কবিরাজ কাহিনি-১

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ০১/০৬/২০১২ - ৮:৪৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

'এই আসিফ ওঠ...ওঠ! কটা বাজে দেখেছিস?'
ধুড়মুড় করে উঠে বসলাম। সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। সাম্যের ডাকে ভেঙে গেল সেটা। কোথায় আছি প্রথমে মাথায় ঢুকল না। একে একে সব মনে পড়ল। আমরা এখন মেহরেপুরে কাটাখালি গ্রামে। আসিফের ছোটমামার বন্ধু ডা. একরামূল হকের বাড়ি। দরবেশপুর এখান থেকে মাইল তিনেক দূরে।
দরবেশপুরের কবিরাজ রীতিমতো হটকেক হয়ে উঠেছে এলাকায়। ক্যান্সার থেকে শুরু করে সর্দিকাশির রোগিরা পর্যন্ত পিঁপড়ের মতো সারি বেঁধে ছুটছে কবিরাজ মহিলার কাছে। রোগ সারছে কি সারছে না তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। সে যে মুখ দেখেই অচেনা অজানা মানুষের নাম, বাপের নাম, ঠিকানা, রোগের নাম গড়গড় করে বলে দিচ্ছে- এই ব্যাপারটাই পাবলিককে চুম্বকের মতো টানছে।
'চল, হাতমুখে পানি দিয়ে নে। এনামূল মামা এসেছেন। আমাদের খুঁজছেন।' বলল সাম্য।
'এনামূল মামাটা আবার কে রে?' ঘুম জড়ানো কণ্ঠে জানতে চাইলাম।
'একরামূল মামার চাচাতো ভাই,’ জবাবে বলল সাম্য।' আমার সাথে এখনো পরিচয় হয়নি, তবে ছোটমামার মুখে শুনেছি তিনি নাকি খুব মজার মানুষ। হরর কাহিনির পোকা। ব্ল্যাকম্যাজিক, প্লানচেটে, ভূত-প্রেতে বিশ্বাস আছে। ছোটমামা আসতে পারেননি, একরামূল মামাও ব্যস্ত- এখন ইনিই আমাদের সঙ্গ দেবেন। চল।'
সত্যিই মজার মানুষ এনামূল মামা। কথার ভেতর দুটো মুদ্রাদোষ আছে। আমাদের দেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, 'আরে তোমরাই না? হে হে হে...তেমাদের গল্পই করছিলাম আমার ছেলেমেয়েদের সাথে...বুঝলে কিনা...তা সাম্য রতœটি কে?'
'জ্বি আমি।'
সাম্য উত্তর দিতেই তিনি বিনয়ের অবতার হয়ে বললেন, 'কী সৌভাগ্য আমার! ওদেরকে বলি দেখ, দেখে দেখে শেখ। যেমন আঁকিয়ে তেমন মেধা! বইয়ের মধ্যে হীরাÑ তুমি ঠিক ধরে ফেললে! আমি হলে এব্যাপারটা মাথায়ই আসত না।'
বুঝলাম সাম্যের গ্রান্ডজুলু রহস্য সমাধানের ব্যাপারটা মিডিয়ার কল্যাণে ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে।
'তুমি নিশ্চয় আসিফ?' আমাকে ইঙ্গিত করে বললেন তিনি। আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়তেই কেউ যেন শুনতে না পারে এমন চাপা স্বরে বললেন, 'এখানে নিশ্চয়ই গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছ। হে হে হে...তোমাদের জুটি জমবে ভালো, তবে...বুঝলে কিনা...এখানে কোনো রহস্য টহস্য নেই। সবাই জানে ও মহিলার কাছে জ্বিন আছে। কিন্তু আমি জানি ওর কাছে জ্বিন টিন কিছুই নেই, প্লানচেট করে আত্মা নামায়। অনেক বড় ব্ল্যাক ম্যাজিশিয়ান সে।'
'এনামূল মামা!' বলল সাম্য। 'আপনি ব্ল্যাক, ম্যাজিক-প্লানচেট বিশ্বাস করেন তাই না?'
'নিশ্চয় তোমাদের ছোটমামা বলেছে?' বললেন এনামূল মামা। 'বাবলুটার...বুঝলে কিনা... সবসময় একটু বাড়িয়ে বলা স্বভাব।'
'আপনি যাই বলেন এনামূল মামা, বললাম আমি। 'আপনাকে কিন্তু আমার বেশ পছন্দ হয়েছে।'
'সে তো ভালো কথা! তোমাদেরকেও আমার খুব ভালো লেগেছে। তবে একটা কথা বলি কী, ছাড়ো তো ওসব এনামূল টেনামূল, আমাকে তোমরা এনুমামা বলে ডাকবে। বুঝলে কিনা... হে হে হে।'
'এনুমামা?' বলালাম আমি।
'হ্যাঁ, সবাই আমাকে এনু নামে ডাকে কিনা। তাই বলছিলাম কি... বুঝলে কিনা... এনুমামা নামেই ডাকবে... হে হে হে।'
'আচ্ছা তাই হবে। আপনাকে আমরা এনুমামা নামেই ডাকব।'
'এনুমামা আজ কি কবিরাজের সাথে দেখা হবে?' জিজ্ঞেস করল সাম্য।
'হবে, জবাব দিলেন এনুমামা। 'এখনই চলো না...হে হে হে...'

