সীমান্তরেখা-৩

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: বুধ, ০৩/১০/২০১২ - ৮:০১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সীমান্তরেখা-১
সীমান্তরেখা-২
তৃতীয় অধ্যয়
সবেদ আলির মনে বেশ ফুর্তি ফুর্তি ভাব। সেদিনের মেঘলায় পাঁচু মাঝি দুপুরে ঘুমের আলস্যে পরাজিত হয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়লেও পরদিন রেহায় দেয়নি ব্লাক মার্কেটরা। শুধু ব্ল্যাক মার্কেটই বা কেন, মেঘের অবগুণ্ঠন সরানো সূর্যের সোনাঝরা রোদে ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল সবেদ আলি-হাবুডাগাদের গোত্রীয় মাথামুটের অন্নাভাবে মলিন মুখগুলোও। সেই ঝিলিকের চিহ্ন এখনো লেগে আছে সবেদ আলির চেহারায়। কিন্তু বউটার মন খারাপ নাকি শরীর খারাপ সেটা ঠাহর করে ওঠা তার জন্য পর্বত-লঙ্ঘনের মতো দুরাতিক্রম্য চ্যালেঞ্জ। একবার ভাবে জিজ্ঞেস করবে, পরক্ষণে একপশলা অভিমান এসে ভর করে মনে। খুব যে নতুন তাও নয়, নয় নয় করে ছয় মাস পার হলো, এই বয়সী দম্পতিরা কত আমোদ-আহ্লাদ করে, কিন্তু হুরমতি সেসবের ধার ধারে না। অথচ মুখরা রমনী সে।

তার সাথে কথ কম বললেও বাংলাদেশের শাশুড়ি ননদের সাথে কুলবধূর যে বৈরিতা, তার অবশ্য ব্যতয় ঘঠেনি সবেদ আলির ঘরে। নতুন বাড়িতে এসেই শুরুতেই নিজের অস্তিত্বের ঘোষণা করতে সময় নেয়নি এক সপ্তাহ। আচার-ব্যবহারে এক মাসের ভেতর বুঝিয়ে দিয়েছে নবাজাদীরা এতোদিন পায়ের পা তুলে সংসারের ছড়ি ঘুরিয়েছ সেটি অন্তত আর হচ্ছে না। ছ’মাসের ভেতর পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে হয় কাজ করবে নইলে এ বাড়ির অন্নের আশা ত্যাগ করো। বিশেষ করে সবেদের সরু কাঁধের সওয়ারী আছিয়া হাড়ে হাড়ে তিন বছর পর অনুভব করছে নিজ সংসারের অভাবটা। ছেলের বিয়ের দিন ধার্য হলে মা অবশ্য ভেবেছিল নতুন বউ ঘরে এলে তার তার একটু শোয়া-বসার ফুসরৎ মিলবে। চাইলে হয়তো স্বরূপপুর কিংবা গাড়াপোতায় ভাইয়ের বাড়ি বোনের বাড়ি থেকে কুটুম্বিতের সাধটাও পূরণ হবে। কতইবা দূর হবে স্বরূপপুর- তিন মাইল, গাড়াপোতা পাঁচ। আছিয়াকে সাথে নিয়ে পায়ে হেঁটেই চলে যেতে পারবে। বছর দশেক তো হবেই বাপের বাড়ির পানি পেটে পড়েনি, পড়াবার সময়ই নেই। ভাইদের সংসারেও তো কাজের বোঝা কম নয়। তা তারা যদি একবারটি বোনের মুখ দেখবার ফুসরৎ না পায় তাদের অবশ্য খুব বেশি দোষ দেয়া যায় না। যত অভিমান তার ছোট বোনটার ওপরে, হয়েছেই না হয় বড়লোকের বউ, তাই বলে মায়ের পেটের বোনকে একবার খোঁজ নিবি না। তা না নিক, সে নিজেই এবার বোনের বাড়ি গিয়ে তাদের চমকে দেবে। কিন্তু তার সেই আশা হতাশায় পরিণত করে কোন দূর জগতের স্বপ্ন করে তুলেছে হতচ্ছাড়ী বউটা। ছেলেটাও যেমন! মেড়ার দলের শেষ ভেড়া। বউ পাগলা ঘরকুনো অবশ্য তাকে বলা যায় না। তবে মা-বোনের পক্ষ নিয়ে বউকে দু-চার ঘা বসিয়ে দিলেই বা কার কী যায় আসে! ঘা-এর কথায় বা আসে কেন, বউকে চড়া গলায় দু-চার কথা যে বলবে সে সাহসটুকুও নেই বীরপুরুষের!
