এ ও সে ও : ১১ - রঙের খেলায় পিপড়েরা

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: সোম, ১৭/১০/২০১১ - ১০:৩৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্যারামাউন্ট পিকচার্স যদি ‘অ্যান আমেরিকান ট্র্যাজিডি’র বদলে ‘এ বাংলাদেশী হিরো’ নামের একটা ছবি বানাতো - তাহলে দিব্যি আযাদের গল্পটা সিনেমায় ঢুকিয়ে দেয়া যেত। মফস্বলের ঐ গেয়ো ছেলেটাই আমাদের মধ্য থেকে সবচেয়ে উন্নতি করেছে। ওর কথা বললেই বন্ধূদের চেখে মুখে চোখে মুখে একটা ঈর্ষার ভাব ফুটে ওঠে। এখন এই শহরের জাদরেল মার্কেটিয়ারদের মধ্যে - সে একজন কেউকেটা।
গাড়ির ভেতর থেকে হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা বাড়িয়ে বলে - ‘কিরে, উঠ, উঠ’। জোর করে আমাকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে সে চলতে শুরু করে।
গরমে ধুকতে থাকা দুপুরটা ওর গাড়ির ভেতরে শীতে জবুথুবু হয়ে থাকে। দামী গাড়ির মসৃন আরামদায়ক সিটে নিজেকে গুঁটিয়ে রাখি। আমার নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। শার্ট থেকে ঘামের দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। সঙ্কোচটাকে ভুলে থাকার জন্য বাইরে তাকাই। চেনা শহরটাকে কাঁচের ভেতর থেকে অন্যরকম লাগে। লাস্টবেঞ্চির বর্ণিত মানুষেরা মৃতপ্রায় পড়ে থাকা দেহ মাড়িয়ে স্রোতের মত ছুটে চলেছে। সেই স্রোতের মধ্যে কেউ দাড়িয়ে, কঙ্কালের মত হাত বাড়িয়ে দুটো টাকা চাইছে। কিন্তু এই দামী গাড়ির ভেতর থেকে ওদেরকে অনেক দূরের মনে হয়। যেন ওরা নেই, এই যে দেখছি তা আমারই মনের ভুল। গাড়ির শীতল জগতটার মধ্যে পৃথিবীটা এসে পড়ে। জানালা দিয়ে এই পৃথিবীর বাইরে চোখ মেলে এই শহরের দৈনন্দিন মানুষগুলোকে দেখি। অসুখি আর অতৃপ্তির স্রোত। সেই স্রোতের দু একজনের সাথে চোখে চোখ পড়ে, চমকে উঠি। সেই দৃষ্টি থেকে ঈর্ষা, ক্রোধ আর বিদ্বেষের বৃষ্টি ফোটায় ফোটায় ঝরে পড়ছে। গাড়ির কাঁচ বিন্দু বিন্দু জলে ঘোলা হয়ে আসে। আমি জানালার কাচে হাত দিয়ে দেখি। ঠাণ্ডা। বাইরে জমে থাকা জল হাতে লাগে না। কিন্তু এত বিদ্বেষের বিষবাস্পের মধ্যে এই আরামদায়ক শীতলতা কতক্ষণ থাকবে বুঝতে পারিনা। আযাদ ওর ফিরিস্তি দিয়েই যাচ্ছে।
: মার্কেটিং, ক্যানভাসারের কাজ বলতে পারিস।
ওর শব্দগুলো মাথার ভেতরে রাস্তায় মজবা বসিয়ে ক্যানভাসারের শেয়ালের মাংস, জোকের তেল বিক্রি করার চেহারাটা জাগিয়ে তোলে।
: গাদা গাদা সব ফালতু জিনিষকে এমন করে ফুলিয়ে ফাপিয়ে বড় করে দেখানো যে- ওটা না কিনলে বিরাট একটা পাপই হয়ে যাবে।
: হ্যা -মানুষের চাহিদা বেড়ে গেছে অনেক।
আমি আলগাস্বরে বলি।
: চিরটাকালই মানুষের চাহিদা অসীম। সে নিজেও জানে না আসলে সে কী চায়। তবে পার্থক্য এটাই- এখন চাহিদা তৈরীর ম্যাকানিজমটা ডেভেলপ করেছে। যেমন মানুষের রিপ্লেসমেন্ট হয়েছে প্রোডাক্ট দিয়ে।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। ঠিকমতো কথাগুলো বুঝতে পারি না।
: ব্যাপারটা কী রকম ? ধর একটা ছেলে - ছোট্ট একটা ছেলে, বাবা অফিসে যাবে- ছেলে বাবাকে যেতে দেবে না। এখন বাবাকেতো যেতে হবে। ছেলেকে একটা চিপসের প্যাকেট ধরিয়ে দিল। ছেলে বাবাকে যেতে দিল। তার মানে চিপসটা ঐ মুহূর্তে বাবার একটা রিপ্লেসমেন্ট। আবার ধর, স্বামী অফিসে গেছে। বউ সারাদিন একা একা তার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছে। বিকেলে তার সাথে কোথাও একটু ঘুরতে যাবে। কিন্তু স্বামী বেচারা আর আসতেই পারলো না। তো স্বামী যদি বুদ্ধিমান হয় সে একটা শাড়ি কিনে বাসায় ফিরলে বউ এর রাগ খতম। সে ঐ দিনতো বটেই আর কয়েকদিনই স্বামীর সাথে আর খ্যাটম্যাট করবে না। ঐ শাড়িটা তখন তার স্বামীর রিপ্লেসমেন্ট। প্রোডাক্ট এর ব্র্যান্ডিংটাও ঠিক ওরকমই। প্রোডাক্টের ক্যারেক্টারের মধ্যে একটা মানুষের একটা আদল দিয়ে দেয়া হয়। যেমন ধর একটা গুড়োদুধ - হলো গিয়ে বাচ্চার টিচার। এই গুড়োদুধ খাওয়ান... বাচ্চা আপসেই ভাল করবে। বাচ্চার রেজাল্ট খারাপ করলে অবশ্য টিচারের দোষ। হাঃ হাঃ হাঃ...