দুই
কবিরাজের বাড়িতে গিয়ে দেখি খাঁ খাঁ করছে। একটা রুগিও নেই। ও বাড়ির লোকজনও কেউ নেই বাইরে। তবে ঘরের ভেতর থেকে মেয়েমানুষের খিলখিল হাসি শোনা যাচ্ছে। এনুমামা গলাটা কেশে পরিষ্কার করে বললেন, 'কেউ আছেন?'
বেরিয়ে এলো এক মাঝবয়সী মহিলা। 'কী চাই?'
এনুমামা স্বভাবমতো 'হে হে হ করে হেসে নিয়ে বললেন, ‘এই ছেলেরা এসেছে কবিরাজ আম্মার সাথে কথা বলতে। বুঝলেন কিনা...?'
মহিলা বলল, 'কবিরাজ আম্মা তো আজ কারো সাথে কথা বলবেন না। অন্যদিন আসুন।'
মহিলা দরজাটা লাগিয়ে দিতে যাচ্ছিল তার আগেই ভেতর থেকে আরেক মহিলার গলা শুনতে পেলাম। 'সাম্য, আসিফ তোমরা পরশু এসো। ঝিনেদা জেলার রোগি আমি রোববারে দেখি।'
আমার চোখ চড়কগাছ! সাম্যও থ মেরে গেছে। না দেখেই আমাদের নাম-ধাম বলে দিলেন! সাম্যের মনের ভেতর কী হচ্ছে জানি না। মহিলার প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মনটা ভরে গেল।
এনুমামা স্বাভাবিক, এমনটা ঘটবে যেন তিনি জানতেন।
'হে হে হে... রোগি দেখার নতুন নিয়ম হয়েছে তা কিন্তু আমার জানা ছিল না। তাহলে এখন আর কী করা? দুপুরে আমার বাড়ি চারটে ডালভাত খেয়ে চলো বিকেলে আমঝুপি থেকে ঘুরে আসি।'
'আমঝুপি! সে তো ভালো প্রস্তাব! আচ্ছা মামা, আমঝুপি কত দূর? ' বলল সাম্য।
'বেশি দূর নয়, হে, হে, হে ..?'

দুপুরে এনুমামার বাড়ি খেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছি। এনুমামার ছোট্ট মেয়ে নিশু একটা অ্যালবাম হাতে আমাদের ঘরে ঢুকল। ছয় সাত বছর বয়স। ও আমাদের সাথে এমনভাবে কথা বলতে শুরু করল যেন আমাদের কত আগে থেকে চেনে। 'সাম্য ভাইয়া, আসিফ ভাই, ছবি দেখবে? ছবি!'
'দাও তো দেখি, কেমন ছবি?' বলে সাম্য হাত বাড়িয়ে অ্যালবামটা নিয়ে উল্টাতে শুরু করল। আমিও হুমড়ি খেয়ে পড়লাম অ্যালবামে। একাল সেকাল মিলিয়ে গোটা পঞ্চাশেক ছবি আছে। সবই পারিবারিক। পাঁচটা ছবি একটু আলাদা। এই ছবিগুলোতে আশির দশকের আদল রয়েছে। এনুমামা তখন একেবারেই তরুণ। কক্সবাজারে পিকনিক ট্যুরে তোলা। চারটে ছবি তোলা একেবারে বেলাভূমিতে। একটা ছবি বোধহয় হোটেলের লবিতে। দশ পনেরো জন লোক বিশ্ব^ চ্যাম্পিয়ান ক্রিকেটদলের মতো করে যেন ফটোসেশন করেছে। সবার মাঝখানে এনুমামা দাঁড়িয়ে। পেছনের ওয়ালে একটা ব্যানার। তাতে বড় করে লেখা 'আনন্দ ভ্রমণ: কক্সবাজার ১৯৮২' তার নিচে কোনো এক কোম্পানির লোগো। বৃত্তের মতো গোল সেই লোগোর ভেতরে বেশ কায়দা করে লেখা পাঁচটি ইংরেজি অক্ষর- 'টি আর বি এস এল'। অ্যালবামটা সাম্যের হাত থেকে নিতে যাচ্ছিলাম। তখনই এনুমামার কথা শুনতে পেলাম। বোধহয় মামির সাথে আলাপ করছেন। নিশু তড়িঘড়ি করে বলল, 'ভাইয়া, ছবিগুলো দাও, দাও... আব্বু আম্মু দেখলে বকা দেবে!'
আমরা দুজনই হেসে ফেললাম। নিশু ছবিগুলো নিয়ে কোথায় যেন লুকিয়ে ফেলল।

