ভিনগ্রহের পাণ্ডুলিপি- শেষ পর্ব

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ২৫/০৫/২০১২ - ৪:০৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

৯ এপ্রিল
আজ আমি উথলীর নিজ বাড়িতে বসে ডায়েরি লিখছি। গত দু'দিন যে ঝড় আমার ওপর দিয়ে গেছে- বেঁচে ফিরতে পেরেছি এটাই আমার জন্য বড় পাওয়া।
পরশুদিন সন্ধ্যায় আব্বাসের হাতে চিঠিটা গুঁজে সোনালি বক্সটা খুলে প্রোফেসর শঙ্কুর পাঠানো নতুন পাণ্ডুলিপিটা মেলে আরেকবার পড়তে শুরু করলাম। অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া গেল তাতে। তথ্যগুলো নিজেকে ও পৃথিবীকে C-A-S গ্রুপের হাত থেকে রক্ষা করতে কাজে আসবে। আমার নিজের মাথা থেকেও একটা বুদ্ধি বেরোলো।
কাজ শেষ হতে রাত এগারোটা বেজে গেল। ভাবছি, আজ আর বোধহয় C-A-S গ্রুপ হামলা চালাবে না। এখন একটু ঘুমিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু আমাকে আর কষ্ট করে ঘুম পাড়ানি মাসিপিসিকে ডাকতে হলো না। কোত্থেকে মিষ্টি একটা গন্ধ এসে আঘাত করল আমার নাসারন্ধ্রে। বড়ই মুগ্ধোকর সে সুবাস- কেমন যেন নেশা ধরানো, নেশা ধরানো একটা অনুভূতি আমাকে পেয়ে বসল। মনে হলো, এই মূহের্তে আমার চেয়ে সুখি বুঝি পৃথিবীতে আর কেউ নেই। গোটা দুনিয়ার রাজা-মহারাজা ভাবতে শুরু করলাম নিজেকে। আস্তে আস্তে দু'চোখের পাতা বুজে এলো।
চোখ মেলে দেখি, আমার শিয়রে বসে আছে আমার নিখোঁজ বন্ধু আফজাল! ধুড়মুড় করে উঠে বসে বসলাম। প্রথমে বুঝতে পারিনি কোথায় আছি, কেন আফজাল আমার আমার পাশে বসে আছে? পরে আস্তে আস্তে সব ঘটনা মনে পড়ল। বাকিটা আফজাল আমাকে বুঝিয়ে দিল। আমিও ওকে এই ক'দিনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা সবিস্তারে জানালাম।
আমরা আসলে সুন্দরবনের কোনো এক জঙ্গল বাড়িতে বন্দি। এটাই C-A-S গ্রুপের অস্থায়ী কার্য্যালয়। সকাল এগারোটার দিকে চারজন গুণ্ডা এসে আমাদের চোখ বেঁধে কোথায় যেন তুলে নিয়ে গেল। চোখ খোলার পর দেখি, বিশাল এক সবুজ প্রান্তরে আমরা দাঁড়িয়ে। উলু আর দূর্বা ঘাসে ছেয়ে আছে প্রান্তরভূমি। বহু দূরে রাজপ্রাসাদের মতো মস্ত একটা বাড়ি। আরো দূরে আবছাভাবে নজরে পড়ল একটা পাঁচিল- এই প্রান্তর ভূমিসহ সেই রাজপ্রাসাদতূল্য বাড়িটাকে ঘিরে রেখেছে পাঁচিলটা। আমাদের কানের লতিতে পিস্তল ঠেকিয়ে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে দুজন গুণ্ডা। তারা আমাদের সামনে এগোনোর নির্দেশ দিল। আমরা টুঁ শব্দটিও না করে তাদেরকে অনুসরণ করলাম।
রাজপ্রাসাদতূল্য বাড়িটার সামনে বিমানন্দরের মতো একটা রানওয়ে রয়েছে। রানওয়ের মাঝখানে আকাশছোঁয়া একটা টাওয়ার- ডিশ এন্টেনার মতো নানা রকম যন্ত্রপাতি টাঙানো রয়েছে সেই টাওয়ারে; সেই সাথে টাঙানো আছে মস্ত বড় একটা আয়না। কিন্তু টাওয়ারের মাথায় অতবড় একটা আয়না কেন ঝুলছে; বুঝতে পারলাম না। গুণ্ডারা আমাদেরকে টাওয়ারের লোহার বিমের সাথে বেঁধে ফেলল। ওদের একজন সুইচ টিপে বাজিয়ে দিল টাওয়ারের সিগন্যাল এলার্ম। সাইরেণের মতো বিকট আওয়াজ তুলে কান ঝালাপালা করে দিল এলার্মটা।
ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে খুলে গেল রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িটার মূল ফটক। তিনজন লোক বেরিয়ে এলো সেই বাড়ি থেকে। সেইসাথে এলো একজন পিঁপড়ে মানব।
তিন বিদেশি আর পিঁপড়ে মানব সামনে এগিয়ে এসে দাঁড়াল আমাদের নিঃশ্বাস দূরে । বিদেশি তিনজনের বয়স প্রায় কাছাকাছি- পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। এদের একজন লম্বা, রোগা-পাতলা, মাথায় চুল নেই বললেই চলে। একজন বেশ কেতাদুরস্ত সাস্থ্যের অধিকারী, মাথার চুলের রং প্রায় লাল। আরেকজন স্বাভবিক সাস্থের, মাথায় শিখ টুপি- এ নির্ঘাত লখিন্দার সিং। এই তিনজনই যে C-A-S গ্রুপের তিন পাণ্ডা তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর ঐ পিঁপড়ে মানবটা কে? ক্যালাপেগাস?
পাগড়ি পরা লোকটা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, 'স্যরি, মি. জামিল, আসলে আপনাকে এভাবে বেঁধে রাখাটা মোটেও উচিত হয়নি। কিন্তু কী করব বলুন, আপনি যে সাংঘাতিক লোক! মিরর ইমেজিং ইনজেকশন পুশ করেও আপনাকে প্রতিবিম্ব মানবে বদলে ফেলতে পারিনি! তবে আপনিই বলুন এখন আপনাকে বেঁধে না রাখাটা রিস্ক হয়ে যায় কিনা।'
তার কথার কোন জবাব দিলাম না। ভাবছি, গতরাতে বুদ্ধি করে নিজের শরীরেও ইনর্ভাস মিরর ইমেজিং ইনজেকশন পুশ না করলে আমিও এতক্ষণে C-A-S গ্রুপের গিনিপিগে পরিণত হয়ে 'জি হুজুর, জি হুজুর' শুরু করে দিতাম!
'আসুন সবার সাথে পরিচয় করে করিয়ে দিই-' রোগা-পটকা লোকটাকে দেখিয়ে লখিন্দার সিং বলল, 'ইনি চার্লস এভারটন।'
তারপর কেতাদুরস্ত লোকটাকে দেখিয়ে বলল, 'ইনি হেনরিখ ক্লিন্সম্যান।'
'আর ইনি-' পিঁপড়ে মানবটাকে দেখিয়ে বলল লখিন্দার সিং, 'টাফার মহামান্য সম্রাট ক্যালাপেগাস!'
আমি বললাম, 'মহামান্য না কচু; মহামান্য হতে হলে মহনুভব হতে হয়, অন্যের ক্ষতি করে নয়।'
