গল্প ছোট, কিন্তু দু:খ নয়

শব্দ পথিক এর ছবি
লিখেছেন শব্দ পথিক [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৭/১১/২০১৩ - ১০:৫৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

দেশ সবেমাত্র স্বাধীন হয়েছে, চারদিকে দাঙ্গা তখনও থামেনি। এইতো সেদিন একটা ট্রেন কলকাতা যাবার পথে পুড়িয়ে দেয়া হলো কুষ্টিয়াতে। সবাই বললো এটা মুসলিম লীগের ছেলেপেলেদের কাজ, কিন্তু এটাতো মানুষেরই কাজ। এরই মাঝে একদিন ঘটা করে পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হলো। পুরো ভারতবর্ষে তখন স্বাধীনতা উল্লাসে মত্ত, দাঙ্গার দিকে ফিরে তাকানোর সময় সরকারের কোথায়? রাষ্ট্রের মানুষ চাই না, জমি চাই। তাইতো প্রতিটি সীমান্তে, প্রতিটি কোণে যখন মানুষের হাতে মানুষ মারা পড়ছে তখনও রাষ্ট্র ব্যস্ত কাশ্মীর কে পাবে সেটা নিয়ে। কাশ্মীরের মানুষ কী চায় সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের মান-সন্মান, ইজ্জত। মাস্টারমশাই ক্লাসে একদিন বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রের কাছে রক্তের মূল্য নেই, কিন্তু ইজ্জত অমূল্য।‘

ব্রিটিশ ফৌজে সেপাই এর কাজ করা লোকের কাঁধেও তখন তারকা খচিত পদবি জ্বলজ্বল করছে, কিছু লোক রাতারাতি বিশাল রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছেন, কেউবা ব্যাংক লোন নিয়ে কারখানা শুরু করার ফন্দিতে আছেন। সব ব্যস্ত মানুষের কোলাহলে একটা ছোট মফস্বলে কি হচ্ছে তার খবর কে রাখে? কোন এক হিন্দুর জমি দখল হয়ে গেলো, তার বউ-মেয়েকে হুমকি দিয়ে শাসানো হলো, ছেলেটাকে রাস্তায় একটু পিটিয়ে দেয়া হলো। ব্যাস, মালাউন ব্যাটা আর কদ্দিন টিকবে, তাকে জমি-জিরাত, ভিটে-পুকুর ছেড়ে যেতেই হবে। সমস্ত দেশ থেকে হিন্দু তাড়ানোর ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করেছে মুসলিম লীগের ছেলেরা, মহাকবি ইকবালের পেয়ারা পাকিস্তানে আর যাই হোক বংশদন্ডের চামড়া না ফেলানো নাপাক হিন্দুদেরতো রাখা যাবেনা। চলে যখন যাবেই, তখন ব্যাটাদের বউ-মেয়েদের দিকে নজর দেয়াই যায়। হিন্দুর মেয়েরা বেশ সুন্দর, এমন বাড়ন্ত বুকের মেয়ে বোধ হয় ঈশ্বরের এই দুনিয়ায় আর নেই।

বউ-মেয়ের সম্ভ্রম বাঁচাতেই হোক কিংবা শান্তিতে একটু ঘুমের জন্যই হোক দেশ থেকে পঙ্গপালের মতো মানুষ দেশান্তরী হচ্ছে। নিজ ভূমি-মা হারিয়ে সবাই রিফিউজি হয়ে যাওয়াটাকেই নিয়তি বলে মেনে নিয়েছে। এপার থেকে যাচ্ছে, ওপার থেকেও আসছে তেমনি। অনুপাতে কম-বেশি হতে পারে কিন্তু মানুষের নির্মমতায় কমবেশি নেই।

এটা নিয়ে একদিন প্রশ্ন করেছিলাম ক্লাসে। মাস্টারমশাই বললেন, 'দেশ স্বাধীন করতে গেলে অনেক মূল্য দিতে হয়, বিনামূল্যে স্বাধীনতা অর্জন হয়না। তোমরা কী বুঝতে পারছো বাবারা, স্বাধীন হতে হলে, গর্বিত হতে গেলে রক্ত দিতে হয়, অশ্রু দিতে হয়, এরপরই না মিলবে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা' -মাস্টারমশাই আবেগে কাতর হয়ে ছিলেন, ঘন্টা পড়ে যাওয়ায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলেন। শুধু কী দীর্ঘশ্বাস, আমরা যারা সামনে ছিলাম তারা স্পষ্ট দেখছিলাম মাস্টারমশাইয়ের চোখের কোণের জল।