এনুমামার বাড়ি থেকে আমঝুপিতে যেতে খরচ হলো মাথাপিছু পাঁচ টাকা করে। আমঝুপি ইতিহাস বিখ্যাত নীলকুঠি। ছোটবেলায় নবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌলা ছবিটি দেখেছি অনেকবার। আনোয়ার হোসেনের সাদাকালো প্রবীর মিত্রের রঙিন-দুটোই। তখন থেকেই মনের ভেতরে গেঁথে আছে একটা ছবি। একটা বৈঠক ঘর। লাল ভেলভেটে মোড়ানো কতগুলো চেয়ার। সেখানে বসে সিরাজ-উদ-দ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে লর্ড ক্লাইভ, মীর জাফর, জগৎশেঠ, উমির চাঁদেরা। সেই হলঘর আজ চোখের সামনে!
জানি না সিরাজ-উদ-দ্দৌলা ছবির শ্যুটিং এখানে হয়েছিল কিনা। তবে বৈঠকঘরটা দেখতে হুবহু সিনেমার সেই বৈঠক ঘরের মতো।
বিরাট একটা আমবাগানের মাঝে একটা বাগানবাড়ি। নীলকরদের নীলচুল্লির চিহ্ন মাত্র নেই। বাগানবাড়ির সব কামরায় ঢোকা নিষেধ। যেগুলোতে ঢুকতে পারলাম সেগুলোতে অপরিচিত কোনো বস্তু নেই। তবে এখানে ওখানে সাজানো সেসব জিনিসপত্রের মাহত্ম্য বাড়িয়ে দিয়েছে ছোট ছোট কিছু ফলক। সংক্ষেপে বর্ণনা করা কিছু তথ্য ১৭৫৭ সালের ইতিহাসের আবহ তুলে ধরার চেষ্টা করছে।
কুঠির পুরো বাগান, শুকিয়ে যাওয়া লেক ঘুরতে ঘুরতে বিকেল পার হয়ে গেল। ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছি ঠিক সেই সময় পেছন থেকে একটা হাঁক শুনতে পেলাম। 'এই যে বাবু শোনো!' ভারী গলার হাঁক শুনে পেছন ফিরে দাঁড়ালাম। বেশ লম্বা, পাকানো গোঁফের এক ভদ্রলোক আমাদের সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন। আমরা থামতেই তিনি এনুমামার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি রায়হান। ডিসকভারি চ্যানেলের সাংবাদিক। এই এলাকায় এসেছি মুজিবনরের ওপর একটা প্রতিবেদন তৈরি করতে।’
এনুমামাও হাত বাড়িয়ে করমর্দন করে অনিচ্ছাভরে নিজের পরিচয়টা দিলেন। মনে হয় লোকটাকে পছন্দ করতে পারেননি।
‘ভাবছ তোমাদের চিনলাম কী করে?’ সাম্যকে ইঙ্গিত করে বললেন লোকটা। ‘আরে, তোমার চেহারা বাংলাদেশের সবলোক মনে হয় চিনে ফেলেছে।’ তারপর সাম্যের পিঠে একটা চাপড় মেরে বললেন, ‘কুঠি দেখতে এসেছ নিশ্চয়? দেখো আমি যাই!’
লক্ষ করলাম লোকটা সরে যেতেই এনুমামার বিচলিত ভাবটা কেটে গেছে। ‘হে হে হে... চলো তোমাদের নীলগাছ দেখিয়ে নিয়ে আসি।’
‘নীলগাছ!’ সমস্বরে বিস্ময় প্রকাশ করলাম আমি। ‘আজো আছে?’
‘এ কী আর সে যুগের নীল গাছ। বুঝলে কিনা... নতুন করে লাগানো হয়েছে।’
নীল গাছ দেখে হতাশই হলাম। যেমন ভাবতাম তেমন নয়। সাধারণ গুল্মলতার মতো ছোট্ট একটা গাছ। হাতভাবে সাম্য আমার মনের কথা বুঝে ফেলল। বলল, ‘ তোর বোঝা উচিত ছিল নীলকরেরা জোর করে চাষীদের দিয়ে নীল চাষ করিয়ে নিত। নীলগাছ যে বটগাছের মতো বিরাট হবে না, সেটা একটু চিন্তা করলেই মাথায় আসে...’
কথা শেষ করতে পারল না। তীরবেগে কী যেন ওর কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। বিঁধল গিয়ে সামনের আমগাছটার গুড়িতে। নিজের অজান্তেই আমার মুখ দিয়ে ‘আঁউক’ করে একটা শব্দ বেরিয়ে এলো। এনুমামা বললেন ‘সর্বনাশ!’ তার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন। হতভম্ব হয়ে গেছে সাম্য। এনুমামাই প্রথম এগিয়ে গেলেন। গাছ থেকে টেনে ছাড়িয়ে আনলেন একটা চাকু। ‘ডেগার!’ বিড়বিড় করে বললেন তিনি। ‘বাটের ভেতরে চাকু লুকানো থাকে। সুইচ চাপলে ফটাশ করে বেরিয়ে পড়ে।’
চাকুটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলেন। সাম্য ঘোর কাটিয়ে প্রথম কথা বলল, ‘চাকুটা দেখি মামা।’
এনুমামা চাকুটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। চাকুটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে গিয়ে হঠাৎ কী যেন চোখ পড়ল সাম্যের। বাটের ভেতরের খাঁজ থেকে টেনে বের করল একটা ছোট্ট কাগজ। ভাঁজ খুলে জোরে জোরে পড়লÑ ‘শিঘ্রি এই এলাকা ছাড়ো। নইলে মারবে।’
সাম্য কী যেন ভাবল। তারপর বলল, ‘সন্ধ্যা নামতে এলো, চলুন ফিরে যাই!’
হতভম্ব ভাব কাটানোর চেষ্টা করে ধীর পায়ে এগোলাম ফেরার পথে।
কুঠির ফটক রায়হান পার না হতে সেই লোকটার সাথে আবার দেখা। রিকশার জন্য অপেক্ষা করছেন। ‘কি ফিরে যাচ্ছ? তা এখানে কোনো রহস্য-টহস্যের গন্ধ পেলে নাকি?’
হাসির মুড কারো নেই। তবু সাম্য জোর করে একটু হাসি ফোটানোর চেষ্টা কলে বলল, ‘না, এমনিই এসেছিলাম কুঠি দেখতে।’
একটা রিকশার ক্রিং ক্রিং আওয়াজ আসতেই সেদিকে ঘুরল লোকটা। তারপর পেছন ফিরে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যাই তাড়া আছে। আশা করি, আবার দেখা হবে। বাই।’
রাতে ঘুম এলো অনেক দেরিতে। আমঝুপির ঘটনাটা মনকে অস্থির করে তুলেছে। কেউ আমাদের তাড়াতে চাইছে। হয়তো কবিরাজ মহিলার লোক। কিন্তু কেন? তার যখন অতই অলৌকিক ক্ষমতা, আমাদেরকে ভয় পাবার কী আছে?
চাকুটা কে ছুঁড়েছে এটাই আমার কাছে মস্ত রহস্য। রায়হান নামের ঐ লোকটার ওপর সন্দেহ হচেছ। সাম্যকে জানালাম সে কথা। লোকটার ওপর কিছুটা সন্দেহ আছে ওরও। কিন্তু অন্য কারও হাতও থাকতে পারে বলেও জানালো।