আমার কথা শুনে রেগে ফুঁসতে লাগল ক্যালাপেগাস। এই পিঁপড়ে মানবটাও দেখি মানুষের ভাষাও বোঝে!
এভারটন মুখ খুলল, 'জানো কাদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছো?'
'জানি,' অবজ্ঞার সুরে বললাম আমি। 'তিন ছিঁচকে পোচার আর এক ভিনগ্রহের কুৎসিত জানোয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছি।'
'বেয়াদব, দাঁড়াও তোমার দর্প আমি এখনি চূর্ণ করে দিচ্ছি-' বলে ক্লিন্সম্যান খপ করে কোমরে হাত দিয়ে হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে আমার দিকে তাক করে ধরল। ক্যালাপ্যাগাসের চোখ রাগে ইটের ভাটার মতো জ্বলছে। এভারটনের হাতে উঠে এসেছে আমার তৈরি শঙ্কুর এনাইহিলিন গান।
আমার বন্ধু আফজালের চোখেমুখে ভীতির রেখা ফুটে উঠল। লখিন্দার সিং তিনজনকেই বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিবৃত্ত করল। আফজাল ফিসফিস করে বলল, 'একটু রয়ে সয়ে কথা বল্ না। কী দরকার বাঘের খাঁচায় বন্দি হয়ে তার সাথে লড়তে যাওয়া।'
লখিন্দার সিং আমার দিকে ফিরে বলল, 'মি. জামিল, তোমার সাথে অত তর্ক করার সময় আমাদের নেই। তোমার বাঁচার রাস্তা একটাই। শঙ্কুর পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধারের সূত্রটা আমাদের দিয়ে দাও।'
'ও, তাহলে তোমরা পাণ্ডুলিপিটাও হাতে পেয়ে গেছো,' যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব করে বললাম।
'দুটোই পেয়েছি-' বলল লখিন্দার সিং।
'দুটো মানে, আমার বাড়িতেও হানা দিয়েছো নাকি?' এবার অবাক হয়ে পারলাম না। সোনালি বক্সে পাঠানো পাণ্ডুলিপিটা সরিয়ে ফেলার আগেই আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আফজাল আমাকে যেটা পাঠিয়েছিল, সেটা এমন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিলাম, আমি ছাড়া অন্য কারো পক্ষে খুঁজে পাওয়ার কথা নয়!
'শুধু তাই নয় তোমার চাকর আর প্রিয় কুত্তা এখন আমাদের হাতে...' বলে খ্যাক শিয়ালের মতো বত্রিশ পাটি দাঁত কেলিয়ে খ্যাক খ্যাক করে হাসতে লাগল ক্লিন্সম্যান।
'কী বলছো এসব!' এবার সত্যিই আমার বুকটা কেঁপে উঠল। 'তোমাদের বোঝাপড়া আমাদের সাথে, জগমোহন আর ভীমকে এর মধ্যে টেনেছো কেন?'
'কারণ আমরা জানি, সোজা আঙ্গুলে ঘি তুলতে দেয়ার লোক তুমি নও।' আমার কথার রেশ ধরে বলল এভারটন। 'এখন চট-জলদি সূত্রটা বলে ফেলো দেখি! তাহলে তুমিও বাঁচবে, তোমার চাকর আর কুকুরও বাঁচবে, বাঁচবে তোমার বন্ধুও।'
আমাকে চুপ থাকতে দেখে এভারটন বলল, 'আমাদের কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? এই দ্যাখো...' বলে পকেট থেকে একটা রিমোট বের করে তার একটা বাটনে চাপ দিতেই রাজপ্রাসাদের মতো বাড়িটার সদর দরজা খুলে গেল।
কাচের তৈরি ছোট্ট একটা ড্রাইভারহীন কাচের গাড়ি বেরিয়ে এলো সেই দরজা দিয়ে। গাড়ির ভেতর করুণ মুখে বসে আছে জগমোহন আর আমার প্রিয় কুকুর ভীম। আমাকে দেখে কী যেন বলল ওরা। চারপাশ কাচ দিয়ে ঘেরা সেই গাড়ির ভেতর থেকে তাদের কথা আমার কান পর্যন্ত পৌঁছালো না।
গাড়িটা তিন বিদেশি আর ক্যালাপেগাসের সামনে থামতেই লখিন্দার সিং বলল, 'এই গাড়িটা কিন্তু নিছক গাড়ি নয়, ইলেট্রিক শকেরও ব্যাবস্থা আছে এতে।'
কথাটা শেষ করে লখিন্দার সিং এভারটনকে ইশারা করতেই সে রিমোটের আরেকটা বাটনে চাপ দিল। সঙ্গে সঙ্গে জগমোহন আর ভীমের চেহারা এমন হলো- আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি, তীক্ষè আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে ওদের মুখ থেকে। এ দৃশ্য সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। অনুরোধ করে এভারটনকে বললাম, 'থামো এভারটন, থামো। অনেক হয়েছে। তোমরা যা চাও তাই হবে।'
এভারটন রিমোট চেপে শক বন্ধ করে দিল।
আফজাল 'রয়ে সয়ে' থাকার কথাটা বেমালুম ভুলে গিয়ে বলল, 'সূত্রটা ওদের বলে দিবি? সারা দুনিয়া তাহলে চষে ফেলবে ওরা।'
'এছাড়া আর কী উপায় আছে বল।'
আমাদের ফিসফাস করতে দেখে ক্লিন্সম্যান বলল, 'বদ মতলব আঁটছো না তো। বেশি চালাকি করলে জগমোহন আর ভীমকে তোমার চোখের সামনে কাবাব বানিয়ে ফেলব কিন্তু!'
আমি বললাম, 'ঠিক আছে, আমি কোন চালাকির চেষ্টা করব না। তোমরা কীভাবে সূত্রটা জানতে চাও বলো।'
'তুমি প্রথমে আমাদের সূত্রটা বলে দেবে, তারপরে আমরা পুরো পাণ্ডুলিপিটা একবার পড়বে আমরা সেটা রেকর্ড করে নেব। তখন যদি মনে হয় তুমি ঠিকঠাক সূত্রটা বলেছো, তাহলে প্রাণে বাঁচবে আর যদি মনে হয়, ঠিক সূত্রটা বলোনি, তবে প্রথমে তোমার চাকর আর কুকুরটাকে কাবাব বানাব, তারপরে তোমার নিজের তৈরি এনাইহিলিন গান দিয়ে তোমাকে আর তোমার বন্ধুকে একেবারে উড়িয়ে দেবো; কোনো চি‎হ্ন থাকেবে না-' ঠাণ্ডা মাথায় প্রচ্ছন্ন হুমকি দিল লখিন্দার সিং।
আমি বললাম, 'সূত্রটা বলে দিলেই তুমি আমাদের ছেড়ে দেবে তার কী গ্যারান্টি আছে?'
ক্লিন্সম্যান বলল, 'কোন গ্যারান্টি নেই, আমাদের বিশ্বস করা ছাড়া তোমার আর কোন উপায়ও নেই।'
আফজাল বলল, 'খবরদার জামিল, তুই সূত্রটা বলবি না। আমাদের প্রাণ যায় যাক।'