একবার বলেছিলাম, 'মাস্টারমশাই সবাই যাচ্ছে, আপনি কী যাবেন না?'
একথা শুনে মাস্টারমশাই বললেন, 'সবাই গেলে আমার এই দেশটাকে কে দেখবে বল? আর এই টাঙ্গনের জলে স্নান না করলে আমিতো সুস্থ থাকবো নারে'

মাস্টারমশাইয়ের পরিবারের প্রায় সবাই চলে গেল। বড় ছেলেটা প্রেসিডেন্সিতে পড়তো, ছোট দুটি মেয়ে আর বউ নিয়ে তিনি থেকে গিয়েছিলেন টাঙ্গনের তীরে, যে নদীর পানিতে ভেসে গেছে তার মায়ের ভস্ম। তখন বুঝিনি, তার অনেকদিন পর বুঝেছিলাম মাস্টারমশাইয়ের মতো অনেকেই ছিলেন বলে আমরা একটা জাতি হতে পেরেছিলাম, নিজেদের চিনতে শিখেছিলাম।

আমার বন্ধু নরেন খুব মেধাবী ছাত্র ছিলো, মুখে মুখেই পাটি গণিতের সমাধান দিতো সে। পরিবারের সাথে সেও একদিন চলে গেলো জলপাইগুড়ি। যাবার আগে সে দেখা করতে এসেছিলো সে, হাসিমুখেই বিদায় নিলো-যখন সে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছিলো তখন তার হাঁটায় যে অসম্মতি ছিলো, না যাবার তীব্র আকাংখা ছিলো সেটা বোধ হয় কখনো ঈশ্বরের নজরে আসেনি।

পাশের গ্রামের ফুটবল প্লেয়ার রমেশ দাও পরিবার-আত্মীয়ের সাথে হুগলিতে চলে গেলেন। মাস কয়েক পর একদিন তিনি আবার একা ফিরেও আসলেন, জিজ্ঞেস করলাম, দাদা ফিরলেন যে? দাদা বললেন, পায়ে ঘা নিয়ে হাসপাতালে গেসিলাম একদিন। ডাক্তার এসে দেখছিলোনা, এটা নিয়ে একটু উত্তেজিত হতেই রিফিউজি বলা হলো। নিজ দেশ ছেড়ে রিফিউজি হয়ে থাকতে ভালো লাগেনারে, তাই চলে আসলাম। রমেশ দা এক দূর সম্পর্কের পিসির বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করলেন, এরপর পরিণত বয়সে তিনি দেশটাকে বদলে দেয়ার জন্য, মানুষগুলোকে নিজেদের পরিচয় চেনাতে কি না করেছেন।

তখন মনে হতো, কিছু কিছু মানুষের কোন দেশ নেই। তারা বড্ড দুর্ভাগা, কোথাও তাদের জায়গা নেই। ঈশ্বর থাকেন ওই দূর আকাশে, এই দোআঁশ মাটির গ্রামে-গঞ্জে তার গতিবিধি সীমিত।

সেই ১৯৪৭ এ শুরু হয়েছিল, এখনো চলছে দেশ ত্যাগ। আমরা কিছু মানুষ নিজেদের ইনসানিয়াত দেখাতে প্রতিনিয়ত দেশত্যাগে বাধ্য করছি আমাদের প্রতিবেশিকে, বন্ধুকে, একসময়ের সহপাঠীকে, ব্যবসায়িক পার্টনারকে। ১৯৪৮ এর মুসলিম লীগ আর নেই, কিন্তু আমরা রয়ে গেছি। সময় পরিবর্তন হয়, রক্ত না। রক্ত বদলাতে হলে শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন, ডিগ্রী অর্জন করে রক্ত বদলে না। স্বাধীন দেশে আমরা এখনো প্রতিদিন গর্বিত হচ্ছি প্রিয় ভাইটিকে ভিটেছাড়া করে রিফিউজি বানিয়ে।