তিন
পরদিনটা অলস কাটবে ভেবেছিলাম। কিন্তু এনুমামা এসে জানালেন মেহেরপুরে সার্কাস চলছে। যাব কিনা জানতে চাইলেন। বহুদিন সার্কাস দেখা হয় না। তাই এককথায় রাজি আমরা।
দ্য রয়্যাল বেঙ্গল সার্কাসের তৃতীয় শো চলছে। একেবারে হাউজফুল। আমাদের আসন ভিআইপি গ্যালারিতে। আমাদের টিকিটের দাম লাগেনি। এনুমামার নাকি বিশেষ পাশের টিকিট আছে। ভেতরে ঢুকে বুঝলাম সার্কাসের কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে দারোয়ান পর্যন্ত সবাই এনুমামাকে চেনে। বেশ খাতির টাতিরও করে। এনুমামা জানালেন, স্বয়ং সার্কাসের মালিক নাকি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তা না হলে এ যুগে কেউ কাউকে পাত্তা দেয়?
সাতাটায় শুরু হলো শো। এথলেটদের চোখ ধাঁধানো সব কসরৎ দেখতে দেখতে কেটে গেল এক ঘন্টা। তারপর হঠাৎ করেই বিদ্যুৎ চলে গেল। গরমকাল, তাই লোডশেডিং খুব সাধারণ ঘটনা। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই গুঞ্জন উঠল কারেন্ট নাকি যায়নি। তারমানে সার্কাসের তাবুর বাইরে সবখানে বিদ্যুৎ আছে। শুধু তাই নয়, হ্যান্ডমাইকে দর্শকদের জানানো হলো সার্কাসের নিজস্ব জেনেরটরও নাকি কাজ করছে না। জেনেরেটর আছে বলে হ্যাজাক লাইটের ব্যবস্থাও করা হয়নি। কোত্থেকে দুটো চার্জার লাইট এনে কোনোমতে অন্ধকার তাড়ানোর চেষ্টা করা হলো। মাইকে দর্শকদের জানানো হলো, আধঘন্টার ভেতরেই সমস্যা সারিয়ে নেয়া যাবে। ততক্ষণ যেন দর্শকরা ধৈর্য ধরে।' অনুরোধও ঘোষিত হলো বারবার। এনুমামা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, 'হে হে হে... তোমরা বসো, বুঝলে কিনা.. আমি একটু ম্যানেজারের সাথে আলাপ করে আসি।' মিনিট দশেক পর ফিরে এলেন হাঁপাতে হাঁপাতে। 'কী সবনার্শ, বুঝলে কিনা..কী সর্বনাশ।'
'কী হয়েছে মামা?' আতঙ্কিত হয়ে বললাম আমি। সাম্যের চেহারাতেও উৎকণ্ঠা।
'কেউ ইচ্ছে করে কারেন্টের মেইন তার কেটেছে। বুঝলে কিনা... ষড়যন্ত্র, সব ষড়যন্ত্র। কেউ একজন চাইছে না এখানে সার্কাসটা চলুক।'
'তাতে কার লাভ?' বিড়বিড় করে সাম্যকে বলতে শুনলাম।
'এখানে কি লাভ খাওয়া লোকের অভাব আছে। বুঝলে কিনা... গুণ্ডা বদমাশদের আড্ডাখানা আমাদের এলাকাটা। কাউকে দেখে বুঝার উপায় নেই, কে শত্র“ কে মিত্র।' একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো এনুমামার বুক চিরে। একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। ফিরে এসে পর্যন্ত এনুমামা একবারও তার বোকামার্কা হাসিটা দেননি। বন্ধুর সার্কাস বন্ধ করা যড়যন্ত্র তাকে ভালোই বিচলিত করেছে।