আমি আফজালের কথায় কান না দিয়ে ওদের বললাম, 'ঠিক আছে, আমি তোমাদের বিশ্বাস করছি। আশা করি, তোমরা আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবে।'
আমি আফজালের নিষেধ অমান্য করে C-A-S গ্র“পকে সূত্রটা বলে দিলাম। তারপর পুরো পাণ্ডুলিপিদুটোর ইংরেজি অনুবাদ করে উচ্চৈস্বরে পড়লাম। ওরা সেটা রেকর্ড করল। তারপর ওরা সূত্রের সাথে রেকর্ডকৃত অনুবাদটা মিলিয়ে দেখে নিশ্চিত হলো, আমি ঠিকঠাক অনুবাদ করেছি কিনা।
আমি বললাম, 'এবার আমাদের ছেড়ে দাও।'
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল তিন বিদেশি। ক্যালাপেগাস এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। আমার মনে হলো, সেও অট্টহাসিতে অংশ নিল। তার সেই হাসিটাও বিচিত্র!
'তোমাকে ছেড়ে দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না,' বলল লখিন্দার সিং। 'আমারা ছাড়া একমাত্র তুমিই জানো কীভাবে এনাইহিলিন গান তৈরি করতে হয়, তোমাকে বাঁচিয়ে রাখা মানে ভয়ংকর প্রতিদ্বন্দ্বীকে বাঁচিয়ে রাখা। সে ভুল আমরা করতে চাই না।'
ক্লিন্সম্যান বলল, 'দুদিন পরে আমরা হবো দুনিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষ। তারজন্য হয়তো অনেক অন্যায়-অপরাধ করতে হবে, সেটা তুমি ভালো করেই জানো; এতবড় সাক্ষীকে বাঁচিয়ে রাখাটা ঝুঁকি হয়ে যায় না?'
আফজাল এবার উচ্চৈস্বরে বলল, 'আমি তোকে আগেই নিষেধ করেছিলাম। সূত্রটা বলে দিয়ে পৃথিবীকে বিভীষিকার মধ্যে ঠেলে না দিয়ে নিজেরা মরাই কী ভালো ছিল না? অন্তত মৃত্যুর আগে এমন অস্বস্তি নিয়ে মরতে হত না।'
আমি ওর কথায় জবাব না দিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে লাগলাম, কী করা যায়?
এভারটন এনাইহিলিন গানটা আমার চোখের সামনে বাগিয়ে ধরে বলল, 'এনাইহিলিন গানটা তো তুমিই তৈরি করেছো, এটা নিশ্চয় এখনো পরীক্ষা করে দ্যাখোনি?'
আমি মাথা নেড়ে বললাম, 'করেছি, কালিন্দির পাড়ে, টাফার একটা নোংরা পিঁপড়েকে দিয়ে।'
'সেটা তো শুধু লখিন্দার সিং দেখেছে। আমি আর এভারটন দুজনের কেউই সেখানে ছিলাম না। এবার আমরা নিজেরো এনাইহিলিন টেস্ট করব আর তুমি দেখবে, বুঝলে?' ক্লিন্সম্যান বলল।
এভারটন এনাইহিলিন গানটা নাচাতে নাচাতে বলল, 'প্রথমে তোমার বন্ধু আফজালকে ভ্যানিশ করে দেব, তারপর এটা দিয়ে ভ্যানিশ করব তোমাকে। তোমার চাকর আর কুকুরকে আমরা মারব না, ওদেরকে মিরর ইমেজিং সিস্টেমে প্রতিবিম্ব করে টাফায় পাঠিয়ে দেব।'
একথা শুনে কুৎসিত ক্যালাপেগাস বিচিত্র শব্দে হাসতে হাসতে অতিকায় সাঁড়াশি দুটো দিয়ে কয়েকবার হাততালি দেয়ার চেষ্টা করল।
আমি আপত্তি জানিয়ে বললাম, 'আমাকে না হয় মারলে মানলাম, আফজালকে কেন?'
'ওর জন্যই তো এত হাঙ্গামা, ও যদি প্রথমেই পাণ্ডুলিপিটা আমাদের দিয়ে দিত তাহলে এতো গোলমালের দরকার হতো। ও বড্ড বেয়াড়া, ওকে সাজা দেয়াও হবে আবার এনাইহিলিন গানটা টেস্ট করাও হবেÑ ক্ষতি কী?' বলল লখিন্দার।
'অত কথার কী দরকার,' বলে এনাইহিলিন গানের নলটা আফজালের দিকে বাগিয়ে ধরে ঘোড়া টিপতেই এমন একটা কাণ্ড ঘটে গেল- আমি বাদে সবাই একবারে থ! কারণ আফজাল ভ্যানিশ হয়নি, ভ্যানিশ হয়ে গেছে এভারটন নিজেই। সত্যি বলতে কী কাল রাতে আমি এনাইহিলিন গানে এই কারিকুরিটাই করে রেখেছিলাম। এনাইহিলিন গানের পেছন দিকে একটা ছিদ্র করে ট্রিগারের সিস্টেমটা এমন করে রেখেছিলাম যাতে নল দিয়ে গুলি বের না হয়ে পেছনের ছিদ্র দিয়ে গুলি বের হয়। এখন সেটাই ঘটেছে আর পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এভারটনের দেহটা।
বিস্ময়ে বিমূঢ় ক্লিন্সম্যান আর লখিন্দার সিংয়ের ঘোর কাটতে ঝাড়া দু'মিনিট সময় লাগল। আমাদের হাত বাঁধা, তাই এই সুযোগটাও কাজে লাগাতে পারলাম না। পড়ে থাকা এনাইহিলিন গানটার দিকে ফিরেও তাকাল না ওরা। ক্যালাপেগাস কীসের যেন একটা এলার্ম বাজিয়ে দিয়েছে। ক্লিন্সম্যান তার হাতের পিস্তলটা আমার দিকে তাক করে ঘোড়া টিপে দিল। আমি আর আফজাল রীতিমতো মৃত্যর জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছি। কিন্তু ক্লিন্সম্যানের পিস্তল থেকে গুলি বের হলো না।
'কী হচ্ছে এসব?' রেগেমেগে বলল লখিন্দার সিং। তারপর নিজের কোমর থেকে পিস্তল বের করে আবার আমার দিকে তাক করে ঘোড়া টিপল। আবার সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি, অর্থাৎ লখিন্দার সিংয়ের পিস্তল থেকেও গুলি বের হলো না।
ওদের চেহারায় হতাশার ছবিটা এমনভাবে ফুটে উঠল, যেন কারো আর কিছু করার নেই। এসব অলৌকিক কাণ্ড কীভাবে ঘটছে, তার পেছনের রহস্য ধরতে পারলাম না আমিও।
লখিন্দার সিং আর ক্লিন্সম্যান ক্যালাপেগাসকে দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন বলল। ক্যালাপেগাসও মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল।
