এ ও সে ও : ০৪ কল্পনার ফ্রিদা ও বাস্তবের ঝুমি

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: শুক্র, ২৩/০৯/২০১১ - ১:২৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার মনে হয়, আমরা প্রত্যেকেই এমন একজনকে ভালবাসি - যে কি না, আসলে এই পৃথিবীতেই থাকে না। আমাদের মনের মধ্যে ওরা কোথাও থাকে। বাইরের পৃথিবীতে ওদের ছায়া পড়ে। সেই ছায়ার আদল কারো মুখে খেলে গেলে আমরা তাদের প্রেমে পড়ি।
ফ্রিদা হলো সেই মেয়েটা - যাকে আমি ভালবাসি। আমার যখন পুরনো দিনের কথা মনে হয় তখন ফ্রিদার কথা মনে হয়। আমি যখন আগামীর কথা ভাবি তখনও ফ্রিদার কথা মনে হয়। আমি যখন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মত বিরাট হয়ে উঠি তখন ফ্রিদার কথা মনে হয়। আবার শূন্যতায় টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ি তখনও ফ্রিদার কথা মনে হয়। কলেজে, বাসায়, রাস্তায়, বাজারে, মাঠে, কেমেস্ট্র্রি বই এর পাতায়, চাকরীতে- কোথায় না ... যখন তখন মনের মধ্যে হুটহাট রাত নেমে আসে।
সেই রাতের আকাশে একটা গোল চাঁদ উঠেছে- আর অনেক নিচ দিয়ে, প্রায় মাথার উপর দিয়ে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ উড়ে যাচ্ছে।
ছাদে দাঁড়িয়ে আছে ও- একা। মাতাল একটা বাতাস উঠেছে - সেই বাতাসে চুলগুলো উড়ে ওর মুখের উপর পড়েছে। স্নিগ্ধ একটা আলো আর রহস্যময় অন্ধকারের একটা অস্পষ্ট মায়ামূর্তির মত মনে হয় ওকে। আমি বাতাসে ভর করে ফ্রিদার কাছে চলে আসি। মাইকেল জ্যাকসন যেমন বাতাসের সাথে উড়ে উড়ে থেমে থেমে বয়ে বয়ে নেচে যায় তেমনি করে ফ্রিদাকে ঘিরে আমিও শিশুর মত নাচতে থাকি। ফ্রিদার আধারে ঢাকা মুখের হাসি চাঁদের আলো হয়ে আমাকে ছুঁয়ে যেতে থাকে।
ফ্রিদার মুখটা আসলেই আমি কখনও দেখিনি। আকাশের গায়ে চাঁদ দেখে যেমন তার আসল চেহারাটা বোঝা যায় না ফ্রিদাও আমার কাছে ঠিক তেমনি। কলেজের ইংরেজী ম্যাডামের বাসায় পড়া বুঝে নিতে গেলে ফ্রিদাও মাঝে মাঝে দরজাটা খুলে দিত- কিন্তু সাহস করে মুখ তুলে ওর মুখের দিকে কখনও তাকাতেই পারি নি। গ্রামার বইয়ের খটোমটো স্ট্র্রাকচারগুলো পূরণ করতে করতে কানদুটো খাড়া করে রাখতাম। ফ্রিদার দু’একটা উচ্ছ্বল শব্দ, চপল পায়ের আওয়াজ যদি ভেসে আসে। মাঝেমধ্যে চকিতে হটাৎ হটাৎ ওর একটা অস্পষ্ট অবয়ব পর্দার আড়ালে উঁকি দিয়ে চলে যেত - আবার হয়তোবা মৃদু কোন একটা মিষ্টি গান ভেসে আসতো ওর ঘর থেকে। পড়ার মধ্যে কিছুতেই মন বসতো না। খালি মনে হতো - ঐ গান বুঝি আমাকে শোনাবার জন্যই ও বাজাচ্ছে। ইংরেজী ম্যাডামের লাল কালির দাগে পুরো খাতা ভরে যেত। বুঝতে পারতাম - শৈশব আর বালকবেলার আবছা একাকীত্ব বিরাট হয়ে ফ্রিদার জন্য একটা মূর্তি বানিয়ে বসে আছে। রানু আর তুলির জন্য অষ্পষ্ট অনুভূতিগুলো শেষপর্যন্ত ফ্রিদা হয়ে জঁমাট বাঁধে। বুকের মধ্যে এইসব অনুভূতি চেপে থাকে সারাক্ষণ। একটা দমবন্ধ করা গানের মত।
বিনুদি একবার বলেছিল, বালিশের নিচে কারো নাম লিখে রেখে দিলে সে নাকি তার স্বপ্ন দেখে।
আমি ফ্রিদার নাম লিখে বালিশের নিচে রেখে দেই। ঘুমে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে আসা পর্যন্ত ভাবি, ফ্রিদা আমাকে দেখছে।
পৃথিবীর সব প্রেমের গল্পগুলোই যেন ও আর আমাকে নিয়ে লেখা। বই এর পাতার ভেতরে মুখ গুঁজে নিজেকে কল্পনার নায়ক বানিয়ে ইচ্ছের ময়ূরকণ্ঠী ভাসিয়ে নিয়ে বেড়াই- কল্পনার মেঘে আমি জন লেনন, এলভিস প্রিসলি ... গিটার হাতে পৃথিবীর সমস্ত সুর ফ্রিদাকে উদ্দেশ্য করে বাজিয়ে যাই।
এইতো, স্কুলের ডাকসাইটে নিয়মভাঙা ছেলে ফিরোজ একদিন নিজেকে নষ্ট করলো সংসদ ভবনের উদ্যানের ছায়াময় অন্ধকারের হাতছানিতে। ফিরোজের উত্তেজিত ভঙ্গী আর - সবার উন্মুখ মুখ চোখে ভেসে ওঠে। অজানা কিন্তু দুর্নিবার আকর্ষণে স্থির হয়ে ফিরোজের কথা শুনতে শুনতে - কল্পনার মধ্যে দৃশ্যগুলো জাগিয়ে তুলতে তুলতে সবাই ভাবে- গাছ আর দূরের বাতিগুলোর আধো আলো অন্ধকারে সেই মেয়েটি সাপের মতো জড়িয়ে ধরে ফিরোজ নয়, তাদেরই ঘাড়ে গরম নিঃশ্বাসের হলকা ছোটাচ্ছে। সবাই ঘাড়ে হাত দিয়ে সেই পোড়া জায়গাটা অনুভব করে।
‌নষ্ট হবার কষ্ট আছে - এই কষ্ট তুমি সহ্য করতে পারবে না।
ফ্রিদা কানে কানে বলছিল।