কথা রেখেছে সাকার্স পার্টি। আধঘন্টার আগেই আবার শুরু হলো শারুদ্ধকর সব খেলা। হাতির ফুটবল । মানুষে-ভালুকে কুস্তি। কুকুরের আগুনঝাঁপ। খাঁচার ভেতর মোটর সাইকেল চালানোর দম বন্ধ করা দৃশ্য। একেবারে শেষ পর্যায়ে শুরু হলো চাকুনিক্ষেপ। তুমুল উত্তেজনার এই খেলাটা আমাকে খুব টানে। সাম্যকেউ। একটা মেয়েকে গোলাকার একটা কাঠের বোর্ডে চার হাত-পা ছড়িয়ে যিশু খ্রিস্টের মতো খাড়া করে কষে বাঁধা হয়। তারপর একটা মোটরের সাহায্যে ঘোরনো হয় মেয়েটাসহ সেই কাঠের বোর্ডকে। তার থেকে দশ বারো হাত দূরে দাঁড় করানো হয় চোখ বাঁধা এক চাকুবাজকে। একে একে তার হাতে তুলে দেয় হয় শ’খানেক চাকু। সে চাকুগুলো ছুঁড়ে মারে হাত-পা বাঁধা মেয়েটাকে লক্ষ্য করে। দর্শকরা দম বন্ধ করে দেখে আর শঙ্কিত হয়, এই বুঝি একটা চাকু মেয়েটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল। কিন্তু চাকুবাজ এতটাই দক্ষ, মেয়েটার সারা দেহের কিনার ঘেঁষে বোর্ডে চাকু গেঁথে যায়। কিন্তু কোনো চাকু তার চুলও স্পর্শ করে না।
খেলাশেষে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে তাবু ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। 'উফ, একেবারেই গিয়েছিলাম।' বেরিয়েই মুখ খুলল সাম্য।
'আমারও একই অবস্থা।' বললাম আমি। কিন্তু এনুমামার মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই। আমাদের কথার রেশ টেনে তিনি বললেন, 'আমার কিন্তু ওসব হয় না। বুঝলে কিনা... এতোবার সার্কাস দেখেছি...' কথা শেষ করতে পারলেন না তিনি।
পেছন থেকে হাঁক এলো, 'এই যে, এনামূল সাহেব!'
ঘুরে দেখি রায়হান নামের সেই লোকটা। 'ছেলেদের নিয়ে সার্কাস দেখতে এসেছিলেন? বেশ বেশ।'
এনুমামার চেহারায় বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। লোকটাকে তিনি পছন্দ করতে পারেননি। তবু ভদ্রতার খাতিরে দু-একটা কথার উত্তর করলেন।
'সাম্য বোধ হয় একটা রহস্য পেয়ে গেছ তাই না?' রায়হান নামের লোকটা জিজ্ঞেস করলেন।
'আমি অবাক! কোন রহস্যের কথা বলছে লোকটা, গতকালের আমঝুপির ঘটনা?' কিন্তু সাম্যের জবাবেই পরিষ্কার হলো ব্যাপারটা।
'কারেন্টের তার কাটা রহস্য?'
লোকটা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।
'দেখুন সার্কাসের ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি এসেছি কবিরাজ দরবেশপুরের কবিরজের অলৌকিক কারবার দেখতে।'
'বেশ ভালো। আমিও একবার যাবো ওখানে। ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং। তো ঠিক আছে আজ আসি, আবার দেখা হবে।' লোকটা বিদায় নিয়ে হারিয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে।
লক্ষ্য করলাম এনুমামার চেহারা থেকে বিরক্তির চিহ্নটা মুছে গেল সাথে সাথে।

আমার বিশ্বাস রায়হান নামের লোকটা সবসময় আমাদের ওপর নজর রাখছে। হয়তো বদ মতলব আছে। এনুমামারাও ধারণাও তাই। শুধু তাই নয়, সার্কাসের কারেন্ট চলে যাওয়ার হোতাও নাকি ওই লোকটা। 'বুঝলে কিনা ...' থমথমে মুখে বললেন এনুমামা। ‘ষড়যন্ত্র! গভীর ষড়যন্ত্র চলছে সার্কাসটা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। তোমাদের দেখে ভড়কে গেছে ষড়যন্ত্রকারীরা তাই এই লোকটাকে লেলিয়ে দিয়েছে আমাদের পেছনে! ভাড়াটে গুণ্ডা বুঝলে কিনা ...'
সাম্য হ্যাঁ না কিছুই বলল না। চুপচাপ গ্রামের ফিরে এলাম। ঘুমানোর আগে সাম্যের সাথে এ বিষয়ে আলাপ করতে চাইলাম। ও একটা কথাও না বলে লাইট নিভিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

