ডাবলিনের ডায়েরী - ২১ (শেষ পর্ব) [প্রথম খণ্ড]

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী (তারিখ: শুক্র, ০২/০৯/২০১১ - ৩:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

“When I die, Dublin will be written in my heart.”

James Joyce

কিছু কিছু শহর রয়েছে যেগুলো আমাদের হৃদয়ে গেঁথে যায়। তখন আমরা যেখানেই থাকি, যাই করি, সে শহরকে মনে পড়ে। সে শহরের মানুষগুলো, তাদের সাথে কাটানো আনন্দের মুহূর্তগুলো, ব্যস্ত-ফাঁকা রাস্তাগুলো, হঠাৎ ওঠা দমকা হাওয়া যা এক সময় খুব বিচ্ছিরি লাগতো, পাড়মাতালের গায়ে পড়ে মাতলামী করা, এমন কি তিক্ত মুহূর্তগুলোকেও মিস করতে শুরু করি আমরা। এই মিস করার যে অনুভূতি, সেটার জন্ম একটা বোধ থেকে। এমন একটা বোধ যা কৃত্রিম নয়, যা মানুষের গড়ে তোলা নয়। এটা স্বতস্ফূর্ত ভাবে তৈরি হয় হৃদয়ে। এই বোধ একেকটা শহরের সাথে আমাদের আত্মার সম্পর্ক জুড়ে দেয়। আমরা তখন যেখানেই থাকি না কেন, মন সেই শহরকে খুঁজে ফেরে প্রতিনিয়ত।

দু্ঃখজনক হলেও সত্য, আমার জীবনে এরকম কোন শহর ছিল না। এর একটা অন্যতম কারণ হয়তো এই যে আমার শৈশব কেটেছে বিভিন্ন শহরে। আমার জন্ম চট্টগ্রামে। পুলিশ কর্মকর্তা বাবার চাকুরী সূত্রেরই সেখানে জন্ম। জন্মের তিন মাস না কাটতেই বাবা পাবনা জেলায় বদলী হয়ে যান। তারপর দুই বছর পর পটুয়াখালী এবং আরো দুই বছর পর ঢাকা। আমরা চার বছর ঢাকা ছিলাম। ১৯৯১ সনে বাবা বদলী হলেন চাপাই নবাবগঞ্জে এবং তারপর মাদারীপুর, খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহী হয়ে ১৯৯৯ সনে মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে ফিরে এলাম আবার ঢাকায়। সেই থেকে ঢাকায় থাকা পরবর্তী আট বছর। এই আট বছরে দুই বছর কাটে উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র হিসেবে নটরডেম কলেজে, পাঁচ বছর কাটে ব্যাচেলর এবং মাস্টার্সের ছাত্র হিসেবে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং পরবর্তীতে প্রায় এক বছর কাটে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের শিক্ষক হিসেবে উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পুরো সময়টা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ক্লাবিং-এর সাথে জড়িত ছিলাম। ফলে ছাত্র এবং শিক্ষক জীবনকে আমি শেষ বিন্দু পর্যন্ত উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছি। জীবনে ঘাত, প্রতিঘাত এবং সংঘাত এসেছে প্রচুর। কঠিন বাস্তবতাকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করারও সুযোগ হয়েছে। ২০০৬ সনে বাবাকে হারাই। তবুও জীবন চলতে থাকে। জীবনের এই চলার পথে উত্তাল সাগরে পাশে পেয়েছি পরিবারকে, বন্ধুদের, ভালোবাসার মানুষকেও; কিন্তু তবুও কেন যেন ঢাকার সাথে আমার সেই নাড়ির টানটা প্রতিষ্ঠা হয় নি। একটা শহর যে একটা মানুষের জীবনে বিশেষ কিছু হতে পারে সেটা বোঝার এবং উপলব্ধি করার মত সেই বোধটাই হয়তো আমার মনে তখনও সৃষ্টি হয় নি।