স্বামীটা যে আস্ত বলদ সে কথা প্রকাশ না করলেও মনে মনে স্বীকার করে হুরমতি। নইলে ষাড়ের মতো বোনটাকে ঘরে বসিয়ে খাওয়ায়! কত রাঢ় মাগিরা তো কাপড়-চোপড়ের ব্ল্যাক করে। বাল-বাচ্চা নিয়ে দিব্যি চলে যায় তাদের সংসার। তুইও না হয় করলি, ভাইয়ের ঘাড়টা একটু হালকা হল, কিন্তু মাগীর মান সম্মানের নাকি টানাটানি হবে! স্বামীকে বশ করতে পারে না, তার আবার ইজ্জত ধুলোয় লুটানোর ভয়! বলদ স্বামীটার তো বটেই কুটনি বুড়িটার আস্কারাও এতে কম নয়।
অভিমান বেশিক্ষণ জিইয়ে রাখতে পারে না সবেদ আালি। হুরমতি চোখ মুখ বিকৃত করে কেমন জানি করছে। চেহারায় অসুস্থতার লক্ষণ। সবেদ আলি অভিমান ভরা আবেগ দূরে ঠেলে মুখ খোলে, ‘তুমার শরীলডা কি খারাপ? জ্বর আসবে?’
মুখে জবাব দেয় না হুরমতি। চোখ-মুখ কুঁচড়ে, কুঁচকে আরো বেশি বিকৃত করে ফেলে চেহারা। অবশেষে বাধ মানে না কণ্ঠনালি। ‘ওয়াক ওয়াক’ শব্দ বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে। মুখ চেপে ধরে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। দাওয়ার খুঁটি চেপে ধরে ভেতর থেকে উগরে দেয় আকালের বাজারের দুর্মূল্যের ভাত। কিছুটা হতভম্ব কিছুটা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বেরিয়ে আসে সবেদ আলি। হাতে টোপ খাওয়া দোমাড়ানো স্টিলের জগ। বউয়ের মাথায় পরম মমতায় পানি ঢালে।
হুরমতির দুর্বল দেহটাকে ধরে ঘরের ভেতরে ছয়টা খুঁটির ওপর কাঠের চৌকির মতো করে পাতা বাঁশের মাচাটার ওপর বসায় সাবধানে। ক্ষীণ একটা হাসির রেখা ফুটে ওঠে হুরমতির কালচে ঠোঁটে। বিদ্রুপের হাসি তো নয়ই, বরং নিজের দারিদ্র্য-দুর্বলতাকে পাশ কাটিয়ে আরেকটি সত্ত্বার জয়গান মাখা আছে সেই হাসিতে। সবেদ আলি চমকে ওঠে! বিস্ময়ে, আনন্দে।
সবেদ আলি মনে মনে অঁকে দূরাগত এক স্বপ্নের ছবি। ছোট্ট একটা বাড়ি একটা ঘরের ছবি। ঘরের কাঠামো একই- মেটে দেয়ালের মাথায় গমের নাড়ার ছাউনি। কিন্তু সেই ঘর এই ঘরের মতো ঝুলে ভরা নয়, আড়মাচা থেকে নেমে আসা ময়লা চিটচিটে পোশাক ঝুলানো আড়া নেই সেই ঘরে। বাঁশের মাচানের বদলে কাঁঠাল কিংবা সেগুন কাঠের মজবুত চৌকি। একটা আলামারী- কাচের না হোক, কাঠের পাল্লা হলেও চলবে সেই আলমারীর। তাতে ছেলে-বৌমার নতুন পোশাক যেমন থাকবে, সবেদের সাদা রংয়ের পাঞ্জাবি, কিংবা হুরমতির একঢালা তোলা শাড়িটাও থাকবে। ভাঁজকরা। ভাঁজের ফাঁকে ফাঁকে সাদা ন্যাপথলিন। ঈদ-পাবর্নে সেই পোশাক যখন ওর কিংবা হুরমতির গাত্রোত্থান হবে তখন আতরের সাথে ন্যাপথলিনের মাতাল করা সুবাসে প্রাণ ভরে শ্বাস নেবে সবেদ আলি। ম্যাট্টিক পাশ করাতে না পারুক ছেলেকে অন্তত প্রাইমারির গ-িটা যে করেই হোক পার করাবে। পারলে দুই-এক বিঘে জমিও কিনে দেবে যাতে পরের ব্লাকের মাল টানতে না হয় কিংবা ব্ল্যাক মার্কেটের তকমা গায়ে চাপতে না হয়।
‘কী হলো, কী ভাবছে?’ অবশেষে মুখ খোলে হুরমতি। সে এখন অনেকটাই সুস্থ।
‘না, কিছু নাই, এমনিই...’
