আড়িয়ল বিলের মাঝি

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি
লিখেছেন আব্দুল গাফফার রনি [অতিথি] (তারিখ: মঙ্গল, ২৭/০১/২০১৫ - ৭:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

DSC00398
ছোটবেলায় বেলায় মাঝি বলতে একজনকেই চিনতাম। নারাণ মাঝি। ওঁর বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার হাঁসখালি থানার পাখিওড়া গ্রামে। আসলে পাখিওড়া আর আমাদের গ্রাম পাশাপাশি। সেকালে কাঁটাতার ছিল না। চোরাচালান ছিল অবাধ। নারাণ মাঝিই চোরাচালানিদের ‘সবে ধন নীলমনি’। তাছাড়া পাশাপাশি গ্রাম, গাঁয়ের বেশিরভাগ মানুষই রিফিউজি, তাই আত্মীয়-স্বজনের বিরাট একটা অংশ রয়ে গেছে ওপারে। ইছামতী সেকালেও খরস্র্রোতা ছিল না। তবে এখনকার চেয়ে অবস্থটা বেশ ভালো ছিল। তাই নায়রী পারাপারেও নারাণ মাঝির ডাক পড়ত।

নারাণ মাঝি নৌকা কখনও বেঁধে রেখে যেত না। বিশেষ করে শীত গ্রীষ্মে। এসময় ইছামতীতে স্রোত থাকে না বললেই চলে। তাই নারাণ ঘরে ফেরার সময় নৌকাটাকে ডুবিয়ে রেখে যেত। কোথায় ডোবাত, সেটা আমরা জানতাম। দলবল নিয়ে হৈ হৈ করে নৌকা টেনে তুলতাম বোঁদ-কাদার ভেতর থেকে। তারপর পানি সেঁচে নৌকাটা চালানোর চেষ্টা করতাম। একসময় শিখেও ফেলেছিলাম বেশ। কিন্তু নারাণ মাঝি মাঝে মাঝেই বাগড়া দিত। হৈ হৈ করে তেড়ে আসত। তখন নৌকা ফেলে পালাতাম আমরা।

নৌকা কী, কাকে বলে, সেটা বুঝলাম ২০০০ সালে কুষ্টিয়ায় গিয়ে। শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে যাব। গড়াই নদী পার হতে হবে। বিশাল একটা নৌকা ঘাটে ভিড়ল। ইঞ্জিনওয়ালা। নৌকাটা মানুষ তো বইছেই, ছোখাট গাড়িও উঠিয়ে নিল তার বুকে। এরপর কুঠিবাড়িতে গিয়ে দেখলাম আরেক নৌকা। দোতলায় য়ত্ন করে রাখা। সেই বিখ্যাত বোট। এতে বসেই জোড়াসাঁকোর রবি রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছিলেন। এতে বসেই কবি নওগাঁর পতিসর, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ঘুরে বেড়িয়েছেন। পদ্মার জলে ভেসে ভেসে লিখেছেন ‘সোনার তরী’র মতো কালজয়ী সব লেখা। আবেগভরে নৌকার গায়ে হাত বুলিয়েছিলাম সেদিন। কিন্তু আজ মনে হয়, এর মাঝি কে বা কারা ছিলেন রবিঠাকুর সে কথা কী কোথাও লিখেছেন?

ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে গেল না? আড়িয়ল বিলের মাঝিদের কথা বলতে গিয়ে এত ভূমিকার কী দরকার?
আসলে আড়িয়ল বিলে যাওয়ার আগে নৌকা আর মাঝি বলতে আমি ইছামতী, গড়াই আর পদ্মার মাঝিদেরই দেখেছি খুব অল্প সময়ের জন্য। ঢাকায় আসার পর বাংলার মাঝিদের আসল রূপটা দেখলাম। সেও পদ্মায়। গোয়ালন্দ ঘাটে। তবে কোনটাই কাছ থেকে দেখা নয়। আড়িয়ল বিলেই সত্যিকারের নৌকাভ্রমণ হলো। তাই এর আগের ইতিহাসটুকুও কপচে নিলাম।
আড়িয়ল বিল নিয়ে আগেই একটা পোস্ট দিয়েছি। সেটা অবশ্য বেদেদের গল্প। আজকের পেস্ট এর মাঝিদের নিয়ে। ছবিতে ছবিতে।

