প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পরীক্ষায় অতিরিক্ত সময় কেবল শ্রুতি লেখক নিয়োগেই কেনো?

সাবরিনা সুলতানা এর ছবি
লিখেছেন সাবরিনা সুলতানা (তারিখ: সোম, ২৮/০১/২০১৩ - ৪:১৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

২০১২ সালের এইচ.এস.সি. পরীক্ষার কিছুদিন পরেই জানতে পেলাম মাংসপেশী জনিত সমস্যা সেরিব্রাল পালসি তে আক্রান্ত নাবিল পরীক্ষায় অতিরিক্ত সময়ের জন্যে আবেদন করেও শুধুমাত্র শ্রুতি লেখক নিয়োগ না নেবার কারণে অতিরিক্ত সময় পান নি। নাবিলের হাতের আঙুল ভালোভাবে কাজ করে না কিন্তু তবুও কষ্ট হলেও নিজেই লেখে সে। দূরারোগ্য মাস্কুলার ডিস্ট্রফীতে আক্রান্ত সুমাইয়া ও তাসনিনের অবস্থা আরো সঙ্গিন। এ বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালের ঢাকা বোর্ডের অধীনে এইচ.এস.সি. পরীক্ষার্থী সুমাইয়া এবং চট্টগ্রাম বোর্ডের অধীনে এস.এস.সি. পরীক্ষার্থী তাসনিন। মাস্কুলার ডিস্ট্রফী এমন একটি সমস্যা যার ফলে শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পেশী শক্তি প্রচুর দুর্বল হয় এবং বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে দিনে দিনে এই রোগের প্রকোপ বেড়েই চলে যার কোন চিকিৎসাই নেই।
বিভিন্ন ধরণের মাংসপেশীজনিত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি হাত ভালো করে নাড়াতে পারেন না এবং নানা রকম সমস্যার কারণে এদের লেখা ধীর গতির হয়। একাউন্টিং এ ঘর একে অংক কষতে কিংবা নাম্বারের আশায় প্রশ্নের উত্তর বড় করে লেখা বা স্কেল নিয়ে কাজ করা, বই-খাতার পাতা উল্টানো ইত্যাদি নানান সমস্যায় কারণে পরীক্ষাতেও ধরাবাধা সময়ে কিছু নাম্বার ছেড়ে আসতে বাধ্য হন তারা। অনেকটা একি রকম সমস্যার কারণেই মায়োপ্যাথিতে আক্রান্ত ফারহানার জে.এস.সি. পরীক্ষায় সব প্রশ্ন কমন পড়ার পরেও ধীর গতির কারণে উত্তর সব লেখার আগেই সময় শেষ। ঘরে এসেই কান্নাকাটি! মন খারাপ...সবাই পারে আর তারা পেরেও পারে না!