আজাদ একটু থামে। কয়েকটা মুহূর্ত যায়। এসির বাতাস গাড়ির ভেতরে আরও শীত জমায়। কাঁচের বাইরে গোটা জগতটা কেটলীর পানিতে ফুটছে মনে হয়।
: আমিতো সবসময় ঈদটা মায়ের সাথে কাটাই,এটাতো তুই জানিসই। না?
মনে পড়ে - প্রত্যেক ঈদে ও বাড়ি যেত। আমরা কতবার চেষ্টা করেছি একবার একটা ঈদ আমাদের সাথে করাতে। কিছুতেই ওকে রাজি করাতে পারি নি। বলে - এতটুকু সংযমইতো ভালবাসা। ভক্তি। আমরা আর কিছু বলতে পারি না। মাথা নাড়াই।
: তো এক ঈদে, কাজের চাপে আমি বাড়িই যেতে পারলাম না। কোরবানীর ঈদ, তো বাড়ির জন্য একটা ফ্রিজ কিনে পাঠিয়ে দিলাম। মা কিন্তু সেবার কিছুই বললো না। আগে হলে মা খুব হৈ চৈ করতো। ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢুকে যায়। আমার কাছে মনে হয় মা ফ্রিজটা পেয়ে আমার এই না যাওয়াটা মেনে নিয়েছে। মায়ের কাছে নিজেরই একটা ফ্রিজ হয়ে যাওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। মাথার মধ্যে কী যে হলো। একটা ঘোরের মত। আমি আর কোথাও মানুষ দেখতে পাই না। রাস্তায় বের হই দেখি সারি সারি প্রোডাক্ট হেঁটে যাচ্ছে। চারিদিকে সব প্রোডাক্ট আর প্রোডাক্ট। রিকশায় চেপে একটা কসমেটিক্স যাচ্ছে। চিপসের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে একটা ইনসিওরেন্স পলিসি। একটা অর্নামেন্ট বক্স বোগলদাবা করে নিয়ে চলেছে একটা সৌন্দর্য্য সাবান। কী বিরাট একটা শহর কিন্তু একটাও মানুষ নেই।
আমি শিউরে উঠি।
: তারপর।
: তারপর এইতো। কয়েকদিন একটু মন খারাপ করে থাকা। তারপর মানিয়ে নিলাম। আমিও অন্যের কাছে তার চাহিদা পূরনের যন্ত্র, অন্যরাও আমার কাছে তাই। যুগটাইতো মানিয়ে নেয়ার। তাই না...
যুগটা আসলেই মানিয়ে নেয়ার। হয়তো সবযুগই তাই ছিল। সবযুগেই কিছু মানুষ মানিয়ে নিতে পারে নি। যেমন মাস্টারভাই পারে নি। রঞ্জু পারে নি। ওদের কথা মনে হলে মন খারাপ হয়ে যায়। সন্ধ্যা নামে। মন খারাপের রাস্তা ধরে মাস্টারভাই হেঁটে আসেন।
শেষ সূর্যাস্তের লাল আলো হলুদ মলাটে ছিন্নপত্র লেখাটার নিচে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাক্ষরের উপর আলো ফেলে।
: কী ভাবছ - রক্ত
ধরা পড়ে যাবার ভয়ে সামনে জলের দিকে তাকাই। নদীর রূপালী স্রোতে তখন শেষ সন্ধ্যার ছায়া। সূর্যাস্তের লালরঙ খানিকটা জলে মিশে আছে। আমার কেমন জানি লাগে- বুকের ভেতরটা একটু ভারী ভারী লাগে, গলাটা শুকিয়ে আসছে বলে মনে হয়। মাস্টারভাইযে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন মাষ্টারভাইকে না দেখলেও আমি তা টের পাই।
- ধুকে ধুকে মানুষগুলোকে মরে যেতে দিলে হাতে রক্তের দাগ লাগে না। তাই না?
আমি কোন কথা বলি না। একটা পাখি মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায়। তার ডানার শব্দের নিচে আমার চুপ থাকাটাই একরকম উত্তর হয়ে ঝুলে থাকে। আমি আসলে তার কথা মানছি- আবার মানছি না। মাস্টারভাই মনে করতে পারেন আমি বোধহয় প্রসঙ্গটা এড়াতে চাইছি। যুদ্ধের ময়দান থেকে একটু শান্তির আশায় পালিয়ে যাওয়া যোদ্ধার মত। এটা ঠিক - আবার একই সাথে ঠিকও নয়। আমি আসলে জানি না ঠিক সত্য কোনটা। একেক সময় সত্য একেকরকম মনে হয়। সত্যের পেছনে আসলে কী কাজ করে সেটা আমি এখনও বুঝে উঠতে পারি নি। আমি মাস্টারভাই এর দিকে তাকাই।
ছিন্নপত্র হাতে মাস্টারভাইকে গাছের মত লাগে। একটা বুড়ো হয়ে যাওয়া হলুদ পাতার মত ছিন্নপত্রটা ডালের সাথে কোনমতে ঝুলে আছে। কিন্তু গাছটা মরে শুকিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত এই বুড়ো হলদেটে পাতাটা কোনদিন খসে পড়বে না। তিনি ছিন্নপত্র হাতে চাষা মুটে মজুরের সাথে ঘুরে বেড়াবেন। আকাশের তারার আলোর নিচে অথবা ঘরের জঁমাট বাঁধা অন্ধকারে তাদের মধ্যে ক্রোধ আর স্বপ্ন জাগিয়ে তুলবেন। এই তার জীবন। এই তার সত্য। অনেকের চোখে তার এই চেষ্টাটা একটি মিথ্যা, একরাশ অন্ধকার। অনেকের সাথে রাষ্ট্রটাও এটা মনে করে। তাই মাস্টারভাই লুকিয়ে লুকিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে বেড়াচ্ছেন। আমি এই ফেরারী মানুষটার দিকে তাকাই।