‘অনেক রাইত হ্যৈলো ঘুমোও।’ বলে বিছানাপত্র ঠিক করে ফু দিয়ে ল্যাম্প নিভিয়ে দেয় হুরমতি।
ঘর অন্ধকারে ছেয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই সেই রক্ত হিম করা চিৎকার। দেড়েদের বটতলার দিকে। ভয়ে কেঁপে ওঠে হুরমতি। কাঁপন ধরে সবেদ আলির বুকেই। কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে ভয়টা নিজের ভেতর চাপা দিয়ে রাখে। বুকে থুতু দিয়ে জোরে ‘লাইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা...’ পড়ে কয়েকবার। ওই, ওই! আবার ডেকে উঠল অতৃপ্ত আত্মাটা। সাথে তুমুল হুটোপুটি।

দেড়েদের বাড়িতে খুব তোড়জোড় চলছে। স্বভাবতই দৌড়াদৌড়িটা বেশি পুরাতনভৃত্য ফজলে কানারই। বড় মোরগটা তাড়িয়ে ধরো, ছুরিটা বালি দাও, হাসেম আলির বাপের কাছ থেকে মুরগিটা জবাই দিয়ে নিয়ে এসো....।
আরো আছে- বাজারে যাও- আদা গরম মসলা কিনে আনো, গাছ থেকে দুটো বড় দেখে ঝুনো নারকেল পাড়ো, নারকেল টা ভাঙো, মাঠে গিয়ে দেড়েকে খবর দাও ইত্যাদি।
ঝামেলা নবীজান বিবিরও কম যাচ্ছে, কাজের মেয়ে যত কাজেরই হোক শেষ মেষ রান্নাটা তো তাকেই করতে হবে। স্বাদের ক্ষেত্রে কোনো আপোশ চলবে না মোজাম দেড়ের সাথে। একটু এদিক হলেই তাঁর বাজখাঁই গলার আওয়াজে পাড়া মাথায় উঠবে। তবে কিনা আজ তাঁর ভাই এসেছেন, তাই হয়তো চিল্লাচিল্লি বেশি হবে না, তবে ভাইয়ের প্রস্থানের পর রক্তপাত ঘটার সম্ভবনাকে উড়িয়ে দিতে পারে না নবীজান বিবি। তাই আজ একটু বেশিই সর্তক সে। তাছাড়া রবিওল ম-লকেও সে নিজেও খুব ভক্তি করে। বয়সে যত ছোটই হোক বড় ভাইায়ের চার নম্বর বিবিকে মাতৃস্থানীয় মর্যাদায় দেখেন রবিওল ম-ল।
মোজাম দেড়েদের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে দুই প্রান্তিকজন পৃথিবীর আলো-বাতাসে শ্বাস নিচ্ছেন স্বাচ্ছন্দে। দুই আর চার নম্বর বিগত হয়েছেন কোনো উত্তরাধিকার না রেখেই। তৃতীয় জনের মৃত্যুর দ্বিতীয় বার্ষিকী চলছে। আট ছেলে আর দুই মেয়ে এবং তাদের সন্তান সন্ততি নিয়ে রবিওল ম-লের বিরাট সংসার বদ্যিনাথপুর গ্রামে। সেজো জনের উত্তরাধিকারদের বাসও সেখানে। ছোটবোনটাও তার একমাত্র পুত্রকে নিয়ে সে গ্রামেই বাস উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। এখানে শুধু মোজাম দেড়ে আর তার পাঁচ ছেলে-নাতিপুতিদের বিরাট এক একান্নবর্তী সংসার। অবশ্য এক চাচাতো ভাইও রয়ে গেছে এখানে। একেবারে ঘনিষ্ট থেকে দুঃসম্পর্কীয়- মোজাম দেড়ের বাকি ভাইবোনেদের বাসও বদ্যিনাথপুর। অবশ্য প্রথমে সবাই শ্যামকুড়েই প্রথম ঠিকানা বেছে নিয়েছিল। কিন্তু পরে ভেবেছে, যে মসুলিম রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বাড়াতে জন্মভূমি থেকে নির্বাসিত হওয়া, যে হিন্দুদের সাথে কোন্দলে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখা, সেই স্বপই যখন বাস্তবায়ীত হয়েছে তবে আর সীমান্তে বাস করে হিন্দুদের প্রতিবেশী হয়ে থাকা কেন? উঠতে বসতে যদি নমো-শুদ্রদের মুখ দেখতেই হলো তাহলে পাভূমিতে আসা কেন? এই দর্শন থেকে তারা পনেরো মাইল দূরে কুষ্টিয়ার বদ্যিনাথপুর গ্রামে বসবাস শুরু করে।
