এ ও সে ও: ১২- শূন্যতার ছায়াপথে

কর্ণজয় এর ছবি
লিখেছেন কর্ণজয় (তারিখ: শনি, ২২/১০/২০১১ - ৯:১১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

রঙধনু রঙের মগ্ন আনন্দে মশগুল পৃথিবী বাইরে পড়ে থাকে। দমবন্ধ ঘরের বদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিতে নিতে মৃত্যূকেও বড্ড বদ্ধ মনে হয়। বাঁচতে ইচ্ছে করে না। মরাও হয়ে ওঠে না। জটপাকানো রোদ আর অন্ধকার বুকের পাঁজরে একটু পরপর টোকা দিয়ে যায়।
লাস্টবেঞ্চি আবার মাথার ভেতর ঘুরপাক খায়।
“যখন অনিচ্ছাসত্ত্বেও মৃত্যু ঘটে নিশ্চয়ই তোমার উপর মৃত্যু জয়লাভ করে।
আর তুমি যখন মৃত্যুকে বাধ্য কর তোমার কাছে আসতে তবেতো তুমিই তাকে পদানত করলে।”
মৃত লাস্টবেঞ্চিকে মাথা থেকে তাড়াতে পারি না। এত দীপ্তিবান মনে হয় ওকে। এত প্রখর মনে হয় ওকে। তবে কী মৃত্যু মানুষকে শক্তিশালী করে? আজফারভাই এর বেহালার বাদন শুনতে আসা চে'কে মনে পড়ে। চে ফিদেল কাষ্ট্রোর কথা বলছিলেন। বিনয় মনে হয়। দুনিয়া জোড়া কোটি কোটি তরুনের মধ্যে চে বেঁচে আছে। প্রেরণা হয়ে। স্বপ্ন হয়ে। সে কথা বলতেই - আজফারভাই বেহালা থামিয়ে মুখ তুলে শান্ত গলায় যা বলেছিলেন.. তা চে’র কথারই পুনরাবৃত্তির মতন।
ফ্যাশুনে বিপ্লবীদের কাছেই চে’ অনেক বড় আইকন। বৃষ্টি দেখতে দেখতে- চায়ের কাপ সামনে নিয়ে গিটারে টুংটাং সুর তুলতে তুলতে তোমার চে’র কথা মনে পড়বে। তুমি চে’র মত ঘন অরণ্যে রাইফেল কাঁধে হেটে যাবে। কিন্তু চের জীবনকে ছূয়ে দেখতে কোনদিনও কল্পনার খোলস ছেড়ে মাটিতে পা বাড়াবে না। কারণ চে’র পরিণতি তোমার মাথার মধ্যে আছে। অবচেতন তোমাকে ধমকে উঠবে -
খরবরদার!
আর এই খবরদারের জন্য আমেরিকা চে’র আইকনকে দুনিয়াজুড়ে প্রমোট করে। গেঞ্জি, শার্ট, জুতো, মদ, খাবারের ঠোঙা, সেন্ট, নেল পালিশ - কোথায় না ... চে’র ছবি লাগিয়ে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। ফিসফিস করে বলে - “ভোগ করো - ভোগ কর। চে’কে ভোগ কর - ওকে নিয়ে রোমান্টিকতা করো - ওর জন্য তোমার কল্পনা উজাড় করে দাও। কিন্তু বাস্তবে কখনও চে হতে যেও না। তাহলে এর পরিণাম হবে - চে’র মতোই- তোমার মৃত্যু।”
কিন্তু ক্যাষ্ট্রো? দেখো- আমেরিকার নাকের ডগায় বসে কীভাবে বিপ্লবকে টিকিয়ে রেখেছে। আমেরিকানরা কত ভাবেই না ওকে মারতে চেয়েছে। কতবার! কত শতবার! এ্যাকশন সিনেমার কূট-কুশলী ভিলেনরাও এতসব কারিকুরী কওে না। কিন্তু ফিদেল এরপরও বেঁচে আছে। লক্ষ্যকে টিকিয়ে রেখেছে। সে হলো জীবনের প্রতিচ্ছবি। মৃত্যুর চেয়ে অনেক বড়। জীবনের কাছে স্বপ্ন মানে লক্ষ্য। মৃত্যুর মধ্যে রোমান্টিকতা আছে আর জীবনের মধ্যে আছে- এগিয়ে যাওয়া।
