বিজ্ঞান প্রকাশনা নিয়ে হালকা ভাবনা

সজীব ওসমান এর ছবি
লিখেছেন সজীব ওসমান (তারিখ: শনি, ১৯/১২/২০১৫ - ৫:৫৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বিজ্ঞান গবেষণায় পরীক্ষার ৯০ শতাংশই ব্যর্থতা। বহুবার চেষ্টা করে কিছু সফল পরীক্ষার কিছু ব্যাখ্যাসক্ষম ফলাফল পাওয়া যায়। ব্যর্থতায় মনোবল ভাঙলে গবেষণা হয়না।

পৃথিবী দিনদিন গবেষণায় আরও প্রতিযোগিতাপূর্ণ হচ্ছে। সাধারণভাবে বলা চলে, ৭/৮ বছর আগেও নেচার পত্রিকায় একটা প্রকাশনা থাকলে আমেরিকা/কানাডা/ব্রিটেন/জার্মানি'র বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগদেয়ার জন্য কোন গবেষককে এগিয়ে রাখতো অনেকখানি। এখন আর সেই দিন নাই। আমার পরিচিত একজন পোষ্টডক নেচার পত্রিকায় প্রকাশণার একবছর পরেও পোষ্টডক/রিসার্চ এসিস্যান্টই আছেন এবং নিজের দেশে (রোমানিয়া) অধ্যাপনার সুযোগ খুঁজছেন। তবে, আমি বলছিনা যে ভাল প্রকাশনা কোন কাজে লাগেনা, ব্যাপারটা শুধু অনেক বেশি প্রতিযোগিতা বাড়ার।

একই জিনিস খাটে পত্রিকায় প্রকাশনার ক্ষেত্রেও। ১০ বছর আগে কোন গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিনের গঠন আবিষ্কার করলেই সেটা 'নেচার স্ট্রাকচারাল এন্ড মলিকিউলার বায়োলজি'তে প্রকাশের যোগ্য ছিল, বা অন্য কোন উঁচুদরের পত্রিকায়। এখন অনেককিছু লাগে সঙ্গে। 'প্রোটিন কোন জীবে কোন কাজ করে' সেসব তথ্য আবিষ্কার না করে শুধু গঠন আবিষ্কারে আর প্রকাশ করেনা ভাল কেউ, ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরে নিচের দিকে থাকা কোন পত্রিকা ছাড়া।

সেইজন্য, নিবন্ধ প্রকাশে প্রথমে একটু উপরের দিকের পত্রিকায় পাঠানো দিয়ে শুরু করতে হয়। প্রত্যাখ্যাত হতে হতে একজায়গায় এসে প্রকাশিত হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপরের ছবির মত রিভিউ প্রক্রিয়ার যেকনো পর্যায়ে গিয়ে বাদ পরে। আমার সর্বশেষ প্রকাশনা প্রথমে পাঠিয়েছি 'সেল হোস্ট এন্ড মাইক্রোব্স' এ, তারপরে 'প্লস প্যাথোজেন', তারপরে 'জেবিসি' এবং সবশেষে 'মলিকিউলার এন্ড বায়োকেমিক্যাল প্যারাসাইটোলজি'তে এসে প্রকাশিত হয়েছে।

তবে, নিজের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার নিয়ে একটা মোটামুটি ধারণা থাকলে ভাল - পৃথিবীর বিজ্ঞানে নিজের গবেষণা কতটুকু প্রভাব ফেলছে। সে অনুযায়ী পত্রিকা পছন্দ করে সেখানে গবেষণার ফলাফল পাঠানো গেলে সেটা আদর্শ হত! কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই এই জিনিস নির্ধারন করাটা কষ্টকর হয়ে যায়।

তাহলে, 'পরাজয়ে ডরেনা বীর' কথাটার বিজ্ঞানবচন কী হতে পারে?
'এমন বিজ্ঞান পরীক্ষাও কোনো পত্রিকা ফিরিয়ে দিয়েছিল যা পরবর্তীতে অন্যত্র প্রকাশিত হয়ে নোবেল পুরষ্কার জিতেছে!'

পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকাগুলির একটি হল 'সায়েন্স'। এই পত্রিকা তাদের কাছে পাঠানো নিবন্ধের ৮ শতাংশেরও কম প্রকাশ করে। কতটা নিবন্ধ পাঠানো হয় তাদের কাছে জানেন? প্রতিবছর ১২ হাজার! তার মধ্যে বেশিরভাগই পিয়ার রিভিউয়ের আগেই পত্যাখ্যাত হয়। সায়েন্স পত্রিকাটিতে প্রকাশিত লেখকদের গড় বয়স ৪০ বছর!

অন্যদিকে, আরেকটা বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা 'নেচার' তাদের কাছে প্রতিসপ্তাহে পাঠানো ২০০ বিজ্ঞান নিবন্ধের মাত্র ৮ শতাংশ প্রকাশের জায়গা রাখে। পৃথিবীর সবেচেয়ে বনেদী দুই বিজ্ঞানপত্রিকা (সায়েন্স এবং নেচার) প্রায় একই সমান নিবন্ধ প্রতিবছর গ্রহণ করে যার মধ্যে বেশিরভাগই প্রত্যাখ্যান করে প্রথম ছাকুনিতেই।

ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরে নেচার অবশ্য সায়েন্সের চেয়ে প্রায় ১০ পয়েন্টে আগানো। পছন্দ করতে দিলে পৃথিবীর বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত নেচারকে পছন্দের তালিকায় আমেরিকা থেকে প্রকাশিত সায়েন্সের চেয়ে এগিয়ে রাখবেন।

এইবার একটা মজার তথ্য দেই।

নেচার পত্রিকা সায়েন্সের ১১ বছর আগে থেকে প্রকাশিত। নেচার প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ সালে।

কিন্তু নেচারের মত পত্রিকাটিতে Scientist শব্দটা প্রথমবার ব্যবহৃত হয় ১৯২৪ সালে। তাও আপত্তি উঠেছিল এই শব্দের ব্যবহার নিয়ে!

পদার্থবিদ নরম্যান ক্যাম্পবেল নেচার পত্রিকায় চিঠি লিখেছিলেন এই 'সায়েন্টিষ্ট' শব্দটা না ব্যবহারের জন্য। আমেরিকায় জনপ্রিয় হওয়া এই শব্দটা ব্রিটিশদের কাছে বরাবরের মতই 'গেঁয়ো' ছিল।

নেচার পত্রিকার তখনকার সম্পাদক স্যার রিচার্ড গ্রেগরি একটা মতামত আহ্বান করেন, বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই ব্যবহারের পক্ষে রায় দেন। আর এখন দেখেন এই শব্দটি ইংরেজীতে সাধারন বিজ্ঞান লেখার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দগুলির একটি।


মন্তব্য

Emran  এর ছবি

আপনার লেখার বিষয়বস্তু গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু লেখা পড়ে মনে হচ্ছে "নেচার"/"সায়েন্স"-এ প্রকাশিত না হলে গবেষক জীবনই বৃথা! ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর নির্ভর করে মূলতঃ কোন জার্নাল কত বেশী সাইট করা হয় - তার ওপর। "নেচার"/"সায়েন্স" বিশেষায়িত জার্নাল না; বিজ্ঞানের সব শাখা/উপশাখার লেখাই এগুলিতে প্রকাশ করা হয়। সেকারণে বিজ্ঞানের সব শাখা/উপশাখার গবেষকই এই দুটো জার্নাল সাইট করেন।

ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর কম হলেই সেই জার্নাল নিম্নমানের - এই ধারণাটাও পুরোপুরি ঠিক না। অত্যন্ত বিশেষায়িত জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর কম হতেই পারে; তার অর্থ এই না যে সেসব জার্নালে প্রকাশিত লেখার মানও কম। আমার নিজের গবেষণাক্ষেত্রের (অ্যানাটমি) প্রধান দুটো জার্নাল হল "Journal of Anatomy" এবং "Anatomical Record"। দুটোর ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরই তিনের নিচে!