হঠাৎ বিকট শব্দে মেঘ গর্জে উঠল। সেই মেঘের আড়ালে ঢেকে গেল যেন সূর্যের খানিকটা অংশ। তার ছায়া পড়ল মাটিতে। তারপরেই সাঁ করে আমাদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে নামল কোলা ব্যাঙের মতো সেই আজব প্রাণীটা। দানব ব্যাঙটা ইয়াবড় হাঁ করে তার জিবটা বের করে মাটিতে পাতল। ক্লিন্সম্যান, লখিন্দার সিং আর ক্যালাপেগাস গিয়ে সেই জিবের ওপর উঠে দাঁড়াল। অমনি ব্যাঙটা তাদেরকে চেটে পুটে খাওয়ার মতো করে গিলে ফেলল।
আমি পত্রিকায় ব্যাঙটার কর্যকলাপ সম্পর্কে আগেই পড়েছি। তাই জানি, ব্যাঙটা আসলে ওদেরকে খায়নি, বরং ঘোর দুর্যোগে আশ্রয় দিয়েছে। এও জানি, ঐ ব্যাঙাকৃতির মহাকাশযানটার ভেতরে ক্যালাপেগাসের পিঁপড়েবাহিনী রয়েছে। তাই নয়, আমাদের সামনে এখন ঘোর বিপদ, তার ওপর হাত-পা বাঁধা। এরপরও যদি বেঁচে ফিরি, তবে সেটা কপাল জোরেই বলতে হবে।
কলজে কাঁপানো বিকট একটা গর্জন করল কিম্ভূতকিমাকার প্রাণীটা। তার চোখদুটো ইটের ভাটার মতো জ্বলতে শুরু করল। আমার বেয়াল্লিশ বছরের জীবনে এই প্রথমবারের মতো মৃত্যূভয়ে কেঁপে উঠলাম। আফজালের দিকে তাকিয়ে দেখি, ওরও একই অবস্থা।
ব্যাঙের মতো প্রাণীটা আবারো ভয়ংকর একটা গর্জন করে উঠল। তার পরে যা ঘটল, তা অবিশ্বাস্য, অচিন্তনীয়। প্রাণীটার গর্জনের সাথে সাথে দেখি কোত্থেকে একটা খয়েরি রঙের দেয়াল দৈত্যাকার ঐ প্রাণীটার সামনে থেকে আমাদেরকে আড়াল করে দিল। এভাবে কেটে গেল কয়েকটা মিনিট। চারিদিকে নেমে এসেছে ভুতুড়ে রকমের সুনসান নীরবতা। ভোজবাজির মতো থেমে গেছে ভিনগ্রহের কিম্ভূতদর্শন ঐ প্রাণীটার তর্জন-গর্জনও। কেন...?
ভুতের মতো হঠাৎ কোথা থেকে যেন এসে হাজির হলো আব্বাস। আমাদের বাঁধন কেটে দিয়ে শুধু একটা কথাই বলল, 'ভ্যানিশ।'
'কে?' হাতে বেঁধে রাখা জায়গাগুলোতে দড়ির ঘর্ষণে হওয়া দাগে হাত বুলাতে বুলাতে বলাম আমি।
'ক্যালাপেগাস আর কিম্ভূত জানোয়ারটা' বলল আব্বাস।
'কীভাবে?' জানতে চাইল আফজাল।
আমারও একই প্রশ্ন।
সামনের পঞ্চাশ ফুট উঁচু খয়েরি দেয়ালটা দেখিয়ে বলল, 'এটার কারণেই আপনারা বেঁচে গেছেন। বাকিটা আমি আর বলছি না, আপনারা নিজের চোখে দেখবেন, আসুন।'
আমরা দেয়ালটা ঘুরে ওপাশে গিয়ে যা দেখলাম, তাতে লখিন্দার সিং আর চার্লস এভারটনের জন্য একটু মায়াই হলো- শত্রু হলেও তো তারা মানুষ! ক্যালাপেগাস আর তার চেলাদের জন্য একটুও সহানুভূতি অনুভব করলাম না।
যা দেখলাম তা হলো, ভিনগ্রহের ব্যাঙাকৃতির বিশাল সেই প্রাণীটা পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। লখিন্দার সিং আর চার্লস এভারটনের ভাগ্যে কী ঘটছে তা আর লেখার প্রয়েজন মনে করছি না। খয়েরি রংয়ের যে দেয়ালটা আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে সেটা হলো, আমরা যে টাওয়ারে ছিলাম, তার মাথায় যে আয়নাটার কথা আগেই বলেছি- এটা সেই আয়না। তবে এটাকে আমি আগে সাধারণ আয়না মনে করেছিলাম, আসলে তা নয়। এটা কসমিক প্যানেলÑ অনেকটা আমাদের সোলার প্যানেলের মতো- মহাকাশ থেকে আগত কসমিক রশ্মি সংগ্রহ করে অত্যন্ত উচ্চমাত্রার বিদ্যুত উৎপন্ন করতে পারে এই কসমিক আয়না। এটাই শেষ পর্যন্ত ক্যালাপেগাস, ক্লিন্সম্যান আর লখিন্দার সিংয়ের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল!
কিম্ভূতদর্শন দানব ব্যাঙটা যখন আমাদের উদ্দেশ্যে তার চোখ দিয়ে লেজার রশ্মি ছুড়ে মেরেছিল, ঠিক তখনি আয়নাটা সময় মতো বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ছুড়ে মারা লেজার এই আয়নাতে প্রতিফলিত হয়ে দুই বিদেশি, ক্যালাপেগাস আর তার স্যাঙ্গাতদের সহ দানবটাকেই পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়।
'লেজার রশ্মিটা আমরা দেখতে পেলাম না কেন?' বোকার মতো প্রশ্ন করল আফজাল।
'পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষকের মুখে এই প্রশ্ন!' বললাম আমি। 'কোনো আলো দেখতে পাওয়া মানে সেটা আমাদের কাছে পৌঁছে যাওয়া। তা-ই যদি ঘটত, তবে ছাই ওরা নয় আমরাই হতাম।'
নিজের ভুল বুঝতে পেরে কিছুটা লজ্জিত হলো আফজাল।
কথা হচ্ছে, আব্বাস এই অসম্ভবকে সম্ভব করল কীভাবে? আলোর গতি সেকেণ্ডে ত্রিশ কোটি মিটার। আমাদের থেকে দানবটার দূরত্ব ছিল বড়জোর দশ মিটার। তাহলে ওটার কাছ থেকে আমাদের কাছে আলো এসে পৌঁছাতে সাকূল্যে এক সেকেণ্ডের তিন কোটি ভাগের এক ভাগ সময় লাগার কথা। অতি ক্ষুদ্র এই সময়ের মধ্যেই কীভাবে আব্বাস আয়নাটা দুইশ' ফুট ওপর থেকে নিচে নামাল? কথাটা ওকে জিজ্ঞেস করলাম।