এই যে মাস্টারভাই - যে সমস্ত মানুষেরা বেঁচে থাকার অধিকার পাচ্ছে না কিংবা অধিকার হারাচ্ছে, তাদেরকে নিয়ে তাদের প্রাপ্য আদায়ের জন্য সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়ানোর জন্য সারাটাজীবন ব্যয় করেছেন । নিজে ধনী কৃষক পরিবারের সন্তান, অভাব কী নিজের জীবনে কোনদিন জানেন নি। তবুও চাষাভুষোদের জীবনটাকে নিজের স্বপ্নে জড়িয়ে জোতদার আর বড়লোক শ্রেণীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এলাকায় এলাকায় পার্টি গড়ে তুলছেন । গরীব জেলে কৃষকের পার্টি। তার লক্ষ্য- এক একটা এলাকা দখল করবেন আর যাদের কোনকিছু নেই তাদের জন্য পার্টি শাষন চালু করবেন। এক একটা এলাকা হবে কৃষক শ্রমিক মজুরের দেশ। এক একটা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করে সেখানে নিজেদের মত ভূমি সংস্কার করে খাস জমিগুলো দখল করে জমিহীনদের মধ্যে বিতরন করে দেয়া হবে। জলার উপর জেলের অধিকার ফিরে পাবে। ছোট ছোট এলাকা একদিন বিশাল হয়ে উঠবে। সব মানুষ সমান হবে। সুন্দর একটা ছবি। নদীর মত। বাতাসের মতো। চীনের মত। মাও সেতুং তার নিজের দেশের সীমান্ত অতিক্রম করে এখন মাষ্টারভাইদের চিন্তার মধ্যে বেঁচে আছেন।
কিন্তু সেই ছবি ঠেলে আর একটা ছবি ভেসে ওঠে। কোন একটা পত্রিকায় দেখেছিলাম। একটা সমুদ্রের ছবি। সেই বি¯তৃত জলরাশি জুড়ে অনেকগুলো যুদ্ধ জাহাজ শান্ত ভঙ্গীতে চুপচাপ ঘুমিয়ে আছে। গুয়েতোনামো উপসাগরে আমেরিকার নৌঘাটির ছবি ছিল এটা। অনেক উপর থেকে তোলা একটা ছবি। ছবিটা রক্তের ভেতরে ঢুকে যায়। আমি জাহাজগুলো গুনতে থাকি। এক- দুই -তিন -চার - পাচ -ছয় -সাত- আট - নয় - দশ -পনেরো - বিশ -তিরিশ - .. দিগন্তের ভেতরেও আবছা মিশে আছে অনেকগুলো জাহাজ- এতগুলো যে গুণে শেষ করা যায় না। এক একটা কী বিশাল। কী বিরাট। সব যুদ্ধ জাহাজ। ওরা অপেক্ষা করছে। একটা নির্দেশ। কয়েকজন মানুষের একটা খেয়াল। তারপর আগুনের ফুলঝুরিতে নেচে উঠবে পৃথিবী। কী ভয়ঙ্কর। বুকের ভেতর একটা শীত জমে।
মাস্টারভাইরা কাদের বিরুদ্ধে লড়ছেন? কী করে পারবেন। মানুষ কী এত বড় বড় সব আয়োজনের বিরুদ্ধে সত্যিই দাঁড়াতে পারবে?
কিন্তু কিছু মানুষ এখনও বিশ্বাস করে -তারা পারবে। তারা মাষ্টারভাইদের অনেকটা যিশুখ্রীষ্টের মত ভাবে। পরিত্রানদাতা। তারা বিশ্বাস করে একদিন মাস্টারভাইরা শোষনটা বন্ধ করতে পারবে- মাস্টারভাইরা তাদের বোঝান, কীভাবে এটা হবে?- সবমানুষ একসাথে এই অন্যায় রুখে দিবে - সবাই কাজ পাবে - সবাই ভাতটা পাবে - চাষের ভাগটা পাবে- নদীতে মাছটা ধরতে পারবে- - ন্যায্য মজুরী পাবে - ন্যায্যতা একেক জায়গায় একেক রকম - কিন্তু বাঁচার মত মজুরীটা পেলে আর ওদের লড়াই করতে হবে না।
লড়াই?
রঞ্জুর মুখ চোখে ভাসে। কী স্বপ্নময় চোখদুটো ছিল ওর। বাড়িতে বউ রেখে পালিয়ে এসেছিল বিপ্লব করবে বলে । ও বলছিল - তাহলে এসব কী চলতে থাকবে ? দশজন মানুষের জন্য বাকি নব্বইটা মানুষ। ওর শেষ নিঃশ্বাসের স্পর্শ বাতাসে উড়ে যাওয়া পাখির ডানার পালকের মত ছটফট করে।
দিদিমণি এসে দাঁড়ায়।
ছোটবেলায় পড়া সেই কবিতাটা নড়েচড়ে ওঠে।
মাথার উপর বাঁশবাগানে চাঁদ উঠেছে ওই।
মাগো আমার শোলোক বলা কাজলা দিদি কই।
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই।
মাগো আমার ষোলক বলা কাজলাদিদি কই।
সেই কাজলা দিদি এসেছে ভাই এর খোজে। কিন্তু ছোট্ট ভাইটা আর নেই। তার আদরের ডাক্তারভাইটা চলে গেছে।
কাজলা দিদি কাদছে। কেন জানি না সব কান্নার ভেতরেই স্মৃতি লুকিয়ে থাকে। তার কান্নার শব্দে তার ছোট্ট ভাই -আমাদের ডাক্তারভাই ঝলকে ওঠে।
ও ডাক্তার ছিল না। ও ডাক্তার লিখতো না। ও শরীরের সুস্থতার চেয়ে অন্তরের সুস্থতাকে বড় মনে করতো।
ও চলে গেল।
একটা মানুষ চলে গেল।
একটা রঙ চলে গেল।
পেছনে একটা দল থেমে গেল। সেই দলটা আমি বুঝি নাই।
আমার যখন বাচ্চা হলো ও আমাকে বললো-
তুই মা হয়েছিস তোকে সাইকোলজি পড়তে হবে।
তাইতো আমি সাইকোলোজিষ্ট হয়েছি।