ঝকঝকে কাঁসার বদনায় ভরে বারান্দায় পানি দিয়ে যায় নবিজান বিবি। দেবরকে বলে, ‘ছোট মিঁয়া এতদূর সাইকেল চেইলে এয়োচো, এখন হাতমুখ ধুয়ে বিছেনে গড়া দ্যাও। তুমার ভাই মাটে গিয়েছে এখনি এলো বলে।’
‘আচ্ছা ভাবি,’ রবিওল ম-ল ইতস্ততবোধ করে বলে, ‘হঠাৎ বড়্ ভাই ডাকলে কেনো বলো তো? কোনো সমস্য?’
‘সিডা তুমার ভাই’র মুখ থেকেই শুইনো।’ রহস্যময় একটা হাসি ফুটিয়ে বলল নবিজান বিবি।
‘রবিওল এয়েছে নাকি?’ তাদের কথা শেষ না হতেই পায়ে এক দঙ্গল কাদা জড়িয়ে বাড়ি ঢুকলেন মোজাম দেড়ে।
‘হ্যাঁ বড়্ভাই আলাম তো। পথে যে কাদা। সাইকেল নড়তিই চায় না।’
‘যাক ভালো হৈল। আমি আবার দক্ষিণ মাঠে একপাক দবো। জনেরা পাট কাটছে। কেউ না থাকলিই শালাইনরা ফাঁকি দেয়। আইলে বসে বিড়ি টানবে। তুই খাওয়া-দাওয়া করে নে। আমি ঘুরে আসি। রাতি কথা হবানি।’
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর গল্পে মশগুল দুই ভাই। নবিজান বিবি মিলের পাটি বিছিয়ে মেঝেয় বসে দু’ভাইয়ের গল্প শুনছেন। মাঝে মাঝে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছেন। মাঝে মাঝে দেবরের কাছে স্বামীর ছোটখাঠো ত্রুটির নালিশ। মোজাম দেড়ে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিেিচ্ছন নবীজান বিবির সেইসব অভিযোগ।
কত কথা কত স্মৃতি, বিশেষ করে পশ্চিবঙ্গবাসের স্মৃতি। বাবা-দাদার ভিটে ছেড়ে এ বাংলায় পাড়ি জমানোটা আদৌ ঠিক ছিল কিনা, হতাশার দীর্ঘশ্বাস, সাফল্যের ঢেকুর তোলা- সব থাকল সেই আলোচনায়। বড় বিবির জেষ্ঠ্য পুত্রকে নিয়ে আতঙ্কের বহিঃপ্রকাশ দীর্ঘ সংগ্রাম পাড়ি দেয়া কুঁচকানো মুখম-লে ভীতির রেখা এঁকে দিয়েছে মোজাম দেড়ের। ‘বড়টা দিন দিন রাক্ষস হইয়ে উঠেছে রে রবিওল। আমার সম্পত্তি তো খেয়েছেই, শগুনির মতো নজর দিয়ে চলেছে ছোটদের যেটুকু আছে সে দিকিও। উত্তর মাঠের বিশ বিঘে জমি, খাজনা দিয়ার নাম কইরে লিখে নেলে। আমার তো চোখ নেই। কী করব বল, না বুঝে সই দিয়ে দিইছি। আবার জাল দলিল করেও আরো পঁঞ্চাশ বিঘে হেইতে নিয়েছে। বুঝে উঠতি পারছি নে কী করব। তুই আমার বুদ্ধি দে তো।’
‘বড়্ ভাই, এট্টা কথা জিজ্ঞেস করব,’ রবিওল ম-লের কণ্ঠে দ্বিধা। মোজাম দেড়ের অবয়ব থেকে সবুজ সংকতে পেয়ে প্রশ্নটা প্রসব করলেন তিনি, ‘ক বিঘে জমি এখন তুমার হাতে আচে?’