তবে হ্যা, সেই বোধ একটু একটু করে সৃষ্টি হতে শুরু করে ২০০৭ সনের শেষ দিকে এসে। মানুষের জীবনে কিছু কিছু পরিবর্তন হয় খুব অদ্ভুত এবং অপ্রত্যাশিত ভাবে। তেমনই একটা পরিবর্তন আমার ডাবলিনে আসা। আমি যখন প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম লন্ডনের কোন একটা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পাবার, তখন অনেকটা অপ্রত্যাশিত ভাবে আমি কম্পিউটার বিজ্ঞানে মাস্টার্স করার জন্যে স্কলারশিপ পাই ট্রিনিটি কলেজ, ইউনিভার্সিটি অব ডাবলিন-এ। কিছুদিন পরই ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়ার জন্যে স্কলারশিপ পাই ডাবলিন সিটি ইউনিভার্সিটিতে। আরো কিছুদিন পর পাই আইরিশ সরকারের রাষ্ট্রিয় স্কলারশিপ। ট্রিনিটির প্রতি আমার একটা অন্যরকম আবেগ কাজ করতে শুরু করেছিল যখন আমি প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টার ক্যাম্পাস দেখেছিলাম। তাছাড়া রেপুটেশনের দিক থেকেও ট্রিনিটি এগিয়ে। তাই কোন রকম দ্বিতীয় চিন্তা না করেই ট্রিনিটিতে পড়তে চলে আসি।

আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, প্রথম যেদিন ডাবলিন এসে নামলাম তখন তাপমাত্রা ছিল ৬ ডিগ্রী। লাগেজ হারিয়ে কনকনে শীতের রাতে কোথায় যাবো বুঝতে পারছিলাম না। সারা রাত এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে ঘুমিয়ে ভোর ছয়টায় বেরিয়েছিলাম ডাবলিনের মুক্ত আকাশে। সেই শুরু। তারপর কেটে গিয়েছে প্রায় চার বছর। সেদিন ভোরে বেরিয়ে সরাসরি চলে আসি ট্রিনিটিতে। যেহেতু শীতের সময় সূর্য ওঠে প্রায় আটটার সময়, তাই তখনও বেশ অন্ধকার ছিল। আমাকে যখন বাসটি অপরূপা ট্রিনিটির গেইটে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, তখন অবাক হয়ে ভাবছিলাম স্বপ্নও মাঝে মাঝে সত্যি হয়!

আমার ডাবলিন জীবনের প্রথম দুই বছর কাটে লেখাপড়ার মাঝেই। স্কলারশীপের টাকাটা নিয়মিত এসে জমা হতো ব্যাংক একাউন্টে। ফলে অর্থনৈতিক কোন চিন্তা আমার ছিল না। প্রথম তিন মাস কাটাই ৪৪০ ইউরো মাসিক ভাড়ায় থাকা একটা সিঙ্গেল কিন্তু তুলনামূলক ভাবে বড় রুমে। বাসাটা ছিল ডাবলিন ৩ এলাকার সমুদ্রের পাড়ে ক্লনটার্ফ সংলগ্ন ভেরনন এ্যভিনিউতে। সারাদিন থাকতাম ল্যাবে। ক্যাফে থেকে আইরিশ স্টু বা এ ধরনের কিছু খেয়ে নিতাম। আর সন্ধ্যার পর দোকান থেকে রোল, পটাটো ওয়েজেস অথবা চিকেন ফিলেট কিনে নিয়ে আসতাম। দুই বেলা খেতাম। মাঝে মাঝে তাও না।