মা এবং মানুষ ছাড়া কাউকে ও ভালবাসতে পারে নি।
এই ছিল কাজলাদিদির কাছে ছোটভাইটি। সেও চলে গেলে। তার চলে যাওয়ার গল্পটি ইতিহাসে থাকবে। ইতিহাস। সরকারী বিবৃতিগুলোতো ইতিহাসই। সেই ইতিহাস বইতে কী লেখা থাকবে ডাক্তার ভাইকে নিয়ে? একটা ডাকাত। ভয়ংকর খুনী। আইনের হাত পালাতে গিয়ে - গোলাগুলিতে মৃত। মগজের মধ্যে অন্ধকার নামে। বাইরেও তাই।
সন্ধ্যার আলো এখন পুরোটাই নিভে এসেছে। অনেক কথাই জমে থাকে কিন্তু আমি জানি এগুলো বলে কোন লাভ হবে না। আমি আকাশে তাকাই। নদীর উপরের আকাশে সন্ধ্যাতারা ফুটেছে। আমি জলের মধ্যে তার ছায়া খুঁজি। কিন্তু বিপুলায়তন এই জলরাশির মধ্যে তার কোন ঠাহর খুঁজে পাওয়া যায় না। হটাৎ করে আমার ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগে। শীত তাহলে আসছে। আমি অস্ফুট স্বরে বলে উঠি-
: জোর করে কিছু হবে না
রাতের আধারে তাকে আরো অন্ধকার দেখায়। দূরে বিন্দুর মত একটা আলো কেবল দুলতে থাকে। দলছুট কোন জেলে নৌকা আগেভাগে জাল নামিয়েছে। তার সেই টিমটিমে বাতির দিকে আমি চেয়ে থাকি আর এরপরের শব্দের জন্য অপেক্ষা করি। কিন্তু মাস্টারভাই এইবার যেন একটু বেশি সময় নিচ্ছেন। দুজনের মধ্যে অখণ্ড একটা নীরবতা ঝুলে থাকে।
: যখন ব্যবধানটা অনেক বেশি থাকে... ব্যবধানটা বাড়তেই থাকে?
: অবশ্যই সেটা মানা যাবে না। যেতে পারে না।
: তাহলে?
লেনিনের ছবিটা ভাসে। অন্ধকার ঘরে মোমের আলোয় নিমগ্ন একটা চেহারা। কিন্তু আমি মুখে বলি আব্রাহাম লিংকনের কথা। খুব কী আলাদা স্বপ্ন ছিল দুই জনের?
: অফ দ্য পিপল বাই দ্য পিপল ফর দ্য পিপল।
মাস্টারভাই একটু রেগে ওঠেন ।
: কোথায় পিপল? কোন পিপল? কেমন পিপল?
: একটা সিস্টেম -আমেরিকানরা এর মধ্য দিয়ে বেশ খানিকটা এগিয়েছে ।
: ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, ইরাক ,ল্যাটিন আমেরিকা ...
মাষ্টারভাইয়ের ক্রোধ ঝরে পড়ে।
আমার মনে পড়ে সোভিয়েত ইউনিয়নও কম যুদ্ধ করেনি। আফগানিস্তান, পোল্যান্ড, ...। যুদ্ধ মানেই রক্ত আর রক্ত।
কলম্বাসের সেই ডালটা চোখে ভেসে ওঠে। সেই ডালটাকে একটা ডাল মনে হয় না। একটা চিন্তা মনে হয় ওকে। ‘ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতার চিন্তা’। নিউ ওয়ার্ল্ড। নতুন পৃথিবী। একটা কনসেপ্ট। একটা ধারনা। একটা বিশ্বাস। জেফারসন। আব্রাহাম লিঙ্কন। মার্টিন লুথার কিং। আই হ্যাভ এ ড্রিম। চিন্তার মৃত্যু নেই। সে বারবার ফিরে আসে। এই জন্য যেমন করে চীনে হয়তো মাং সেতুং আর তার মত করে নেই, মাষ্টার ভাইয়ের মধ্যে আছে। যেমন করে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটা চিন্তা ছিল। সেই দেশটা নেই, অনেকে বুকের মধ্যে পুরে সেই চিন্তাটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
সোভিয়েত ইউনয়নের মত সেই বিশ্বাসের আমেরিকাও নেই হয়ে গেছে। আগে - একজন শত্র“ কমিউনিষ্টও প্রাণ সংশয় হলে একদিন আমেরিকায় পালিয়ে গিয়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখতো। আমেরিকা তাকে আশ্রয় দিত। সে বেচে থাকতো। এই ছিল আমেরিকা। আর এখনতো মুসলমান হলে ওরা তাদের দেশে ঢুকতে দিতেই চায় না। পদে পদে বিড়ম্বনা করে।
কিন্তু এমনটা কেন হলো?
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলো। আমেরিকার কোন শত্র“ রইলো না। মারণাস্ত্র নির্মানের জন্য যে বিপুল সম্পদ ব্যয় হতো তার আর প্রয়োজন থাকলো না। এই সম্পদগুলো মানুষের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার জন্য ব্যয় করা যেত। মানুষের স্বাধীনতার শর্তই হলো বেঁচে থাকার মৌলিক প্রয়োজনগুলো মেটানো। কিন্তু মানুষের স্বাধীনতাকে আরও সমুন্নত না করে আমেরিকা নিজেই শত্র“ তৈরী করলো? তারতো কোন শত্র“ ছিল না। কেন করলো তাহলে?
শত্র“ মানে যুদ্ধ। যুদ্ধ মানে অস্ত্র।
