিক শর্তেই সদর হাসপাতালভিত্তিক নতুন সরকারী মেডিকেল কলেজগুলোর সঙ্গে তুলনায় আসবারই যোগ্য নয়। কারণ সদর হাসপাতালগুলোতে কমপক্ষে ৪০০-৫০০ রোগী প্রতিদিন চিকিৎসাসেবা পায়। চিকিৎসাশিক্ষার মত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে কোনভাবেই ক্লিনিকব্যবসা দিয়ে বিতর্কিত ও বাণিজ্যিকীকরণ করা সমর্থনযোগ্য নয়। বেসরকারীকরণ মন্দ কিছু নয়, তবে তা যেন মানহীন না হয়। সরকারী বা বেসরকারী কোন পর্যায়েই মানহীন মেডিকেল কলেজ কারো কাম্য নয়।


মন্তব্য

শেহাব এর ছবি

দরকারী লেখা।

নির্ঝর অলয় এর ছবি

শেহাব ভাই, ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
চিকিৎসকদের মধ্যে শিক্ষা নিয়ে ভাবেন, জাফর ইকবাল স্যারের মত তেমন মহৎ মানুষ দুর্লভ। বাধ্য হয়ে আমাদের মত পামরদেরই এগিয়ে আসতে হয়!

বাংলাদেশের মত দরিদ্র দেশে স্বাস্থ্য খাত ও মেডিকেল এজুকেশনের বাণিজ্যিকীকরণের ফলাফল হবে ধ্বংসাত্মক।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

যে নির্বোধেরা সামান্য আর্থিক বা অন্যান্য সুবিধা উৎকোচ নিয়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে তারা কখনোই ভাবে না এইসব মেডিকেল কলেজ ক্লিনিক নামক হাঁসজারুর পাল্লায় সে নিজেই বা তার প্রিয়জন কেউ পড়তে পারে। আর এইসব প্রতিষ্ঠান 'ডাক্তার' নামে বাজারে যে মাল ছাড়ছে তাতে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাও ধ্বংস হচ্ছে।

একবার ঢাকার এক নামকরা হাসপাতালে গেছি বন্ধুর মা'কে রক্ত দিতে। রক্ত দেবার সময় উপস্থিত ডাক্তারের সাথে গল্প করছি। কথায় কথায় জানা গেলো তিনি যে কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছেন সেটা নাকি কয়েক বছর আগে 'নাই' হয়ে গেছে। তো অমন তেলেসমাতি মেডিকেল কলেজের প্রডাক্ট এমন নামকরা হাসপাতালে! আমি তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার মান নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়লাম।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নির্ঝর অলয় এর ছবি

পাণ্ডবদা, কী আর বলব?
যাহোক ঐ বিশেষ চিকিৎসক ভদ্রলোক হয়তো ভালোও হতে পারেন। তবে আসলে বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, নামী-দামী হাসপাতালে এখন যারা চাকরি পাচ্ছে তারা সবাই কোন না কোন বিখ্যাত অধ্যাপক চিকিৎসকের পুত্র-কন্যা-জামাই-পুত্রবধু- নিদেনপক্ষে ভাতিজা-ভাস্তি ইত্যাদি। ভালো মেডিকেল কলেজ বা ভালো ব্যাকগ্রাউন্ডের প্রচুর ডাক্তার বেকার ঘুরছে বা অসম্মানজনক বেতনে ক্লিনিকে খ্যাপ মারছে। নেহাত অস্বাভাবিক ভালো ইন্টারভিউ হয়েছিল নইলে এই বাজারে কোনভাবেই দু-দুটো নামী মেডিকেল কলেজে চাকরী জুটত না, বিনা তদবিরে!