-'এখানে থেকো না। এখানে থাকলে তুমি নষ্ট হবার কষ্টে আরও নষ্ট হয়ে যাবে। থেকো না এখানে। চলে এসো... চলে এসো বলছি।'
ফিরোজের নষ্টগল্পের হাতছানি থেকে ফ্রিদার ডাক শুনে বেরিয়ে আসি। কেউ টের পায় না। সবাই তখন নষ্ট গল্পে নিজেকে নষ্ট করায় মগ্ন।
অনেক দূর যেতে হবে, আমাকে... হাঁটতে হাঁটতে আমি ভাবি।
নিজেকে তখন এত বড় মনে হচ্ছিল যে নিজেকে শুধু নিজের মনে হয় না, মনে হয় আমি ঐ তারাদেরও।
তারারা কত দূরের দেশের- কিন্তু ওরাও কখনও কখনও এ-ত নিচে এসে নামে, মনে হয় এইতো সে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে .. ফ্রিদা! আমার ছোট্ট খুকী।
বদ্ধ ঘরের জানালা গলে আকাশ দেখতে গিয়ে পর্দায় দৃষ্টি আটকে গেলেও তখন মনের দরজা খুলে হুড়মুড়িয়ে ঢোকে হু হু আকাশ। ওরা এক্কা দোক্কা খেলে, কখনও দোলনার দোল দোলে। মনে হয় ওদের সাথে মিলে- আমার ছোট্ট খুকী তুমি, বায়না ধরেছো - ‘মেলায় যাবো’। সাথে সাথে সোরগোল বাঁধিয়ে প্রথমে এলো রাজ্যের যত বাজনদার, তাদের ঢাক- ঢোল ঝাঁঝর বাজতেই থাকে আর বাজতেই থাকে। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে আসে পুতুলনাচের ও¯তাদ কারিগর। বাজিগর জীবনের সবচাইতে ভয়ংকর খেলাটি দেখাবে বলে হাঁকডাক জুড়ে খুকিকে ডাকছে। সাত সমুদ্দুর আর তেপাšতরের মাঠে পেরিয়ে কত লক্ষ কোটি খেলনা নিয়ে এসেছে নানান দেশের রঙ বেরঙের দোকানীরা- খুকি দেখবে বলে। এত্ত বড় এক নাগরদোলা, যেখান থেকে হাত বাড়িয়ে আকাশ থেকে সূর্যকে পেড়ে আনা যাবে - গাল ফুলিয়ে সে’ বসে আছে খুকি এখনও ওর ওখানে আসছে না দেখে। পাহাড়ের মত বিশাল বিশাল খাবারের স্তুপ সাজিয়ে চারদিক থেকে ছুটে আসছে মৌ মৌ গন্ধ। এই সময় বাজনা আর হল্লা ছাপিয়ে ভেসে এলো মেঘের ডাক। আর সাথে সাথে পূর্ব কোণের আকাশ কালো করে ধেয়ে আসে ছাদ সমান এক সমুদ্রের ঢেউ। তার তোড়ে বুঝি ভেসে যাবে সব, ভয় আর শঙ্কা চিৎকার-চেচামেচির ঘুর্ণি তোলে। শেষপর্যন্ত সবার অবাক চোখের সামনে ঠিক খুকির সামনে এসে দুই হাত করজোড় করে বসে পড়লো সেই বিরাট ঢেউ এর মতো একটা ছাই রঙা হাতি। মাথা ঝুকিয়ে কুর্ণিশ করে সে। আর তার উপরে বসে এক ছোট্ট মাহুত তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসে...
তখনই কোত্থেকে জানি এলো- আলখেল্লায় মোড়া জরিদার ছোট্ট এক জাদুকর। মাথা ঝুকিয়ে সেই জাদুকর বলে - ‘খুকি এসো, তোমাকে জাদু দেখাই’। বলেই সে সটান সোজা হয়ে আকাশে হাত বাড়িয়ে একটা ঝকমকে লাঠি কয়েকবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হঠাৎ সুস্থির দাঁড়িয়ে পড়ে। যেন সে আকাশ থেকে কথা বলছে এমনভাবে ঝুকে সে তোমাকে বলে, পাগড়ীর নিচ থেকে চোখের কোনে মিষ্টি হাসি ঝলমল করে,
‘চারদিকে যা দেখছো সব আমি অদৃশ্য করে দিতে পারি, দেখবে?’
কি আশ্চর্য্য- জাদুকরটা চোখের নিমিষে ভোজবাজির মত ঐ অলৌকিক মেলাটা মিলিয়ে দিলে- উধাও হয়ে গেল আমার কল্পনার খুকি।... পৃথিবীটা পৃথিবীর মতই পড়ে রইলো।
আমি জাদুকরটার মুখের দিকে তাকাই।
ফ্রিদা!
আমি জমে যাই।
কল্পনার না। রক্ত মাংশের শরীর নিয়ে ফ্রিদা দাঁড়িয়ে আছে।
‘শোন তোমার এই কল্পনার ভেতরে সারাদিন পৈ পৈ আমার একদম পছন্দ না। অন্ধ হয়ে যাবে শেষে’-
বলে ও।
‘চোখ খুললেই যখন দেখবে চারপাশটা কল্পনার সাথে মিলছে না, ভাল লাগবে না কিছু। চোখ বন্ধ করে তুমি আবার ডুবে যাবে কল্পনার মধ্যে। শেষে আর চোখই খুলতে পারবে না। পুরো অন্ধ হয়ে যাবে তুমি। চোখ খুলে রাখো...’
আমি চোখ খুলে তাকাই। চোখ খুলে বাস্তবের পৃথিবীতে ফ্রিদার সাথে আমার পরিচয় হলো। ভাল লাগে। খুব ভাল লাগে। স্বপ্নের মতন। কিন্তু আমি জানি এটা স্বপ্ন নয়। কড়কড়ে রোদগুলোও মেঘের ছায়ার মত লাগে আর আকাশটা সবসময়ই মনে হচ্ছিল কেমন বেগুনী বেগুনী। মানুষগুলো ছবির মতন। খড়খড়ে রাস্তায়ও মনে হয় মাঠের উপর দিয়ে হাঁটছি।
ওর মোহময় দৃষ্টির সামনে সমস্ত তিক্ততা মুছে গিয়ে পৃথিবীটা রঙীন হয়ে উঠছিল আর আর প্রজাপতির মত আমার পিঠেও দুটো ডানা গজিয়েছিল। সারাক্ষন মনে হতো - এখনই উড়ে গিয়ে ওর ঠোটের উপর বসি। চারপাশের ঘটে যাওয়া কোন দৃশ্যই চোখে ধরা পড়ছিল না- কোন শব্দও কানে ঢুকছিল না। এমনকি চোখ বন্ধ করলেও দেখি ও। আমি মায়ের কথাও ভুলে যাই।