'জ্ঞান ফেরার পর দেখি, আমার হাতে আপনার লেখা চিঠি,' আগের রাত থেকে বর্ণনা শুরু করল আব্বাস। 'প্রথমে কেমন জানি ঘোর ঘোর লাগছিল। ধাতস্থ হতে সময় লাগল কয়েক মিনিট। তারপর ধীরে ধীরে সব মনে পড়ল। তিন বিদেশির কথামতো চলেছি বলে নিজের প্রতি রাগও হলো কিছুটা। তারপর হঠাৎ করে আবার সেই ঘোরলাগা ভাব। আবার মনে হলো, কেউ আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে সেটা ঐ তিন বিদেশির পক্ষে নয়; বিপক্ষে। আমার মাথার ভেতরে কে যেন বলল, 'তোমার ভাই আর ড. জামিলকে বিদেশিরা বন্দি করে রেখেছে।' ওটাই আমার ভেতরে প্রতিহিংসার অগুন ধরিয়ে দিল। কীভাবে জানি নাÑ C-A-S গ্রুপের আস্তানার প্রতিটা কোণা আমার নখদর্পনে। আমি তীরের বেগে সেই রাত্রিতেই ছুটলাম। কিন্তু আস্তানায় গিয়ে ওদের কাউকে পেলাম না। তার বদলে ওদের দুজন চেলাকে পেলাম। ওরা আমাকে আগে থেকেই চেনে। তাই আমাকে দেখে সন্দেহ করেনি। আমি কৌশলে ওদেরকে ঘায়েল করে এই গোপন আস্তানার ঠিকানা পেয়ে গেলাম। কিন্তু এখানে পৌঁছাতেই এতটা সময় লেগে গেল! এসেই দেখি, পিস্তল হাতে লখিন্দার সিং, ক্লিন্সম্যান আর এভারটন আপনাদের সামনে রুদ্রমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি পাশের ঐ ঝোপটার পেছনে লুকিয়ে পড়লাম। হঠাৎ এভারটন মাথাগরম করে ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেল! তারপর লখিন্দার সিং আর ক্লিন্সম্যান আপনাদের গুলি করার চেষ্টা করল। কিন্তু আমার একবারের জন্যেও মনে হয়নি, ওরা আপনাদের মেরে ফেলতে পারে।'
একটু থেমে লম্বা একটা দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করল আব্বাস, 'তারপর মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। চোখের সামনে একটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখলাম- দানব ব্যাঙটার চোখ দিয়ে বেরোনো আগুনের হল্কায় আপনারা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছেন। মাথা খারাপ হয়ে গেল আমার। কেউ খেয়াল করেননি- ক্যলাপেগাস যখন দানব ব্যাঙটাকে ডাকার জন্য এলার্ম বাজাচ্ছিল, আমি তখন চুপিচুপি সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। এ বাড়ির প্রতিটা দরজা কোড লকড- আমি সেসব কোড জানিও না, কিন্তু কীভাবে জানি হঠাৎ সবক’টা দরজার কোড নম্বর মাথায় এসে গেল। ভেতরে ঢুকে সোজা চলে গেলাম কন্ট্রোল রুমে। তখনি সেখান বসেই আয়না নিয়ন্ত্রক সুইচ টিপে দিলাম। কী আশ্চর্য দেখুন আয়নাটা এমন সময় নামল, এক মহূর্ত দেরি হলে...!'
আমি বিড়বিড় করে বললা, 'শঙ্কুর ফিউচার ভিউয়ারের কাজ।'
'তার মানে?' জিজ্ঞেস করল আফজাল।
'ফিউচার ভিউয়ার এমন একটা যন্ত্র, যা দিয়ে ভবিষ্যত দেখা যায়- এরকম একটা যন্ত্র আমি অনেক আগেই তৈরির চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সফল হইনি।'
'সেটা তো তুই করেছিলি, আব্বাস হঠাৎ করে মহবিজ্ঞানী হয়ে গেল কীভাবে?'
'আব্বাস যা করেছে, তা ও নিজে থেকে করেনি, টাফায় বসে প্রোফেসর শঙ্কুই ওকে দিয়ে করিয়েছেন।'
'শঙ্কু করিয়েছেন! কীভাবে?'
'শঙ্কু অনেক আগে থেকেই আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলেন, টাফার বিদ্রোহীরা হয়তো সে চেষ্টা সফল হতে দেয়নি। বিদ্রোহীদের প্রধান ক্যালাপেগাস যখন আমাদের সাথে লড়ছে, তখন শঙ্কুর দিকে নজরদারীতে ঢিল পড়েছে আর সেই সুযোগে শঙ্কু আফজালকে কাজে লাগিয়েছে।' বললাম আমি।
'কিন্তু আসল প্রশ্নটাই তো এড়িয়ে যাচ্ছিস-' বলল আফজাল।
'ভুলে যাচ্ছিস কেন, আব্বাসের মাথায় শয়তানেরা একটা কমিউনিকেশন মডিউল লাগিয়ে রেখেছিল? ইনভার্স মিরর ইমেজিং ইনজেকশন পুশ করার কারণে আব্বাস প্রতিবম্ব মানব থেকে আবার আগের আগের অবস্থায় ফিরে এলেও ওর মাথার ভেতরের মডিউলটা অকার্যকর হয়নি। শঙ্কু সেটা ব্যবহার করেই ওকে দিয়েই আমাদেরকে বাঁচিয়েছেন।' আব্বাস বোকার মতো আমাদের কথা শুধু শুনল; কিছুই বুঝল বলে মনে হলো না।
'সবই তো বুঝলাম, ওদের পিস্তল থেকে গুলি সরিয়েছিল কে?' বলল আফজাল।
আমি বললাম, 'সে প্রশ্ন তো আমারও?'
হঠাৎ রাজপ্রাসাদের মতো সেই বাড়িটার ভেতর থেকে এক বাঙ্গালীমতো ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে আমাদের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, 'আমি-'
'আপনি আবার কে?' বলল আফজাল।
আমি সুজিত রায় আমেরিকান বাঙ্গালী, 'বলল লোকটা। 'C-A-S গ্রুপের তিন স্বত্ত্বাধিকারীর সেক্রেটরী। ওদের সব কাজ আমিই দেখাশোনা করি। বলব না যে আমি খুব সৎ। বরং C-A-S গ্রুপের সাথে চলতে চলতে আমিও ওদের মতো অন্ধকার জগতে তলিয়ে যাচ্ছিলাম। ওরা যখন থেকে চোরা শিকারের ব্যবসা শুরু করে তখন থেকেই আমি ওদের সাথে রয়েছি। ওদের সব কুকর্মের সহযোগিতাও করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ভিনগ্রহী ক্যালাপেগাসের সাথে সখ্যটা আমি মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। যখন টের পেলাম পৃথিবীকে ওরা সর্বনাশের দিকে ঠেলে দেয়ার পায়তারা করছে তখনি সিদ্ধান্ত নিই সুযোগ পেলেই কিছু একটা করব। ওরা যখন বাংলাদেশে এসে আপনাদের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে শুরু করল, তখনি বুঝেছিলাম ওদের কাছে আপনাদের গুরুত্ব কতখানি। কাল যখন ওরা আপনাদের জঙ্গলবাড়িতে নিয়ে গেল- সিদ্ধান্ত নিলাম কিছু একটা করতে হবে। সে জন্যেই ওদের পিস্তলের ম্যাগাজিন থেকে গুলি সরিয়ে রেখেছিলাম।'
আমি লোকটার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললাম, 'অনেক ধন্যবাদ ভাই, আপনার জন্য আজ নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে নতুন জীবন ফিরে পেলাম।'
লোকটা একটু লজ্জা পেল বোধহয়। মাথা নিচু করে বলল, 'আপনারা পৃথিবীর জন্য যা করলেন তার তুলনায় এটা কিছুই না-'