অস্ত্রতো নিরাপত্তার জন্য শুধু নয়, এটা একটা ব্যবসাও। লাভের খতিয়ান। কিন্তু ব্যবসাটাকে সবসময় একটা নীতির মধ্যে চালাতে হয়। না হলে ব্যবসাটাই সবকিছু গিলে খায়। আমেরিকাকে যেমন গিলে খেয়েছে। লাভের অংকটার পেছনে ছুটতে গিয়ে অস্ত্র ব্যবসার কাছে আমেরিকা নামের বিশ্বাসটাই শেস পর্যন্ত হেরে গেল। ব্যক্তি স্বাধীনতার এই চিন্তার পৃথিবীটা শেষ পর্যন্ত আটপৌড়ে সংকীর্ণ একটা রাষ্ট্রের মধ্যে ঢুকে ছোট্ট হয়ে গেছে।
আমেরিকার জন্য মন খারাপ লাগে। সেভিয়েত ইউনিয়নের জন্য যেমন মন খারাপ লাগে। কিংবা এটাই হয়তো নিয়ম। প্রগতি। বিবর্তন, পরিবর্তন, উত্থান, পতন। অন্তহীন। অন্তবিহীন।
কিন্তু মাষ্টারভাইকে এই কথাগুলো বললে কষ্ট পাবে। বিশ্বাসী মানুষ। অন্যের মতকে বিবেচনা করতে কেন জানি বিশ্বাসীদের কষ্ট হয়। এই জন্য কমিউনিষ্টদের অনেকসময় প্রগতিশীল মনে হয় না। গোড়া ধার্মিকদের মত। কিছু বলা যায় না। কিন্তু কোন কিছু বিশ্বাস করতে আমারও ভাল লাগে। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়। বিশ্বাসীদেরও ভাল লাগে। আল্লার প্রেমে মাতোয়ারা বাউলদের কথা মনে হয়। খুব ভালবাসি আমি ওদের। কমিউনিষ্টদের ভালবাসি। ভিন্ন চিন্তা করার জন্য যেই ব্যক্তিমানুষটাকে কমিউনিষ্টরা ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে যাচ্ছে তাকে ভাল লাগে। আবার কাউবয়দের.. অজানা একটা দেশে গিয়ে নিজের মত করে করে বুদ্ধি প্রয়োগ করে একটা দেশ গড়ে তুলছে... ভাবতেই ওদের বন্ধু মনে হয়... ওদের হাতে খুন হয়ে রেড ইন্ডিয়ানদের রক্ত ঝরছে সেখানেও আমার রক্ত ঝরে। ভাবনার এইসব কথা বলা যায় না। মনের মধ্যে ওরা বাস করে। আমি মাষ্টারভাইকে মার্কসের কথা বলি।
: পুজি সঞ্চয়নের নিয়ম এটা- কাল র্মার্কসের কথা। এর বিকাশ না হওয়া পযর্ন্ত এই শোষন চলবে।
: তাহলে আমাদের অনন্তকাল অপেক্ষা করতে হবে?
: আমি বলতে পারি না - কিন্তু আপনারা যেভাবে করছেন - এভাবে হবে না।
: কী ভাবে হবে?
আমি কী বলবো বুঝতে পারি না। এর উত্তর দূর আকাশের তারার মতো। একবিন্দু আলোর মত জ্বলজ্বল করে। কলম্বাসের মত কোন দক্ষ নাবিক হয়ত এই তারার আলোয় দিক ঠিক করে বন্দর অভিমুখে তার যাত্রা সমুন্নত রাখতে পারে। কিন্তু আমার মত সাধারন মানুষের কাছে গণগনে সূর্যের আলো নিভে গেলে অন্ধকার নেমে আসে। কোন পথ পথ খুঁজে পাওয়া যায় না।
: এর উত্তর আমরা জানি। মাও সেতুং দিয়ে গেছেন - লেনিন দিয়ে গেছেন। বিপ্লব - বিপ্লব ছাড়া কোন মুক্তি নেই। সবর্হারার একনায়কত্ব। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আর তার পুজিবাদী দোসরদের হাত থেকে যেদিন শোষিত মানুষ ক্ষমতা দখল করবে সেদিনই প্রকৃত মুক্তি আসবে, এর আগে না।
: শব্দগুলো খুব পুরোনো হয়ে গেছে - নতুন শব্দ দরকার ,-অন্য কোন শব্দ।
: সমস্যাটাও পুরোনো। আর এটার সমাধান হয় নি। নতুন শব্দ দিয়ে কী হবে?
: কিন্তু পৃথিবীতে অনেক নতুন কিছু ঘটে গেছে।
: মৌলিক সমস্যাগুলো এখনও দুর হয় নি। বরঞ্চ বৈষম্য আগের চেয়ে বেড়েছে। বিজ্ঞান এগিয়েছে, কিন্তু বিজ্ঞানের উপর মানুষের অধিকারটা আসেনি।
: শাষনব্যবস্থায় মানুষের অংশগ্রহন কিন্তু বেড়ে গেছে। মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা বেড়ে গেছে। সে নিজে একটা শক্তি। এখন সেই শক্তিটা সে ব্যবহার করতে পারে।
: এই বুর্জোয়া ভোট দিয়ে মুক্তি হবে না।
মওলানা ভাসানী সেই কবে বলেছিলেন ভোটের আগে ভাত চাই। কিন্তু কে দেবে তার ভাত? মানুষ হয়ত ঠিকভাবে বাছাই করে না, কিন্তু মানুষ কী খুব বেশি ভুল করে? আস্থাতো নেতাকেই অর্জন করতে হয়। ভাতের দাবীতে তিনি ৭০ এ নির্বাচনের মাঠ থেকে সরে গেলেন। তিনি যদি সরে না যেতেন ... কী হতো তাহলে? ইতিহাস কী অন্যরকম হতো? বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, যে কোন অবস্থায় আমি নির্বাচনে যাবো। আমি রায় চাই - কে বাংলাদেশের কথা বলবে। আমার জনগণের উপর আস্থা আছে তারা ভুল করবে না। ভাসানী নির্বাচনে যান নি আর জনগনকে বঙ্গবন্ধুর উপর আস্থা রাখতে দ্বিতীয় কোন চিন্তা করতে হয় নি। ভাসানী কী বাংলাদেশের মাতাল স্বতস্ফুর্ততা বুঝতে পেরেই নির্বাচন থেকে সরে দাড়িয়েছিলেন - মুক্তিপাগল বাঙ্গালীকে ভাগ করতে চান নি বলে? এটা কী তার মহানুভবতা নাকি অদূরদর্শীতা? কী জানি। দূর দিয়ে একটা স্টিমার চলে যায়। ইতিহাসের এই সব প্রশ্নগুলোকে নদীর মতো মনে হয়। সারজীবন ধরে বইতেই থাকবে।