২০১০ সালে সরকারী ঘোষণা হয় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাসহ দেশের সব পাবলিক পরীক্ষায় প্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীদের বিশ মিনিট সময় বরাদ্দ দেয়া হবে। এতে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পাশাপাশি সেরিব্রাল পালসিজনিত (অপরিণত মস্তিষ্কে আঘাতজনিত কারণে শারীরিক প্রতিবন্ধিতা) এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী (হাত নেই বা হাতের গঠন এমন যে সেই হাত দিয়ে লেখা সম্ভব নয়) শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার প্রবেশপত্র হাতে পাওয়ার পর শ্রুতি লেখক নিয়োগের জন্যে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করলে এ-সংক্রান্ত একটি অনুমতিপত্র পাবেন তারা। নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যেগ। কিন্তু দেশের বিভিন্ন জেলায় কেউ অতিরিক্ত নিয়ম পাচ্ছেন নিয়ম মোতাবেক আবার কেউবা নিয়ম বহির্ভুত! কোন কোন জেলায় অনেকের শুধু মাত্র পায়ের সমস্যা, নিজের হাতে লিখছেন তবু প্রতিবন্ধী পরিচয়ে অতিরিক্ত সময় পাচ্ছেন আবার তাসনিন-সুমাইয়াদের মতো গুরুতর মাত্রার প্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থীরা আবেদন করেও কিছু হচ্ছে না যেখানে প্রয়োজনটা তাদের বেশি। এ যেনো শুভঙ্করের ফাঁকির মতোনই হয়ে গেলো বিষয়টা। অতিরিক্ত বিশ মিনিটের এ নিয়মটি কেবল মাত্র শ্রুতি লেখক নিয়োগেই। এখানে প্রশ্ন এসে যাচ্ছে তবে কেনো কেউ কেউ শ্রুতি লেখক নিয়োগ না নিয়েও অতিরিক্ত সময় পাচ্ছেন! মূলত সরকার সংলিষ্ট ব্যক্তির অসচেতনতার ফলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্যে বরাদ্দকৃত এই সময় নিয়ে বিভ্রান্তির কারণেই হচ্ছে সমস্যাগুলো। এখানে আরেকটি ব্যাপার উল্লেখ্য, যারা শ্রুতি লেখক নিয়োগ নিয়ে পরীক্ষা দেবেন সরকারী পরিসংখ্যান মতে একমাত্র তারাই প্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থী! একে তো বিশ মিনিট অনেক কম সময়, এটি নুন্যতম ত্রিশ মিনিট হওয়া উচিৎ তার উপর শ্রুতি লেখক নিয়োগ নিয়েও কম ভোগান্তি পোহাতে হয় না পরীক্ষার্থীদের। পরীক্ষার ফর্মেও যেহেতু বিষয়টির উল্লেখ থাকছে না, কে জানছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিটি নিজের শরীরের সাথে লড়াই করে পরীক্ষাও দিচ্ছেন আবার বেশ কিছু নাম্বারও ছেড়ে আসতে বাধ্য হচ্ছেন!
আমার প্রশ্ন হলো- তাদের জন্যেও অতিরিক্ত সময় কেনো নয়?? একে কি প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে সরকারের অজ্ঞতা বা অসচেতনতা বলবো নাকি অবহেলা!? স্বাভাবিক জীবন যাপনের এই অসম্ভব যুদ্ধে শুধু কি নাবিল, সুমাইয়া, তাসনিন বা ফারহানাই আফসোস করছে! আরো কতশত অগুনতি প্রতিবন্ধী পরীক্ষার্থী আছেন এদেশে। কিন্তু তাদের এ ক্রন্দন কিভাবে পৌছে দেই সরকারের নীতি নির্ধারণী মহলে??

আমার আজকের লেখা মূলত তাদের উদ্দেশ্যে যারা বঞ্চিত হচ্ছেন। তার মানে এই নয় সব ধরণের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরই অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন। মাঝারি এবং গুরুতর মাত্রার শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যারা মায়োপ্যাথি, মাস্কুলার ডিস্ট্রফী বা সেরিব্রাল পালসি অথবা মাংসপেশীজনিত নানান সমস্যায় আক্রান্ত। অনেকের হাত নেই, পা অথবা মুখ দিয়ে লিখছেন। অর্থাৎ যারা শারীরিকভাবে দুর্বল এবং হাতে সমস্যা বেশি অথচ কষ্ট করে নিজেরাই লিখতে পারছেন হোক না তা ধীর গতির তবুও তো যুদ্ধ করেই চলেছেন তারা। যেহেতু তারা দ্রুত লিখতে সক্ষম নন তাদেরও এই অতিরিক্ত সময়টা প্রাপ্য। তাদের সমস্যাটা আমাদের বোঝার চেষ্টা করা উচিৎ! এক্ষেত্রে ডাক্তারের সার্টিফিকেট বা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চাওয়া যেতে পারে প্রমাণ হিসেবে। তবুও তাদের জন্যেও অতিরিক্ত সময় বরাদ্দ করা হোক এবং এই সময়টির যাদের প্রাপ্য তাদের সবার জন্যে এটি ত্রিশ মিনিট করা হোক।