ভীম আর জগমোহনকে ইলেট্রিক গাড়ি থেকে বের করলাম। তারপর পোড়া দানব ব্যাঙটার পাশ থেকে এনাইহিলিন গানটা তুলে নিয়ে একট গোপন সুইচ টিপে ট্রিগার সিস্টেম পরিবর্তন করে সেটাকে আবার নিয়ে এলামস্বাভাবিক অবস্থায়। এনাইহিলিন গানের নলটা দানব ব্যাঙটার পোড়া শরীরের দিকে তাক করে ট্রিগার টিপে দিলাম। মুহূর্তের মধ্যে ছাইয়ের অতবড় পাহড়টা উধাও হয়ে গেল।
আফজাল খেকিয়ে উঠে বলল, 'জামিল, করলি কী্‌ করলি কী! শঙ্কুর পাণ্ডুলিপিটা যে ওই ছাইয়ের টিপির ভেতরে ছিল...!'
মনেই ছিল না, শঙ্কুর পাণ্ডুলিপি পোড়ে না- ছাইয়ের ভেতর থেকে সেগুলো উদ্ধার করা সম্ভব। তাই এনাইহিলিন গানের ট্রিগার চাপার আগে ভেবেছিলাম পাণ্ডুলিপিটা আগেই পুড়ে গেছে। তবে লেজার রশ্মিতে না পুড়লেও সেগুলো ঠিকই এনাইহিলিন গানের গুলিতে ভ্যানিশ হয়ে গেছে।
বড় কিছু হারালাম, তার জন্য কিছুটা আফসোস হলো, তবে এনাইহিলিন গানের এতবড় পরীক্ষাটা নিজ হাতে করতে পারার সাফল্যটাকেও খাটো করি কীভাবে?

