নিউ ইয়র্ক টাইমসে রবীন্দ্রনাথ :: নোবেল থেকে মরণ

পলাশ দত্ত এর ছবি
লিখেছেন পলাশ দত্ত (তারিখ: শনি, ১৯/০৯/২০০৯ - ২:৪১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


১৯৪১ সালের আট আগস্ট রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে দুটি লেখা ছাপা হয়েছিলো নিউ ইয়র্ক টাইমসে। একটি হলো খবর যে রবীন্দ্রনাথ মারা গেছেন। অন্যটি সম্পাদকীয়।

খবরটার শিরোনাম ধীমান পাঠকের জন্য আগ্রহোদ্দীপক : TAGORE DIES AT 80; NOTED INDIAN POET. ১৯৪১-এ এসে রবীন্দ্রনাথকে আর হিন্দু কবি বলা হচ্ছে না। তবে তাকে কবিও বলা হচ্ছে না কিন্তু। পত্রিকাটির ভাষায় তিনি ‘উল্লেখযোগ্য ভারতীয় কবি’। এবং শিরোনামটি লক্ষ্য করলে দেখা যায় কবি রবীন্দ্রনাথ মারা যাননি; মারা গেছেন রবীন্দ্রনাথ নামে এক ভদ্রলোক যিনি ভারতের উল্লেখযোগ্য কবি। খবরে এও জানানো হচ্ছে যে বাংলায় তিনি এক বিশাল জমিদারির মালিক।

‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ শিরোনামের সম্পাদকীয়টিতে তার খ্যাতির পতনের কথা উল্লেখ করে এর কারণ খোঁজার একটা চেষ্টা আছে। এতে বলা হয় : ‘৮০ বছর বয়সে মারা যাওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খ্যাতি কৌতূহলোউদ্দীপকভাবে তার জীবদ্দশাতেই বিবর্ণ হয়ে যায়। বছর ত্রিশেক আগে স্যার উইলিয়াম রোদেনস্টেনি ও ডব্লিউ বি ইয়েটস ঠাকুরের লেখার একটি সংস্করণ প্রকাশ করেন নজর কাড়ার মতো একটি প্রতিকৃতিসহ। তার খ্যাতির জোয়ারে সুবিদাটা কে নিয়েছিলেন, তিনি নাকি তার প্রকাশক?
খুব দ্রুত তার বই বেরিয়েছিলো একের পর এক। নোবেল পুরস্কার তাকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে যায়। ... ভঙ্গি এবং চিত্রকল্পের একঘেঁয়েমি, অধিবিদ্যা (মেটাফিজিক্স) ও অতিন্দ্রীতার (মিস্টিসিজম) চাপ, অতিরিক্ত গীতিকবিতা, নাটক, উপন্যাস, এবং যতো রকম লেখা সম্ভব সমস্ত রকমের বই প্রকাশÑ এসব কারণেই কী তার খ্যাতি ক্ষয়ে যায়?
যেকোনো হিসেবেই তার সূর্যালোক বদলে গিয়েছিলো চন্দ্রালোকে। হতে পারে এটা ফ্যাশনের একটা অবিচার, কিন্তু অনুবাদগুলি, যা সাধারণত তিনি নিজেই করতেন, স্মরণ করলে মনে হয় না যে, ভঙ্গি বা উদ্দীপনার ক্ষেত্রে ওগুলির ঘাটতি ছিলো? এই হলো সংকলনগুলির শেষ পরিণতি। ঠাকুরের অগণিত বই থেকে যৌক্তিকভাবে কিছু বাছাই করা হলে তা হয়তো কিছুটা ভূমিকা রাখতে পারে তার খ্যাতি পুনরুদ্ধারে।’

এই অভিযোগ মেশানো মন্তব্য করছে যে পত্রিকা সেই তো নোবেল পাওয়ার এক বছর পর রবীন্দ্রনাথকে ঠেলে দিয়েছিলো আধ্যাত্মবাদের জগতে। যে-জগতে মানুষের চেয়ে কবিতার চেয়ে অপার্থিব এক অস্তিত্বই বড়ো; যে-অস্তিত্ব মানুষকে পৃথিবীতে ধরে রাখে। ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৫তে প্রকাশ হলো রবীন্দ্রনাথের করা কবীরের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ, একই সময়ে বেরুলো তার নিজের The king of Dark Chamber. এই দুই বইয়ের আলোচনায় টাইমসের আলোচক জানিয়ে দেন যে রবীন্দ্রনাথ ‘মিস্টিক’ কবীরের পথসারী হলেও তিনি তার অনুকারক নন। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ একজন বড়ো মাপের কবি বটে, তবে তিনি ‘মিমিস্টক’ কবি। এবং ওই আলোচনার সমাপ্তি টানা হচ্ছে খোদ খ্রিস্টান ধর্মের ধর্মপুসতক বাইবেলে সঙ্গে ওই দুজনকে আধ্যাত্মবাদের সম-উপযোগিতায় ফেলে! : “The likeness between the doctrines of the two Indian seers andn that of the Gospels is very striking. Kabir’s Lord and Tagore’s King of the Dark Chamber are equally the unknown God to whom the ancient Athenians raised an alter; the same when the Gospel according to St. Jhn names as the Spirit of Truth.Whom the world cannot receive, because it seeth Him not, nether Knoweth Him; but ye know Him : for He dwelleth with you, and should in you.”