হয়ত মাস্টারভাই যা বলছে তাই ঠিক। কিন্তু কোথায় জানি তাদের চিন্তার মধ্যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি একটা অবহেলা, একটা অবজ্ঞা টের পাই। হয়ত জীবনের সমস্ত স্বপ্নগুলো মানুষকে নিয়ে দেখতে দেখতে তাদের জীবন এক একটা আকাশ হয়ে গেছে। মাুনষের চেয়ে অনেক উচুঁতে তারার মত মনে হয় মাস্টারভাইকে। একা নিঃসঙ্গ। এই পদ্মার বালুচরে নির্জন রাত্রিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। ফ্রিদার কথা মনে পড়ে। ঝুমির কথা । কেউ নেই পৃথিবীতে - কেউ নেই - কেউ।
আমি আজ আকাশের মত একেলা ..
সজল উদাস বায়ে বুকের কাছে স্মরণের তারাগুলি লুকায়ে থাকে।
মানুষের প্রতি ভালবাসাগুলো কী মান্না দের গানের স্মরনের তারাদের মত এমনিভাবে লুকিয়ে থাকে? যা কোনদিন কেউ জানতে পারে না।
পদ্মার স্রোতকে অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করতে করতে আমি এইসব ভাবি। আমার এবার মাষ্টার ভাইয়ের জন্য কষ্ট হয়। আমার মনে হয় তাকে জড়িয়ে ধরে বলি - শব্দের নিঃসঙ্গতায় আটকা পড়ে আপনি মারা যাবেন মাস্টারভাই। এখনকার ছেলেমেয়েরা বাবার জোরকেও মানে না। বাবাকেও সন্তানের বন্ধু হতে হয়। সন্তানের কথা শোনবার জন্য বাবাকে তৈরী হতে হয়। পৌরানিক নায়কের মত সবাইকে জোর করে আর কিছু করা যাবে না।সবার জন্য সমান সূযোগ তৈরী হয়, প্রত্যেকে যেন সেই সূযোগকে ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে এমন এক স্বাধীনতার সাম্য ব্যবস্থার কথা আপনারা ভাবেন। তাহলে হয়ত দেখবেন অনেক দূরের পথও দেখা যাচ্ছে।
কিন্তু কিছুই বলা হয় না। কিংবা আমি বুঝে ফেলি এই কথাগুলো বলা হয়ে গেছে অনেকবার। কেবল একটা নৈঃশব্দ আকাশের চাদের আলোর নিচে দিগন্তজুড়ে চিকচিক করে। ভাল করে তাকিয়ে দেখি নৈঃশব্দ না, নদীতে তখন অনেক নৌকায় আলো জ্বলে উঠেছে। সারি সারি আলোর মুকুট পরে পদ্মা যেন কনের বাড়ি সেজেছে। - আমি তাকিয়ে দেখি
খুব বাতাস উঠেছে নদীতে। হাত পকেটে ঢুকিয়ে শরীরটাকে কুকড়ে নিয়ে আসি নিজের ভেতরে। পূর্ণিমার চাঁদের গায়ে লাল ছোপ। স্বপ্ন, রঞ্জু, মাস্টার, মাঝি, পদ্মার স্রোত, কাজলাদিদির ডাক্তারভাই, পূর্ণিমার চাঁদ, শীতে কুকড়ে যাওয়া শরীর একাকার হয়ে যায়...চারপাশের নিরুত্তর ধ্বনি ভেসে আসে... টকটকে কালো অন্ধকার মনে হয় সবকিছু । গলার কাছে কেমন নোনতা লাগে, আমি ঢোক গিলি। হটাৎ খেয়াল করি মাস্টারভাই অন্ধকার তীর ধরে হাঁটতে শুরু করেছেন... আমি মাস্টারভাইকে চিৎকার করে ডাকি- মাস্টারভাই। তিনি থমকে দাঁড়ান। কিন্তু না। এক মুহূর্তের জন্য সেটা - তারপর আমার ডাক উপেক্ষা করে তিনি হাঁটতেই ধাকেন। হাঁটার গতি বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় দৌঁড়ের মত, একবার ভাবি তার পেছনে ছুটি... কিন্তু মাটিতে আঙ্গুল গেড়ে দাঁড়িয়ে থাকি... তার পেছনে ছুটতে পারি না।
ওটাই তাকে ছুড়ে দেয়া আমার শেষ ডাক। ডাকটার ভেতরে তিনি কী দেখেছিলেন? আমার বিশ্বাসের অস্বীকার কিংবা তার অপারগতা... কিংবা সেটাও ছিল কেবলই এক নিরুত্তর মূহূর্ত।
আমি চকচকে নলের সামনে মাস্টারভাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। একটা ঠাণ্ডা শীতল গলা ভেসে আসে। ঠাণ্ডা হীমের চেয়েও জঁমাট সেই গলা। সামনে যান...... একটা ধাক্কা দিতে লোকটা হাত বাড়ানোর আগেই কে সজোরে লাথি হাকে -সামনে বাড়। মাষ্টারভাইয়ের গলা থেকে একটা আওয়াজও বের হয় না। একটা খিস্তি খেউর ওঠে। মাষ্টার কেবল অন্ধকারের ভেতর তাকিয়ে লোকটার চোখে চোখ রাখবার চেষ্টা করেন। তারার আলোয় চোখে চোখ রাখা কষ্টকর। একরাশ অন্ধকার ওখানে খেলা করে। অনেক দূর থেকে কয়েকটা গুলির আওয়াজ শোনা যায়। কেউ কেউ ওই শব্দ শুনে থাকবে। তারা চমকে ঘুমভাঙ্গা কল্পনায় একটা কিছু মনে করার চেষ্টা করবে, কিন্তু এরকম আজকাল প্রায়ই হয়। আবার ঘুমিয়ে পড়ার আগে তারা জানবে না এ শব্দ হবার ঠিক এক মুহূর্ত আগে একটা মানুষের ঠোঁটজোড়া একটু কেঁপে উঠেছিল। এর পরেই তিনি চিরদিনের জন্য অনড়, স্তব্ধ, আর নিশ্চল একটা বাস্তবতা আর পত্রিকার জন্য সরকারী মন্ত্রনালয়ের ছোট্ট একটা প্রেসনোট হয়ে যান।