(শেষ)
-------------------
আব্দুল গাফফার রনি

*শেষ হল ড. জামিলের প্রথম অভিযানের গল্প। ইতিমধ্যে এই সিরিজের আরো তিনটি গল্প আমি সচলদের শুনিয়েছি। কেমন লাগল জানাবেন দয়া করে।
*ভিনগ্রহের পাণ্ডুলিপি শেষ হলেও শেষ হচ্ছে না জামিল সিরিজ। খুব শিঘ্রি আসছে 'বিষ্ণুপদের বিড়াল'।
*একটা গোয়েন্দা সিরিজেও হাত দিয়েছিলাম। সিরিজের প্রথম গল্প 'গ্র্যান্ডজুলু রহস্য' ইতিমধ্যে প্রকাশ হয়েছে আলোকলতা নামের একটা কিশোর সংকোলনে। এই সিরিজের দ্বিতীয় গল্প 'কবিরাজ কাহিনি'ও লেখা শেষ। শেষবারের মতো ওটা এডিটিং করে সচলে পোস্ট কতে চাই। সচলদের সমর্থন প্রয়োজন।

* ভিনগ্রহের পাণ্ডুলিপির অন্য পর্বগুলো পড়তে কী-ওয়ার্ডের 'জামিল সিরিজ' লেখার ওপর ক্লিক করুন।


মন্তব্য

প্রদীপ্তময় সাহা এর ছবি

আপনি যেটাকে লখিন্দর সিং এর ঠাণ্ডা মাথায় দেওয়া প্রচ্ছন্ন হুমকি বলেছেন, তা আসলে কিন্তু প্রচ্ছন্ন নয় যথেষ্ট স্পষ্ট। চিন্তিত
ক্লাইম্যাক্স ভালো লেগেছে।
ঘটনা শেষ করে তারপর পাঠককে ব্যাখ্যা দেবার এই ধরণটা ভালো লাগে।

তবে জামিল ভাইয়া এভাবে পাণ্ডূলিপির কথাটা ভুলে গেলেন?

'বিষ্ণুপদের বিড়াল' এর অপেক্ষায় থাকলাম।
আর আপনার গোয়েন্দা গল্পেরও। হাসি

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
পর্বতীতে চেষ্টা থাকবে আরো ভাল করার।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

বন্দনা এর ছবি

ভাগ্যিস আপনি অন্যদের মত সিরিজ শুরু করে পালিয়ে যাননি। আজকেই যে শেষ পর্ব পাবো এতটা আশা করিনি অবশ্য। আমার বেশ ভালো লেগেছে আপনার লিখুনি, যদি ও একটু বেশি নাটকীয় হয়ে গেসে পিস্তল থেকে ও গুলি না বের হওয়া। পরের নতুন সিরিজগুলা অবশ্যই আসুক, আমরা আরো জামিল সিরিজ পড়তে চাই।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
জামিল আন্তর্হীত হলেও তাঁর ডায়রি তো আছে আমার কাছে। অতএব আরো কয়েক বছর নিশ্চন্তে চালিয়ে যেতে পারব জামিল সিরিজ।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

সাফি এর ছবি

আপনি লেখা না দিলে কী হবে, এমনিতেই দ্বিতীয় পাতায় চলে গেছিল বাকীদের কল্যাণে, হুহ

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

শয়তানী হাসি

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

সাফি এর ছবি

সত্যি বলতে কী বাকি পর্বগুলোর তুলনায় শেষটা অত জমেনি বলে মনে হয়েছে। আপনি কন্ট্যাক্টে অনুরোধ করেছিলেন আপনার বাকী লেখাগুলো একাউন্টে জুড়ে দেওয়ার ব্যাপারে? আগের লেখাগুলো পড়তে ইচ্ছে করছে।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

করেছিলাম এখন জবাব পাইনি। আন্য লেখাগুল পড়ার জন্য আপনি গল্প পাতায় গিয়ে খুজে দেখতে পারন, আষ করি পাবেন।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

অতিথি লেখক এর ছবি

>দারুন চলছে রনি ভাই, এগিয়ে চলুন।

আশরাফুল কবীর

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ধন্যবাদ, আপ্নিও আমাদের সাথে থাকুন।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

মরুদ্যান এর ছবি

সিরিজ চলুক।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
চলবে গুল্লি বেগে

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

পড়ছি। চলুক।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

পড়ার জন্য আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
আমি না মরলে সিরিজ চলবে

