স্মৃতির মিনার, শ্রদ্ধার মিনার

উপল মাহবুব এর ছবি
লিখেছেন উপল মাহবুব (তারিখ: শনি, ২০/০২/২০১০ - ১০:৪৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.

আমি যখন মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করি তখন আমার খালাতো ভাইয়ের সাথে একবার ঢাকা এসেছিলাম বেড়াতে। শিশু পার্ক, বোটানিক্যাল গার্ডেন, আহসান মঞ্জিল, লালবাগ কেল্লা এসব দেখে গেলাম জাতীয় স্মৃতিসৌধ দেখতে। চিরকাল বিটিভির খবরের আগে বা বইয়ের পাতায় স্মৃতিসৌধ দেখে এসেছি দূর থেকে। গিয়ে দেখি, ওমা, যে কেউই তো এটার মধ্যে গিয়েই দাঁড়াতে পারে। অনেকে দেখলাম এর বিভিন্ন খাঁজে খাঁজে আড্ডার আসর জমিয়েছে। এর চেয়েও মজার ব্যাপার হল স্মৃতিসৌধের ঢাল বেয়ে ওঠার খেলাটা - ধুমসে খেলছে সবাই। বাদামওয়ালা আর ঝালমুড়ির ব্যবসা দেখলাম হুলুস্থুল চলছে, আর ডাস্টবিনের বালাই নেই বলে খোসাগুলো আর ঠোঙাগুলোও জমছে সৌধের আশেপাশেই।

আমার মনে শান্ত সৌম্য স্মৃতিসৌধের ভাবগাম্ভীর্য ওখানেই শেষ...

২.

মাসকয়েক আগে সুন্দরবন বেড়াতে গিয়েছিলাম। সিনিয়র জুনিয়র মিলে মোট উনিশ জনের দল। দু'জন বাদে কেউই আমার পূর্বপরিচিত ছিল না, ভ্রমনের সুত্রে যাত্রাপথে সবার সাথে ধিরে ধিরে পরিচিত হলাম। অনেকে চাকুরিজীবি, বাকিরা ছাত্র। বেশ মজার ও রোমাঞ্চকর সময় কাটলো, ফলে বন্ধুত্বের সম্পর্কও দৃঢ় হল।

ফেরত আসার পথে খুলনাতে ছিলাম একদিন। আমাদের সাথে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এবং খুলনার স্থানীয় কয়েকজন ছিলেন। তারা সহ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়াতে গেলাম। বিভিন্ন বিভাগ আর হল দেখতে দেখতে একসময় এলাম শহীদ মিনারের কাছে। স্থাপত্যশৈলী দেখে মুগ্ধ হলাম প্রথমেই। খুবই নান্দনিক স্মৃতিস্তম্ভ, যার মূল আকর্ষণ স্তম্ভের মাঝামাঝি অবস্থিত একটা পাথরের ঘনকাকৃতি - যেটা সামনে থেকে দেখে মনে হয় যেন শূণ্যে ভেসে আছে।

বাকিরাও উল্লসিত হয়ে উঠলো তা দেখে। খুব দ্রুত দুই একজন সাবলীল ভাবে বেয়ে উঠে গেল মিনারের ওপরে, বাকিরা (কেউ জুতো খুলে, কেউ বা তাড়াহুড়োয় জুতো না খুলেই) একে একে বসে গেল মূল বেদীতে আর দেয়ালের কিনারায়। নানান ভঙ্গিতে ছবি উঠলো।

আমি দেখেও না দেখার ভাণ করলাম...

৩.

বুয়েটের হল থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এত্তকাছে... স্নাতকের ছাত্র থাকাকালে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি বুয়েট শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়েছি। বহুলোকের ভিড় থাকলেও মূল বেদীর কাছে কড়াকড়ির কারণে ফুল দেওয়ার ব্যাপারটি যথাযথ মর্যাদা সহকারে হয় বলে মনে হয়েছে। গতবছর দুর্ভাগ্যবশত রাতে যেতে পারি নি, ২১ তারিখ সকালেও সুযোগ হয় নি। ফলে শহীদ মিনার যখন গেলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা। হায় খোদা, টেলিভিশন চ্যানলে আর সাংবাদিকরা নেই বলেই বোধহয় লোক দেখানো কড়াকড়িও শেষ। সব ব্যারিকেড উধাও। আর পিপিলিকার মত মানুষ বেদীমূলে উঠছে, নামছে, বাদাম খেয়ে খোসা ফেলছে, আইসক্রিমের প্যাকেট ফেলছে - আর সবচেয়ে নিদারুণ - জুতো দিয়ে সব ফুল মাড়িয়ে একাকার করছে। কে যে কেন এখানে এসেছে, কিসের আশায় এসেছে, তা-ও বোধহয় কারো জানা নেই। সবাই এলোপাথাড়ি ঘুরছে, ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হলে চটপটি, ফুচকা বা আইসক্রিম খাচ্ছে।

মাথানত করে ফিরে এলাম...