আমি মাথা নাড়ি। ঘরের মধ্যে এক টুকরো আলো এসে পড়ে। কোত্থেকে এক ঝিরঝিরে হাওয়া বইতে শুরু করে। ঘরের বদ্ধ গুমোট ভাবটা কেটে যেতে শুরু করে। ফুরফুরে লাগে।
‘শুধুমাত্র আরো কয়েকটা বছর বেশি বেঁচে থাকার লোভে নিজের মধ্যে খালি ফাঁপা যুক্তি তৈরী করছিস।’ - লাস্টবেঞ্চি আমার চিন্তার সূতোয় কাচি চালায়।
: লর্ড ক্লাইভের মত একটা খলনায়কও আত্মহত্যা করেছিল। কেন জানিস? সাতসমুদ্র পাড়ি দিয়ে আরেকটা দেশ জয় করতে যে শক্তিটা লাগে ওর সেটা ছিল। কিন্তু চারপাশের আত্মসন্মানহীন আমাদের নায়কদের দিকে তাকা। পারবে ওরা ক্লাইভের মত নিজের জীবনটাকে নিয়ে নিতে? পারবে না। ঐ শক্তিই ওদের নেই।-
লাস্টবেঞ্চি উজ্জ্বল তারার মত জ্বলতে থাকে। তার আলোর তীব্র বিচ্ছুরনে আমি অন্ধ হয়ে বসে থাকি।
: বঙ্গবন্ধু... তার মৃত্যুর কথা ভাব। কী এক অপূর্ব কবিতা।
বঙ্গবন্ধুর সিঁড়িতে পড়ে থাকা নিথর দেহ চোখের সামনে ভেসে ওঠে।রক্তে ভিজে জমাট বেঁধে কালচে হয়ে আছে বুকের কাছটা।শরীরজুড়ে জীবনানন্দ দাশের অভিমান থথর থর করে কেঁপে ওঠে।
পৃথিবীর সব রঙ শুষে নেয়।
এইভাবে কেউ তার পিতৃত্বের প্রতীককে উপড়ে ফেলে!
রক্তগুলো কান্না হয়ে যায়।
কোন মানে নেই। কোন মানে নেই কোনকিছুর। মনের মধ্যে রাগ পাথরের মত - জমাট বেধে উঠতে থাকে।
এমন মৃত্যুকে লাস্টবেঞ্চি অপূর্ব বলছে! লাস্টবেঞ্চিকে অসহ্য মনে হয়। অস্থির লাগে।
‘লাস্টবেঞ্চিতো বলবেই’- হটাৎ মনে পড়ে - সে তো মৃত্যু। আর বঙ্গবন্ধু ছিলেন জীবন। পিতা। মৃত্যুতো জীবনের ধ্বংশস্তুপই দেখতে চাবে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে কি আর এত অন্ধকার নেমে আসতো! লাস্টবেঞ্চি আমাকে মৃত্যু বিষয়ে এত জ্ঞান দিতে পারতো! আমি ফুঁসে উঠি। লাস্টবেঞ্চির চোখে চোখ রেখে সমস্ত রাগ উগড়ে দি।
: উলঙ্গ হয়ে তোকে থুথূ মারি।
কারো প্রতি চূড়ান্ত ঘৃণা প্রকাশ করতে হলে এভাবেই চিৎকার করে উঠতেন দেলওয়ার কাকা। লাস্টবেঞ্চির জন্য আমার মধ্যে দেলওয়ার কাকার রাগ ফিরে আসে।
হাঃ হাঃ হাঃ ...
অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে লাস্টবেঞ্চি। ওর হাসির সামনে থতোমতো খেয়ে বোকার মত চুপ করে যাই। কিন্তু ভেতরে ভেতরে রাগ বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে। ও হাসতেই হাসতেই বলে
: মুজিবকে কে মেরেছে?