আমি নিজের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারি নি বলেই কিছুতেই চাই না অল্পের জন্যে জীবন যুদ্ধে হেরে যাক তারা। তাদের জন্যেই তাদের পক্ষ হয়ে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীসহ সংলিষ্ট সকলের কাছে বিনীত আবেদন জানাচ্ছি, বিষয়টির মানবিক দিক বিবেচনায় উল্লেখিত সমস্যায় আক্রান্তদের জন্যে শ্রুতি লেখক নিয়োগ ব্যতীত পরীক্ষায় অতিরিক্ত সময় বরাদ্দ করা হোক যেনো তারা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে লিখতে পারেন।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

ফারাসাত

Emran এর ছবি

আমার ধারণা এটি অসচেতনতা এবং অবহেলার মিশ্রণ। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের Disability Support Service-এ আমি কিছুদিন কাজ করেছিলাম। সেখানে দেখতাম প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ ছিল পরীক্ষার মূল সময় + মূল সময়ের অর্ধেক। মূল পরীক্ষার সময় তিন ঘণ্টা হলে প্রতিবন্ধীরা ৩ + ১-১/২ = ৪-১/২ ঘণ্টা ধরে পরীক্ষা দিতে পারে।

সাবরিনা সুলতানা এর ছবি

উন্নত বিশ্বের সরকার সংলিষ্ট মহল এবং সেখানকার সমাজে প্রতিবন্ধী মানুষদের কখনোই আলাদা করে দেখা হয় না। তারা প্রতিবন্ধী না ভেবে ভিন্নভাবে সক্ষম হিসেবে এই মানুষগুলোকে সম্মান করে। আমাদের দেশে এই অবহেলার অবসান হয় কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয় ইয়ে, মানে...

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মায়ার নেশা কাটাতেই এ তীব্র অস্থিরতা
তবু, মায়ার পাহাড়েই আমার নিত্য বসবাস।

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

ঘরে এসেই কান্নাকাটি! মন খারাপ...সবাই পারে আর তারা পেরেও পারে না!

আমার আজকের লেখা মূলত তাদের উদ্দেশ্যে যারা বঞ্চিত হচ্ছেন। তার মানে এই নয় সব ধরণের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরই অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন। মাঝারি এবং গুরুতর মাত্রার শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যারা মায়োপ্যাথি, মাস্কুলার ডিস্ট্রফী বা সেরিব্রাল পালসি অথবা মাংসপেশীজনিত নানান সমস্যায় আক্রান্ত। অনেকের হাত নেই, পা অথবা মুখ দিয়ে লিখছেন। অর্থাৎ যারা শারীরিকভাবে দুর্বল এবং হাতে সমস্যা বেশি অথচ কষ্ট করে নিজেরাই লিখতে পারছেন হোক না তা ধীর গতির তবুও তো যুদ্ধ করেই চলেছেন তারা। যেহেতু তারা দ্রুত লিখতে সক্ষম নন তাদেরও এই অতিরিক্ত সময়টা প্রাপ্য। তাদের সমস্যাটা আমাদের বোঝার চেষ্টা করা উচিৎ! এক্ষেত্রে ডাক্তারের সার্টিফিকেট বা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চাওয়া যেতে পারে প্রমাণ হিসেবে। তবুও তাদের জন্যেও অতিরিক্ত সময় বরাদ্দ করা হোক এবং এই সময়টির যাদের প্রাপ্য তাদের সবার জন্যে এটি ত্রিশ মিনিট করা হোক।

সাবরিনা, আপনার কথা আমার এক বন্ধুর কাছে প্রথম শুনি । তার একটি বোন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী । আপনার প্রতি, আপনার মত সকল প্রতিবন্ধীদের প্রতি জানাতে চাই সংহতি । আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও নীতি নির্ধারকদের ঘুম ভাঙ্গুক এই কামনা করছি । সকলের মেধা বিকাশের পথটি সুগম হোক এই কামনা করছি ।