এক বন্ধু আমাকে ফ্রিদার জন্য অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিল - ‘তোমার জীবন এখন পূর্ণ হলো।’
ফ্রিদার সাথে নতুন সম্পর্কের শুরুটা হয়েছিল একটা তিরতিরে নদী, মৌন সাদা বক, অধীর সবুজ ক্ষেতের স্পর্শের মধ্যে।
ও আসলে শহরে থাকতে চাইছিল না। শহরের বেড়াজালে আটকে থেকে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিল ও । আমার দিকে বড় বড় চোখ মেলে ও বলে- এখানে বাতাস নেই। চল বাইরে কোথাও যাই।
আমিও তাই ভাবি।
আমরা হাঁটতে থাকি। পায়ে পায়ে। যেখানে চোখ যায়।
: আমি ঘৃণা করি।
হটাৎ ও বলে উঠে। আমি চমকে উঠি।
: কী?
: ফ্যামিলি। আমার জন্ম না হলেই পারতো। আমার বাবা মা ... স্বার্থপর। ওরা খালি নিজেরটাই ভাবে। আমাকে খালি ওদের মত করে হতে বলে। ওরা একটুও ভাবে না, আমি ওদের মত না। আমি আমার মত হতে চাই। আমার মত হতে না দিলে আমি আমার মত হবো কী করে? আমি একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যাবো।
এক টুকরো নিরুদ্দেশের আনন্দের লোভেই ও আমার সাথে চলতে শুরু করে। আমরা পাশাপাশি হাঁটতে থাকি। ওর দিকে তাকিয়ে বড়দের উপর রাগ জমে। তোমরা ছোটদের তোমাদের মত বানানোর চেষ্টা করো না। বরং তোমরা ছোটদের মত হওয়ার চেষ্টা করতে পারো।*২ - আমি ভাবি।
দূরে গাছের মাথায় কয়েকটা সাদা ঘুড়ি আটকে গেছে। একটা ঘুড়ি চমকে দিয়ে হটাৎ আকাশে উড়ে যায়। - বক। বক! বক!! আমি চিৎকার করে উঠি। ফ্রিদা হাসে। ওর হাসি দেখে আমার মন ভরে ওঠে। নিজেকে এবার সত্যি সত্যি বড় মনে হয়। ওকে নিয়ে আরো দুরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে।
: সামনে নদী আছে।
: কত দূর - ফ্রিদার চোখ নেচে ওঠে।
: এইতো সামনে।
: আমি যাবো।
: হাঁটতে হবে কিন্তু।
: হাঁটবো।
আমি খুশি হয়ে উঠি। চারপাশটা শীতকালের মিষ্টিরোদে ঝলমল করে। আমি কথা উড়াই।
: সবচেয়ে বেশি কী ভালবাসো তুমি? এই পৃথিবীতে?
: আমাকে।
আমি থমকে যাই। এ কেমন উত্তর হলো?
কিন্তু কথাটার মধ্যে এমন একটা প্রকাণ্ড সত্যি লুকিয়ে থাকে যে - কিছুতেই ফেলে দেয়া যায় না। কিছুক্ষণের জন্য আমি দমে থাকি। আকর্ষণটা আরও গাঢ় হয় ভেতরে ভেতরে। ফ্রিদা তখন রোদ খাচ্ছে, বাতাস খাচ্ছে, মেঘ দেখছে, ঘাস ছুচ্ছে, উড়ে যাওয়া পাখির দিকে তাকিয়ে আছে। আমার কেমন একলা লাগে। আমি একটু চুপ করে থাকি। একটু দূরে একটা বটগাছ জটা বুড়ির মত দাঁড়িয়ে আছে। মোটা মোটা শেকড় অজগর সাপের মত মাটিকে পেঁচিয়ে আছে। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে সেই শেকড়ের উপর বসে গুটগুট কথা বলে যাচ্ছে। ওদের দিকে আড়চোখে তাকাই। ওদের কথা শুনতে ইচ্ছে হয়। বাতাসে কান রাখি। ওদের কথাবার্তার টুকরো টাকরো ভাসতে ভাসতে কানে বেঁধে।
: তুমি আমার জন্য কী করতে পারো?
: মরতে পারি।
ছেলেটার উত্তর শুনে মেয়েটা হাসিতে ভেঙে পড়ে। - ‘সেটাতো সবাই পারে। এক মুহূর্তের ব্যাপার।’ বলেই মেয়েটা চূপ হয়ে যায়। এক মূহূর্তের জন্য। আলতো স্বর বেজে ওঠে - ‘অপেক্ষা করতে পারো? অপেক্ষা। সারাজীবন অপেক্ষা? করতে পারবে? এটা তুমি পারবে না।’
মেয়েটার উত্তরে ছেলেটা কিছু একটা বলে কি বলে না- সেটা আর শোনা হয় না। আমরা ততক্ষণে নদীর কাছে চলে এসেছি। একটা লোক কোঁচ হাতে একদৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। কোঁচের তীক্ষè ধাতব ফলাগুলো রূপোলী মাছের শরীরের খোজে উদ্ধত ভঙ্গিতে চেয়ে আছে। আমরা ওকে ফেলে একটা চায়ের দোকানে ঢু দেই। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ফ্রিদা কোথায় জানি চলে যায়। আমি চায়ের কাপ হাতে একলা বসে থাকি। তাকিয়ে দেখি লোকটা এখনও - সেই একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রাগৈতিহাসিক কোন শিকারীর ছবির মতন লাগে ওকে।
আমি ফ্রিদাকে খুঁজি। কোথায় গেল মেয়েটা?
ফ্রিদা তখন জলের উপর ঝুকে নিজের ছায়া দেখছে। মানুষই বোধহয় একমাত্র প্রাণী যে এভাবে নিজেকে দেখে। ফ্রিদা নিজেকে দেখে, আমি ফ্রিদাকে। কয়েকটা সাদা হাঁস গলা উঁচিয়ে নদীর জলে সাতার কাটছে। ময়ুরপঙ্খীর মত । ফ্রিদাকে বলি - ‘এই নদীর ধারে আমি একটা বাড়ি বানাবো।’
ফ্রিদা বড় বড় চোখ মেলে তাকায়, -
- ‘আমাকে থাকতে দিবে...?’