চার
'পরের সিরিয়াল কার?' একজনকে বিদায় করে হাঁক শুরু করেছে কবিরাজের সহকারী। রোগিদের ভিড় শামলাতে দুই সহকারীর রীতিমতো ঘাম ছুটে যাচ্ছে। ভিড় ঠেলে কোনোমতে মাথাটা গলিয়ে দিয়ে একনজর দেখলাম মহিলাকে। সত্যি বলতে কী হতাশই হতে হলো আমাকে। ভেবেছিলাম ইয়ামোটা, দশাসই চেহারার কোনো মহিলাকে দেখব। মাথায় জটা চুল, একহাতে সাপের মতো বাঁকা লাঠি, আরেক হাতে তসবিহ থাকবে। কিন্তু একেবারে বাঙ্গালি গৃহস্থ বউয়ের মতো চেহারা। বয়সও বেশি নয়, ত্রিশের আশেপাশে হবে। মাথায় কাপড় দেয়া। আমরা ভিড় ঠেলে সামনে এগোতে যাচ্ছিলাম মুশকো জোয়ান আর তেমনি কালো একটা লোক আমাদের বাধা দিয়ে বলল, 'আপনারা এখনো সিরিয়াল করেননি। আসুন আগে নাম লেখান। সিরয়াল পড়লে আমাদের লোক আপনাদের ডেকে নেবে।'
'বাহ! ডাক্তারের মতো সিরিয়াল করে রোগি দেখতে শুরু করেছে।' মুখ খুলল সাম্য।
এনুমামা তার স্বভাবমতো 'হে হে হে...' করে একচোট হেসে নিয়ে কালো-মোটা লোকটাকে পটানোর চেষ্টা করলেন, 'বুঝলেন কিনা... এরা তো বহুদূর থেকে এসেছে একটু আগের সিরিয়াল যদি করা যেত...'
এনুমামার কথা শেষ করার আগেই কালো লোকটা বলল, 'ওসব ধানাই-পানাই এখানে চলবে না। সিরিয়ালে নাম লেখালে লেখান, তা না হলে পথ মাপুন।'
'নাম লিখিয়ে ফেলা যাক এনুমামা।' বললাম আমি। সাম্যও আমাকে সমর্থন দিল। কিন্তু এনুমামাকে মনে হলো নিমরাজি। ফিসফিস করে বললেন, 'নাÑ মানে- ইয়ে। বুঝলে কিনা...হে হে হে...বেশি দেরি হলে স্টার জলশার টাপুর-টুপুর সিরিজটা মিস হয়ে যাবে।'
'টাপুর-টুপুর! গতরাতে দেখেননি?' বললাম আমি।
'দেখেছি, কিন্তু দিনের বেলা আরেকবার না দেখলে ভালো লাগে না, বুঝলে কিনা... হে হে হে...'
'তাহলে আজ আর দেখতে হবে না। রাতে আবার নতুন পর্ব দেখবেন। তার আগে কবিরাজের ভেলকিটা দেখে নিই, চলুন।'
উঠোনের বড় একটা পেয়ারা গাছের নিচে বসে আমরা সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। ভিড়ের ভেতরে কী বলছে শুনতে পেলাম না। ঘন্টাদুয়েকের মধ্যে ভিড় একেবারেই কমে গেল। তখন ভালো করে দেখার সুযোগ পেলাম। উস্কোখুষ্কো চেহারার এক লোক পাঁচ-সাতমাস বয়সি একটা মেয়ে কোলে নিয়ে কবিরাজ মহিলার সামনে দাঁড়াল। মেয়েটার পেট আতিরিক্ত মোটা। গায়ে জামা নেই, হয়তো রোগির অবস্থা বোঝানোর জন্যই। কিন্তু যিনি মুখ দেখেই সব বলতে পারেন, তাকে রোগির বেহাল দশা দেখানোর কী দরকার ছিল? যাইহোক, মেয়েটার গায়ে মাংস নেই একচিমটিও। বুকের খাঁচার প্রতিটা হাঁড় গোনা যাবে। কবিরাজ লোকটার উদ্দেশ্যে বলল, 'রুগির নাম আছিয়া খাতুন। মায়ের নাম আকলিমা বেগম। বাপের নাম, মানে আপনার নাম আবদুস সামাদ। গ্রাম আমবটতলা, থানা চৌগাছা, জেলা যশোর। তিনবছর ধরে মেয়েটা রিকেটে ভুগছে।'
রোগির বাবা তো হাঁ হয়ে গেছে। হাঁ গেছি আমিও। কিন্তু সাম্য মাথা নিচু করে চুপচাপ কী যেন ভাবছে। শুরু হলো এনুমামার কেবলা কেবলা ঘ্যানঘ্যানানি, 'কী বলেছিলাম না! ব্ল্যাক-ম্যাজিক! বুঝলে কিনা... ওই মহিলা কিন্তু নিজে বলছে না। প্লানচেট করে আগেই বদলোকের আত্মা নামিয়ে রেখেছে, সেই বলে দিচ্ছে।'
সাম্য কথা বলছে না চুপ করেই আছে। আমি বললাম, 'সাম্য! তাহলে সত্যিই প্লানচেট করে আত্মা নামানো যায়?'
'থাম তো! এখনো সত্যি-মিথ্য। বলার সময় হয়নি, ভালো করে দেখে যা।'
আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম সাম্যের কথায় এনুমামা ক্ষুন্ন হলেন, কিন্তু মুখে প্রকাশ করলেন না।
পরের রোগির ডাক পড়ল। বেশ সুঠাম দেহের পরিপাটি এক যুবক সামনে এগিয়ে গেল। এবার কবিরাজ আগের মতো মুখ দেখেই নাম পরিচয় বলতে পারল না। 'এই সবাই চুপ থাকবা, আমি এখন হজুরের সাথে কথা বলব।'
সাথে সাথে দিনের বেলাতেও সেই উঠোনে নেমে এলো ভূতুড়ে নীরবতা। 'হজুর, বলে চেঁচিয়ে উঠল কবিরাজ। তারপর মুখনিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, 'হজুর আছেন?' শুরু হলো অশরীরির সাথে কথপোকথন। তবে আমরা শুনতে পাচ্ছি শুধু কবিরাজের কথা-'বাবা শুনতে পাচ্ছেন?' একটু থেমে আবার, 'সাদা চেক শার্টপরা, পরনে নীল রঙের জিন্স প্যান্ট, রবিনহুডের মতো দাঁড়ি, মাথায় লম্বাচুল...' তারপর কিছুক্ষণ নীরবতা। হঠাৎ মুখ তুলে গড়গড় করে রোগির বৃত্তান্ত এক নিঃশ্বাসে বলে গেল। তার পর এক সহকারীর দিকে ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে এক বোতল পানি নিয়ে, তাতে বিড়বিড় করে পড়ে ধরিয়ে দিল রুগির হাতে। রুগিও হাসিমুখে সেই ধন্বন্তরি নিয়ে ফিরে গেল। তারপর গোটাদশেক রুগির নাম ঠিকানা গড়গড় করে বলে গেল। এলো আমাদের পালা।
আমাদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা- নাম, ঠিকানা মুখস্থ বলে বলে যাওয়া। আমি ক্যান্সারে ভুগছিলাম সে কথা বলে দিল। বলল কীভাবে সুস্থ হলাম সে ঘটনাও। তারপর চোখ মোটা করে সাম্যের দিকে তাকিয়ে বলল, 'তোমার একটা বড়রোগ আছে।' শুনে আঁৎকে উঠলাম আমি, সাম্যের শরীরে কোনো মরণব্যাধী বাসা বেঁধেছে! কিন্তু সাম্যের ভাবান্তর ঘটল না। সাম্যকে না ঘবড়াতে দেখে ভ্রু নাচিয়ে কবিরাজ বলল, 'বিশ্বাস হচ্ছে না?' সন্দেহ বাতিক আছে তোমার। আমাকে বিশ্বাস করছ না তুমি, জ্বিন হুজুরকেও না। সন্দেহ...' কথা শেষ করতে পারল না মহিলা। বেজে উঠল হাতের মোবাইলটা। ফোনটা ডানহাতে রিসিভ করে বাম কানে ধরল। উচ্চৈস্বরে কার সাথে যেন আলাপ সেরে ফিরে এলো আগের প্রসঙ্গে, 'অনেক বড় ব্যাধি, বুঝলে?' এখনো সাবধান হও, নইলে বড় বিপদে পড়বে তোমরা। এমনকী জীবনও চলে যেতে পারে। সন্দেহবশে গ্রান্ডজুলু রহস্য সমাধান করেছ বলে ভেবো না সবজাগায় সেটা কাজে আসবে। সন্দেহ রোগের চিকিৎসা জ্বিনে হুজুর করেন না। আমি বলি কি ঘরের ছেলে ঘরের ফিরে যাও। জ্বিন হুজুরকে রাগিয়ে মায়ের বুক খালি করো না।'
মহিলার কথাগুলো হুমকি না ভয়ঙ্কর কোনো বিপদের ভাবিষ্যদ্বাণী বুঝলাম না। সাম্যকে জানাতেই ওর এক কথার জবাব, 'হুমকি।' কিন্তু কেন জানি হুমকির চেয়ে মহিলার আধ্যাত্মিক শক্তির কথাই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো।
ফেরার সময় দেখি ভিড় আবার জমে উঠেছে। এর মধ্যে চশমাপরা, ক্লিন শেভ করা ভদ্রগোছের এক লোকের সাথে কালো-মোটা ভোম্বল টাইপের আরেক লোকের তর্কযুদ্ধ চলছে। ভ্রদ্রলোক ভোম্বলকে পিংয়ে মোড়ানো একটা প্যাকেট গছাবার জন্য ঝোলাঝুলি করছেন। কিন্তু কালো ভোম্বলটা কিছুতেই নেবে না। কবিরাজ নাকি চিকিৎসা করে কোনো টাকা পয়সা, উপহার ছাদকা নেয় না। শত সাধাসাধি করেও কাজ হলো না। ভদ্রলোক নিরাশ ফিরে যাচ্ছিলেন সাম্য পেছন থেকে হেঁকে তাকে থামালো। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম আমরা। এনুমামাও আছেন পেছনে। 'কিছু মনে কর’ বলে নিজেদের পরিচয় দিয়ে বলল, ‘কারো রোগে ভালো করে দেয়ার জন্য উপহার নিয়ে এসেছিলেন তাই না।'
'হ্যাঁ, কিন্তু কী বিশ্রী ব্যপার হলো একটা। দামি একটা গিফট কিনেছিলাম। এখন এটা হাতে করে ফিরে গেলে গিন্নি রেগেমেগে অস্থির হয়ে উঠবে।' মুখ কাচুমাচ করে বললেন ভদ্রলোক।
'কার অসুখ ছিল?' জিজ্ঞেস করলাম।
'আর বলো না। আমার পিচ্চি একটা মেয়ে আছে। জন্ডিস বাঁধিয়েছিল। ওর মা তো ডাক্তারের ওষুধ খাওয়াবে না। শেষমেশ এখানে এনে ভালো হলো।'
লোকটার বোধহয় তাড়া ছিল। তড়িঘড়ি করে কথাগুলো বলে হনহন করে চলে গেলেন।

