বন্ধু গাছ ও একটি খেলার মাঠ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ০৯/০৯/২০১১ - ৬:৩০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাকে সবাই কাব্য বলে ডাকে। নামটা আমার ছোটমামার দেওয়া। মামা ছড়া-কবিতা লেখে। আমাকে নিয়েও লিখেছে কয়েকটা। সবাই বলে, আমিও নাকি মামার মতো হয়েছি।

আমাদের বাসাটা চারতলায়। বাসার সামনেই খেলার মাঠ। চারদিকে অনেক গাছ। একটা গাছ রাস্তা পার হয়ে আমার ব্যালকনিতে এসে লেগে গেছে। বাবা একবার ডাল কেটে দিতে চেয়েছিল। রোদ না আসলে কাপড় শুকাতে নাকি সমস্যা হয়। আমার জন্যেই পারেনি। বাবা আমার উপর রাগ করলেও মামাকেই গালাগাল দিল। মামাই নাকি আমার মাথাটা নষ্ট করছে।

মামা আমাদের বাসায় প্রায়ই আসে। একদিন জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা মামা, এই গাছটা আরও বড় হলে আমার ঘরে ঢুকে যাবে?
মামা বলল, তার আগেই তোর বাবা কেটে ফেলবে। আমি চেতে উঠলাম। বললেই হলো? আমি কাটতে দিলে তো?

আমার বয়স এখন দশ। ছোটবেলায় মাঠটা অনেক বড় ছিল। আমাদের বাসায় ফ্যানই চালাতে হতো না। এখন আর অাগের মতো বাতাস ঢোকে না। একদিন বাবার কাছে জানতে চাইলাম-
- আচ্ছা বাবা, আমাদের মাঠটা দিনদিন ছোট হয়ে যাচ্ছে কেন?
- তুই বড় হচ্ছিস তো। তাই তোর কাছে ছোট লাগছে।
- তুমি কি আমাকে বোকা মনে কর? আমি যেন কিছুই বুঝি না? তাহলে ঐ বিল্ডিংটা, ঐ ক্লাবটা কীভাবে এলো?
- ওরা কিনে নিয়েছে।
- আমাদের খেলার মাঠ ওরা কিনে নেবে কেন? তুমি তো কিনতে যাওনি?
- আমার কি সেই ক্ষমতা আছে?
- থাকলে কিনতে?
- কিনতাম না মানে?
- তোমরা বড় হলে না, বুদ্ধি কমে যায়!

বাবা খুব রেগে গিয়ে একটা থাপ্পড় মেরেছিল। আগে কখনও মেরেছে কি না মনে পড়ে না। পরে মা আমার মাথার চুল নাড়তে নাড়তে বলল, বাবাকে কেউ ওভাবে বলে?
- বাবা আমার সাথে মিথ্যে কথা বলল কেন?
- কী মিথ্যে বলল?
- তোমরা কী মনে কর? ছোটরা কিছুই বোঝে না? তোমরাই কিছু বোঝ না!

মাকে সেই ঘটনা খুলে বললাম। আমাদের মহল্লার জয়নব চাচা। বাচ্চাদের দেখলেই তার চাঁদি গরম হয়ে যায়। একবার খেলতে গিয়ে বল চলে গিয়েছিল তার সীমানায়। সেটাও মাঠেরই জায়গা। বেড়া দিয়ে নিজের জায়গা করে নিয়েছে। ব্যাটা আমাদের কান ধরে মাঠ থেকে বের করে দিয়েছিল। তারপর দেখলাম বেড়া দেওয়া জায়গার গাছ কেটে ফেলা হলো। এখন সেখানে বিরাট বিল্ডিং। ইচ্ছে করে, বল মেরে জানালার সব কাঁচ ভেঙে দিই!

আমার কথা শুনে মা যেন কথা খুঁজে পেল না। শুধু বলল, তুই এতোকিছু খেয়াল করিস? মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেল।

সেদিন শুক্রবার। মামাও এসেছে বাসায়। মামা আর আমি ব্যালকনিতে বসে। আমাকে নিয়ে নতুন একটা ছড়া লিখেছে।

কাব্য যখন একা রয়,
গাছের সাথে কথা কয়।
গাছের পাতা দিলে ডাক,
ছোটে কাব্য যেথায় থাক।
বিরাট গাছের গর্ব নাই,
ছোট্ট ছেলের বন্ধু তাই।

মামাকে দিয়ে ছড়াটা ফ্রেশ কাগজে লিখে নিলাম। পাশে আমার বন্ধু গাছের একটা ছবি আঁকলাম। বন্ধুর চেহারার মতো অবশ্য হলো না। মামা এবার একটা ছেলের ছবি আঁকল। গাছটাকে জড়িয়ে ধরে আছে। বুঝলাম, এটা আমিই। রঙ করে আমার ঘরে টাঙিয়ে রাখলাম।

বাবা বলে, মামা নাকি সব পারে, শুধু টাকা কামাতে পারে না। মা এটা শুনলেই ক্ষেপে যায়। প্রায়ই দেখি মা চুরি করে মামাকে টাকা দেয়। আমি বুঝি না। সাংবাদিকরা বেশি বেতন পায় না বুঝি?

