শীত শীত শীতের হাওয়া, তোর কি সাধ্য আমায় ছোঁয়া

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি
লিখেছেন পান্থ রহমান রেজা (তারিখ: সোম, ২০/১০/২০০৮ - ৭:৩৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ক্লায়েন্ট যে কী জিনিস ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। বিজ্ঞাপনে কাজ করতে এসে আমিও হাড়ে হাড়ে বুঝতেছি। আমাদের সচল বড়ো ভাই নজরুল ইসলামের এ বিষয়ে ব্যাপক অভিজ্ঞতা আছে। আপনারা জিজ্ঞেস করলেই তা জানতে পারবেন। সচলত্বের টানে সেদিন আমাদের অফিস পরিভ্রমণে এসে কিঞ্চিত জানিয়েছেন তা। তো যাই হোক, এজন্য আমরা ক্লায়েন্টদের ঘাটাই না। তাদের চাহিদামাফিক সব ডেলিভারি দিতে সচেষ্ট থাকি। তবে এবার একটু ফ্যাঁকড়া বাঁধালেন আমাদের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর আসিফ ভাই। ঘটনাটা একটু খুইলা কই এবার।

দেশে শীত আসে নভেম্বরের শেষের দিকে। আর আমাদের মিডিয়াকমে শীত আসে আগস্ট-সেপ্টেবরে। মানে মেরিলের উইন্টার প্রডাক্ট নিয়ে কর্মযজ্ঞ তখন শুরু হয়। আমরা গরমে ঘামি আর মনে মনে শীতের হাওয়ার কাঁপন অনুভব করি। ভাবতে ভালোই লাগে। আজকেও এমন একটা ঘটনা ঘটলো। মেরিল পেট্রোলিয়াম জেলির জন্য প্রেস অ্যাড তৈরি হয়েছে। ক্লায়েন্ট এসে বললো, এইটা তো পাবলিকে বুঝবো না। আসিফ ভাই বলেন, না বোঝার কিছু নাই। তবুও আমরা অফিসের অ্যাডমিন, ফাইন্যান্স আর অফিস পিয়নদের ডেকে এনে দেখাই। ওরা ঠিকই বুঝে। তারপরও ক্লায়েন্টর দাবি, না পাবলিকে বুঝবো না। পাবলিক বুঝে কি না বুঝে তার সরজমিনে পরখ করার দায়িত্ব পড়ে আমার আর মূর্তালার ওপর। সাথে ক্লায়েন্ট সার্ভিসের শাওন। আসিফ ভাই বলেন, পান্থ তুই আর মূর্তালা যা, ঢাকা শহর ঘুইরা আয়। জনে জনে জিগাবি, এই অ্যাড বোঝে কী’না। তয় যাওয়ার আগে একবার কনজ্যুমার প্রোফাইলে নজর বুলাইয়া যাস।

আমি, মূর্তালা আর শাওন রাস্তায় বের হই। বাইরে তখন গনগনে রোদ। ভাবি, এই গরমে শীতের শুষ্কতা নিয়ে কথা বলতে গেলে পাবলিকে যে কী কয়। তবে আমাদের ভাগ্য ভালো কেউই মারমুখী হয় নাই। একবিন্দু রাগ হয় নাই। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যে আসলে সহৃদয়বান তা আরেকবার দেখি। কড়া রোদে তারা সিটি বাসের জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়াইয়া আছে। জ্যামে স্থবির হয়ে বাস আসার লক্ষণ নাই, তবুও তারা হাসিমুখে আমাদের সাথে কথা বলেন। কেউ কেউ আগবাড়িয়ে আমাদের পরিচয় নেন। মেরিলের আগের বিজ্ঞাপন নিয়ে তাদের ভালো লাগা মন্দ লাগা জানান। দোকানদার হিসেবপত্র রেখে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেয়। মেরিলের পণ্য কেমন চলে তাও জানায়। বেকার যুবক সাইফুর’স-এর বইয়ের পাতা ভাঁজ করে আমাদের সাথে কথা বলে। কাজ শেষে উল্টা আমাদেরই চা খাওয়ার অফার করে। আবার আরেকজন নিজে থেকেই এসে প্রেস অ্যাডের ডামি কপি নিয়ে তার মতামত জানায়। তার কাছ থেকে আমাদের ক্রিয়েটিভিটির কিছু প্রশংসাও জোটে। সে আমাদের সার্টিফিকেটও দেয়, এই অ্যাড বাংলাদেশের সবাই বুঝবে।