পাঁচ
রাতে খাওয়া দাওয়ার শেষে যথারীতি মুখ থমথমে করে বসে আছে সাম্য। মাথায় চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে হয়তো। একের পর রহস্যময় ঘটনা ঘটছে। কী ভাবছে ও জানতে পারলে ভালো হতো। গতরাতে কথা বলার চেষ্টা করে লাভ হয়নি, আজও কি বলবে? কৌতুহল দমন করতে পারলাম না।
'কবিরাজের ব্যাপারটা কী ভাবছিস?'
'ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।' বলল সাম্য। 'আরেক বার যেতে হবে ওখানে। কিন্তু আমাদের এলাকার রোগি রোজ দেখে না। যাই হোক, একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিস?'
'কী?'
মহিলা ফোন রিসিভ করল ডান হাতে অথচ ধরল বামকানে! ব্যাপারটা কেমন কেমন ঠেকছে না? নিশ্চয়ই ডানকানে কোনা সমস্যা আছে।'
'হয়তো!' জবাব দিলাম আমি। 'আর কোনো ব্যাপারে খটকা লাগছে?'
'লাগছে, ঘোমটাটা। সাধারণত এত আঁটোসাটো করে কেউ ঘোমটা মাথায় দেয় না। যত লোকের ভিড় সামলাতে হচ্ছে মাঝে মাঝে ঘোমটা পড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু মহিলার একবারও তা হয়নি। তার মানে, ঘোমটার ব্যাপারে সে অতি সতর্ক। আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করেছিস? ওই যে লোকটা- ভোম্বলমতো লোকটার কাছে কবিরাজের জন্য একটা উপহার সাধছিল। ভোম্বলটা নিল না। লোকটাকে চিনেছিস?'
'না-তো!' অবাক হলাম।
'রায়হান নামের সেই লোকটা। ডিসকভারির সাংবাদিক।'
'বলিস কী! আমি তো চিনতেই পানিনি। তুই পারলি কীভাবে?'
'চোখ দেখে।' জবাব দিল সাম্য।
'রায়হান লোকটা ছায়ার মতো আমাদের পিছু নিয়েছে!'
'হ্যাঁ, এটাও একটা রহস্য। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিস?' প্রশ্নবোধক চোখে সাম্য আমার দিকে তাকালো। তারপর আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই বলল, 'পরশু দিনের চাকু ছুঁড়ে ভয় দেখানোর ব্যাপারটা?'
'আমার মাথায় কিছু আসছে না। তুই কি কিছু আঁচ করতে পেরেছিস?' এবার আমি ওর দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি হানলাম।
'কাজটা যেই করুক সে অতি দক্ষ লোক। এ ধরনের দক্ষ লোক কেবল সার্কাসেই থাকে।'
'মানে!' আবারো চোখ কপালে উঠল আমার। 'মানে তুই বলতে চাচ্ছিস রয়্যাল বেঙ্গল সার্কাসের লোক এটা করেছে?'
'রয়্যাল বেঙ্গলই বলছি না। তবে সন্দেহ করছি সার্কাসের লোকেরই কাজ ওটা।' চেহারা রহস্যময় হয়ে উঠল সাম্যের।
'আমার মাথায় কিন্তু আউলা ঝাউলা হয়ে যাচ্ছে। এলাম কবিরাজের ভেলকি দেখতে এর মধ্যে চলে এলো সার্কাস পার্টি। ব্যাপারটা কি বল তো? দুটোর সাথে কোনো যোগসূত্র আছে?' বোকা চোখে তাকালাম ওর দিকে।
'ব্যাপার তো আমিও বুঝতে পারছি না। তবে যোগসূত্র যে আছে সেটা অনুমান করতে পারছি।'
'কীভাবে?' উত্তরের আশায় সাম্যের দিকে তাকালাম। ও চুপ হয়ে গেছে। চেহারায় আবার সেই থমথমে ভাব। ওর এই চেহারা আমি চিনি। এখন ওর কানের কাছে মাইক বাজালেও কোনো কথা বলবে না। অগত্যা আমাকেও থামতে হলো।