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর প্রসঙ্গ উঠলেই আমার মাথার মধ্যে ষ্টেনগান হাতে আততায়ীগুলো চকচকে রাইফেল হাতে সিড়ি বেয়ে উঠতে থাকে। ঐ তো বঙ্গবন্ধূ বেরিয়ে আসছেন। আমি আর দৃশ্যটা সহ্য করতে পারি না। আমার হৃদস্পন্দনটা বেড়ে যায়, চারপাশে বাতাসটা থমকে যায়, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। শেষ পর্যন্ত উজ্জ্বল মেয়েদের স্বপ্নে কিংবা মাইকেল জ্যাকসনের ঐন্দ্রজালিক নৃত্যের রঙীন ভাবনার মধ্যে হারিয়ে গিয়ে তবেই নিঃশ্বাস নিতে পারা যেত। দম বন্ধ করে ফেলা সেই দৃশ্য আবার লাস্টবেঞ্চি ফিরিয়ে এনেছে। আমার আর ভাল লাগে না।
: কে মেরেছে মুজিবকে ? মুজিবকে কেউ মারে নি। তোরা যাদের বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী বলিস, মুজিবকে তাদের কেউ মারে নি। ওরা কী করে মুজিবকে মারবে? মুজিব এত দূর্বল!
কী বলে ও! বুঝতে পারি না। বিভ্রান্ত মূহূর্তগুলো আমাকে অবশ করে রাখে।
আমার বিবশ শরীরের উপর দিয়ে লাস্টবেঞ্চি ঝড়ের মত বয়ে যায়।
: মুজিব জানতো কী হবে- কী হতে যাচ্ছে। মুজিব চাইলে বাঁচতে পারতো। মুজিব সব ইচ্ছে করে করেছে।
মুজিব পঁচাত্তরে বাঁচতে পারতো। কারন - গোটা পৃথিবী ওর কথা শুনতো।
কেন, তাকে কেউ কী সতর্ক করে নি?
আমার মনে পড়ে- তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা বঙ্গবন্ধুকে কারা কারা জানি আগে থেকেই সতর্ক করেছিল।
লাস্টবেঞ্চি সেই প্রসঙ্গটাই টেনে আনে।
বলেনি – ‘৩২ নাম্বার রাস্তার এই বাড়িটায় আপনার থাকা উচিৎ হবে না।বঙ্গভবনে গিয়ে থাকুন।’ কেন যায় নি সে?
বলেনি-‘ তোমাকে হত্যার ষড়যন্ত্র হচ্ছে? সাবধানে থেকো…’।
কারও কথা সে শোনে নি কেন? কেন শুনে নি সে? বলতে পারিস?
আমার মাথায় কোন কিছু কাজ করে না। বোকার মত ওর দিকে চেয়ে থাকি। স্বপ্নের ঘোরের মত দেখায় ওকে।হাতের তর্জনী তুলে এমনভাবে কথাটা বলে যেন সে নিজেই বঙ্গবন্ধু-
‘কারন সে বুঝতে পেরেছিল- কীভাবে মৃত্যুর উপর জয়ী হওয়া যায়।’
লাস্টবেঞ্চির কথাগুলো - অসীম, অনন্ত সমুদ্রের দিকে ধারবমান অনর্গল স্রোতের মত বইতেই থাকে। আমি সেই স্রোতের টানে ভেসে চলেছি- একটা খড়কুটোর মত, দল থেকে খসে পড়া এক টুকরো কচুরীপানার মত। যার কিচ্ছু করার নেই। কিচ্ছু বলার নেই। নেচে ওঠা ঢেউ মত লাস্টবেঞ্চির কথার টানে আমি পড়ে থাকি।
যে জনক - সে যেমন করে চেনে তার সন্তানের প্রতিটি নাড়ি ও নক্ষত্র-
সে এদেশের প্রত্যেকটা মানুষকে সে এভাবে চিনেছে।
সে এই জীবনেই যেমন জেনেছে জীবনের গন্তব্য
তেমনি করেই বুঝেছে মৃত্যুর অমরত্ব।
তার ইচ্ছার বাইরে কিছুই হয় নি। কিছুই ঘটেনি।
জীবনের মত তার মৃত্যুও ছিল তার ইচ্ছের অধীন।
লাস্টবেঞ্চি কি যে বলে যায় - আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকে না। কি বলতে চাচ্ছে ও? ভাবতে গিয়ে সব বাতাসের মত মনে হয় সবকিছু- হালকা, পলকা। নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগে।