৪.

বুয়েট শহীদ মিনারটা নিয়ে কিছু বলি। এর একদম সামনের সিঁড়ি গুলো ছাত্রদের নিয়মিত আড্ডার জায়গা। তবে মাঝেমাঝেই দেখতে পাই অনেক ছেলেমেয়ে সামনের সিঁড়ির গণ্ডি পেরিয়ে মূল বেদীতে জুতো-স্যান্ডেল নিয়ে উঠে পড়েছে। বড্ড কষ্ট হয় এমন দেখলে... নিজের কাছের মানুষদের হয় তো বলতে পারি এমনভাবে নিজের জাতিসত্তার অবমাননা না করতে, কিন্তু বাকিরা কবে বুঝবে?

প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদ মিনার সাজানো হয়, আশেপাশের পুরো এলাকাও সুন্দর ও শোভন করার চেষ্টা চলে। কিন্তু বাকি সারাটা বছর এর যে দুর্দশা তা এর কাছাকাছি থাকি বলেই নিয়মিত দেখতে পাই আর আত্মদহনে পুড়ি। এই স্মৃতিস্তম্ভগুলো যে শুধু ইট, বালু, সিমেন্টের স্থাপত্য নয়, বরং তারচেয়ে অনেক বেশী পবিত্র কিছু, অনেক শ্রদ্ধার কিছূ - এমন চেতনা এবারের একুশে সবার মনে জাগুক, এটাই কামনা।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

এসব দেখলে এখন প্রথম আলোর কথা মনে পড়ে- "আপনি শুরু করুন, বাকিরাও একদিন বদলাবে"।
আমি কিন্তু উল্টো চিত্রও দেখেছি - বুয়েটেই চাওয়ালা মামাকে দেখি সাধারণ সময়েও জুতা খুলে বেদীতে উঠতে।

---------------
আলোর ছটা
---------------

উপল মাহবুব এর ছবি

চা ওয়ালা মামার ব্যাপারটা খেয়াল করি নি তো!

তিথীডোর এর ছবি

আজ দুপুরে শহীদমিনারে গিয়েছিলাম, তুমুল প্রস্তুতি চলছে...
মনে পড়লো অসময়ে এক সন্ধ্যায় দেখা জীর্ণ শহীদবেদীর চিত্র!

একদিন বদলাবে সব, এই বিশ্বাসটুকুই তো সম্বল...

--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

উপল মাহবুব এর ছবি

একদিন বদলাবে সব, এই বিশ্বাসটুকুই তো সম্বল...

তিথীডোর এর ছবি

ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা! শ্রদ্ধা

--------------------------------------------------
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

হিমু এর ছবি

shahidminar

একটা আঁকিবুকি দিলাম শহীদ মিনারের। এমবেড কোডটা হচ্ছেঃ



বুকে BOOK রেখে বন্ধু চলো আজ যাবো বরাহশিকারে মোরা ধার ধার ধার দিও বল্লমে ♪♫

নাশতারান এর ছবি

খুব ভালো লাগলো এই আঁকিবুকি।

_____________________

আমরা মানুষ, তোমরা মানুষ
তফাত শুধু শিরদাঁড়ায়।

অতিথি লেখক এর ছবি

কয়েকদিন আগে আমার এক পরিচিত আপুকে বুয়েট দেখাতে বের হলাম। খুব ভাবের সাথে ক্যাম্পাস দেখাচ্ছি। কত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, কত গোছানো, এই সব। সব দেখেশুনে আপু একেবারে মুগ্ধ। মেইন গেইট দিয়ে বের হয়ে শহীদ মিনারের সামনে আসতেই তিনি অবকাঠামো দেখে আবারো মুগ্ধ। জিজ্ঞেস করায় বেশ গর্বের সাথে বললাম, এটা আমাদের শহীদ মিনার।
তিনি বিস্ময়মাখা চোখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "তোমাদের ছেলেরা শহীদ মিনারে জুতা পায়ে উঠে?"
আমি মাথা হেঁট করে চুপ করে হাঁটা শুরু করি। মন খারাপ

- মুক্ত বয়ান।

হাসিব এর ছবি

বুয়েটের ছেলেরাই শুধু শহীদ মিনারে জুতো পায়ে ওঠে না । তালিকা করতে শুরু করলে কেউই বাদ পড়বে না । অতএব "তোমাদের ছেলেরা" যে বলছেন তিনি নিজেদের সম্পর্কে ধারনা না নিয়েই বলেছেন ওকথা ।

একটা অফটপিক - কিছু প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির নিজস্ব ক্যাম্পাস হয়েছে বলে জানি । সেখানে কি শহীদ মিনারের কোন অস্তিত্ব আছে ?

