পথের গল্প ১

রাসেল এর ছবি
লিখেছেন রাসেল (তারিখ: শুক্র, ১৫/০২/২০০৮ - ৮:২৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

চলতি পথেই নানা রকম মানুষের সাথে পরিচয় হয়ে যায়- ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে গল্প ছড়িয়ে থাকে আর সে গল্পের শ্রোতা থাকে না কেউ- শহরের মানুষেরা বধির- অন্ধ আর ভীষণ রকম আত্মকেন্দ্রীক - নিজের বানানো জগতের ভেতরে ঢুকে বসে আছে- আর এর সাথে আমাদের সমাজের কণ্ঠস্বর মানুষেরাও বিভিন্ন সংগঠনের রাজনৈতিক পকেটে ঢুকে বসে আছে-

নানা রকম ব্যবসার চিন্তা ঘুরে তাদের মাথায়- ঢাকা শহরের সৈন্দর্য বর্ধনের তাগিদ থাকে- চলতি পথে দেয়াল লিখন দেখি- সিটি কর্পোরেশন বলছে আমাদের শহরকে সুন্দর করে সাজানোর দায়িত্বে আপনারাও আমাদের অংশীদার-

আমিও দায়িত্ব নিতে চাই- শহরের গলিতে আবর্জনা- ময়লা ফেলার গাড়ী আসে না - প্রধান সড়কের উপরে ডাস্টবীন ময়লায় উপচে পড়ে আর আমাদের সিটি কর্পোরেশনের গাড়ী ঠিক ৭টায় রওনা দেয়- শহরের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছাতে পৌছাতে শহরের অফিসগামী মানুষের ভীড়- তাদের উপরে অত্যাচার হলেও এটা আমাদের সৈন্দর্য বর্ধন প্রক্রিয়ার অংশ-

স্থান- সেরাটনের উল্টো পাশের রাস্তা- সাকুরার নীচেই কাঁথা বিছিয়ে ৩ জন- ঘুমাচ্ছে ,ট্রাক থেমে আছে- আড়মোড়া ভাঙছে মেয়েটি- কুৎসিত সন্তানের দিকে মোহগ্রস্ত চোখে তাকিয়ে আছে- কালো বাচ্চার চোখের কোনে পিচুটি জমে আছে- ঠোঁটের পাশে সাদা কষ- এরপরও মায়ের চোখে সন্তানের মায়ার কাজল মাখা- মায়ের পাশে পড়ে আছে শাল- ইদানিং ঢাকা শহরের সকালে ঠান্ড পড়ে- ফাল্গুনের বাতাসে উড়ুউড়ু মন নেই- রমনার সামনের রাস্তায় কনডম পড়ে আছে- এক মেয়ের মুখে লেগে আছে গতরাতের মেকাপের অবশিষ্ঠাংশ- ভয় লাগে- দিনের আলোতে তার বসে যাওয়া গালের নীচে সস্তা মেকাপের পুরু দাগ বুঝা যায়- সামনে আগাতে থাকি- প্রধান উপদেষ্টার নিবাস- সাম্প্রতিক সময়ে তার ক্ষমতার শেষ নেই- দিবানিশি তিনি জপ করছেন সাধারণ নির্বাচন সাধারণ নির্বাচন- প্রধান উপদেষ্টা বিদেশে গেলেন- দাতা দেশগুলোর সামনে প্রতিশ্রতি দিলেন- আগামী ডিসেম্বরের ভেতরেই নির্বাচন হবে-
প্রধান উপদেষ্টা রংপুরে- বর্ধিত এবং স্থানান্তরিত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক। মঙ্গার হোগা মেরে সাফ করে দিবেন তিনি- আর ডিসেম্বরে নির্বাচন হবেই- সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হবে- জুনের ভেতরেই শুরু হবে নির্বাচনের মৌসুম-

ভোটার তালিকার ৬০ শতাংশ কাজ বাকি- এরপরে বিবিধ অভিযোগ আর অনুযোগের নিরসন- জরুরি অবস্থা বাতিল- তবে ডিসেম্বরে নির্বাচন হবেই- বদরুদ্দোজা বলেছেন আমাদের প্রয়োজন জাতীয় সরকার- আমাদের জাতীয় সরকারের কোনো ভিত্তি নেই-

আমাদের নির্বাচন কমিশন- আমাদের বিশিষ্ট ভদ্রজনেরা সবাই নির্বাচনকে সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ এবং গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের পথ- আমাদের গনতন্ত্র গিলিয়ে খাওয়ানো হবে- আমরা গণতন্ত্র খাবো- গণতন্ত্র দেখবো স্বপ্নে আমাদের বিষ্ঠা আর লালায় সিক্ত হবে গণতন্ত্র- আমি আশায় আশায় থাকি-