মৃত্যুর জন্য তার দিকে গুলিটা ছোড়ার ঠিক আগে রাষ্ট্রীয় ইউনিফর্মে মোড়া চৌকস পেশাদার মানুষটাকে কী বলতে চেয়েছিলেন তিনি ? মাষ্টারভাই কী ঐ প্রশ্নটাই করতে চেয়েছিলেন তাকে? যে প্রশ্নটা তিনি সবাইকে করে বেড়াতেন।
- আপনি কী রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন? জীবনে অন্তত একবার, রবীন্দ্রনাথ?
মাষ্টারভাই চলে যাওয়ার পর শিলপাটা ধার দেওয়া নিবারন দাদুর প্রশ্ন নিয়ে কেউ আর আসে না।
আমাদের সেই শৈশবে আমরা তাকে দাদু ডাকতাম। তার মুখের দিকে তাকালেই মনে হত - তার বুঝি খুব ক্ষিদে পেয়েছে। কালো রঙের লম্বা লোকটা, বয়সের ভারে একটু কুজো, ভাঙা চোয়ালে খোচা খোচা সাদা দাড়ি। চোখে গোল গোল মোটা কাঁচের চশমা, ক্যানভাসের ময়লা একটা ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত - ‘শিলপাটা ধার, লাগবে শিলপাটা ধার’ ডাক দিয়ে হেঁটে যেতেন। তিনি মাঝে মাঝে মাঝ দুপুরে বাসায় খেতে আসতেন। আশ্চর্য মিল ছিল নিবারন নামের লোকটা আর দাদুর চেহারার মধ্যে। ওই জন্যই কিনা কে জানে, বুড়োটাকে মা আদর করে খাওয়াতেন। ঐ বুড়োটাকে মা যখন খাবার বেড়ে দিতেন - গোগ্রাসে গিলতে থাকা চোয়ালজোড়ার দিকে তাকিয়ে আমার চোখে দাদুর চেহারাটা ভেসে উঠতো। সাদা সফেদ একটা বিছানায় দাদু শুয়ে শুয়ে একতালে তজবীটার সবুজ দানাগুলো জপে যাচ্ছেন। পাশের টেবিলে থরে থরে ফল, খাবার, পথ্য সাজানো পড়ে আছে। আর তখন দাদুুর মতো অবিকল লোকটা ঝা ঝা দুপুরে শি-ল-পা-টা ধার বলে চিৎকার করতে করতে রাস্তা ধরে ক্ষিদেপেট নিয়ে একমুঠো খাবারের জন্য মায়ের কাছে এসেছে। ছোট্ট মাথায় প্রশ্ন জাগতো - কেন নিবারন দাদুর জন্য, আমার দাদুর মতো খাবার থাকে না ? জ্ঞান হবার পর থেকেই জানতাম হিন্দুরা দোযখে যাবে আর মুসলমানরা একদিন না একদিন বেহে¯েত যাবে। নিবারন দাদুকে দেখে মনে হত এই লোকটা মৃত্যুর পর দোযখের অনন্ত আগুনে পুড়তেই থাকবে, এই পোড়া কখনও শেষ হবে না। আমার খুব কষ্ট হতো। কেন নিবারন দাদু সারাজীবন আগুনে পুড়বে ? আমি আল্লাকে পেলে বলতাম। হিন্দু ধর্মে বলে উল্টো কথা। নিশ্চয় মুসলমানদের জন্য বেশ বড়সর একটা কড়াইয়ে অনবরত তেল ফুটছে। মুসলমানী আত্মায় নরক গুলজার হবে।
নিজেকে পিপড়েটার মত মনে হয়। নিজের অজান্তেই শাস্তি আর পুরস্কারের দোলায় দুলছি।
এটা সেই শিশু বয়সের কথা। তখন প্রতিটি মূহূর্তই খেলার মাঠে গড়িয়ে যাওয়া সময়ের মত।
একটা পিপড়েকে পাকড়াও করে বড় একটা কাগজে ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করছি। কাগজটায় রঙ পেন্সিল দিয়ে গোল গোল রঙীন রঙীন সব বৃত্ত আঁকা। একেক রঙের জন্য একটি করে ভাগ্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছি। পিপড়েটা হাঁটতে হাঁটতে যেই রঙের বৃত্ত অতিক্রম করবে আর সেই বৃত্তের জন্য নির্ধারিত ব্যবস্থা তার উপর প্রয়োগ হবে।
যেমন সবুজ রঙের উপর দিয়ে পিপড়েটা গেলে দুটো চিনির দানা ওর জন্য বরাদ্দ কিন্তু লাল রঙের উপর দিয়ে গেলে ওর একটা পা টেনে ছিড়ে নেয়া হবে। পিপিড়েটা যদি হলুদ রঙের উপর দিয়ে যায় তাহলে ওর জন্য বাঁধা মৃত্যু, অবশ্য নীল রঙের উপর দিয়ে গেলে ওকে ছেড়ে দেয়া হবে। গোলাপী রঙের উপর দিয়ে গেলে ওর উপরে অনেক উপর থেকে তিনবার পেন্সিল রাবার ছুড়ে ফেলা হবে- বেচে গেলে মুক্তি। নেভি ব্লু রঙের উপর দিয়ে গেলে মুক্তির সাথে সাথে পাউরুটির টুকরো... এইসব আর কী।
খেলা শুরু হবার আগে পিপড়েকে বলে দিতাম এই করলে এই হবে কিন্তু পিপড়েরা এইসব কথার যে কী বুঝতো সেই জানে। ওরা বারবার বিপদজনক রঙগুলোই পাড়ি দিতো। তাদের উপর শাস্তি নেমে আসতো নিয়তিতাড়িত হতভাগ্য মানুষের মতই।
আমার মতই।
এটাই কী নিয়তি ?
কোন আশ্বাস ধ্বনি আসে না। গোটা পৃথিবী নিরুত্তর বসে থাকে। মূহূর্তগুলো কেবল পাখির ডানা মেলে উড়তে থাকে।