একদিন চোখ মুছতে মুছতে ব্যালকনিতে গিয়ে চোখ কপালে উঠে গেল। কারা যেন ফিতা দিয়ে মাঠের মধ্যে মাপামাপি করছে। চিৎকার করে মাকে ডাকলাম। মা বলল, কিছু একটা করবে বোধহয়, জানি না। বাবাকে ডাকলাম। বলল, বোধহয় বিল্ডিং উঠবে।

বাবা খুব নিষ্ঠুর। তাই এমন নিষ্ঠুর কথা বলতে পারল। খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। তাহলে তো আমার বন্ধুকেও কেটে ফেলবে! কী করবো ঐ সব ছড়া-টড়া দিয়ে?

কয়দিন মাঠ একেবারে চুপচাপ। কেউ খেলতে আসতে পারছে না। মাঠের গেটে তালা দেওয়া। বাবাকে কিছু বললে ধমক দেয়। যেন ছোটদের কথার কোন দামই নেই! তবুও সাহস করে বলেই ফেললাম। বাবা শুনে বলে, ভাড়া বাসায় থাকি। ওসব নিয়ে আমাদের ভেবে কাজ নেই।

তাই বলে এতোগুলো গাছ কেটে ফেলবে? আমার বন্ধুকেও? মাঠ না থাকলে আমরা খেলবো কোথায়? কী করবো বুঝতে পারছি না।

হঠাৎ একটা বুদ্ধি এলো মাথায়। মামাকে ফোন দিলাম। একে একে আমার সব বন্ধুকেও। ওদেরও খুব মন খারাপ।

মামা এলো। দেখি মামাও বড়দের মতো কথা বলছে! বলে কিনা, কী আর করবি বল? মানুষের লোভ অনেক বেড়ে গেছে। ওদের অনেক ক্ষমতা। সবাইকে কিনে নিতে পারে। আটকানো যাবে না।

আমি পুলিশকে ফোন দেওয়ার কথা বললাম। কিন্তু নাম্বার? মামা বলল, সে তো নেটেই পাওয়া যাবে। কিন্তু লাভ কী?
- চেষ্টা করেই দেখ না, মামা। আমি নাছোড়বান্দা।

মামা পুলিশকে ফোন করল। পুলিশ নাকি বলেছে, 'নিজের চরকায় তেল দ্যান'।

মামা হাত তুলে বলল, হবে না।
- পুলিশের চেয়ে বেশি ক্ষমতা কার?
- এম.পি-দের, মন্ত্রীদের।
- তাদের কাউকে ফোন করা যায় না?
- যায়। উনারা কি আর কথা বলবে? এখানে উনাদের ভাগ আছে না?

বুঝলাম, মামাও বড় হয়ে গেছে। বড়দের মতোই কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না। আমার পাল্লায় পড়ে মামারও না বলার সুযোগ নেই। নেট থেকে আমাদের এলাকার এম.পি-র নাম্বার বের করে দিল। সব বন্ধুকে নাম্বার দিয়ে দিলাম।

সকালে ফোনে পেলাম না। দুপুরেও না। রাত দশটা বেজে গেল। অন্য কেউ ধরে বললেন, তিনি বাসায় ফেরেননি।

রাত এগারোটায় আবার ফোন দিলাম। এবার একটু মোটা গলা শুনতে পেলাম।
- তুমি আগেও অনেকবার ফোন করেছিলে?
- হ্যাঁ। আপনাকে খুব দরকার।
- বল কী সমস্যা?

এ.পি আঙ্কেলকে সব বুঝিয়ে বললাম। মনে হল, উনি সবই জানেন। সরকার নাকি কাকে কাকে লিজ দিয়েছে। লিজ মানে জানতাম না। ডিকশনারি দেখে নিলাম।

আমার সব বন্ধু একে একে ফোন দিয়েছে। রাত্রে বোধহয় ঘুমাতেই দেয়নি আঙ্কেলকে।

আমার ডে-শিফ্টে স্কুল। সকালে তাই বাসা-ই থাকি। হঠাৎ মাইকের শব্দ শুনতে পেলাম। একলোক হ্যান্ড মাইকে বলছে-

“প্রিয় এলাকাবাসী, আপনাদের অবগতির জন্য জানানো যাইতেছে যে, এই বর্ণালী মাঠের গাছ কাটা এবং কোন বিল্ডিং উঠানোর ব্যাপারে অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করা হইয়াছে।"

হৈ চৈ করে ব্যাট-বল নিয়ে মাঠে চলে এলাম। সবুজ, অমিয়, বাদল, ফিরোজ, দীপক, সাগর, আরিফ সবাই এসেছে। আজ আমাদের খুশির সীমা নাই! বোলিং করলে যেন ব্রেট লি-র মতো জোরে ছুটছে। ব্যাটিংয়েও তাই। চার মারতে গিয়ে ছয় হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে, ছয় মেরে মেরে জানালার ঐ অবৈধ কাঁচগুলো ভেঙে গুঁড়ো করে দিই!

