একটি লেখার পুনর্পাঠ শেষে

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি
লিখেছেন পান্থ রহমান রেজা (তারিখ: রবি, ৩১/০৭/২০১১ - ১০:৫২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ম্যালাদিন আগের কথা। সেটা সম্ভবত ১৯৯৮ সাল। কলেজে পড়ি। আমাদের বাড়ির পাশে একটা পাঠাগার ছিল। সেখানে ভোরের কাগজ পত্রিকা রাখতো। বিকেলে সেটা পড়তাম। সেই পত্রিকায়, শুক্রবারের সাহিত্য সাময়িকীতে একটা লেখা এলো একদিন। লেখার শিরোনাম: পোয়েমিক্স_ কী, কেন, কীভাবে: একটি অসম্পূর্ণ খশড়া। লেখক তুষার দাশ। লেখাটি আমাকে অভিভূত করে। আমার মাথার ভিতরে গেঁথে যায়। এই এতকাল পরেও, প্রায় তের বছর পর আমি সেই প্রথম পড়ার কথা, মুগ্ধ হওয়ার মুহূর্তটি এই এখনও দিব্যি স্মরণ করতে পারি।

এক বইমেলায়, সাবের ভাইয়ের (সাহিত্যিক মঈনুল আহসান সাবের) সাথে গল্প করছি। তারই প্রকাশনী দিব্য প্রকাশের (না কি বিদ্যাপ্রকাশ!) সামনে। এমন সময় তুষার দাশ আসেন। ততদিনে পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি দেখে তুষার দাশকে মুখচেনা হয়ে গেছে। পোয়েমিক্স পড়ার সেই মুগ্ধতার কথা তাকে জানাই। বলতে দ্বিধা নেই, তাকে জানাতে পেরে আমার খুব ভালো লাগে। সে রাতেও আমি ভোরের কাগজে পড়া লেখাটির কথা ভাবি। ততদিনে অবশ্য লেখাটির আদ্যপ্রান্ত অতটা আর মনে নেই। শুধু মুগ্ধতার মুহূর্তটুকু মনে পড়ে।

লেখক, সাংবাদিক আহসান কবিরের একটা বই আছে। নাম- ভালোবাসা মরে যায়, মুগ্ধতা মরে না। তুষার দাশের লেখাটির প্রতি মুগ্ধতা হঠাৎ-ই পড়ে গেল, লেখাটি পূনর্পাঠ করে। পুনর্পাঠ নিয়েই এখন একটু বলবো।

গেল বৃহস্পতিবার, সপ্তাহান্তের ছুটি শুরুর রাতে, একটা ফুর্তি পার্টি ছিল। পার্টির আয়োজক শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেল। তার বাসাতেই পার্টি। সেই সুরাসমেত আড্ডায়, সোহেল ভাইয়ের স্টুডিও রুমের শেলফ হাতড়ে পেয়ে যাই তুষার দাশকে। ‘সেইসব মুখশ্রীর আলো ও আমার জীবনানন্দ’ বইটি মূলত কবি তুষার দাশের বিভিন্ন সময়ের লেখা গদ্যের সংকলন। দেখি মুগ্ধতা জাগানিয়া লেখাটি মলাটবন্দি হয়ে আছে। পড়তে শুরু করি। পড়তে পড়তে টের পাই, আমার সেই মুগ্ধতা আস্তে আস্তে উধাও হচ্ছে। আমি একটু কেঁপে উঠি, ভ্যাবাচ্যাকা খাই। কারণ, লেখাটি আমার মাথার ভেতরে তের বছর ধরে আছে। তখন তাহলে লেখাটিতে কী এমন পেয়েছিলাম যে আমি মুগ্ধতা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিলাম এতকাল!