- ‘হ্যা’ - আমি মাথা কাত করি। ঘরটা যে আসলে আমার জন্য না- ওরই জন্য আমি বানাবো কথাটা ভাঙি না। আমি চোখের উপর ঘরটাকে দেখি। একটা কাঠের দোতালা ঘর। কয়েকটা ঘর, একটা বারান্দা। ছোট্ট একটা বাংলোর মত।
‘এই নৌকা - এই' ...
এক বুড়ো মত মাঝিকে একলা নৌকা বাইতে দেখে ডাক দেই। নৌকাটা তিরতিরিয়ে ঘাটে ফিরে। লাফিয়ে নৌকার উপরে আমরা উঠে বসি। গলুইয়ে মাথা রেখে আকাশ দেখি। মাঝে মধ্যে ফ্রিদাকে। ফ্রিদা হাত দিয়ে জল ছিটিয়ে দিলে আমি হুড়মুড়িয়ে বসি। নদীর দুই পারে এলোমেলোভাবে অনেকগুলো কাঁশ ফুলের গুচ্ছ ফুটে আছে। ফসলের মাঠ চলে গেছে চোখের সীমানা ছাড়িয়ে আরো অনেক দূরে। ঢেউ খেলানো সবুজ আর সোনালীর মধ্যে মধ্যে মাথা উঁচিয়ে দু’একটা বাড়ি উঁকি দিচ্ছে। একটা ঘোমটাটানা বউ নদীর ঘাটে থেকে কলশ ডুবিয়ে আমাদের আড়চোখে দেখে। আমার মনে হয় আমি যেন অনন্তকাল ধরে এই নৌকায় চেপে ফ্রিদাকে নিয়ে ভেসে যাচ্ছি। আর চোখের সামনে এই নদীর দৃশ্য, পাড়, হটাৎ উড়ে যাওয়া পাখিদের দল - কখনই এই দৃশ্য চোখ থেকে হারিয়ে যাবে না। শেষ বিকেলের ম্লান আলো, কুয়াশায় মোড়া আবছা দিগন্ত, বৈঠার ছপাৎ ছপাৎ শব্দ। ফ্রিদাকে নিয়ে খুব ভাল লাগে। এত ভাল লাগা বোধহয় কোনদিনও আসে নি।
কিন্তু এই ভাল লাগাটা বেশিক্ষন থাকে না, চিতার ক্ষিপ্রতায় রাত দৌঁড়ে আসে। সূর্যটা ডুবে যেতেই অন্ধকারটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে আমাদের উপর এসে পড়ে। আমরা একটু কেঁপে উঠি। একটু আগেই এই নির্জনতাটা ভাল লাগছিল - এখন চারধারে ঝিঁঝিঁপোকার ডাক মনে ভয় ধরায়। দ্রুত নৌকাটা পাড়ে ভিড়িয়ে নেমে যাই। চারদিকে জনশূন্য অন্ধকার। ফ্রিদার চোখে মুগ্ধতার জায়গায় শঙ্কা ভরে উঠছে - ওর চোখের দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারি। কোন কথা না বলে হাঁটতে শুরু করি। পাশাপাশি দু’জন। অনেকখানি পথ পেরোতে পারলে তবে লোকালয়, শহরের নিরাপত্তা। সেই নিরাপত্তাকে ঢেকে দিতে শীতের কুয়াশা নামছে। একটা সাদাটে অন্ধকারের মধ্যে আমরা চুপচাপ খালি হাঁটছি। দুপাশে ফসলের মাঠ। সেখানে কুঁয়াশার হিম জমছে। কোথাও একটা প্যাঁচা তারস্বরে ডাকছে। অশুভ সঙ্কেতের মত সরু পায়ে চলা মেঠো পথটা কুয়াশার ভেতরে মিশে আছে। এই পথ কখনও যেন শেষ হবে না- এরকম মনে হয়। তবু আমরা চলি। অন্ধকারের ভেতরেও হটাৎ হটাৎ একটা গ্রাম ভেসে ওঠে। আগুন টুকরো টুকরো কুণ্ডলী পাকিয়ে সেখানে ওঁম ছড়ায়। তাদের ঘিরে অস্পষ্ট দু’একটা শব্দ জমে ওঠে। আমরা যতটা সম্ভব নিঃশব্দে হেঁটে যাই। এইসময়টা ফ্রিদার সাথে কথা বলতেও ভয় হয়। শব্দ শুনে যদি কেউ ছুটে আসে। ওর যদি কিছু হয়? আমার নিজেকে অপরাধী মনে হয়। টের পাই চারপাশের নির্জনতা না - মানুষকেই আমাদের ভয়। আমি টের পাই ফ্রিদাকে। অনুভব করি একটা নারীকে। আলিঙ্গন করি একটা নিরাপত্তাহীনতাকে।
রাস্তা যখন - এই শীতের রাতেও মাঝেমধ্যেই একজন দুইজন করে মানুষের দেখা মেলে। ওদের ছায়াময় শরীরটাই ছুরির মত। চোখে পড়লেই বুকের হৃদপিণ্ড কেঁপে ওঠে। আমাদের পায়ের গতি আরও দ্রুত হয়ে যায়। ওদের বিষ্ময়সূচক কথাবার্তা জমে ওঠার আগেই ওদেরকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চাই।
একটা ছেলে আর মেয়েকে অন্ধকার কুয়াশামাখা নির্জন রাতে আবিস্কার করার বিষ্ময়ের মধ্য দিয়ে আমরা এগুতে থাকি। কখনও কখনও পেছন থেকে এলোমেলো শব্দ উড়ে আসে। কে যায়- কোত্থেকে? আমরা ভান করি - কোথাও কেউ নেই। এই চলার শব্দ ছাড়া পৃথিবীতে কিছু নেই। কোন মানুষ নেই। শুধু জোঁনাকী। শুধু ঝিঁঝিঁর ডাক। শুধু ফসলের কুয়াশামাখা মাঠ।
আশার আশাবরী চাঁদের মত হটাৎ মেঘ ফুঁড়ে বের হয়ে ওঠে শহরের আলো। নিরাপত্তার একটা উষ্ণ উত্তাপ শরীর জুড়ে বয়ে চলে। বুকের মধ্যে টের পাই - বিপদ কেটে গেছে। আমি ফ্রিদার দিকে এই এতক্ষণে তাকাই।
ওর চোখ কাঁপছে।
আমি ওকে জড়িয়ে ধরি। আমি জড়িয়ে ধরে ওর জন্য অপেক্ষা করি।
সময় ভেঙে ভেঙে চলতে থাকে।
ভাল লাগে- কিন্তু কোথাও যেন একটা অপূর্ণতা মধ্যে মধ্যে জেগে ওঠে।
একটা কষ্টের মতন। খা খা। খা খা।