তখন পৃথিবীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। এই বিধ্বস্ত অবস্থায় পার্থিব পৃথিবীর দুর্দশা থেকে পালাতে তথাকথিত আধ্যাত্মবাদই ভালো। কিন্তু ঈশ্বরের আস্থায় যে-আধাধ্যাত্মবাদ সে তো মেনে নিতে পারে না পশ্চি, পশ্চিমের মানুষ্ তাই তারই কাছাকছি কোনো মানুষকে যদি আধ্যাত্মবাদের আলখাল্লা পরিয়ে নিয়ে নিজেদের পালনোর পথটা তৈরি করা যায় সেই তো ভালো। তাই রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠতে লাগলেন, আমেরিকার কাছে, মিস্টিসিজমের পোক্ত ধ্বাজ্জাধারী; সাথে রইলো কবীরের জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ।


অবশ্য এ জন্য শুধু পত্রিকাটিকে দোষ দেয়াও হয়তো ভুল হবে। কেননা এক্ষেত্রে ১৯১৫ সালে ইংল্যান্ড ও আমেরিকা থেকে বেরুনো রবীন্দ্রনাথের দুটি ইংরেজি ভূমিকাও কম নয়। একটি লিখছেন আর্নেস্ট রিস, অন্যটি লিখছেন বসন্ত কুমার রায়। তখন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ইংরেজিভাষীদের জানার ওই পথ ছিলো ওই জীবনী দুটিই। দুটি জীবনী মিলিয়ে একটি আলোচনা ছাপা হয় নিউ ইয়র্ক টাইমসে। সেই আলোচনায় বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে রবীন্দ্রনাথের জীবনদর্শন সম্পর্কে পাঠকদের জানান আলোচক। সেই আলোচনায় কবি রবীন্দ্রনাথের কোনো হদিশ নেই। যদিও তিনি নোবেল পুরস্কারটি পেয়েছিলেন তার কবিতার জন্য।

যাকে নিয়ে জীবনী সেই লোকটি জীবন্ত আমেরিকায় এলেন পরের বছর। তার সাক্ষাৎকার ছাপা হলো নিউ ইয়র্ক টাইমসে। জীবনী দুটিতে যেখানে তাকে কবি পরিচয় অতিক্রম করে চিন্তাদিব দার্শনিক, সমাজ-সংস্কারক ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা (এবং সেখানেই রবীখ্যাতির পতনের বীজ বপন) সাক্ষাৎকারে ঠিক তা নয়। এতে কবির সঙ্গেই কথা বলছেন সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী। সাক্ষাৎকারের মূল উদ্দেশ্য ছিলো সমাজের সঙ্গে কবির কী সম্পর্ক সে বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা রবীন্দ্রনাথেরই মুখ থেকে শোনা।

সেই সাক্ষাৎকারে তার কাছে জানতে চাওয়া হচ্ছে যে কবির কি লেখালেখি করে জীবিকা অর্জনের চেষ্টা করা উচিত, নাকি অন্য কোনো উপায়ে নির্ভর করবেন তিনি? উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‍"নিজেদের কাজকে সত্যি করতে হলে কবি ও শিল্পীদের বিপুল অবসর প্রয়োজন। ফলে নিজেদের কাজের বাইরে জীবিকার জন্য যেকোনো ধরনের সংযুক্তি তাদের জন্য বিধ্বংসী। অন্যদিকে জনগণের কৃপার ওপর নির্ভর করতে যাওয়াটাও, যারা কিনা কখনোই শিল্পের নতুন ধরনের সৃষ্টির সেরা সমঝদার নয়, এক মারাত্মক ধরনের অপকর্ম। তবে দুটোর মধ্যে দ্বিতীয়টাই তুলনামূলক কম খারাপ।" এখানেই তিনি কথা প্রসঙ্গে পশ্চিম ও পুবের কবিদের ভাবগত মিল বিষয়ে বলছেন। বলছেন ওয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতা আমেরিকান হয়েও তো পুবের ধারণা ও অনুভূতিকে ধারণ করে। পার্সি বিসি শেলি ও ওয়ার্ডসওয়র্থের কবিতাও তো স্পিরিটের দিক দিয়ে পুবেরই ঘরানার।

এ সাক্ষাৎকারেই পশ্চিমে মুক্তগদ্যে কবিতাচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু সবশেষে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী পাঠককের মনে করিয়ে দেন যে ইয়েটস ও তার মতো আরো কিছু লোক কবি রবীন্দ্রনাথকে মহান একজন মিস্টিক ও বিরাট এক অধ্যাত্মবাদী গুরু বলে মনে করেন!