একাডেমিক চাকরি পাওয়ার জন্য এখন প্রকাশনার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল গ্র্যানট; গ্রান্ট থাকা মানে আপনি গবেষক হিসেবে সক্রিয়। ২০ বছরের পুরনো ডেটা দিয়েও পেপার পাব্লিশ করা যায়; আমার এক কলিগ খালি রিভিউ পেপার পাব্লিশ করেন। সুতরাং পাব্লিকেশনের সংখ্যা দিয়ে আসলে গবেষক হিসেবে কারও সক্রিয়তা যাচাই করাটা একটু কঠিন। তবে এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রমাগত বানিজ্যিকিকরন। গ্রান্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আয়ের অন্যতম উৎস। যে গবেষকের গ্রান্ট আছে, তিনি হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুধেল গাভী, তার কদরই আলাদা। গ্রান্ট না থাকার কারণে আমার বিভাগের এক সাবেক ছাত্রের সম্প্রতি টেনিউর ডিনাই হয়েছে; অথচ গত ৫ বছরে সে ৩০খানা পেপার প্রকাশ করেছে! বীতশ্রদ্ধ হয়ে সে একাডেমিক ফিল্ড পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে কর্পোরেট সেক্টরে চাকরি নিয়েছে।

সজীব ওসমান এর ছবি

প্রথম কথাটা মনে হলে আমি দুঃখিত যে বোঝাতে পারিনি। (সেজন্য দ্বিতীয় প্যারার একটা বাক্য একটু পরিবর্তন করে দিয়েছি।) কিন্তু নেচার এবং সায়েন্স পত্রিকাদুটির কথা বলাটা মানে তাদের ওখানে প্রকাশ না হলে জীবন বৃথা বোঝানো নয়। অতটা নির্বোধ আমি নই। এই পৃথিবীবিখ্যাত এবং ঐতিহাসিক প্রাচীন বিজ্ঞান পত্রিকাগুলির কথা এই লেখার প্রধাণ অংশ।

হয়তো আপনার চোখ এড়িয়ে গিয়েছে। তৃতীয় প্যারাতেই বিশেষায়িত পত্রিকা 'নেচার স্ট্রাকচার' এর নাম আছে (নামটা সংক্ষিপ্ত করে দিয়েছিলাম বলে দুঃখিত, পুরো নাম নেচার স্ট্রাকচারাল এন্ড মলিকিউলার বায়োলজি) সেটার উদাহরণেই ভাল প্রকাশণার কথা বলেছি। যার সঙ্গে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জড়িত।

বিশেষায়িত পত্রিকার কথা যখন বললেনই এপ্রসঙ্গে আরেকটা কথা টানি। ৪ টা একই বিষয়ে বিশেষায়িত পত্রিকার মান সমান হয়না বেশিরভাগ ক্ষেত্রই। যারা গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশণা করেন তাদের সাইটেশান ভাল হয়। তাই সাইটেশানকে এড়ানো বা ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরকে এড়ানোটা চাইলেই করা যায়না। পৃথিবীর নামীদামী বিজ্ঞানপত্রিকাগুলি তাদের ওয়েবসাইটে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর কত সেটা নাহলে লিখে রাখতোনা। তেমনি, পত্রিকাগুলির তুলনা করতেও এটা জরুরী, বিশেষায়িতদের মধ্যে এবং অবিশেষায়িতদের মধ্যে।

পত্রিকায় প্রকাশের সঙ্গে গবেষণার পরিচালক পদে নিয়োগপ্রাপ্তির খুব ভাল যোগাযোগ আছে। হ্যাঁ, ফান্ডিংটা একটা বড় ব্যাপার, কিন্তু প্রথম নিয়োগের সময় এটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা হয়না বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে (আমি কানাডার কথা বলছি, ইউএস হয়তো অন্যরকম)। কারন এখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নিজেদেরই কিছু স্টার্টিং ফান্ডিং থাকে। বেশিরভাগ গবেষকই এভাবে ফান্ডিং নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে পারেন না। তবে হ্যাঁ, ফান্ডিং কেউ সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারলে সেটার নিয়োগকে অনেক সহজ করে দেয়। এবং ফান্ডিং এর সাথে টেনিওর হওয়া সম্পৃক্ত।