লাস্টবেঞ্চি বোধহয় আমার অবস্থাটা বুঝতে পারে। কথা থামিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। ওর চোখদুটি কেমন বিরাট, বড় বড় - কাজী নজরুল ইসলামের মত। যেন বিস্ফোরিত হয়ে এক্ষুনি ফেটে পড়বে। আমার কেমন শীত শীত লাগে। ভয়টা কাটানোর জন্যই কিনা কে জানে- একটা মৃদু হাসি মুখে ফুটিয়ে ধীরে ধীরে কাছে আসে। পুরনোদিনের বন্ধুর মত মনে হয় ওকে। হতবিহ্বল দৃষ্টির সামনে সে এসে বলে
শুধু বঙ্গবন্ধূ কেন, তাজউদ্দিন আহমেদও এটা জানতো।
আমার ঘোর যায় না। লাস্টবেঞ্চির কথাগুলো যেন বুঝতে পারছি আবার বুঝতে পারছিও না। আমি যে কি বলি তাও বুঝি না। শুধু শূনতে পাই নিজের গলা থেকে একটা ধ্বনি লাস্টবেঞ্চির দিকে উড়ে যায়।
‘কী?”-
লাস্টবেঞ্চি আস্তে, শান্ত স্বরে এমনভাবে কথাটা বললো যেন ও বাইরে থেকে এসে আমার ঘুম ভাঙিয়ে বললো- বাইরে খুব বৃষ্টি নেমেছে।
তাজউদ্দিন আহমেদ জানতেন কিভাবে পিতা তার এবং নিজের মৃত্যুকে রচনা করলেন।
আমি চমকে উঠি।
লাস্টবেঞ্চি আমার চোখের উপর তার চোখ রেখে নিঃশব্দে হাসতে থাকে। আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি।
লাস্টবেঞ্চি চোখের তারা যেন আগ্নেয়গিরির মত জ্বলতে শুরু করে। তার চোখের মণি যেন লাভামুখ। সেখান থেকে থেকে অফুরন্ত লাভাস্রোতের মত বেরিয়ে আসতে থাকে মহাশূন্যের অসীম অন্ধকার। ধীরে ধীরে সবকিছু সেই অন্ধকারে ডুবে যায়। কোথাও কোন স্পন্দন নেই। মনে হয় অনন্তকাল ধরে জীবন- মৃত্যুর অতীত কোন কালের নিস্তরঙ্গ, অসীম রহস্যময় এক শূন্যতা একটা ছায়াপথের মত ছড়িয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত প্রশান্ত সবকিছু।


মন্তব্য

তানিম এহসান এর ছবি

রিমি আপা যেভাবে তার বাবাকে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তাতে তাকে নিয়ে আমার কৌতুহলের শেষ নেই, শেষ নেই আবেগের। আপনার লেখায় তাজউদ্দীন আহমেদ প্রায়শই থাকেন, এমন একটি চরিত্র যার সঠিক ইতিহাস এবং মূল্যায়ন বাংলাদেশ এখনো করতে পারেনি বলেই আমি মনে করি .... আমার প্রিয় নায়ক!

শুধুমাত্র তাজউদ্দীন আহমেদকে নিয়ে একটি বিশদ লেখার আবেদন থাকলো আপনার কাছে, আমাদের জন্য এটা খুবই প্রয়োজন।

ধন্যবাদ আপনাকে, আাপনার প্রতিটি লেখাতে এতসব চরিত্রের সন্নিবেশন ঘটে এত বৈচিত্রে - মুগ্ধ হই!

bluesawn এর ছবি

সুন্দর শব্দবিন্যাস । হো হো হো

মেঘ অদিতি এর ছবি

দারুণ ভালো একটা লেখা পড়লাম।
মেঘ অদিতি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।