--------------------------------------
শব্দ পথিক
নভেম্বর ৭, ২০১৩


মন্তব্য

 মেঘলা মানুষ এর ছবি

দুঃখ আসলেই ছোট নয়।
অন‌্য ধর্মের প্রতি আক্রোষের বিষে বিষাক্ত হয়েছে আমাদের মানবিকতা।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য, অন্য ধর্মের প্রতি আক্রোশতো আমাদের সবার যথেষ্ঠই আছে। মানুষের প্রতি ভালবাসাও কমে আসছে দিনদিন।

শব্দ পথিক
নভেম্বর ৮, ২০১৩

Joltorongo এর ছবি

চলুক মন খারাপ

এক লহমা এর ছবি

"কিছু কিছু মানুষের কোন দেশ নেই। তারা বড্ড দুর্ভাগা, কোথাও তাদের জায়গা নেই।"
যথার্থ।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

গান্ধর্বী এর ছবি

নির্মম বাস্তবতা।

অতিথি লেখক এর ছবি

মুখে যাই বলি যেখানে যে ধর্মের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ তারাই সংখ্যায় নগন্যদের দমিয়ে রাখে, অধিকার বঞ্চিত করে রাখে। এটা শুধু হিন্দু-মুসলমান করে যে তা নয়। সব ধর্মেই করে, অহিংসের বাণী প্রচার কারী বৌদ্ধ ধর্মের অহিংসের নমুনা আমরা দেখেছি মায়ানমারে। মানব ইতিহাসের বড় বড় যুদ্ধগুলো সেই ধর্মকে নিয়ে, নিজের ধর্মকে প্রতিষ্ঠার জন্যে। কোন ধর্মই তলোয়ার আর রক্ত ছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি কোন দেশে। ধর্মই মানব ইতিহাসকে যুগে যুগে রক্তাত্ত করেছে পৃথিবীর মানচিত্রের নানান বাঁকে। নানা দেশের মানুষের নানা ভাষা, নানান সংস্কৃতি কিন্তু সব ধর্মেরি রুপ আর ভাষা সব দেশে এক।

ভুল তত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে ভাগ হয়েছিলো ভারত-পাকিস্তান। ধর্ম দিয়ে দেশ ভাগের নজির বোধহয় আর একটিও নেই পৃথিবীর মানচিত্রে। তুমি হিন্দু আর আমি মুসলমান, আমরা একে অপরের শত্রু এমন করে বিভাজনের যে রেখা টেনে দেওয়া হয়েছিলো ১৯৪৭ এ, আজো ডিএনএর মতো আমরা বয়ে চলছি তা। তার দৃষ্টান্ত যারা সংখ্যায় নিতান্তই কম তাদেরকে ভিটেছাড়া করা, ঘর বাড়িতে আগুন দেওয়া। কয়জন-ই বা পারে সেই ডিএনএকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মতো পরিবর্তন করে নতুন বৈশিষ্ট্যের আনায়ন করতে?

মাসুদ সজীব

অতিথি লেখক এর ছবি

ভারত-পাকিস্তান ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়েছিলো, আমরা পাকিস্তান থেকে ভাগ হয়ে বাংলাদেশ হয়েছি ভাষা-সংস্কৃতির জন্য। এরপরও প্রতি বছর লাখো মানুষ দেশ ছাড়ছে।

ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার একটা ভূমিকা তাতে অবশ্যই আছে, এর পাশাপাশি বিবেকবোধের অভাবও যথেষ্ঠ। জানিনা কি হবে সামনে, একদিন হয়তো বাংলাদেশ শতভাগ মুসলিমের গর্বিত (!) দেশ হয়ে যাবে।

শব্দ পথিক
নভেম্বর ৮, ২০১৩

ঈমান নূর এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

-এস এম নিয়াজ মাওলা

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

কঠোর নির্মম বাস্তবতা!!