তো যাই হোক, আসল প্রসঙ্গে আসি। আমাদের ক্লায়েন্ট যারা বলেছিল, পাবলিকে বুঝবো না। তারা যে আসলে পাবলিকরে অনেক সময় আন্ডারএস্টিমেট করে, আবারও তা হাড়ে হাড়ে টের পাই। তাদের মনগড়া অনেক তথ্যই পাবলিকের ওপর চাপিয়ে দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আমরা যাদেরই ইন্টারভিউ করি, সবাই একপলক দেখেই অ্যাডের মাজেজা বুঝে ফেলে। কয়েকজন সিএনজিওয়ালা, তারা পড়াশোনা জানেন না, কিন্তু ভিজুয়াল দেখেই তারা বলেন, এখানে শীতের শুষ্কতার কথা বলা হয়েছে। শীতে যে হাত শুকিয়ে খসখসে হয়ে যায়, তা ঝরাপাতার মাধ্যমে বুঝানো হয়েছে। আর তা থেকে রক্ষার জন্য মেরিল পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহার করা দরকার। আমরা সিএনজিওয়ালার কথা শুনি আর মনে মনে ক্লায়েন্টের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করি। কিন্তু আমাদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধারে ক্লায়েন্টের কী’বা আসে যায়। ক্লায়েন্ট তো ক্লায়েন্টই। দেবতাজ্ঞানেই তাদের পুজো করতে হয়।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

হুম............ বুঝছি বড় হইয়া ক্লায়েন্ট হওয়া লাগব পান্থ ভাইয়ের ক্লায়েন্ট ।
নিবিড়

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

নিবিড় আপনাকে ক্লায়েন্টভূবনে স্বাগতম। তয় তাড়াতাড়ি বড়ো হইয়া উঠেন।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

একবার এক বিজ্ঞাপন বানাবো। একটা জিঙ্গেল তৈরি করাইলাম বাপ্পাদারে দিয়া... ক্লায়েন্ট বললো এইটা স্লো... আরেক্টু ফাস্ট কিছু চায় তারা। এইবার বানাইলাম রিপন খানরে দিয়া... এইটা পছন্দ করলো। সেই জিঙ্গেলের উপরে দিয়া বিজ্ঞাপন বানাইলাম। ক্লায়েন্টরে দিলাম। তাগো খুব পছন্দ হইছে... সন্ধ্যায় ফাইনাল টেপ ডাউনলোড।

বিকালে সেই ক্লায়েন্ট ফোন করলো... নজরুল সাহেব... আপনার বিজ্ঞাপনটা একেবারে ঠিক আছে... কোনো সমস্যা নাই, কিন্তু এখন আমার অফিসের লোকজন বলছে যে আগের গানটাই নাকি ভালো ছিলো... আপনি এক কাজ করেন, এই ভিডিওর সাথে শুধু অডিওটা চেইঞ্জ করে দেন।
আমি বললাম এইটা তো সম্ভব না। কারন দুইটা জিঙ্গেলের মুড ভিন্ন... ঐ জিঙ্গেল দিলে নতুন কইরা শুট করতে হইবো।
কিন্তু সে কিছুতেই মানতে রাজী না... তার ধারণা অডিওটা পাল্টাইলেই হয়া যাবে... এখন তারে কেম্নে বুঝাই?
আমি আমার মতো একটা আর তার মতো একটা দুইটা ভার্সন তৈরি কইরা পরদিন হরতালের মধ্যে উত্তরা থেকে মতিঝিল তার অফিসে গেলাম। সে তার রুমে অফিসের পিয়ন দারোয়ান থেকে শুরু করে এক্সিকিউটিভ সবাইরে ডাইকা আনলো... দুইটাই দেখানো হইলো... সে সবার মতামত জানতে চাইলো... সবাই বললো আগের গানের সাথেরটাই নাকি ভালো... ক্লায়েন্টের দাবী হইতেছে এই যে এতগুলা লোক এরা তো আসলে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি... আমার তো মেজাজ খারাপ। তখন দিলাম একটা ভাষণ।
বললাম না এরা সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি না। এরা নিজেদের প্রোডাক্ট খারাপ হইলেও সাধারণ লোকেরে বোঝানোর চেষ্টা করে তারটাই সেরা। এরা প্রোডাক্ট বিক্রি করে আর সাধারণ পাব্লিক কিনে... আকাশ পাতাল ফাড়াক। আর সবচেয়ে বড় কথা এরা কেউ আসলে নিজের কথা বলতেছে না। এরা সিদ্ধান্ত জানানোর আগে আপনে কোন সিদ্ধান্ত পছন্দ করবেন সেইটা অনুমান করতেছে তারপর সেইটাই বলতেছে... কারন আপনে তাগো বস...