এই যে তুষার দাশের পোয়েমিক্স_ কী, কেন, কীভাবে: একটি অসম্পূর্ণ খশড়া এখন আমার ভালো লাগছে না, এই ব্যর্থতার দায়ভার কার? পাঠক হিসেবে আমার? না কি তের বছর ধরে আমার ভিতরে ঘটে যাওয়া পরিবর্তন? পাঠকদের সবিনয়ে একটা তথ্য জানিয়ে রাখতে চাই, তের বছর আগে তুষার দাশ বিজ্ঞাপন জগতের সাথে কবিতার যে মিলমিশ দিতে চেয়েছিলেন, সেই বিজ্ঞাপন-ই আজ আমার রুটি-রুজির উৎস। এ বিষয়ে একটু জানাশোনা হয়েছে। কাজ করতে করতে একটু একটু স্পষ্ট হচ্ছে এর অলিগলি। তাই, এতদিনে এসে মনে হয়েছে, লেখাটি খুবই সাধারণ গোছের। মার্কেটিং মিক্স-এর সাথে কবিতার মিক্স কীভাবে হচ্ছে, তার কোনোই স্পষ্ট ছবি দেখতে পাই না লেখাটি পড়া শেষে। কবিদের ক্ষেত্রে ব্র্যান্ডিংয়ের যে কথাটি হাজির করছেন, সেটাও খুলে বলেননি। কবিতার ব্র্যান্ড বিল্ডিং কীভাবে হচ্ছে, সেটার কোনো উদাহরণ নেই। কোনো পণ্যের ব্র্যান্ড এক্সটেনশন যেভাবে একটা অ্যাসোসিয়েশন নিয়ে এগোয়, একজন কবির ক্ষেত্রে গল্প বা প্রবন্ধ লিখে কি সেভাবে এক্সটেনশন সম্ভব? কিংবা শুদ্ধতম কবি বা নির্জনতার কবি’র এক্সটেনশন কীভাবে গল্পে বা প্রবন্ধে টেনে নেয়া সম্ভব! তুষার দাশ এইসব নিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন, সেটা আমার কাছে ঠিক যুতসই মনে হয় না এখন আর! আর লেখাটি বিজ্ঞাপন আর কবিতার মিলমিশ নিয়ে হলেও সিংহভাগ জুড়ে থেকেছে বিজ্ঞাপনের অবয়ব।

তুষার দাশের লেখাটির মতো আরো অনেক লেখকের লেখার মুগ্ধতা মাথায় করে বয়ে বেড়াচ্ছি, যেগুলো হয়তো পড়েছি অনেক আগে। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ’কী নিয়ে, কাকে নিয়ে লিখবো’ লেখাটি। লেখাটি কোনো এক ছোটকাগজে পড়েছিলাম। কাগজটির নাম সম্ভবত ব্যাস। সম্পাদক ছিলেন রবিউল করিম। মুক্তকণ্ঠের শুক্রবারের সাময়িকী খোলাজানালায় পড়েছিলাম, আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘কালের কবিতা, কালান্তরের কবিতা’ লেখাটি। এই লেখাটির প্রতি মুগ্ধতা এখনো আছে। একই কাগজে পড়েছিলাম কমল মমিনের নিত্যদিনের রবীন্দ্রনাথ লেখাটি। দেশ পত্রিকার কোনো এক পুজাবার্ষিকী সংখ্যায় জয় গোস্বামীর ‘হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ’ লেখাটির কথা মনে হলে এখনো বুক হাহাকার করে ওঠে। জানি না, এইসব লেখা আবার নতুন করে পড়লে সেই মুগ্ধতার স্বাদ পাবো কি না! পুনর্পাঠে প্রথম পাঠের অনুভূতি আবার দোলা দেবে কি না!


মন্তব্য

অর্ক রায় চৌধুরী এর ছবি

চলুক

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

ধন্যবাদ!

দিহান এর ছবি

'পাঠকের মৃত্যু' গল্পটা পড়েছেন নিশ্চয়ই?!

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

বনফুলের তো অনেক গল্প পড়েছি। কিন্তু এই মুহূর্তে ‌পাঠকের মৃত্যু' গল্পটার কথা মনে করতে পারছি না। শেলফ হাতড়ে বনফুলকে আবার খুঁজে বের করতে হবে!