ঋতব্রত এর ছবি

লেখকের সাথে প্রায় সব বিষয়ে একমত জানাই। Thomson Reuters কৃত impact factor একটি গুরুত্বপূর্ণ parameter. তবে সমস্ত বিশয়ে impact factor দ্বারা measure করা মুশকিল। বস্তুত গণিত বিশয়ে impact factor misleading হয়। কোন ফলিত গণিতের গবেষণা সাধারণত অনেক বেশি citation পায়। তাই applied mathematics এর journal গুলির impact factor অত্যন্ত বেশি। এর জন্য American Mathematical Society একটি পৃথক parameter বানিয়েছেন, যেটি MCQ নামে খ্যাত। MCO হিসাবে প্রথম তিনটি journal হল Annals of Mathematics, Acta Mathematica, এবং Publications Mathématiques. Institut de Hautes Études Scientifiques. প্রত্যেকটির impact factor অত্যন্ত কম। এদের সম্পাদকীয় নীতি এতই কঠিন যে অনেক সময় paper submission ও paper acceptance এর মধ্যে ১০ বছরের পার্থক্য থাকে চোখ টিপি
তবে যেমনটি বলেছেন, এইজাতীয় journal এ paper থাকলে চাকরি বা funding নিয়ে চিন্তা করতে হয় না।
ঋতব্রত

সজীব ওসমান এর ছবি

হেহে
১০ বছরের এই অপেক্ষাটা দরকারী কিনা চিন্তা করছি!
এমসিকিউ পদ্ধতিতে পয়েন্ট যাচাই কেমন করে হয় খুঁজে দেখবো। জানানোর জন্য ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধর্মগ্রন্থগুলোয় এত বিজ্ঞান আছে শুনি, এক-আধটা কপি-পেস্ট সাবমিট করে দেখা যায় না- পাবলিশ করে কিনা! হাসি

সজীব ওসমান এর ছবি

হেহে।
প্রাসঙ্গিকভাবে বলি। কয়েকবছর আগে এরকম একটা বিষয় নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল বিজ্ঞান প্রকাশণার জগতে। কোন একদল লোক গার্বেজ একটা লেখা কয়েকটি পত্রিকায় ইচ্ছা করে পাঠিয়েছিলেন পত্রিকাগুলির রিভিউ প্রক্রিয়া যাচাই করতে। কয়েকটা পত্রিকাতে প্রকাশও হয়েছিল! হাসি

অনার্য সঙ্গীত এর ছবি

ছোট্ট লেখা, ভালো লাগলো।

নিউ ইংল্যাণ্ড জার্নাল অব মেডিসিনের ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর আমার জানামতে সবচে বেশি। ন্যাচার সায়েন্স তার ধারেকাছেও নেই।

______________________
নিজের ভেতর কোথায় সে তীব্র মানুষ!
অক্ষর যাপন

সজীব ওসমান এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

কিছুমাস আগে বোস্টনের কনফারেন্সে সায়েন্স পত্রিকার একজন এডিটরের সাথে কথা হয়েছিল। তিনি বলছিলেন সায়েন্সের এডিটরেরাই নাকি সাবমিট করা আর্টিকেলগুলোর ৮০% রিজেক্ট করে দেয়। মানে পাবলিশ হওয়ার ফার্স্ট স্টেজেই এত আর্টিকেল বাদ পড়ে।
_________________
সৌমিত্র

সজীব ওসমান এর ছবি

হুমম। যাদের কাছে সপ্তাহে ২০০ বিজ্ঞান নিবন্ধ আসে প্রকাশের জন্য তাদের জন্যতো প্রথম যাচাইয়েই বাদ দিয়ে দেয়া স্বাভাবিক!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।