এরপর এলো ১৯১৮ সাল। সে বছর রবীন্দ্রনাথকে খবর ছাপা হলো নিউ ইয়র্ক টাইমস ও শিকাগো ট্রিবিউনে। তবে তার সঙ্গে সাহিত্যের কোনো যোগ নেই। আন্তঃরাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রে রবীন্দ্রনাথের লিপ্ত থাকা নিয়ে খবর বেরুলো। ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখে ছাপা হলো সেই খবর। খবরে জানানো হলো ব্রিটিশ ভারতে বিদ্রোহ সংগঠনে জার্মানির উস্কানি আর তাতে জাপান ঘুরিয়ে রবীন্দ্রনাথের যুক্ত থাকার কথা। খবরটি কোনো পত্রিকার নিজের বানানো নয়; স্বয়ং আমেরিকার সরকার বিষয়টি সাধারণের গোচরে আনার জন্য প্রকাশ করেছে! দুটি পত্রিকাই এই কথা দিয়েই খবরটি শুরু করেছে।

প্রতিবেদনটিতে বলা হচ্ছে : “সরকারের প্রকাশ করা নথিতে দেখা যাচ্ছে স্যার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যিনি কিনা ব্রিটিশ নাইট এবং কবিতার জন্য নোবেল পুরস্কারজয়ী, ভারতে স্বাধীন একটা সরকার প্রতিষ্টায় কাউন্ট ওকুমা এবং তেরাউচির আগ্রহে সমর্থন দিয়েছেন। তবে যে-চিঠিপত্র উদ্ধার করা হয়েছে সেগুলো ওকমা এবং তেরাউচির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকের যোগাযোগ সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করে না।” চিঠি থেকে উদ্ধৃতিও দেয়া হচ্ছে : “স্যার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের পরামর্শের সঙ্গে একমত হয়েছেন। তিনি বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাউন্ট ওকুমা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কাউন্ড তেরাউচি এর পক্ষে। স্যার রবীন্দ্রনাথও জাপানের অনুল্লেখযোগ্য কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছেন।”

রবীন্দ্রনাথকে এই আসামী বানিয়ে ছাপানো খবরের পর খবরটির আর কোনো ফলোআপ ছাপেনি নিউ ইয়র্ক টাইমস।

(চলতে পারে)

স্বত্ব :: পলাশ দত্ত


মন্তব্য

রাগিব এর ছবি

সম্ভবত গোলাম মুরশিদের লেখায় ১৯১৮ এর দিকে রবীন্দ্রনাথের ব্যর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের কথা পড়েছিলাম। সেবার রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছা ছিলো শান্তিনিকেতনের জন্য মার্কিন উচ্চবিত্ত সমাজসেবীদের কাছ থেকে টাকা তোলা। কিন্তু হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্রের সাথে তার সংশ্লিষ্টতার কথাটা প্রচার হয়ে যাওয়াতে আর সাড়া পাননি, তাই ব্যর্থ হয়ে ফেরত এসেছিলেন।

---

রবীন্দ্রনাথের প্রথম ধাপের মার্কিন সফর কিন্তু অনেক বর্ণাঢ্য ছিলো। তখনো তিনি নোবেল পাননি। তাঁর ছেলে রথী আর রথীর বন্ধু (পরে রবীন্দ্রনাথের মেয়ের জামাই) আমার এই ভুট্টাক্ষেত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিলো, স্থানীয় এক দার্শনিক সংগঠনের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ আসেন এখানে। রবীন্দ্রনাথ যে বাড়িটিতে ছিলেন, আমার বাসা থেকে অল্প দূরেই সেটি।

আপনার এই সিরিজ পড়ে উৎসাহ পেলাম, এই বিষয়ে একটা কিছু লিখবো সামনে।

----------------
গণক মিস্তিরি
ভুট্টা ক্ষেত, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | কুহুকুহু

----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম

পলাশ দত্ত এর ছবি

লিখুন না শিগগির। ওই ষড়যন্ত্রের খবরের কিছুদিন পরই এর প্রতিবাদ করেছিলেন ইলিনয়স ইউনির এক শিক্ষক যার বাড়িতে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
সেটা ছবি আকারে জুড়ে দিলাম।
ছাপা হইছিলো ইলিনয়স ইউনির দৈনিক পত্রিকা ডেইলি ইলিনি-তে।

আপনার লেখাটা লিখুন। আর ওই বাড়িটার একটা ছবি তুলে দিন না। ভালো লাগবে।

==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু

==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু

রণদীপম বসু এর ছবি

চলতে পারে নয়, চলবে। এবং চলুক....

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

এনকিদু এর ছবি

ভালই চলছে, চলুক । আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকলাম ।


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...


অনেক দূরে যাব
যেখানে আকাশ লাল, মাটিটা ধূসর নীল ...

নিবিড় এর ছবি

পড়ছি চলুক


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

পলাশ দত্ত এর ছবি

চলার সমূহ সম্ভাবনা আছে।

==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু

==========================
পৃথিবীর তাবৎ গ্রাম আজ বসন্তের মতো ক্ষীণায়ু

নিবিড় এর ছবি

সমূহ বলছেন কেন পলাশদা বলুন সম্ভব হাসি


মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড় ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।