মতিঝিল কলোনীর পাশেই রাস্তার উপরে ৫০টি পরিবাসের বাস- তাদের হাঁড়ি আর উনুনের তেজে রাস্তার সৈন্দর্য কমে যাচ্ছে- তবে বস্তি উচ্ছেদ চলছে- মহাখালী আর তেজগাঁও- নাখালপাড়া আর গুলশান- বস্তিনিধন কর্মসূচি চলছে- তবে এই যে পরিবারগুলো এরা কোথায় যাবে? কিংবা গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষেরা যাদের কোনো সম্পদ নেই- আহারের জোগান নেই- যারা ঢাকায় টাকার ধান্দায় এসেছে- তাদের আবাস নেই- আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের বাড়তি বিছানায় মফস্বলের মানুষ আসে- তাদের চাকুরি দরকার- উমোদরির জন্যও ঢাকায় আসতে হয়- ইদানিং তেলেও কাজ হচ্ছে না- বংশলতিক ঝুলিয়েও পার পাওয়া যাচ্ছে না- আর সারা রাত শেষ হওয়ার পরে ফজর থেকে ধর্ষিত হচ্ছে কান- হুমম- বিশাল পরিসরে ওরশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে- মমোজাহেদ ভাইয়েরা আপনাদের ঘরের স্ত্রী কন্যা কে নিয়ে আসবেন- মাওলানা বয়ান দিবেন-
ফজর থেকেই এলাকার কাকেরা লুকিয়েছে- কাকেরাও বিরক্ত তবে এখনও মানুষ বিরক্ত নয়- রাত ১টার পরে ভোর ৫টায় এই অমানবিক ধর্ষণ শেষে আমার রাস্তায় নামতে হয়- রাস্তায় পরিচয় হয় জনাব শরাফতের সাথে- ভদ্রলোকের বয়েস হবে আনুমানিক ৫০- কিংবা এর কমও হতে পারে- দারিদ্রের সাইনবোর্ড ঝুলে থাকে তাই প্রকৃত বয়েসের অনেক বেশী মনে হতে পারে তাকে-

ভাই এভাবে চালালেই হবে নাকি আরও জোড়ে চালাবো - আমার কোনোটাতেই আপত্তি নেই- তাড়া নেই- ছুটির দিনে শহরের দমবন্ধ জ্যাম নেই- একটু পরে উপস্থিত হলেও তেমন ক্ষতি নেই-

বাবা একটু বাড়িয়ে দিয়েন-

একটু কঠোর চোখে তাকাই- এই বুইড়া রিকশাওয়ালারা ভাড়া নিয়ে ত্যাঁডরামি করে-

সামনে তাকিয়ে থাকি ভবলেশহীন- মনে মনে ফন্দি করি কিভাবে না দিয়ে থাকা যায়- বাবা হাঁফানির টান আসে- একটু থামাই-
ঠিকাছে চাচামিয়া- সামনে সিগারেটের দোকানে থামান
বেনসন ধরিয়ে আসতে রিকশায় চড়ি- কোনো কথা বাড়ানো যাবে না- কথা বাড়ালেই একটা ফান্দে পড়া অবস্থা হতে পারে-

বাবা আমার মেয়েটার ক্যান্সার- ডাক্তার দেখাইতে পারি না- বাসায় যা জমি ছিলো সবই বেঁচে দিছি- এর পরে আর সঙ্গতি নাই- ডাক্তার বলছে মারা যাবে আর কয়েক মাসের ভেতরেই- এই বয়েসে শহরে আইসা রিকশা চালাই- মেয়েরে নিয়া আসছিলাম ডাক্তার দেখাবো- দেখানোর উপায় নাই- টাকা নাই- মেয়ে মারা যাবেই- এখন প্রতিদিন যা পারি কিনে নিয়ে যাই- মারা যাওয়ার আগে ভালোমন্দ খেয়ে মারা যাউক-

আমি চুপচাপ বসে থাকি- প্রচন্ড অসহায়ত্বে মানুষ তীব্র প্রতিবাদী কিংবা ইশ্বরাভিমুখী হয়ে যায়- কেউ কেউ নিয়তিবাদি হয়ে অপেক্ষা করে কখন সেই চুড়ান্ত ক্ষণ আসবে-

আমরা শহরের উঁচু দালানে বসি- নিয়মিত পেপারে লিখি এর জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসুন- তাকে বাঁচান- প্রাণ বাঁচানোর আকুতি থাকেই- মনে হয় মানবতার সাথেই থাকতেভবে- এভাবেই মানুষ হয়ে মানুষের জীবন বাঁচানোর লড়াই মানবিকতা-

পথ ফুরাচ্ছে- আমারও গন্তব্যে নামতে হবে-
সিগারেট শেষ- ছুড়ে ফেলে নেমে যাই- রিকশাওয়ালা হাঁফাতে থাকে- বেশ অনেকটা পথই আসলো- আমি পকেটে হাত ভরে রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দেই- কিছুক্ষণ ভাবি আদতে বাড়িয়ে দিবো নাকি ভাড়াটা-

মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকতেও ভালো লাগে- তবে সারাক্ষণ সংশয় কাজ করে- শালার শহর ঠগে ভরে গেছে- কে কোন গল্প ফেঁদে বোকা বানিয়ে ফেলে বলা যায় না-

ইদানিং সকল সাহায্যের আবেদনেই এমন সংশয় থাকে-
না দেওয়া উচিত হবে না-

আমি শহরের পথে বুক ফুলিয়ে হাঁটি- শালার গরীবের সাথে বেশী কথা বলাই ঠিক না- এই শালাদের সাথে দহরম মহরম মানেই পয়সা গচ্ছা


মন্তব্য

সুমন চৌধুরী এর ছবি

ঠিক।
বেশী কথা না বলাই ভালো। ফাংশনাল হতে হবে।



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

রাসেল এর ছবি

হুমম চেপে যেতে হবে সযতনে- মানবিকতার মায়েরে বাপ-

------------------------------------

আমি তো গণে নেই বিচ্ছিন্ন একা
সঙ্ঘে সমুহে নেই সঙ্ঘমিতা।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

একটানে পড়ার মতো লেখনী।
চলুক

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

চমৎকার লেখা।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

রাসেল এর ছবি

জুবায়ের ভাই লজ্জা দেন কেনো-

------------------------------------

আমি তো গণে নেই বিচ্ছিন্ন একা
সঙ্ঘে সমুহে নেই সঙ্ঘমিতা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।