উপল মাহবুব এর ছবি

তালিকা করতে শুরু করলে কেউই বাদ পড়বে না ।

দুঃখজনক হলেও কথাটা পুরোপুরি সত্যি মন খারাপ

এখন পর্যন্ত কোন প্রাইভেট ভার্সিটিতে শহীদ মিনার আমি অন্তত দেখি নি... তবে নিজেদের শহীদ মিনার থাকতেই হবে এমনটা কি খুব জরুরী? বরং শহীদ মিনারের প্রতি শ্রদ্ধাটুকু যেন থাকে তা নিশ্চিত করা দরকার বলে মনে করি...

হাসান মোরশেদ এর ছবি

নিজেদের শহীদ মিনার থাকতেই হবে এমনটা কি খুব জরুরী?

জরুরী না তবে এটা বোধগত বিষয়। মফস্বলের অনেক প্রাথমিক/মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে দেখবেন নিজেদের শহীদ মিনার আছে।
-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

অতিথি লেখক এর ছবি

নাহ, আমার তা মনে হয় না। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসে ছাত্রদের মাঝে সম্মান প্রদর্শনের বোধটা আসা উচিত। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় যেগুলোর নিজস্ব শহীদ মিনার আছে, সেটার পরিচর্যা, সম্মান রক্ষার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আর সাথে সাথে শিক্ষার্থীদেরও।

অ:ট: আমার জানামতে, নাই, বা থাকলেও শুনিনি।
কিন্তু, একটা ব্যাপার খুব বিচিত্র, এই ভাষার মাস বা বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবস, যেগুলো নিয়ে আমরা খুব গর্বিত, সেগুলোতে প্রচারের ব্যাপারে ঐ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই এগিয়ে। দেখবেন, তারাই কিন্তু, ব্যানার/ ফেস্টুন/ প্ল্যাকার্ড লাগায়, এখানে সেখানে লিফলেট বিলি করে। হোক সেটা ব্যবসায়িক বুদ্ধি, তাদের নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচারণা, তারপরও তো তারা সেটা করছে। কিন্তু, আমাদের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ ব্যাপারে গণসংযোগমূলক কোন প্রচারণাই নেই।
আরো মজার ব্যাপার হল, খোদ সরকারই এব্যাপারে নীরব। প্রতি অনুষ্ঠানে একটা করে বাণী দিয়েই দায় এড়ানো।

- মুক্ত বয়ান

হাসিব এর ছবি

সেগুলোতে প্রচারের ব্যাপারে ঐ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই এগিয়ে। দেখবেন, তারাই কিন্তু, ব্যানার/ ফেস্টুন/ প্ল্যাকার্ড লাগায়, এখানে সেখানে লিফলেট বিলি করে।

এইটা একটা নতুন আর ই-ন্টা-রে-স্টি-ং তথ্য ।

রাফি এর ছবি

http://www.banglarchokh.com.bd/thumb.php?CurPage=8&catid=1&catname=Daily%20Events&picid=4737&currpos=9

এইটা দেখে খারাপ লাগল।

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

---------------------------------------
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে;
সে কেন জলের মতন ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!

অতিথি লেখক এর ছবি

মওদুদের গায়ে ঐটা কী?? "মুজিব কোট" নিকি?? চোখ টিপি ;)

- মুক্ত বয়ান

হাসিব এর ছবি

হমম । সুশীল ভদ্রলোকেরা জুতো ছাড়া ওখানে যেতে পারেন না । আরো একটা ছবির কথা মনে পড়ে । সম্ভবত আওয়ামী লীগের নেতারা শহীদ মিনারে জুতো পরে ওঠা নিষেধ সাইনবোর্ডের পাশেই দিব্যি বসে আছেন কোন এক জনসভা করতে ।

অতিথি লেখক এর ছবি

small

কদিন আগেই একুশের উপর একটা ছোট সরল প্রতীক বানাতে গিয়ে এটা করেছিলাম। এটা আসলে বড় ভার্সন, আরো ছোটো মাপের প্রয়োজন পড়েছিল, তাই ভেতরে রেখাগুলো দিলে বোঝা যেত না। হিমুদার আঁকিবুকিটা দেখে এখানে দেওয়ার সাহস করলাম।

উইকিপিডিয়াতে যে ছবিটা আছে, যে অ্যাঙ্গেলটা সব ছবিতেই দেখা যায়, সেটা হল পাশ থেকে। একইরকম করতে চাইনি বলে সামনে থেকে করলাম। কখনও নিজের চোখে দেখা হয়নি, ভুল-ত্রুটি হলে মাপ করে দেবেন। উপরের ঝুঁকে আসা সরু অংশটা বোঝাতে গিয়ে সরু করলাম আর শেড দিলাম, তবু বোধহয় ভালো ফোটাতে পারলাম না। মুশকিল হল, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা কেউই দেখে প্রথমে ঠিক চিনতে পারল না...

P.S.: ছবিটার সাইজ বদলে অরিজিনাল সাইজে দিতে গেলে কি করব? ফরম্যাটিং গাইডবুক দেখে [img=172*107]...[img] দিতে গেলাম, কাজ করল না...

কৌস্তুভ

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

আমাদের শুভবুদ্ধি হোক।

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।