DSC00548
ইনি আমদের সারথী। ছয়টা ঘণ্টা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাদের আড়িয়ল বিলের সৌন্দর্য দেখিয়েছেন। একেবারে সহজ-সরল মানুষটার ভেতর ছয়ঘণ্টার মধ্যে ন্যূনতম রাগ-ঝাঁঝ বা বিরক্তির চিহ্ন দেখিনি। আমাদের মাঝির নাম আমাজাদ আলি।

DSC00106
এক চাচা মাঝি, কোথায় চলেছেন কে জানে।

DSC00158
খালের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে আমাদের নৌকা। আমাজাদ চাচা যেন আমাদের নিয়ে চলেছেন স্বপ্নালু এক মায়াময় জগতের ভেতর দিয়ে। খালের ‍দুধারে স্বপ্নের মতো গ্রাম। তোলা-আধাপাকা বাড়ি। লম্বা লম্বা পিলারের ওপর বসানো ঘরগুলো। মাঝে মাঝে শাঁনবাঁধানো সিঁড়ি। নারী ও শিশুদের ভিড়। গোসল করবে বা করছে। তার পাশ দিয়ে চলছে এক নৌকা।

DSC00174
DSC00167
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে আড়িয়ল এলাকার মানুষ বয়ে বেড়ায় দাড় বইবার শক্তি। নারীরাই বা বাদ যাবে কেন?

DSC00177
মিষ্টির কার্টুন নিয়ে এই শিশুরা কোথায় চলেছে, বোনের বাড়ি?

DSC00220
DSC00221
শুক্রবার। নামাজ ধরার তাড়া আছে। মসজিদ ওপারে। তাই নৌকাই ভরসা। অজুটাও সারা হচ্ছে বিলের পানিতে।

DSC00301
কী যেন করছে ওরা। দূর থেকে ঠিক বোঝা গেল না।

DSC00297
এই ছবিটার ক্যাপশন খুঁজে পেলাম না।

DSC00329
DSC00325
মাছের সন্ধানে।

DSC00237
DSC00241
সত্যিকারের সাহসী মেয়ে।

DSC00290
কারও জন্য মধ্যাহ্ন ভোজ যাচ্ছে।

DSC00351
একা!

DSC00397
DSC00395
দুই প্রজন্ম। আড়িয়ল বিলে দেখা সেরা ছবি। এই ছেলেটা বড় হয়ে কী হবে বলুন তো? ওকি ওর মাকে রবি ঠাকুরের মতো বলে--
মা, যদি হও রাজি,
বড় হলে আমি হব
খেয়াঘাটের মাঝি

DSC00577
নীল আকাশ, সাদা মেঘ। তার নিচে মাঝি আর মালো মাছ ধরে।

DSC00898
দূর থেকে দেখা এক নায়রী নৌকা।

শেষ করি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের “দূরের পাল্লা” দিয়ে।

DSC00268
ছিপখান তিন-দাঁড় -
তিনজন মাল্লা
চৌপর দিন-ভোর
দ্যায় দূর-পাল্লা!
পাড়ময় ঝোপঝাড়
জঙ্গল-জঞ্জাল,
জলময় শৈবাল
পান্নার টাঁকশাল।

আগের পর্ব : আড়িয়ল বিলের বেদেপল্লীতে


মন্তব্য

ঐকতান এর ছবি

পতিসার না, ওটা পতিসর হবে। আর পতিসর পাবনায় না, নওগাঁ জেলার আত্রাই থানায় অবস্থিত।

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ঠিক করে দিলাম। ধন্যবাদ ভাই।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

মরুদ্যান এর ছবি

চলুক

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

অতিথি লেখক এর ছবি

ছবি দেখে মুগ্ধ হলাম, ক্যাপসন গুলোও মনকাড়া

তুষার রায়

আব্দুল গাফফার রনি এর ছবি

ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।

----------------------------------------------------------------
বন পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে হাতছানি দেয়
নিস্তব্ধ-গভীর রাতে এতোদূর থেকেও শুনি ইছামতীর মায়াডাক
খুঁজে ফিরি জিপসি বেদুইন আর সাঁওতালদের যাযাবর জীবন...
www.facebook.com/abdulgaffar.rony

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।