(চলবে)

আগামী পর্বে সমাপ্য

----------------------

আব্দুল গাফফার রনি


মন্তব্য

মরুদ্যান এর ছবি

চলুক পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

ভাল লেগেছে। এখন পর্যন্ত কাহিনী জমজমাট। পরের পর্ব তাড়াতাড়ি চাই।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
এটা প্রথম পাতা থেকে সরলেয় ওটা আসবে

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

তারানা_শব্দ এর ছবি

পরের পর্বের অপেক্ষায় ইটা রাইখ্যা গেলাম...

"মান্ধাতারই আমল থেকে চলে আসছে এমনি রকম-
তোমারি কি এমন ভাগ্য বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!
মনেরে আজ কহ যে,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক-
সত্যেরে লও সহজে।"

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

অ্যাঁ
ইটের সাইজ দেখে তো ডর লাগেরে ভাই!

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

অতিথি লেখক এর ছবি

আগামী পর্বের জন্য পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

কড়িকাঠুরে

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আশা করি বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না।

তারেক অণু এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম চলুক পরের পর্ব ছাড়ুন দাদা!

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

দাদাঠাকুর, আমি ছাড়তে চাইলেও সচল তো তা হতে দিচ্ছে না!
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ- প্রথম পাতায় একধিক লেখা পোস্ট করতে নিরুৎসাহিত করা হয়!

সাফি এর ছবি

নিবন্ধিত সদস্যদের অতিথি হিসেবে কমেন্ট করাও নিরুৎসাহিত করা হয় বস, এবং অনেক সময়েই যতদূর জানি সেই কমেন্ট ছাড়া হয়না। এটা খেয়াল রেখেন। নইলে দু`দিন পরে লোকে দেখবেন আপনার নামে অতিথি একাউন্ট থেকে উল্টোপাল্টা কমেন্ট করছে। ঃ)

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ধন্যবাদ সাফি ভাই, দারুন একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে দিয়েছেন তো থ্রিল অনুভব করছি।
সাফি ভাই, আমার অন্য লেখার লিঙ্কগুলি দিলাম-
কুরবানীর হজ্ব
জামিল ও অদৃশ্যমানব
ডোম ও টিয়াপাখি
অন্য পৃথিবী

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

সাফি এর ছবি

মজা লাগছে। পরের পর্ব দেন। ঘোমটার ক্লু থেকে মনে হচ্ছে মহিলার কানে ইয়ারফোন থাকতে পারে।

আগের লেখাগুলো একাউন্টে আনার ব্যাপারে কন্ট্যাক্ট থেকে উত্তর না পেলে আরেকবার ইমেইল করে দেখতে পারেন।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ধন্যবাদ সাফি ভাই, সচলে আবারো ই-মেইল করেছিলাম, এখনো পর্যন্ত সাড়া পাইনি।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।