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

সাবরিনা সুলতানা এর ছবি

কৃতজ্ঞতা হাসি

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মায়ার নেশা কাটাতেই এ তীব্র অস্থিরতা
তবু, মায়ার পাহাড়েই আমার নিত্য বসবাস।

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও নীতি নির্ধারকদের ঘুম ভাঙ্গুক এই কামনা করছি । সকলের মেধা বিকাশের পথটি সুগম হোক এই কামনা করছি ।

চলুক

চমৎকার পোস্টটির জন্য অনেক ধন্যবাদ সাবরিনা আপু।

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার একটি পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।
শুভকামনা রইল।

তুহিন সরকার

অমি_বন্যা এর ছবি

সময়োপযোগী একটি লেখা। চলুক

সাবরিনা সুলতানা এর ছবি

ধন্যবাদ হাসি

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মায়ার নেশা কাটাতেই এ তীব্র অস্থিরতা
তবু, মায়ার পাহাড়েই আমার নিত্য বসবাস।

অসমাপ্ত লেনিন এর ছবি

শ্রুতি-প্রতিশ্রুতি আর কাজে আসবে না, এখন সময় বাস্তবায়নের।

অসমাপ্ত লেনিন।

সাবরিনা সুলতানা এর ছবি

দেখা যাক আমরা বাস্তবায়নের দিকে কতটা পথ এগুতে পারি!

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মায়ার নেশা কাটাতেই এ তীব্র অস্থিরতা
তবু, মায়ার পাহাড়েই আমার নিত্য বসবাস।

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

সাবরিনা আপু, আপনার কথা আমি আরও আগে শুনেছি, আজ আর সঠিক মনে নেই কখন, কোথাই, কিভাবে কিন্তু আপনার অদম্য মনোবল দেখে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলাম, এখনও আছি। হাসি

সচলে এসে এইভাবে আপনাকে পেয়ে যাব ভাবিনি। কিছুদিন আগে কাজ উপলক্ষে ফিনল্যান্ডে ভালেদিয়া তালো তে কাজ করতে হয়েছিল প্রায় দিন পনের মত। এখানে ভালেদিয়া তালো হল শারীরিক বা মানসিক ভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বা বয়স্ক মানুষ যারা কিনা ভীষণ অসুস্থ তাদের জায়গা যেখানে তাদের নিজেদের সক্ষম হতে শিখানো হয়। গায়ে গা লাগান কিছু এপার্টমেন্ট নিয়ে পুরো প্রতিষ্ঠানটি তৈরি যেখানে কিনা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আবাসস্থল থেকে শুরু করে খাবার হোটেল, সুইমিং পুল, জিমনেসিয়াম, ফিজিওথেরাপি, মেডিক্যাল ফ্যাসিলিটি সহ সার্বক্ষণিক সহযোগিতার কিছু মানুষ কি নেই। এমনকি অন্য কোথাও থেকে যদি কোন শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী মানুষ বেড়াতেও আসেন তাদের জন্য হোটেলের ব্যবস্থাও রয়েছে। সব কিছু কাছ থেকে দেখে শুনে ভীষণ মুগ্ধ হয়েছিলাম। জানিনা আমাদের দেশে কোনদিন এমনটি সম্ভব কিনা। খুব ইচ্ছে আছে এটি নিয়ে বিস্তারিত লেখার।

ভালো থাকবেন আপু। অনেক অনেক অনেক ভালো থাকবেন।
আপনার বি স্ক্যানের জন্য আপনাকে শুভেচ্ছা এবং অভিবাদন। হাসি

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

সাবরিনা সুলতানা এর ছবি

আপনার মন্তব্যটি পড়ে দারুণ লাগলো। আমাদের দেশেও একদিন হবে। আমি হতাশবাদীদের দলে নই হাসি
আপনার লেখাটি পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
আপনিও অনেক ভালো থাকুন। আর ভালো রাখুন।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মায়ার নেশা কাটাতেই এ তীব্র অস্থিরতা
তবু, মায়ার পাহাড়েই আমার নিত্য বসবাস।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।