এক অদ্ভুত জীবন কাটাচ্ছিলাম আমি। প্রথম একমাস প্রতিদিন বাসায় ফিরে আমার রুমের দরজাটা বন্ধ করতে করতে নিজেকে বলতাম “আরেকটা দিন শেষ হলো” আর মনে মনে ভাবতাম এভাবে আর কত দিন? আমার সাথে বাসায় থাকতো একটা পোলিশ ছেলে এবং তার ফিলিপিনো গার্লফ্রেন্ড। ঠিক পাশের রুমে ছিল একটা ঘানার ছেলে। নিচে থাকতো একটা ফ্রেন্চ কাপল। কারো সাথেই আমি খুব একটা কথা বলতাম না। বিছানার উপর ল্যাপটপটা রেখে মুভি দেখা এবং দেশে ফোনে কথা - এই ছিল আমার কাজ। পোলিশ ছেলেটার রুমের দরজায় বড় বড় ক্ষত চিহ্ন দেখে অবাক হয়েছিলাম। ঘানার ছেলেটা বলল, “কিছু দিন থাকো, তাহলেই বুঝতে পারবে এর কারণ।” বেশী সময় লাগে নি, এর মাঝে একদিন শুনলাম তাদের ভয়াবহ ঝগড়ার শব্দ। রীতিমত মেয়েটা ছেলেটাকে এবং ছেলেটা মেয়েটাকে মারতো। তাদের এই মারামারির সময় এটা-ওটা ছুড়ে মারার কারণেই দরজার ঐ দশা হয়েছে। আমি কিছু বলি না। চুপচাপ নিজের রুমে সময় কাটাতে থাকি।

একদিন ঘানার ছেলেটা আমাকে নিয়ে গেলো ডাবলিন মস্ক-এ। তারপর থেকে নিয়মিত যেতে লাগলাম। প্রতি শুক্রবার আমি মসজিদে যেতাম দশটার সময়। ওখানে দারুণ খাওয়া পাওয়া যেত। আমি খেয়ে নিতাম প্রথমে। তারপর কোরআনের বাংলা অনুবাদ নিয়ে বসতাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম সুরাগুলো এবং সেগুলোর ব্যাখ্যা। সব ব্যাখ্যা আমি মেনে নিতে পারতাম না। তখন নিজের হাইপোথেসিস দাঁড় করাতে শুরু করলাম। দেখলাম একটা অনুবাদে আমার কাজ হচ্ছে না। তাই বিভিন্ন নাম করা অনুবাদকের অনুবাদ কিনে পড়তে লাগলাম। একদিনের ঘটনা বলি। এখানে বাসে বা ট্রেনে অনেকেই বই পড়ে। এ্যামেরিকার ওয়াশিংটন থেতে প্রকাশিত কোরআনের অনুবাদের একটা পেপারব্যাক সংস্করণ রয়েছে। আমি মাঝে মাঝে সেটা বাসে পড়তাম। সেদিনও ১৩০ রুটের বাসের একদম শেষ সিটে বসে অন্যান্য দিনের মত পড়ছিলাম। হঠাৎ দেখি আমার ঠিক উল্টো দিকে মুখোমুখি বসা এক ভদ্রমহিলা অবাক হয়ে আমার বই-এর নাম পড়ার চেষ্টা করছেন। তার মুখের অভিব্যক্তি ব্যাখ্যা করা কঠিন। সেখানে বিস্ময় ছিল, ভয় ছিল, কিছুটা সম্ভ্রমও ছিল। আমি শুধু হেসেছিলাম।

ঐ বাসায় বেশী দিন থাকা হয় নি। কম ভাড়ার বাসা খুঁজে রীতিমত ডাবলিন থেকে অনেক দূরে ডাবলিন – ২৪ এলাকার বেলিকুলেনে চলে যাই। ৩০০ ইউরো মাসিক ভাড়ায় একটা অতি ছোট রুম নেই। রুমটা এতটাই ছোট ছিল যে বেড থেকে নেমে আমি শুধু কম্পিউটারের টেবিলে বসতে পারতাম। ফাঁকা কোন জায়গা ছিল না। আমার সাথে ঐ বাসায় আরো থাকতো হাঙ্গেরিয়ান কাপল পিটার এবং ওর গার্লফ্রেন্ড মার্থা। বাসায় একটা ডাবল বেডরুম খালি পড়েছিল কিন্তু কেউ ভাড়া নিচ্ছিল না। তাতে অবশ্য পিটার বা মার্থার মাথা ব্যাথা ছিল না। ওরা আয় করতো অনেক। তাই বাসাটাকে নিজেদের মত করে গুছিয়ে নিয়েছিল। আমি আনেকটা সাবলেট-এর মতই থাকতাম ওদের সাথে।