‘মোটে পঞ্চাশ।’ মোজাম দেড়ের সংক্ষিপ্ত জবাব।
‘আমি বলি কি ত্রিশ বিঘে তুমি ছোট ভাবি আর দুই ছেলের নামে লিখে দ্যাও। রহীমার নামে কিছু আছে?’
‘না। ওর আবার কী দবো বিয়ের সময় তো কম দিইনি। তাছাড়া ও আমার বাপ বলেই মানে না!’
‘মানুক আর না মানুক তবু সে তুমার সন্তান। বাপ বইলে মানে না সেজন্যি কি তুমি দায়ি নাই? ভেবে দেখো ওর মা মরার পর থেকে কদিন খোঁজ নিয়েছো। ঈদ-পার্বনে নতুন জামা কাপড়ের মুখও দেখেনি বেচারা। বড়লোক বাপের সন্তান হয়ে গরীব মামুর ঘরে চাকরানীর মতো বড় হয়েছে। তুমি তুমার দায়িত্ব পালন করোনি। এখন শেষ দায়িত্বডাও যদি পালন না করে তুমার মরণ হয়, ওর অভিশাপ থেইকে রেহায় পাবা, ভেবে দেখো?’
‘কী আর ভাববো রে রবিওল,’ সারা জীবন কলুর ঘানি টেনে শ্রান্ত বলদের মতো দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন মোজাম দেড়ে। ‘পাপ তো আমি কম করিনি। পাপ-অভিশাপের হিসাব করতি গেলি রাইত পুইয়ে যাবে, তবু হিসাব মেলবে না। এখন বল কী উপায় করি? রহীমার বরডা আস্ত কুলাঙ্গারণ। ওর বাপেরও ট্যাকা-কড়ি কম ছিল না। হারামীর বাইচ্চা সিদ্দি খেয়ে সব উইড়েচে। আমি কিচু দিলি সিডা ফুরোতি বছর ঘোরবে না। যাক ওর কথা পরে ভাবা যাবে, এদের নিয়ে একন কী করা যায় বুদ্দি দে।’
‘জমি জায়গার ব্যাপারে ভদুর সাথে আলাপ করো। ও এসব ব্যাপার বেশ ভালো বোঝো । আর বড় খোকারও একটু শিকতি বলো। তুমি আর কদ্দিন? চোখ বুজলিই সংসারের হাল ধইরতে হবে ওর।’
‘ও হাল ধরবে? একেবারে বাউত্তারার একশেষ হয়েছে। লিখাপড়াও চালালে না। কী ভালো ছাত্র ছিল! চালচলনডা এট্টু ভালো হলিই আমার ভবিষ্যতে বড় চাকরি বাকরি করতি পাইরতো। দিন দিন উচ্ছন্নে যাচ্ছে ছোড়াডা- আজ এর মেয়ে নিয়ে গুঞ্জন কাইল ওর মেয়ে নিয়ে ফিসফিস!’