আমার গাছ বন্ধু আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন বলছে, সাবাস বন্ধু!
............................................................................................
দেবানন্দ ভূমিপ্ুত্র


মন্তব্য

মৌনকুহর এর ছবি

বাচ্চা-কাহিনী ভালু পাই চলুক

আচ্ছা, 'জয়নব' কি ছেলেদের নাম হয়? কখনও দেখি নি কিন্তু।

-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-
ফেসবুক -.-.-.-.-.- ব্যক্তিগত ব্লগ

দেবানন্দ ভূমিপুত্র এর ছবি

আপনি ঠিকই ধরেছেন। কষ্ট করে জয়নাল পড়ে দিয়েন। সতত শুভকামনা।

আশফাক আহমেদ এর ছবি

ইদানীং বাচ্চাদের নিয়ে কেউ লিখছে দেখে বেশ ভালো লাগলো।
বাচ্চা কাহিনী চলুক।
আর সাহিত্য সমালোচনা করার মত বিদ্যা-বুদ্ধি আমার নেই, ভাই। ভালো লেগেছে, এটুকুই জানিয়ে গেলাম। পড়ে মনে হয়নি, বয়স্ক কেউ লিখেছে। কোন বাচ্চা যদি খাতাকলম পেত, তবে ঠিক এইভাবেই গল্পটাই লিখতো---এমনটাই মনে হয়েছে

-------------------------------------------------

ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

দেবানন্দ ভূমিপুত্র এর ছবি

এটা তো অনেক বড় কমপ্লিমেন্ট। আমি নিজের সাথে যুদ্ধ করছি গল্পের ভাষা ও বিন্যাস শিশুতোষ করতে। এখানে গল্প কথকের বয়স ১০। পড়ে যদি মনে হয় এটা এই বয়সী কেউ বলছে, তাহলে পাচ্ছি মনে। আর সমালোচনা আমরা সবাই করতে পারি। কেউ আঁতলামী করে আর কেউ সরল অনুভূতি প্রকাশ করে। পরেরটাই বেশি দরকারী বলে মনে করি। শুভকামনা অবিরাম।

অতিথি অন্যকেউ এর ছবি

আপনার কথনবিন্যাস বেশ ভালো লাগলো। তবে একটু তাড়াহুড়োর ঘ্রাণ আছে যেন। আরেকটু বিস্তৃত হলে আরও ভালো হোত। মূল বিষয়টা থেকে একেবারেই দূরে সরেননি। আশপাশের অন্য কিছু এলিমেন্ট যোগ করে পাঠককে কিছুটা বাড়তি দৃশ্যকল্প হয়তো দিতে পারতেন। না দেয়াটা এখনও মন্দ কিছু নয়, তবে এই বাড়তি সময়টুকু গল্পের সাথে আত্মীয়তাটা বাড়িয়ে তুলতে পারতো আরও।

সব মিলিয়ে ভালো লেগেছে। চলুক

দেবানন্দ ভূমিপুত্র এর ছবি

সহমত জানাচ্ছি। ভাবলাম, ছোটদের গল্প গতরে বড় হয়ে গেলে শিশুরা বেকায়দায় পড়তে পারে। যদিও ব্লগের পাঠক আলাদা ধরণের। খেলার মাঠ নিয়ে, গাছ নিয়ে বা কাব্যর বন্ধুদের নিয়ে আরও কয়েকটা দৃশ্যকল্প অবশ্যই লেখা যেত। বিষয়টা নিশ্চয়ই ভেবে দেখবো। সতত শুভকামনা।

রিশাদ_ ময়ূখ এর ছবি

শিশুতোষ গল্প ভালো লাগল। আমি আমার আগের লেখায় ভুল করে কিশোর ট্যাগ দিয়ে ফেলেছিলাম। সেখানে আপনার মন্তব্য পেয়েছিলাম, উত্তর দিয়েছি পড়ে

দেবানন্দ ভূমিপুত্র এর ছবি

উত্তরটা দেখেছি আমি। আমারও সেটাই মনে হচ্ছিল। তবে আপনার গল্পে ভিন্নতা আছে। চালিয়ে যান।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।