২০০৮ সনের মার্চ মাস। আমি জীবনে প্রথম রান্না করি। ইউটিউব ঘেঁটে ভাত এবং মুরগি রান্নার রেসিপি বের করে রান্না করে ফেলি। খেতে যে খুব ভালো হয়েছিল তা নয়। তবে প্রথম রান্না হিসেবে খারাপ হয় নি। মাঝে মাঝে মার্থাও আগ্রহ দেখাতো আমাদের উপমহাদেশের খাবারের প্রতি। ঝাল খেতে না পারলেও, ঝাল খাবার চেষ্টায় ত্রুটি ছিল না। মাঝে মাঝেই চেখে দেখতো আমার রান্না করা খাবার। আবার কখনও কখনও ওদেরটাও আমাকে খেতে অনুরোধ করতো। মার্থার রান্না করা একটা এ্যাপেল জুস ছিল। সেটা সে প্রায়ই করতো। এবং করলে সব সময়ই পিটারের পাশাপাশি আমার জন্যে করতো এবং রুমে এসে দিয়ে যেতো। সে সময়গুলোর কথা মনে পড়লে এখনও অনেক মিস করি ওদের।

একবার ১৮ দিনের জন্যে পিটার হাঙ্গেরি গেলো। মার্থা এবং আমি বাসায় একা থাকতাম। এক রাতে হঠাৎ দরজায় নক করার আওয়াজ পেলাম। দেখি মার্থা দাঁড়িয়ে আছে। চোখ লাল। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? সে জানালো পিটারকে খুব মিস করছে। আমি অবাক হয়ে সম্ভমের চোখে তাকিয়ে রইলাম মেয়েটার দিকে। তারপর মার্থা বললো আমি কি তোমার রুমে আসতে পারি? আমি বললাম আসো। কিন্তু আমার রুমতো অনেক ছোট। বসলে বিছানায় বসতে হবে। মার্থা তাতেই রাজি হয়ে এসে বিছানায় বসলো। তারপর প্রায় দুঘণ্টা গল্প করলাম। মূলতঃ আমার প্রচেষ্টা ছিল মেয়েটাকে স্বাভাবিক করা, ওর লোনলিনেসটা কাটানো। তাই মার্থাকে ওদের সম্পর্কের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম। মার্থাও আনন্দের সাথে গল্প বলতে লাগলো। ছয় বছরের সম্পর্ক। ওদের দেশে একটা চমৎকার হৃদ রয়েছে। সেখানে এক বিকেলে পিটার মার্থাকে প্রোপোজ করে। মেয়েটা যখন আমাকে গল্প বলছিল তখন ওর চোখেমুখের উচ্ছ্বাস দেখেই বুঝতে পারছিলাম সে কতটা আনন্দিত ছিল। সেদিন অনেকক্ষণ গল্প করে মার্থা চলে যায়। পরদিন সকালে সে আমার রুমে এসে আবার নক করে। তারপর বলে, “তুমি কি আমার সাথে শপিং-এ যাবে? আমার একা শপিং করতে ভালো লাগে না।” ভেবে দেখলাম আমারও কিছু জিনিস শপিং করতে হবে। তাই রাজি হয়ে গেলাম। কিন্তু শপিং-এ গিয়ে বুঝলাম মার্থা একা শপিং করে অভ্যস্ত না। ওর স্বভাব ছিল সে শপিং করবে এবং একজন সেটা বয়ে নেবে। সব সময় কাজটা পিটার করতো। কিন্তু তার অবর্তমানে মার্থা ব্যাগগুলো আমার হাতে ধরিয়ে দিতে শুরু করলো। প্রথমে একটু বিরক্ত লাগলেও পরে আমার মজাই লাগছিল।