এই জ্বালাময়ী ভাষণে কাম হইলো... হঠকারী সিদ্ধান্ত বাতিল কইরা বিজ্ঞাপনটা অক্ষত থাকলো। যেইনা এইটা পাশ হইলো আমি লগে লগে দৌড়... আমার জন্য সে চিকেন বিরিয়ানি আনাইছিলো... ভদ্রতা কইরাও খাইলাম না... আবার যদি সিদ্ধান্ত পাল্টায়?

বিজ্ঞাপন বানাইন্যা কালে আমরা কাউরে সর্বোচ্চ গালি দিতে হইলে ক্লায়েন্ট বইলা গালি দিতাম। দেঁতো হাসি
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

বিজ্ঞাপন বানাইন্যা কালে আমরা কাউরে সর্বোচ্চ গালি দিতে হইলে ক্লায়েন্ট বইলা গালি দিতাম। দেঁতো হাসি

রানা মেহের এর ছবি

প্রিয় পান্থ
আপনি আজ ক্লায়েন্টদের যন্ত্রনা নিয়ে একটা লেখাটা
মজার। সন্দেহ নেই।

কিন্তু ক্লায়েন্টদের সেবাদানের পাশাপাশি
তাদের প্রাইভেসী এবং কনফিডেনশিয়ালিটি রক্ষাও
আপনাদের দ্বায়িত্ব, তাই নয় কি?

পরেরবার ক্লয়েন্টদের নাম প্রকাশ না করে
লেখার ব্যাপারটা একটু কি খেয়াল করবেন ?
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

রানা ভাই, ধন্যবাদ একটি দরকারী দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য। আমি লেখায় 'মেরিল'-এর নাম না নিলেও পারতাম। এটা আমার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। তবে ঘটনার তিক্ততার অনেককিছুই এড়িয়ে গেছি। আমি চাইলে প্রেস অ্যাডটাও জুড়ে দিতে পারতাম লেখার সাথে। কিছুটা কনফিডেনশিয়ালিটি রক্ষার জন্যই তা এড়িয়ে গেছি। তবে ভবিষ্যতে এসব ব্যাপারে খেয়াল রাখবো।

ভূঁতের বাচ্চা এর ছবি

রেজা ভাইয়ার লেখাটা পড়ে মজা পেলাম, নজরুল ভাইয়েরটাও সবসময়ের মতন মজা হইছে। ক্লায়েন্টের মন রক্ষা করে কাজ করা খুব কঠিল আসলেই।

--------------------------------------------------------

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

ক্লায়েন্টের মন যে কী জিনিস, ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

প্রেমিকাদের মনের চেয়েও জটিল... হো হো হো
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