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

তদানিন্তন পাঁঠা এর ছবি

একসাথে শেষ দুটো পড়লাম। ছোটখাট কিছু খটকা ছাড়া ভালই লেগেছে। তবে শেষটা আরেকটু সময় নিয়ে করলে হয়তো আর ভাল লাগতো। তবে এটা একান্তই আমার নিজের মত। লেখক লিখবেন নিজের ইচ্ছায়। ভাল থাকবেন।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
আপনাদের মুল্যবান মতামতই এই সিরিজটাকে আরো বেগবান ও নিঁখুত করতে পারে

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

রাগিব এর ছবি

আপনার লেখাটা গতরাতে একবারে সব পর্ব পড়লাম। কিছু মন্তব্য আছে। গঠনমূলক সমালোচনা হিসাবে এগুলোকে দেখলে ভালো হবে।

(১) আপনার লেখার উৎসাহ দেখে ভালো লাগছে। তবে আপনার লেখাটা অনেকাংশে সত্যজিতের মতো হয়ে গেছে, সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে। আপনার স্বকীয় রচনাকৌশলের বিকাশের জন্য এটা খারাপ।

(২) এই গল্পটা শঙ্কুর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। থিম থেকে শুরু করে সবটাতেই শঙ্কু। এটার বদলে নিজে আলাদা কিছু নিয়ে লিখুন। শঙ্কুর ওষুধ, পিস্তল এসব নিয়ে যদি পরেও অন্য গল্প লিখেন এই সিরিজে, তাহলে আপনাকে এক সময় অনুকরণের অপবাদ নিতে হবে।

(৩) সত্যজিতের ব্যোমযাত্রীর ডায়েরী সম্ভবত ৬১ সালে লেখা। পরের শঙ্কুগুলা পড়লে দেখবেন সত্যজিতের হাত পেকেছে অনেক, পরের শঙ্কুগুলো অনেক ভালো করে লেখা।
কাজেই ওটাকে আদর্শ ধরে না থেকে অন্যদিকে যান। আপনি আর্থার সি ক্লার্ক বা আসিমভের রচনাবলী পড়তে পারেন। তাতে করে একজনের (সত্যজিতের) প্রভাব কাটতে পারে।

সবমিলিয়ে আমার পরামর্শ হলো, কারো লেখার স্টাইল বা তার চরিত্রকে আত্মস্থ করে লেখাটা খুব সহজ (যেমন, চাইলেই কিন্তু হিমু সিরিজের মতো করে লেখা যায় সহজে, অথবা হুমায়ূন কিংবা জাফর ইকবালের মতো), কিন্তু নিজের আলাদা ঘরানা স্থাপন করাটা অনেক বেশি দরকার। নইলে পরের ঘাড়ে পা দিয়ে কাদা পার হবার অপবাদ লেগে থাকবে। আপনার লেখার ক্ষমতা অবশ্যই আছে ভালোভাবে, কিন্তু সত্যজিতের স্টাইল অনুসরণ করলে কিংবা শঙ্কুর সিকোয়েল লিখলে সেটা লেখক হিসাবে আপনার নিজের ক্ষমতার প্রতি অবিচার হবে।

----------------
গণক মিস্তিরি
জাদুনগর, আম্রিকা
ওয়েবসাইট | শিক্ষক.কম | যন্ত্রগণক.কম

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনার মূল্যবান পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ, মনে থাকবে এগুলো। আর্থার সি ক্লার্ক খুব বেশি পড়িনি, আসিমভ পড়েছি মোতামুটি। ভালো থাকবেন।

নিলয় নন্দী এর ছবি

রনি, রাগিব ভাইয়ের সবগুলো পরামর্শ তো বটেই, বিশেষ করে তিন নম্বরটা ভালো করে বুঝে নিন।
সত্যজিতের প্রথম শংকু আর শেষ শংকুর মধ্যে হাজার মাইলের ব্যবধান।
এটা আমি অনেক আগেই জানিয়েছিলাম আপনাকে।

আপাতত খানিকটা অফ ফর্মে আছি বোধহয়। মনটা একটু বিক্ষিপ্ত থাকায় সচল পড়া বা লেখা হয়ে উঠছে না।
পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

নিলয়দা, আপনার বিক্ষিপ্ত মন আর অফফর্ম- দুইয়ে মিলে রহ্যস্যের গন্ধ পাচ্ছি! শয়তানী হাসি
ফলস্বরুপ খুব শিঘ্রি হয়তো সচলে এর চমক দেখতে পাব।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

স্পর্শ এর ছবি

"ভিন গ্রহের পান্ডুলিপি" ভালো লেগেছে। জামিলের অন্য অ্যাডভেঞ্চারও পোস্ট করেছেন কি? তাহলে লিঙ্কগুলো দেবেন।

আর রাগিব ভাই এর মন্তব্যের সূত্রে বলি। একেবারে ইউনিক কিছু লিখতেই হবে শুরুতেই এমন ভেবে বাড়তি চাপ নেওয়ার দরকার নেই। যেভাবে ইচ্ছে হয়, যার রীতিতে লিখতে ভালো লাগে সেভাবেই লিখতে থাকুন। মজার মজার গল্প লিখতে থাকাটাই আসল। নিজস্বরীতি গড়ে ওঠে খুব ধীরে, সে সময়টুকু তাকে দিতে হবে। "নতুন ভাবে লিখবো" ভাবতেই রাতারাতি হবে না। সত্যজিতেরও হয়নি। কিন্তু অবশ্যই চেষ্টা থাকতে হবে। আপনার সেটা আছে।

শুভেচ্ছা।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
আপনার পরামর্শ মনে থাকবে । বিশেষ করে-

কিন্তু অবশ্যই চেষ্টা থাকতে হবে। আপনার সেটা আছে।

ভিনগ্রহের পাণ্ডুলিপি'র অন্য পোস্টগুলোর লিঙ্ক দিলাম-
জামিল ও অদৃশ্যমানব
অন্য পৃথিবী

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

এছাড়াও
কিউপিড-ব্যালান্স

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।