যাইহোক, এভাবে কেটে যাচ্ছিল আমার জীবন। ৭৪ রুটের বাস ধরে বাসা থেকে ল্যাব এবং ল্যাব থেকে বাসায় যাওয়া। সিনেওয়ার্ল্ডে মুভি দেখা এবং ফুটবল ম্যাচ। মন্দ ছিল না জীবন। সমস্যা ছিল একটাই, আমার এলাকাটা ছিল খুব নিরিবিলি। জাঙ্কিদের উপদ্রব ছিল কিছুটা। তারা মাঝে মাঝে গাড়ি থেকে মাথা বের করে গালাগাল করতো। কখনও বা আরেকটু বেশী। একদিনের ঘটনা, আমি বাসের জন্যে স্টপেজে দাঁড়ানো। হঠাৎ দেখি একটা কারে কিছু টিনএইজার যাচ্ছে। তারা আমার সামনে দিয়ে যাবার সময় আমাকে উদ্দেশ্য করে কিছু কটুক্তি করে। আমি বরাবরের মত পাত্তা দেই না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। কিছুক্ষণ পর দেখি তারা আবার উল্টা দিক থেকে ঘুরে আসছে। তারপর একজন মুখে পানি নিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা সহ শরীরটা বের করে এনে সরাসরি আমার মুখে পানিগুলো ছিটিয়ে দিয়ে যায়। মুহূর্তে আমি হতবাক হয়ে যাই। সেই প্রথম আইরিশদের ব্যবহার আমাকে ব্যথিত করেছিল। তবে এটাকে আমি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে ধরে ভুলে যাওয়াই শ্রেয় মনে করি কিন্তু মাঝে মাঝে সেটা কাঁটার মত বিধতে লাগলো বুকে।

আরো কিছুদিন কেটে যায়। হঠাৎ একদিন মার্থা বলল ওর বান্ধবী গ্যাব্রিয়ালা এসে আমাদের সাথে থাকবে। মেয়েটা সিঙ্গেল ছিল কিন্তু রিলেশনে যেতে ইন্টারেস্টেড। মার্থা আমাকে বেশ কয়েকবার বলল আমার কোন বন্ধু যদি রিলেশনে যেতে চায় তাহলে যেন গাব্রিয়ালার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। আমি দেখলাম ঝামালেয় জড়িয়ে কাজ নেই। তাই মুখে চেষ্টা করবো বললেও সাহায্যের তেমন কোন আগ্রহ দেখালাম না। একদিন মার্থা এসে আমাকে বলে, বাংলাদেশি ছেলেরা বয়ফ্রেন্ড হিসেবে খুব ভালো। শুনেতো আমি অবাক? জিজ্ঞেস করলাম এই হাইপোথেসিস-এর কারণ কী? তারপর সে জানালো তার এক বান্ধবী বাংলাদেশি এক ছেলের সাথে সম্পর্কে আছে। সেই বলেছে। বাংলাদেশি ছেলেরা খুব কেয়ারিং এবং অনেস্ট। মার্থা এটাও জানালো সেই ছেলে তার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে বাংলাদেশে যাবে কিছুদিন পর। আমি মুখে কিছু বলি না কিন্তু মনেমনে আতঙ্কিত হই।

হঠাৎ একদিন দেখি গ্যাব্রিয়ালা খুব মনোযোগ দিয়ে বাসা পরিষ্কার করছে। আমাদের বাসায় বাথরুম ছিল তিনটা যার একটা পিটার-মার্থা, একটা আমি এবং একটা গ্যাব্রিয়ালা ব্যবহার করতো। সেদিন দেখি সে এসে আমার বাথরুমও ক্লিন করে দিচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে। সে জানালো একটা স্প্যানিশ ছেলের সাথে তার সম্পর্ক হবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সেই ছেলে আজ বাসায় খেতে আসবে। সেজন্যে এত আয়োজন। সেই শুরু, এরপর কয়েক মাস মেয়েটাকে দেখলাম ভালোবাসায় ডুবে থাকতে। ছেলেটা মাঝে মাঝেই এসে মেয়েটার সাথে থাকতো। কখনও মেয়েটা থাকতো ওর বাসায়। চারদিকে একটা অন্যরকম ভালো লাগার পরিবেশ দেখতে পেলাম। আমরা সবাই অনেক সুখী ছিলাম তখন।