মন্তব্য

কল্যাণF এর ছবি

গুরু গুরু

ঝুমন এর ছবি

আপনার লেখা খুব সুন্দর হয়। কিন্তু আরেকটু গোছানো হলে বা আরেকটু ছোট পরিসরে হলে আমার মত ছটফটে মানুষেরা আরও বেশি পড়তে পারবে কেননা আমি মনে করি আপনি যে ব্যাপারটা নিয়ে লিখেছেন তা সকলের পড়া উচিৎ। মানুষকে বস্তু দিয়ে প্রতিস্থাপন করার চিন্তাটা আমার অসাধারণ লেগেছে। এভাবে ভাবিনি কখনো।সাম্যবাদের বিশ্বাসকে প্রশ্ন করার জন্যই আপনার লেখা খুব প্রয়োজন।

কর্ণজয় এর ছবি

সমাজ এবং ব্যক্তিজীবনের রূপরেখা নিয়ে যতগুলো কাঠামো রয়েছে- ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে সেই সব কাঠামোগুলো এক নতুন অর্থপ্রাপ্ত হয়। আমাদের জীবনের সাধারণ সব ঘটনার মধ্য দিয়ে যেতে গিয়ে আর সবার মত আমারও নিজস্ব এবং ব্যক্তিগত কিছু অনুভূতি, আবেগ, কল্পনা, স্বপ্ন আর যন্ত্রণার তৈরী হয়েছে। এগুলো কেমন একটা কল্পময় অদ্ভুত পৃথিবীর ছায়া ফেলে। এগুলোকে কি বলে- জীবনানন্দের ভাষায় - এটা কি সেই কোন এক বোধ? আমি জানি না। আমি সত্যিই জানি না। আমি আকতে পারি। শব্দ দিয়ে- আর শব্দ দিয়ে। আর এইসব আকা কোন ছবি তৈরী করে সে কথা আমি ঠিক জানি না...

উচ্ছলা এর ছবি

একটু বেশিই দীর্ঘ; কিন্তু খুব ভালো লাগল পড়তে হাসি

আশফাক আহমেদ এর ছবি

কলেবরে একটু বড় হলেও পড়তে ভালো লাগলো

-------------------------------------------------

ক্লাশভর্তি উজ্জ্বল সন্তান, ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ !
আমি বাজে ছেলে, আমি লাষ্ট বেঞ্চি, আমি পারবো না !
আমার হবে না, আমি বুঝে গেছি, আমি সত্যি মূর্খ, আকাঠ !

তাপস শর্মা এর ছবি

খুবই ভালো লাগলো। চলুক

নিটোল. এর ছবি

বিশাল পোস্ট। কিন্তু তবুও বেশ ভালো লেগেছে।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

অসাধারণ... অসাধারণ...
দীর্ঘই থাকুক... এরকমই থাকুক...
গুরু গুরু (গুরু) গুরু গুরু

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আপনার গল্প পড়লে শাহাদুজ্জামানের প্রথম দিককার গল্পগুলোর কথা মনে পড়ে যায়...
দাদা, এবার একটা বই হবে নাকি?

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

কর্ণজয় এর ছবি

লেখাটা একটা সম্পূর্ণ লেখা হয়ে উঠুক এই লক্ষ্যে কাজটা করে যাচ্ছি। কাঠামোগত ভাবে, আঙ্গিকগতভাবে, বিষয়গতভাবে। একটা বই? - হতে পারে নজরুল ভাই- আকিবুকি রেখা শব্দের মত অনেকগুলি পৃষ্ঠা... হতে পারে। আমি লেখাগুলোকে নিয়ে যখন মনের মধ্যে ভাবি- চোখে দেখার চেষ্টা করি- একটা বই- দুই মলাটের মধ্যে আমি দেখি মাঝে মাঝে...

রাফি এর ছবি

অগোছানো লেখা। ভাল লাগেনি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।