নবীজান বিবি এতক্ষণ দুই ভাইয়ের গল্প চুপচাপ শুনছিলেন, তাঁর বড় পুত্রধনকে নিয়ে টিটকিরি শুনে আর চুপ থাকতে পারল না। ‘এখন ছেলের দোষ দ্যাও কেন? ও তো বংশের ধারা। বাপ যা করেছে, করছে ছেলেও তাই করছে, করবে- এ আর অশ্চর্য কী! শুধুই কি আমার ছেলের দোষ, পাড়ার ঢিঙ্গি মেয়েরাও কম ত্যান্দড় নাই!’
‘থাক থাক অত আর ছেলের গুণপনার দরাকার নেই। তোমর লাই পেয়েই তো দিন রসাতলে যাচ্ছে ছেলেডা।’
‘রসাতলে যাচ্ছে তো চুপ কইরে বসে আচো কেন, বিয়ে দিলিই পারো। দু’টো মেয়েই তো কবরে গেল। ছেলেডার বিয়ে দিয়ে বউ ঘরে আনলিই আমার বুক জুড়োয়।’ টলমল চোখদুটো অঝর ধারায় ভাসবার আগেই শাড়ির আচলে মুখটা আড়াল করলেন নবীজান বিবি।
বড় শক্ত মনের মানুষ নবীজান বিবি। কত উত্থান পতন দেখেছেন চল্লিশ বছরের জীবনে। বড়লোক বাপের প্রথম কন্যা থেকে রাতারাতি হয়ে হয়ে গেলেন ভিক্ষুকের মেয়ে। তারপর কুমল্লিার ভিটেবাড়িটা হারিয়ে ঝিনাইদহের কাছে হাটগোপালপুর। ছেলেবেলার বেশিরভাগ স্মৃতিই তার সেখানকার। তারপর নানা জায়গাঘুরে অবশেষে এই শ্যামকুড়ে। এখানেও মাথা গোঁজার ঠাঁই রহীম বক্সের হতো না হয়তো। সময়মতো মোজাম দেড়ের সহানুভূতির হাত তার মাথায় পড়েছিল বলে রক্ষা। কিন্তু যে হাত ত্রাতা হয়ে মাথার ওপর ছায়া বিছিয়ে দেয়, সেই হাত যদি ভিক্ষুকের মতো কিছু চায় তাকে তো আর ফিরিয়ে দেয়া যায় না। রহীম বক্সও মোজাম দেড়েকে ফিরিয়ে দিতে পারেনি। নিজের রূপবতী মেয়েকে কলেমা পড়িয়ে সমর্পন করেছিল নিজের চেয়েও অনেক বয়সী মোজাম দেড়েকে।
বাপের সরলতার জন্য অনেক দুঃখ আছে নবীজান বিবির মনে। তবু বাপকে কখনো দোষারোপ করতে করতে না। এতো ভালোমানুষ একালে আর কাকে দেখেছে সে। তাই শত বোকামীর দ- সহ্য করেও বাপের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই তার। বরং সুযোগ পেলেই বাপের সরলতা, সততা, ভালোমানুষীর বিবরণ তুলে ধরে কাছের মানুষদের কাছে। একই বছরে ছোট মেয়েটার যন্ত্রণাকাতর মৃত্যু, বড় মেয়ের আত্মহনন আর বাবার ধুকে ধুকে মরার শোক জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে তার বুকে। ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারে না তাদের। এই উঠোনের তিন মাথায় লাগানো তিনটে নারকেল গাছ নারকেল দিতে শুরু করেছে, সেই নারকেল ভেঙ্গে যখন পিঠা-পায়েশ রাঁধতে হয় তখন বুকটার ভেতের হু হু করে কেঁদে ওঠে। ঘরে সানসেডের পাটের ওপর তোলা বাক্স খুলতে ভয় পান ছোট্ট মেয়েটার রঙ্গিন জামাকাপড়গুলোর মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে। ছাদের বর্গাকাঠ থেকে ঝুলানো লম্বা শিকেয় এখনো তেমনিভাবে সাজানো খেলনা বাসন-কোসনগুলো। ঘরের ওপশাটয় যেতেও আতঙ্ক অনুভব করে। মাঝে মাঝে অবশ্য মেয়েদের অনস্তিত্বের কথা মনে থাকে না। ভাবেন এই বুঝি পাগলীটা স্কুল থেকে ফিরে বলবে, ‘মা আমার হাড়িটা-কড়াটা পেইড়ে দ্যাও তো। ঝরনাদের বাড়িতে চড়–ইভাতি আছে।’ ভূল ভাঙ্গতে মুহূর্তকালের অবকাশের দরকার হয় না। যুগ যুগ ধরে সূর্যের লেলিহানে দগ্ধ হওয়া মরুভূমির মতো হাহাকার করে ওঠে নবীজানের মাতৃত্ব। বাপের জন্যও মনটা কেমন কেমন করে ওঠে। আহা বেচারা, ভাতের কষ্ট করতে করতেই অর্ধেক জীবন পার করে শেষ জীবনেও অনাহার-অর্ধাহার তাকে ছায়ার মতো পিছু ধাওয়া করেছে। বড়লোক জামাই- ইচ্ছে করলে রহীম বক্সের গোটা পরিবারের দায়িত্ব নিলেও তার ভাড়ারে টান পড়ত না। কিন্তু তার বদলে সাফ কথা, ‘দু বিঘে জমি রেষ্ট্রি কইরে নিকে করিছি। ঘটে বুদ্ধি থাকলি ওতেই কারো ভাতের অভাব থাকার কথা নয়। যে নিজের ভাগ্য ফিরাতি পারে না, তার জন্যি আমার দেলে দয়ামায়া নেই। এ বাড়ির ভাত শিয়াল-শগুনি খাবে তবু বাপের বাড়ি পাঠাতি পারবা না। আমার চৌদ্দ পুরুষের কেউই শ্বশুর বাড়ি ন্যাওটা ছিল না। আমিও পারবা না। তাছাড়া সমাজে আমার এট্টা সনমান আছে। তুমার বাপ-ভাইদের বইলো সেদিকিটা যেন খিয়াল রাখে।’
তা জামাইয়ের সম্মান রাখার চেষ্টা করেছিল বটে রহীম বক্স। শুধু একদিকে নয় কত দিকে যে তার নজর রেখে চলতে হত। অন্যের ক্ষেতে কাজ করতে গেলে জামাইয়ের সম্মানে লাগে, নদী জলাশয়ে মাছ ধরতে গেলে পাড়া প্রতিবেশীরা ছি ছি করে- ‘ওই দেখো, মোজাম দেড়ে বিয়ে করেছে বটে একখান, একে তো ত্রিপুরা, তার ওপর আবার মালোর দলে যোগ দিয়েছে।’ তো এতসব দিকে খেয়াল রেখে চলতে গিয়ে রহীম বক্সের চুলোয় যে আগুন জ্বলত না সেটা অনুমান করতে কসরৎ করতে হয় না নবীজান বিবির। স্বামীর চোখ রাঙানি এড়িয়ে প্রতিবেশীদের পাখির চোখ ফাঁকি দিয়ে আঁচলের তলায় লুকিয়ে রাতের অন্ধকারে মাকে চারটে চাল কিংবা দুটো বেগুন দিয়ে আসে। বড়রা না হয় যা-তা করে দিন গুজরান করে, কিন্তু নাবালক ভাই-বোনেদের কষ্ট সয় না নবীজান বিবির।
শেষ দিকে এসে রহীম বক্সও ক্ষুধার তাড়নায় জামাইয়ের মান-সম্মানের মাথা খেয়ে বসেছিল। যেচে এসে মেয়ের সংসারের কাজ করে দিত। জামাই-নাতিরা একটু আড়াল হলে, কাজের লোকগুলো মাঠে চলে গেলে হাত-পা ধুয়ে এসে বলত, ‘দে মা চারডি ভাত দে, বড্ড ভুখ পাইছি।’ বাপের এই পরিবর্তনে অবাক হয়নি নবীজান বিবি। বুঝতে পেরেছিল ওপারের ডাক তার বাপের দুয়ারে কড়া নাড়ছে।
অঞ্চলাবৃত বদনটা কেঁপে কেঁপে ওঠে নবীজান বিবির। শত চেষ্টা করেও ফুঁপানির শব্দটা অপ্রকাশিত রাখতে পারে না। মুখে কাপড় চেপে রেখেই ঘর থেকে উঠে যায়। মোজাম দেড়ে এ দৃশ্যের সাথে পরিচিত। কিন্তু রবিওল ম-ল হকচকিত হয়ে পড়ে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় ভাইয়ের মুখের দিকে।