আমি আমার সমস্ত খোলস খুলে ফেলে হৃদপিণ্ডের চেহারাটা ওকে দেখাতে চাই। কিন্তু দেখাতে পারি না। বরঞ্চ রূপকথার অচিন পাখির রঙীন পালকে নিজেকে ঢেকে ওকে আমার আলিঙ্গনের মধ্যে ঝাপটে ধরি। কেন জানি না, জড়িয়ে ধরেও মনে হয় ওকে ধরতে পারি নি। দু’বাহুর মধ্যে কুঁকড়ে থাকা ফ্রিদার চোখ আকাশের কোনে কোনে রঙবেরঙের মেঘ দেখে। আমি টের পাই - ওর ভাল লাগাগুলো অন্য কোথাও ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে। আমাকে ফেলে ওর অন্য ভাবনাগুলো আমার অনুপম অনুভূতিগুলোতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। বড্ড বেশি বাস্তব মনে হয় ওকে। একটা দাম্ভিক খেয়ালের মতো- নৃশংস। ওকে ওর ভাবনাগুলো থেকে ফেরানোর জন্য আমি আরও জোরে ওকে আঁকড়ে ধরি। আঁকড়ে ধরে সমস্ত সময় জুড়ে ওর জন্য অপেক্ষা করি। একটা স্বপ্নের মত। এক ফোঁটা বৃষ্টির জন্য বসে থাকা চাতকের মত। রঙধনুর মত।
অপেক্ষা করতে করতে এক সময় টের পাই- ও আমাকে আর অপেক্ষা করতে দিচ্ছে না। আমার হাত আগলা হয়ে আসে। তবু আমি কান পেতে থাকি। বাইরে থেকে কোন পথচলা পায়ের শব্দ চারদেয়ালের চৌহদ্দি মাড়িয়ে কানে ভেসে আসলে ভাবি- ও এলো। পায়ের শব্দ একসময় শুনশান নীরবতার মাঝে ডুবে যায়। ও আসে না। মনের মধ্যে তখন ওর মুখ ভাসে। ক্রুঢ়, নির্দয়, শীতল সেই মুখের দিকে তাকিয়ে আমি শুকনো চোখে কাঁদতে থাকি। আমার কান্না দেখে ওর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। আমার ওকে খুন করতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু তবু ওকে ভালবাসতে ইচ্ছে করে।
ওকে সত্যি সত্যি খুন করতে ইচ্ছে করে। আঘাত করতে ইচ্ছে করে।
আমি ওর উপর রেগে যাই। কিন্তু যতই রাগি- ততই মনে হয়, ও আমার উপর জেঁকে বসছে।
তখন কাছে পেতে ইচ্ছে করে ওকে। যত ইচ্ছে করে ততই দুরে মনে হয় ওকে। নিষ্ঠুর মনে হয়। ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মত। ড্রাকুলার সঙ্গীনির মত।
আমাদের আসল মুখটাকে কি কেউ কখনও দেখি? মনে হয় না। আমরা আমাদের আসল চেহারায় কেউ কাউকেই দেখি না। আমরা যখন একজনের কাছে আসি - আমাদের মনের মধ্যে ভালবাসা কিংবা ঘৃণায় রাঙিয়ে তার মুখ হয়ে আর একটা মুখ জন্ম নেয়। আমরা সেই মুখটাকেই ভালবাসি, সেই মুখটাকেই ঘৃণা করি। আমি টের পাই ওর কমনীয় চেহারাটা- ওর ভালবাসার চেহারাটা ধীরে ধীরে ঘৃণার চেহারা হয়ে মনের মধ্যে জেগে উঠছে। তারপরও একটা অক্ষম আশা বেঁচে থাকে। সময়ের সাথে সাথে সেটাও গুঁড়িয়ে যায়। একটা সময় আসে - চেষ্টা করলেও ওর কোন কোমল মুখ মনে পড়ে না। আমি বুঝতে পারি আমার ধৈর্য্য কমে আসছে। ও যদি একবার আমার সাথে একটু ভাল ব্যবহার করতো তাহলে ওর এই ভালবাসার চেহারাটা আবার চিনে নিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করতাম। কিন্তু এইভাবে আর কত অপেক্ষা করা যায়? অপেক্ষার একটা গল্প আছে। গ্যাব্রিয়েলা মার্কুয়েজের ‘টাইম অব কলেরা’ - বইটা ওকে দিয়েছিলাম। পড়ে নি বোধহয়। বইটার নায়ক পঞ্চাশ বছর তার ভালবাসার মেয়েটার জন্য অপেক্ষা করে। আমি ফ্রিদাকে বলেছিলাম আমি ওর জন্য ষাট বছর অপেক্ষা করবো। ‘সলিড জিনিষে নাকি ইমোশন বেশি থাকে না’- বলে সে হাঁটতে থাকে। আমি থমকে যাই । কিছু বলতে পারি না। কিন্তু আমি যে ওকে চাই। ওর সাথে সেই প্রথম হারিয়ে যাওয়ার গল্প মনে পড়ে। বটের তলায় একটা মেয়ে যে পাশের ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করেছিল –
‘পারবে, সারাজীবন অপেক্ষা করতে? জানি পারবে না।’
আমার মনে হয় ফ্রিদাই আমাকে কথাগুলো বলছে। আমি ঘাড় ফুলিয়ে বলি- পারবো। আমি অপেক্ষা করি।
কেন?
ভালবাসি বলে?
ওকে চাই বলে?
নিজেকে প্রতিদিন ছোট করে করে আমি ওর জন্য অপেক্ষা করি। ও আমার অপেক্ষাকে দেখে না। ওকে দেখে সবসময় ভয় হয়- যদি সে কোথাও হারিয়ে যায় - যদি এতদূরে চলে যায় সে, যেখান থেকে আর কোনদিন ফেরা যায় না। ভাবতে পারি না। নিজেকে ওর ছায়া করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু ওর শরীরটা আর স্পর্শ করতে পারি না। ওর শুন্যতায় আমি শ্মশান হয়ে যাই। আমি নিজেই নিজের দিকে তাকিয়ে ভয়ে কুঁকড়ে যাই - এই শ্মশানে সে নিজেকে পোঁড়াতে আসবে কোন কষ্টে?