আশালতা এর ছবি

আমরা আমাদের বোধের ভিত থেকে এই লেখাগুলো পড়ি বলেই বোধ হয় বোধের পরিবর্তনের সাথে ভালো লাগা না লাগাটুকু নির্ভর করে।

----------------
স্বপ্ন হোক শক্তি

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

বোধের পরিবর্তন কি না জানি না!
তবে, জীবনানন্দ দাশের আট বছর আগের একদিন কবিতাটি আমার কাছে সবসময়-ই ভালো লাগবে!
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ!

মন_মাঝি এর ছবি

আপনার তুষার দাশের লেখার প্রথম-পাঠ ও পুনর্পাঠ করে যে অনুভূতি হয়েছে, আমার সুনীল-সমরেশ-শীর্ষেন্দুর লেখা পুনর্পাঠ করে একই অনুভূতি হয় ! সুনীল-সমরেশ-শীর্ষেন্দু একসময় গোগ্রাসে গিলতাম, অথচ এখন একদম হাল্কা, জোলো, ভাবভঙ্গি আর ভনিতা-সর্বস্ব লাগে। পড়িই না আর। সময় নষ্ট।

অন্যদিকে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, মানিক, বিভূতি, এবং আরো অনেকে...বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রায় একই রকম আছেন।

আবার হুমায়ুন আহমেদ - পাঠ, পুনর্পাঠ, পুনর্নো-পাঠ, সবসময় একই রকম লেগেছে - ভুয়া ! হাসি

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

আহা! সুনীল, সমরেশ, শীর্ষেন্দু কতদিন পড়ি না।
তবে, হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্প, অতিপ্রাকৃত গল্প কিন্তু আমার এখনও ভালো লাগে!

sumima yasmin এর ছবি

এমনও হয়েছে, কোনো লেখা প্রথমবার পড়ে কিছুই হয় নি, পুনর্পাঠে নতুন উপলব্ধি...!

সুমিমা ইয়াসমিন

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

খুব সত্যি কথা সুমীপু!

তানিম এহসান এর ছবি

পুণরায় পড়ার পর কিছু লেখা মনে হয়েছে আগে ঠিকমত পড়িনি। আমার বারবার পড়ার অভ্যেস আছে। আপনার মত প্রশ্নও জেগেছে কিছু লেখা পড়ে। ভালো থাকবেন।

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

এরকম হয়! আপনিও ভালো থাকবেন।

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

সচল খুলেই চমক। আপনার লেখা একেবারে প্রথমে। এতোদিন পরে লিখলেন, না চমকানোই অন্যায়। তবে খুব ভালোও লাগলো। মাঝে মাঝে নিশ্চয়ই লিখবেন এবার হাসি

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

হ! লিখতে তো চাই-ই চাই! হয়ে উঠছে না এই যা! এইবেলা আর নিয়মিত হওয়ার মিছে প্রতিশ্রুতির কিরা আর না কাটি!

রানা মেহের এর ছবি

লেখাটা অসম্পুর্ন মনে হলো।
ব্যস্ততা?

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

রানাপা, এইটা লেখা না ধরে একটা চটজলদি কমেন্ট বলতে পারেন! তাহলেই বাঁচোয়া!

রণদীপম বসু এর ছবি

পান্থ, এবার আমার মনে করতে হবে কবে কখন এরকম অনুভূতি হয়েছিলো আমার। হতে পারে যেগুলো একবারে বুঝে ওঠতে পারি নি, সেগুলোরই পুনর্পাঠ হয়েছে ! ছোট্ট জীবনে সময়ই তো কেপ্পনের হাড্ডি !!

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

বইখাতা এর ছবি

এইজন্যেই আমি খুব পছন্দের কিছু লেখা আর পড়িনা!

নূর এর ছবি

আপনি যখন প্রথম পড়েন , তখন একটা লেখা পড়ছিলেন, এবার কিন্তু আপনি এক ধরনের প্রত্যাশা নিয়ে পড়ছেন, অন্যভাবে বললে লেখাটার পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। আর সময় তো মনের উপরে তার পায়ের ছাপ রেখে যাবেই, সাথে যুক্ত হয়েছে আপনার এই বিষয়ে আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। সব মিলিয়েই লেখাটি আপনার ব্যক্তিগত কালত্তীর্ন তালিকায় স্থান পায়নি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।