‘ন-মাসের মদ্যি দু-দুটো মেয়ে গেলে, বাপটা গেল। একটা মানুষ আর কত সহ্য করতে পারে রে রবিওল!’ দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মোজাম দেড়ের বুক চিঁরে। ‘ও তবু কেন্দে কেটে, বউ-নাতিদের কাছে দু’চারটে কথা কয়ে নিজে হালকা হতি পারে। আমার বকু ফেটে যায়, কেউরির সাথে বলতিও পারি নে সইতিও পারি নে। আহা, সুনার টুকরো মেয়ে দুটো!’ আবার একটা গরম দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ছড়িয়ে দেন মোজাম দেড়ে।
রবিওল ম-ল কী বলবেন, কী বলা উচিৎ ভেবে পান না। অথর্বের মতো ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকেন। নিজেকে সামলে নিতে দেরি হয় না মোজাম দেড়ের। ‘রবিওল তাড়াতাড়ি ছেলেডার বিয়ের ব্যবস্থা কর। না হলি আরেকটা কবর খুঁড়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে যায় রবিওল ম-লের। ‘দেখি জালালের বইলে। ওর তো ছাত্র ছাত্রী কম নাই!’
‘অত চিন্তা তোর করা লাগবে না রবিওল, আমি এট্টা মেয়ের সন্ধান পেইচি। কাঁটাপোল গ্রামে।’
‘কার মেয়ে?’ রবিওল ম-ল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে জেষ্ঠ্যের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
‘ফতে আলী ম-লের চিনিস?’
‘ফতে আলী! চেনব না কেন বড়্ভাই, সে আমার বন্ধু মানুষ। শুধু আমি কেন দশগ্রামের লোকে তার চেনে। এলাকার শালিশ বিচার তো সেই করে। তা তার মেয়ে যদি হয় তবে বলব বড়্ভাই, দু’বার চিন্তা আর কইরো না।’
‘তুই জালালের বলে মেয়েটার ভালো করে খোঁজ খবর নে। আমি দেখি সামনে মাসে একবার যাতি পারি কিনা।’

দুই ভাইয়ের আলাপ গড়াল গভীর রাত পর্যন্ত। মোজাম দেড়ে উঠি উঠি ভাব করছেন। এমন সময় বাইরে থেকে একটা গোলোযোগ কানে এলো। তিন ব্যাটারির এভারেডি টর্চটা জ্বালিয়ে জানালা গলিয়ে আলো ফেললেন বাড়ির পেছনে বাতাবী লেবু গাছটার নিচে, সারগর্তে। ‘কিডা? কিডা?’ দুটো মৃদুস্বর ভেসে গেল পরপর। তাদের উত্তর দেয়ার দরকার হলো না- টর্চের আলোয় মোজাম দেড়ে পরিষ্কার দেখতে পেলেন, খাকি পোশাক পরা চার মূর্তি তাঁর সারগাদা তছনছ করছে। তিনি নিশ্চিত হয়ে টর্চ নিভিয়ে দিলেন, রবিওল ম-ল প্রশ্ন করার আগেই তাঁর জবাব, ‘বিডিআর বোধহয়, কেউ ব্লাকের মাল টাল রেখে গিয়েচে হয়তো- তা-ই খোঁজছে।’
কিন্তু নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাতে যেতে পারলেন না মোজাম দেড়ে। সদর দরজার গাল্লায় ধাক্কাধাক্কির শব্দ কানে এলো। সেই সাথে কেউ একজন চেঁচিয়ে বলছেন, ‘চাচা দরজা খোলেন! দরজাটা খোলেন!... আমরা বিডিআরের লোক।’


মন্তব্য

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

চালায় যান।

সময়ের অভাবে পড়তে পারলাম না।
পরে, পড়ব নে।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।