ছেলেবেলায় কখনো বুঝিনি হিন্দু মুসলমানের পার্থক্য হতে পারে। দুই ধর্মের লোকজনের মেলামেশায়ও কোন বাধা দেখিনি। তাই কিশোর বয়সে এক সহপাঠী যখন আমার বন্ধু হিন্দু বলে তার সাথে খেলবে না বলে মত জানাল, তখন তার সাথে হাতাহাতি করতে দ্বিধা করিনি। খেলবে না বলে নয়, এমন "অসভ্য" মত প্রকাশের জন্য।

অথচ বড় হয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখতে পেলাম দেশের একটা বিশাল অংশ সেই সহপাঠীর মতে একমত! মাঝে মাঝে মনে হয় সেই সহপাঠী যেন দূরে দাঁড়িয়ে ব্যঙ্গের হাসি হাসছে আর আমার বন্ধুটি বেদনাহত মুখে দাঁড়িয়ে আছে মাথা নত করে!!

এইতো সেদিন আমার ছেলেকে তার ক্লাসের একজন বলেছে কালো পিঁপড়াগুলো মুসলমান তাই তারা কামড়ায়না, লাল পিঁপড়াগুলো হিন্দু তাই তারা কামড় দেয়!!! ছেলে যখন এসে আমাকে বললো, আমি শুধু জিজ্ঞেস করলাম লাল পিঁপড়াগুলো হিন্দু মানুষদেরকেও কামড়ায় কিনা জিজ্ঞেস করতে! বাচ্চা ছেলেদেরকে যদি এই রকম জিনিস শেখানো হয় তবে ভবিষ‌্যত কী?

ইদানীং মনে হয় শুধু ভিনধর্মেই না, ভিন মানুষেই আমাদের আক্রোশ চলে আসছে। নাহলে এভাবে অহরহ পুড়িয়ে, পিটিয়ে, কুপিয়ে মানুষ মারা হচ্ছে কেন যত্রতত্র?

____________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার কেনো জানি মনে হয় ধর্ম নিয়ে বিভেদ সৃষ্টি করে, ধর্মের আনুষ্ঠানিক প্রেক্টিস সবচেয়ে বড় অধর্মের কাজটি করা হচ্ছে। আমাদের দেশের আনাচেকানাচে এখনো প্রতিদিন লুন্ঠিত হচ্ছে মানবতা, এর বড় একটা কারণ ধর্মীয় বিদ্বেষ।

শব্দ পথিক
নভেম্বর ১১, ২০১৩

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটা এখন শিলিগুড়িতে সংসার পেতেছে। ফ্ল্যাট কিনেছে, বউ আর সে দুজনেই ভালো চাকুরী করে, মেয়েটি স্কুলে যায়, বন্ধুটিকে তাঁর কাজের সুবাদে নিয়মিত দূরদর্শনেও দেখা যায়। আপাতদৃষ্টিতে সুখের কোলাহল তাঁর জীবনে।
কিন্তু, তাঁর সঙ্গে যখন ফোনে কথা বলি বা ফেসবুকে চ্যাট করি, দীর্ঘশ্বাসটুকু টের পাই তাঁর।
তাঁর অব্যক্ত প্রশ্নগুলো যখন টের পাই, অন্য প্রসঙ্গে চলে যাই আমি।
আমি মনে মনে তাঁর কাছে ক্ষমা চাই। আমার কিছুই বলার নেই, আমার কিছুই করার নেই।
আমি এবং আমরাই যে তাঁর এই চলে যাওয়ার জন্য দায়ী!

ভালো থাকবেন শব্দ পথিক।
শুভেচ্ছা নিরন্তর।

-------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ

অতিথি লেখক এর ছবি

আমরাই তো দায়ী। আমরা শতভাগ মুসলিমের দেশ হতে উঠে পড়ে লেগেছি।

শব্দ পথিক
নভেম্বর ১৩, ২০১৩

অতিথি লেখক এর ছবি

বেশিরভাগ মুসলিম দেশই শতভাগ মুসলিমের দেশ কেন, ইসলামের মত একটি নবীন ধর্ম আসার আগে সে দেশে কী ধর্ম ছিল, সেই ধর্মের মানুষগুলি একেবারে সব কোথায় গেল, কেন গেল, এ জাতীয় প্রশ্ন কেন মানুষের মাথায় আসেনা? হাসি

ওয়াইফাই ক্যানসার

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।