তারপর নেমে এলো রিসেশন। এ্যামেরিকা থেকে শুরু হয়ে ভয়াবহ গতিতে রিসেশন এসে ধাক্কা দিল কেলটিক টাইগার খ্যাত ইকোনমিক ব্যুমে থাকা আইরিশ অর্থনীতিকে। হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়লো এখানকার জনজীবন। ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হতে শুরু করলো। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় দেখতে পাই হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়ে যাচ্ছে। চারদিকে একটা আতঙ্ক। অর্থনীতিবিদরা রাজনীতিবিদদের দোষ দিচ্ছেন, রাজনীতিবিদরা অর্থনীতিবিদদের। এরকম সময়ে একদিন পিটার এসে আমাকে বলল ওদের জব চলে গিয়েছে। ওরা আর আয়ারল্যান্ড থাকতে পারছে না। তাই বাড়িটা ছেড়ে দেবে। আমিও বুঝি ওদের অবস্থা। তাই অন্যত্র বাড়ি খোঁজা শুরু করলাম। এরই মাঝে মার্থা এসে জানালো ওর বান্ধবী বাংলাদেশে গিয়েছিল। সেখানে তার শাশুড়ী খুবই খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করে। গরমে এবং ডায়েরিয়াতে মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পড়লে ওকে হসপিটালে ভর্তি করে দিয়ে ছেলেটা গায়েব হয়ে যায়। তারপর অনেক কষ্টে মেয়েটা আবার আয়ারল্যান্ড ফিরে আসে। তারপর মেয়েটা সবাইকে বলেছে বাংলাদেশী ছেলেরা খুব খারাপ। কখনওই যেন এদের সাথে সম্পর্কে না যায়। আমি কিছু বলি না। শুধু শুনে যাই।

রিসেশসের কারণে বাড়ি ভাড়া তখন চরম ভাবে কমে গিয়েছে। আমি মাত্র ৩৫০ ইউরো দিয়ে একটা বিশাল আকৃতির (সবাই বলতে ট্রিপল রুম) রুম নিলাম ডাবলিন ৫ এর আরটেইন সংলগ্ন এলাকায়। এর মাঝে মার্থা এবং পিটার হাঙ্গেরি চলে যায়। আমার পুরোনো বাসায় গ্যাব্রিয়ালাই একা ছিল। আমি নূতন বাসায় ওঠার দুই দিনের মাথায় সে আমাকে টেক্সট পাঠায়, ইন্টারনের বিলটা দিয়ে আসার জন্যে। সেও বাসা ছেড়ে দিবে। সাথে এটাও লিখলো, “আইএ্যাম টোটালি ব্রোকেন”। আমি দ্রুত টাকা তুলে দিতে গেলাম পুরোনো বাসায়। বেশ কয়েকবার বেল বাজানোর পর দেখি গ্যাব্রিয়ালা এসে দরজা খুলে দিল। স্মোকি আইজ মেকআপে মেয়েটা অন্যরকম সুন্দর লাগছিল তখন। কিন্তু সেই চোখে কান্নার কারণে মেকআপের কালো রং চোখের পানির ধারার সাথে নেমে এসেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? গ্যাব্রিয়ালা জানালো ওর বয়ফ্রেন্ডের কোন জব নেই এখন। তাই সে স্পেন ফিরে যাবে। ফলে গ্যাব্রিয়ালার সাথে সম্পর্ক রাখা আর তার পক্ষে সম্ভব হবে না। ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে। কিন্তু বাস্তবতার কারণে ওদের মিউচুয়ালি সেপারেট হতে হচ্ছে। কথাটা শুনে আমার কেমন লাগছিল আমি বলে বোঝাতে পারবো না। আবাক হয়ে দেখছিলাম অর্থনৈতিক মন্দা শুধু বাজারেই ধস নামায় নি, মানুষের ভালোবাসাকেও আঘাত করেছে। পরিবেশ এত গুমট ছিল যে আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না। দ্রুত বিলের টাকাটা দিয়ে বেরিয়ে আসতে যাই। তখন গ্যাব্রিয়ালা জানালো, সে আজ শেষ বারের মত তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করবে একটু পর। তারপর হাঙ্গেরি চলে যাবে। আমি যেন যোগাযোগ রাখি। আমি হাসি কিন্তু সেটা আদৌ হাসি হয়েছিল কিনা সন্দেহ আছে। আমি গ্যাব্রিয়ালাকে হাগ দেই, তারপর বেরিয়ে আসি। আসার ঠিক আগ মুহূর্তে আমি আবার দেখলাম দুটো চোখ যেখানে মেকআপের কালো গড়িয়ে পড়েছে পানির সাথে। অদ্ভুত সুন্দর দুটো চোখ। অদ্ভুত ব্যাথাতুর দুটো চোখ। আমি রাস্তায় বের হয়ে গ্যাব্রিয়ালার পাঠানো ম্যাসেজটা ডিলিট করতে গিয়ে আবার পড়ি, “আইএ্যাম টোটালি ব্রোকেন”। আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে। আমি ডিলিট বাটন থেকে হাতটা সারিয়ে ফেলি। ম্যাসেজটা আজও ডিলিট করা হয় নি। (আগামী খণ্ডে সমাপ্ত হবে)