মাঝে মাঝে ভাবি ওর জন্য অন্যদের কত অবহেলা করছি। বাবার চোখ আমার কাছে কী জানি খুঁজে, আমি দিতে পারি না। এমনকি নানু যেদিন মারা গেলেন সেদিনও ওর কথা ভেবে কষ্ট পেয়েছি। বিনুদির কথা মনে হয়। ও কঠিন অসুখে হাসপাতালের ধবধবে বিছানায় একমাস পড়েছিল- তাও একবার তাকে দেখতে যাওয়ার সময় মেলে না। মাঝে মধ্যে মনে হয়, ওকে ছেড়ে ছুড়ে চলে যাই কোথাও। কিন্তু পারি না। একটা দোলাচল - সবসময়। না পারি ওকে বন্দী করতে- না পারি ওর থেকে মুক্ত হতে। আমি ভাবি- কেন এমন হলো? পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে। কল্পনায় দেখা ফ্রিদার সাথে ফ্রিদার বর্তমান চেহারাটা মিলাতে বসি।
আমি চমকে উঠি।
আমার কল্পনার ফ্রিদাতো এই মেয়েটা নয়।
এ হলো ঝুমি। বাস্তবের ঝুমির উপর কল্পনার ফ্রিদার ছায়া পড়েছিল - তাই ওকে আমি ফ্রিদা বলে ভুল করেছি। আমি হাঁপ ছেড়ে ফ্রিদার কথা ভাবার চেষ্টা করি। কিন্তু এই ক’দিনে বাস্তবের ঝুমির জন্য আমার এত অনুভূতি জন্ম নিয়েছে- আমি আর কল্পনার ফ্রিদার কথা ভাবতে পারি না। মনে হয়, ঝুমির কাছ থেকে এখন আমি যদি ফিরে আসি তাহলে ওর জন্য আমার এত অনুভূতি নষ্ট হয়ে যাবে। আমি অপেক্ষা করি। কিন্তু আমি কী নিয়ে অপেক্ষা করবো? অপেক্ষা করার জন্য একটা কিছুতো লাগে। নিদেনপক্ষে ছায়া। এত শূন্যতা আর ফাঁকা একটা বোধ নিয়ে কীভাবে অপেক্ষা করা যায়! শূন্যতার জন্য, একটা অশরীরী কোনকিছুর জন্য অপেক্ষা করতে করতে নিজেই শরীরহীন হয়ে যাই। নিজের অস্তিত্ব হারানোটাও খুব কষ্টের, তাই না? মাঝে মধ্যে মনে হয় ইতিহাসটা যদি পাল্টানো যেত। যদি একবার এসে বলতো - এইতো আমি, আমি যে চলে গেছি- এটা মিথ্যে। এই সম্ভাবনার জন্যও মনে হয় আমি অপেক্ষা করতে পারি- ও আসবে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে জেগে উঠি। জেগে উঠে দেখি - এটা দুঃস্বপ্ন।
কিন্তু আমি জাগি না। আমি খালি দুঃস্বপ্নই দেখি। অথবা হৃদয় আর মস্তিষ্কের পৌনঃপুনিক হতাশার মধ্যে ওর অপেক্ষায় øায়ুগুলো সারাক্ষণ এত সজাগ হয়ে থাকে যে কখনও ঘুমই আসে না। চোখের সামনে দেখি- দিগন্তে শুধু ওই। আর কেউ নেই। সবকিছুতে ও চলে আসে। পরীক্ষার পড়া করতে ইচ্ছে না। পরীক্ষা যদিবা দিলাম, চাকরীর কথা ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে না। একটা মোটামুটি ভাল চাকরী জুটলো না চাইতেই, অনেককিছু করতে পারি যা আগে করতে পারতাম না- সেটাও ব্যর্থ মনে হয়। আর যা যা স্বপ্ন আছে তার কোনকিছুই দেখতে ইচ্ছে করে না। ওর সাথে পুরনো কথাগুলো মনে হয়, যা যা করবো ভেবেছিলাম সেগুলো মনে হয়। কত ছোট ছোট কথা, কত মুহূর্ত- সবকিছু বর্তমানের চেয়েও জীবন্ত মনে হয়। ভবিষ্যতের কথা চোখের উপর ভর করে, কিন্তু শূন্য বর্তমানের উপর দাঁড়িয়ে কিছুই ভাবা যায় না - আমার করার কিছুই থাকে না। পৃথিবীতে সবাইকে খুব দূরের মনে হয়। চার দেয়ালের মধ্যে নিজেকে গুঁটিয়ে কান্নায় টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে থাকি। সময়গুলো নিষ্ফলা মনে হয়। বুকের মধ্যে কে যেন এক আঁটি খঁড় গুঁজে রেখেছে। শুষ্ক, খড়খড়ে, ক্লান্ত সবকিছু। বড়দের প্রেমের গল্পগুলো বহুকালের পুরনো বইয়ের পাতার মতন কেমন ফ্যাকাসে, বিবর্ণ আর নরম। যেন দু আঙ্গুলের সামান্য চাপেই -সব সম্পর্কগুলো গুড়ো গুড়ো হয়ে খসে পড়বে ।
এখনকার মেয়েগুলোকে সব অচেনা মনে হয়। ওদের দেখলেই মনে হয় জীবনটা এখন অন্যদের। ছেলেগুলো যেন তার তাপে সবসময় ফুটছে। ওদের পাশে নিজেকে নিস্তেজ, নিঃসাড়, ব্যর্থ মনে হয়। বিছানার চাদর ঘরের মেঝের মত দিনরাত একইভাবে পড়ে থাকে। পাল্টানো হয় না। আমার অবস্থা দেখে এক বন্ধু চিৎকার করে ওঠে - ‘ত্ইু তো দেখি একবারে অফিসিয়াল দেবদাস হয়ে গেছিস’। আমি কিছূ বলতে পারি না। শুধু ভেতরে ভেতরে ফোঁটা ফোঁটা একাকীত্বের একটা একগুয়েমী জমতে থাকে। একগুয়েমীটা দিয়ে চারপাশের সবকিছু নিজের করে নিতে ইচ্ছে করে। স্পীকারের কালো পর্দা সেই একগুয়েমীতে শুধু কাঁপতে থাকে।
এই চোখে তাকিও না - তুমি লুটপাট হয়ে যাবে
তুমি চৌচির হয়ে যাবে তুমি দিশেহারা হয়ে যাবে
তুমি ঘর হারা হয়ে যাবে।
চোখের ঈশারায় ছুড়ে দেবো সুতীব্র চুম্বন...
নিজের ভেতরেই একগুয়েমীটা গুমড়ে গুমড়ে একসময় কষ্টের বলগ উঠিয়ে ফুটতে শরু করে। ফুটতে ফুটতে একসময় রাগ হয়ে চারপাশ ভাসিয়ে নিতে চায়। মনে হয় নষ্ট করে ফেলি নিজেকে। ক্লান্ত কুকুরের ঝুলে পড়া জিহ্বার মত কামনা বাসনাগুলো টালমাটাল করে ওঠে। কিন্তু এগুলো চরিতার্থ করতে পারার শক্তিটুকুও খুইয়ে ফেলেছি। নিজের অক্ষমতার দোষ চারপাশের মানুষের উপরে পরে। ভেতরে বাইরে হিংস্র হয়ে উঠি। আক্রোশে জ্বলতে থাকি।