আরো মজার বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশে প্রায় কোন হাসপাতালেই ডাক্তারদের পরিশ্রম অনুপাতে বেতন দেয় না। সত্যি বলতে মাত্র ২-৩টা হাসপাতাল ঢাকা শহরে কোনমতে চলার বেতন দেয়। ফলাফল তরুণ চিকিৎসকদের ৭২-৮০ ঘণ্টা পাশবিক শ্রম দিতে হয় স্রেফ ৩০ হাজার টাকার জন্য। ডাক্তারদের অন্যায়ভাবে সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার জায়গায় ৪৮ ঘণ্টা ন্যুনতম কাজ করতে হয়। কোন কোন হাসপাতালে ৪৮ ঘণ্টার পর ওভারটাইম আছে- যা বে-আইনী। বেসিক হিসেব হতে হবে ৪০ ঘণ্টায় কখনোই ৪৮ ঘণ্টায় নয়।

কিন্তু ডাক্তারদের অনেকেই দয়া-দাক্ষিণ্যের চাকরী করেন বলে এ নিয়ে কেউ সোচ্চার নন। ওয়র্কিং আওয়ার নিয়ে আমাদের চিকিৎসকদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। কারণ দেখা যাচ্ছে - এর চেয়ে নিম্ন বেতনে কাজ করার জন্য পুরো পল্টন রেডি। আবার বড় প্রফেসরদের ছেলে-মেয়েদের বেতনের টাকায় সংসার চালাতে হয় না- তাই তারা বেতন বাড়ানো নিয়ে কোন আগ্রহ দেখায় না। মানহীন ডাক্তার, মানহীন সম্মান ও সম্মানী!

মেডিকেল শিক্ষা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবার সময় কারো নেই। অধ্যাপকদের বৃহত্তর অংশই চেম্বার বাদে কিছুই ভাবেন না। বস্তুত এরা ভালো কনসালট্যান্ট হলেও আদৌ এরা কেমন অধ্যাপক তা নিয়ে সংশয় আছে। দেশের সেরা অধ্যাপকদের সংস্পর্শে আসার পর সত্যি বলতে অধ্যাপক আর, আর কৈরী, প্রাণ গোপাল স্যার ও অধ্যাপক শহীদুল্লাহ বাদে কাউকে দেখেই মুগ্ধ হতে পারি নি।

মেডিকেল এজুকেশন নিয়ে শীর্ষ অধ্যাপকদের সাক্ষাৎকারের চেষ্টা করেছি। বলা বাহুল্য চেম্বার ফেলে কেউই সময় দেন নি!

শব্দ পথিক এর ছবি

গুরুত্বপূর্ণ লেখা। ভালো চিকিৎসক হওয়া শেখার ভাল পরিবেশের উপর নির্ভরশীল, চিকিৎসা শিক্ষার ভাল পরিবেশ ভাল হাসপাতাল এবং ডাইভারসিটির উপর নির্ভরশীল।

বর্তমানে যেসব উদ্যোক্তার হাত ধরে বেসরকারী মেডিকেল কলেজ গড়ে উঠছে তাতে শিক্ষার মান নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। আমি মনে করি, জেলার সদর হাসপাতাল ভিত্তিক মেডিকেল কলেজ গড়ে উঠতে পারে সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্বে। জেলা পরিষদ বা জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে সেটার সমন্বয় হতে পারে।

----------------------------------------------------------------
''বিদ্রোহ দেখ নি তুমি? রক্তে কিছু পাও নি শেখার?
কত না শতাব্দী, যুগ থেকে তুমি আজো আছ দাস,
প্রত্যেক লেখায় শুনি কেবল তোমার দীর্ঘশ্বাস!''-সুকান্ত ভট্টাচার্য

নির্ঝর অলয় এর ছবি

ধন্যবাদ।
আসলে বাংলাদেশের মত দরিদ্র দেশে ঢালাও বেসরকারীকরণ অযৌক্তিক। সদর হাসপাতাল-ভিত্তিক মেডিকেল কলেজগুলোতে শিক্ষক-সংকট কোন ভাবেই কাটছে না। অংশীদারিত্ব হতে পারে। তবে সরকারী বা বেসরকারী যাই হোক না কেন স্বাস্থ্যখাত কখনোই মুক্তবাজার অর্থনীতির আওতায় আসা উচিত না। স্বাস্থ্যের সব কিছুই নিয়ন্ত্রিত হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং বিশ্বের সেরা স্বাস্থ্যব্যবস্থাগুলো যেমন ফ্রান্স, ইতালি, যুক্তরাজ্য, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে স্বাস্থ্য নিয়ে যথেচ্ছ ব্যবসা করা যায় না। জাপানে ডাক্তার ছাড়া কেউ ক্লিনিকের মালিক হতে পারে না এবং ক্লিনিক ইত্যাদি দিয়ে লাভজনক ব্যবস্থা আইনত নিষিদ্ধ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।