২ সেপ্টেম্বর ২০১১
ডাবলিন আয়ারল্যান্ড।


মন্তব্য

 তাপস শর্মা  এর ছবি

কেয়া বাত হে ।
চলুক

বেতালা অনুভূতি । স্যালুট

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

অসংখ্য ধন্যবাদ হাসি

মিলু এর ছবি

একটানে পড়ে শেষ করলাম। ভালো লাগছিল। শেষটায় মন খারাপ করা।

মিলু এর ছবি

বাই দ্য ওয়ে নিয়াজ ভাই, 'অন্বেষা' গল্পটা আর লিখছেন না কেন? প্রতিবারই আপনার নতুন পোস্ট 'অন্বেষা'-র পরের পর্বটা হবে বলে ভাবি। শেষে নতুন পোস্ট দেখে আশাহত হতে হয়। পাঠককে এভাবে গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নিয়ে আর কতকাল বসিয়ে রাখবেন? ইয়ে, মানে...

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

আপনাদের আগ্রহকে কোন ভাবেই ছোট করে দেখার অবকাশ বা সাহস আমার নেই হাসি । তবে নিরন্তর-৩ লেখার চাপে অন্বেষা শেষ করতে পারছি না। কথা দিচ্ছি নিরন্তর-৩ শেষ হলেই অন্বেষা শেষ করবো।

শোয়েব মাহমুদ সোহাগ এর ছবি

সারাটা দুপুর রিমঝিম বৃষ্টি পরছে, তার মাঝে আপনার এ লেখাটা পড়ে আরো বেশী বিষন্ন হয়ে গেল মনটা।
চলুক

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

লেখাটা পড়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ। সাধারণতঃ ডায়েরী জাতীয় লেখা খুব একটা পড়ে না কেউ। আপনি দেখছি ব্যতিক্রম হাসি

নজমুল আলবাব এর ছবি

কি চমৎকার টান টান গদ্য। অপেক্ষায় থাকলাম শেষটা জানার জন্য।

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

লেখাটা আগ্রহ নিয়ে পড়ার জন্যে ধন্যবাদ। শেষটা গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করছি। শেষ হলেই পোস্ট দেব। শুভেচ্ছা রইলো।

Kamrul Hasan এর ছবি

ডাবলিন যাইতে মুঞ্চায়। তা ভাই ওই খানে মোটামুটি মান্তলি খরচ (ইউ এস ডি) কত? ছয় মাসের জন্যে ট্রাভেল দিতাম।

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

সাতশ ইউরো হলে ভালো ভাবে থাকতে পারবেন এক মাস। ইউ এস ডলারের হিসেবে সেটা হবে প্রায় এক হাজার ডলার (আজকের রেটে ৯৬৫ USD)

তারেক অণু এর ছবি

ডাবলিনে থাকবেন তো সামনের সামারে ?

নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী এর ছবি

ডাবলিন ছেড়ে চলে এসেছি সব বাধন ছেড়ে। তবে আগামী সামারে ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। হাসি

রিশাদ_ ময়ূখ এর ছবি

অতি চমৎকার বর্ণনা

শহরবালক এর ছবি

আপনার ডাবলিনের ডায়রির সব পর্বগুলোর লিংকগুলো একসাথে চাই।
ভালো থাকবেন।

***ইকরাম****

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।