যাক, আপডেটেড হইলাম। থ্যাংকস, পান্থ।
হ্যাঁ, রানা ভাইয়ের কথা ঠিক। হাসি চলো আমরা আরো একটু কনফিডেন্সিয়াল হই/থাকি চোখ টিপি
তবে, লেখা ভালো হইসে, কোনো সন্দেহ নাই।
নজরুল ভাই, আপনার ওইটার মতো "এ গানের মুণ্ডু তখন বসবে অন্য গানের ঘাড়ে" টাইপ অভিজ্ঞতা আমাদেরও নেহাত কম না। ভালো লাগলো আপনারও ওই হামদার্দী। হাসি
একটা কারেকশন- আমরা যে না ঘাঁটিয়ে ক্লায়েন্টের সব ক্লায়েন্টামি মেনে নিই, তা কিন্তু ঠিক না, পান্থ।
আর, একটা সমর্থনও- ক্লায়েন্ট ঠিক মানুষ না, ক্লায়েন্ট-ই। হাসি
(তবে, আমাদেরকেও কিন্তু অনেকে মানুষ মনে করে না, সেইটা জানো তো? আমাদেরকেও ওরা মনে মনে কিংবা আড়ালে আবডালে গালিই দেয় 'ক্রিয়েটিভ' ব'লে। হাসি

_ সাইফুল আকবর খান

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

আমরা যারা বিজ্ঞাপন বানাই... তাদের কাছে কিন্তু বিজ্ঞাপন এজেন্সীও ক্লায়েন্ট... হো হো হো
আমি কিন্তু আপনারে গালি দেই নাই... চোখ টিপি
আমি তো এই জ্বালায় এখন বিজ্ঞাপন বানানোই ছাড়ানি দিছি...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

অতিথি লেখক এর ছবি

গালি দিতেও পারেন নজরুল ভাই, যদি ইচ্ছা হয়। হাসি
যারা বানায়, তাদের সাথেও আমাদেরও কিছু ক্লায়েন্টামি করতে হয়, অস্বীকার করার উপায় নাই। তবে জানবেন সবাই, সেইটারও বেশির ভাগই করতে হয় ওই আমাদের ক্লায়েন্ট-এর দাবিদাওয়া আর গোঁড়ামির জন্যই।
বিজ্ঞাপন ছাড়ানি দিয়া যে নাটকের হলুদ বৃষ্টি ঝরাইতে নামসেন, এইটা নিশ্চয়ই ভালো হইসে বস্। চোখ টিপি

_ সাইফুল আকবর খান

আহমেদুর রশীদ এর ছবি

আমারে আইসা পান নাই তো কি হইসে....এই এড আমিও বুঝছি।তয় স্যাম্পলটা পাওনা থাকলো।

---------------------------------------------------------

আমরা যারা শিখিনি চাষবাস,ফসলের গীত
গুলালিতে পাখি হত্যা

---------------------------------------------------------

ঘাস তুমি ঘাসের মতো থাকো মাটি ছুঁয়ে
যে দেখার সে নতজানু হয়ে ছুঁবে তোমার আঙুল
অবরুদ্ধ মাঠ থেকে তুমি লাফিয়ে নেমোনা প্লিজ পাথরের পথে
________________________________________
http://ahmedurrashid.

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

টুটুল দা' আপনাকে অ্যাড দেখাইতে যাই নাই। শাহবাগের গেছিলাম, তাই ভাবলাম চামে আপনার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে যাই। আর মূর্তালাও চাইছিল আপনার সাথে কথা বলতে। কিন্তু গিয়া তো আপনারে পাইলাম না। আপনে মিয়া গুলশানের সওদাগরি অফিসে নাকি হাওয়া খাইতে গেছেন।

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

অ্যাড'টা দেখি, তারপর বুঝতে পারব, আসলেই বুঝলাম কী না। হাসি

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

হ, দেইখ্যা মন্তব্য কইরেন। আর দেখতে চাইলে চোখ রাখুন দৈনিক পত্রিকার পাতায়, বিভিন্ন চ্যানেলে। টিভি বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল ব্লগের শিরোনামে দেখুন।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

পার্ফেক্ট ব্লগিং।

অফটপিকেঃ আসিফ ভাই কি আসিফ ইকবাল? (অধুনা গীতিকার?)

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

থ্যাঙ্কু দাদা।
এই আসিফ ভাই হচ্ছেন, আসিফ আকবর খান। বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন জগতের ক্রিয়েটিভ গুরু। আর এজেন্সিওয়ালাদের কাছে সবসময়ের নমস্য।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।