আক্রোশে বেশিক্ষণ জ্বলে থাকা যায় না। ভেতরটা খাঁ খাঁ করে ওঠে একসময়। ভেতরে ভেতরে জল জমতে থাকে। সেই জল অনেক গভীরে কোথাও এক বিষন্ন কোমলতার জন্ম দেয়। একটা নিঃসঙ্গ ঘোরের মত। মৃত্যুর কথা মনে হয়। একটা কোমলতার ভেতরে আবার ডুবতে থাকি। নিঃসঙ্গতায় ডুবে যেতে গিয়ে আবার কল্পনার ফ্রিদার কথা ভাবি। একদিন আমার ভেতরে ওর একটা পৃথিবী ছিল।
সেখানে মিথ্যা ফ্রিদার কন্ঠস্বর শুনে নিঃশব্দে সে চলে গেছে।
দেশ ছেড়ে সেই সুদূর কানাডায়।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে, হঠাৎ হঠাৎ মন খারাপ হয়ে যায়। আমি চাঁদের দিকে তাকাই। ঝুমির কথা ভুলে গিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে ভাবার চেষ্টা করি, এই চাঁদটা আমার ফ্রিদা দেখছে। হাজার মাইলের দূরত্ব এক মুহূর্তে ঘুচে যায়। আমি ফ্রিদাকে ডাকি - বাতাস হয়ে ফ্রিদা বলে - কী?
আমি ওকেতুমি চাঁদের দিকে তাকাও - আমি এই চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছি ।
ফ্রিদা তখন হেসে উঠে বলে –
আপনি এখনও তেমনি পাগল রয়ে গেলেন, এখনতো এখানে দিন, তুষারে চারদিক ঝকমক করছে।
আমার চাঁদটা আর ভালো লাগে না। চাঁদের আলোয় তখন হাজার মাইলের দূরত্ব।
ফ্রিদাকে নিয়ে কল্পনায় আমার এইসব মুহূর্ত কাটে।
ফ্রিদার সাথে যদি কখনও এই বাস্তবের পৃথিবীতে আমার দেখা হয় তাহলে আমি চিনতেও পারবো না- ও হচ্ছে আমার ফ্রিদা। ফ্রিদাও পারবে না বোধহয়।
কিন্তু আমার খালি মনে হয় আমাকে ও সবসময় লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে। আমি ওর জন্য গান গেয়ে উঠি।
তুমি যদি নদী হও আমি হবো জেগে থাকা চর
তুমি যদি গতি হও আমি হবো অনন্ত পথ
আমার চাতক চোখে তুমি হবে দূরের আকাশ
কিন্তু বেশিক্ষণ এই ভাবনাগুলো থাকে না। তখন চারপাশের সবকিছু একসঙ্গে জুবুথুবু মেরে পড়ে থাকে। অনুভূতিগুলো ঝাপসা হয়ে আসে।
আমি আর ঝুমিকে ঝুমির মধ্যে দেখি না। ফ্রিদাকে কল্পনায়ও দেখতে পাই না। আমি আসলে কোনকিছুই দেখি না। শূন্যতার বিন্দু বিন্দু বাস্প দেহের সমস্ত রোমকূপ থেকে বের হয়ে চারপাশে একটা কষ্টের ঝুল জমায়। সমস্ত পৃথিবী তাতে পতঙ্গের মত আটকা পড়ে থাকে। মাকড়সা যেমন তার লালা দিয়ে নিজের পাশে একটা জাল তৈরী করে নিজেকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ওরকম। কষ্টের ঝুলটা থেকে আমি টেনে হেঁচড়ে নিজেকে নিয়ে পালাতে চাই, কিন্তু পারি না। পত্রিকার পাতায় খবরের হেডলাইনগুলোকেও ঝুমির মতো মনে হয়। অনেক দূরের। শুয়ে শুয়ে রেডিওতে ক্রিকেটের কমেন্ট্রি শুনি। অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। এইতো কোন এক ক্রিকেট টুর্ণামেন্টে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হলো। আমার খুব ভাল লাগে। বাইরে তখন আনন্দ মিছিল নেমেছে। নিজেকে চেপে ধরে উল্লাসে ভাসতে থাকা মানুষের দলে পায়ে পায়ে আমিও যোগ দেই। মিছিলের ভেতরে কেমন একটা ওঁম - নিজেকে তখন একা একা মনে হয় না। সবার মধ্যে আমার গলাটাও মিশে থাকে। একটা খালিগায়ে কিশোর মিছিলের পাশ দিয়ে চলে যায়। তার মাথায় লাকড়ির বোঝা। একটা পাজরের হাড় বের করা কুঁজো বুড়ো খড়খড়ে চোখে আমার দিকে তাকায়। আমি মিছিলটা ছেড়ে দি। মিছিল মিছিলের মত চলে যায়। আমি আবার আমার মধ্যে ফিরে আসি। জেমস এর গানগুলো চেপে রাখা আর্তনাদের মতন। আমাদের ঝুলে থাকা সময়ের প্রতিধ্বনির মতন। সারাদিন মনের ভেতর গটর গটর গটর গটর .. ..
কেউ না আসুক আমি আছি খেলবে যখন মরণখেলা
সবুজের মাঝে লাল কাফন আমার
ওগো বাংলাদেশ তুমি আমার কবর তুমি
সাড়ে তিন হাত জন্মভূমি
সাড়ে তিন হাত জন্মভূমি। মাথার মধ্যে কথাটা সময় নেই অসময় নেই, ঝুপঝাপ রাত নামায়। দরজা জানালা বন্ধ করে সেই অন্ধকারের মধ্যে আমার সময় আটকে থাকে। আমার চিন্তা আটকে থাকে। আমি আটকে থাকি। ভাবি, আবেগটাই আমার আততায়ী। ওকে মেরে ফেলতে হবে। ভাবি আমি। কিন্তু কিছুতেই ওকে সামলানো যায় না। নিজেকে আটকে রাখা ছাড়া এই শহরে আমার কিচ্ছু করার থাকে না।


মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

১ম লাইনটা কি দুর্দান্ত ! পরের ঘটনাধারাও গতিশীল।

উচ্ছলা এর ছবি

কেন জানি মনে হলো আপনার ফ্রিদা দেখতে এইরকম

মজা করলাম হাসি লেখা দারুন মন-ছোঁয়া হয়েছে।

কর্ণজয় এর ছবি

এই কি?

তানিম এহসান এর ছবি

একটার পর একটা চরিত্র উঠে আসছে আপনার সিরিজে, কিন্তু এইবার প্রথম প্যারাগ্রাফটায় থমকে দাড়িয়েছিলাম, অদ্ভুত থমকে দাড়ানো! চলুক

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

অসাধারণ একটি লেখা। তারায় তারায় খচিত করতেই হবে! নিতে হবে পসন্দের পোষ্টেও!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

বন্দনা কবীর এর ছবি

আমরা আমাদের আসল চেহারায় কেউ কাউকেই দেখিনা। আমরা যখন একজনের কাছে আসি, আমাদের মনের মধ্যে ভালবাসা কিংবা ঘৃনায় রাঙ্গিয়ে তার মুখ হয়ে আর একটা মুখ জন্ম নেয়।আম্রা সেই মুখটাকেই ভালবাসি, ঘৃনা করি

বাহ্‌ কী চমৎকার কথা!!

কর্ণজয় এর ছবি

বন্ধুজনের সুবাস...

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

এই বইটা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম... ফেব্রুয়ারিতে পাবো?

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

কর্ণজয় এর ছবি

লেখা শেষ হবে জানি...
বই... বলতে পারছি না...
প্রকাশনার গলি ঘুপচিটা চেনা হয় নি...

সুমন তুরহান এর ছবি

আরো আগে মন্তব্য করেছিলাম, কেনো যে এলো না!

লেখা অসাধারণ হয়েছে। কল্পনার ফ্রিদার গল্প পড়ে হুমায়ুন আজাদের 'সব কিছু ভেঙে পড়ে' উপন্যাসের কিশোরী নায়িকা রওশনকে মনে পড়লো।

-----------------------------------------------------------
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।