জনৈক কচ্ছপ সাহেব

শামীম রুনা এর ছবি
লিখেছেন শামীম রুনা [অতিথি] (তারিখ: শুক্র, ২৭/১১/২০১৫ - ৯:৩৮অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ভদ্রলোকের একটি চমৎকার নাম আছে, তার স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ নম্বরযুক্ত সনদপত্রগুলিতে সে নাম জ্বলজ্বল করে লেখা রয়েছে।তাছাড়া কর্মক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখবার জন্য তাকে আরো যে ক’টি সনদ দেওয়া হয়েছে সেসব সনদপত্রে বা কর্মক্ষেত্রে তিনি যে ঘরে বসেন সে ঘরের দরজার ওপর নেম প্লেটে সে নাম লেখা রয়েছে, আরো বিভিন্ন জায়গায় স্বর্ণাক্ষরে বা রৌপাক্ষরে নয়তবা সাধারণ কালিতে তার নাম বিভিন্ন ডিজাইনে লেখা রয়েছে। আমরা আরো সুদূর অতীতে তাকালে দেখবো, জোড়া খাসী জবেহ্ করে ভদ্রলোকের পিতা তার একটি ইসলামি নাম রেখেছিলেন, যে নাম এই গল্পে আমাদের কাছে বিস্মৃত হয়ে থাকবে বা আমরা নামটি উহ্য রেখে তাকে অন্য একটি নামে সম্বোধন করবো যা ভদ্রলোকের বর্তমান চারিত্রিক বৈশিষ্টর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে ধারণা করি। আমরা ধরে নিলাম ভদ্রলোকের নাম কচ্ছপ সাহেব। হ্যাঁ, ঠিক বলছি জনাব জনাবা; আপনারা ঠিকই শুনেছেন; ভদ্রলোকের নাম কচ্ছপ সাহেবই বলছি আমি, তার স্বভাব-চরিত্রের সঙ্গে এই নামটি তাকে চমৎকার মানিয়ে যায়। কারণ?
আমরা কচ্ছপ সাহেবের একদিনের ঘটনার দিকে বরং নজরদারী করি, যেহেতু আমাদের হাতে তেমন কোনো কাজকর্ম নাই তাই কচ্ছপ সাহেবের পিছন পিছন আজকের দিনের কিছু সময় খরচ করি কি বলেন? যত যাই বলেন, পরের ব্যাপারে নাক গলানোর মধ্যে পরকীয়া প্রেমের মতো নিষিদ্ধ ঘ্রান রয়েছে।
প্রতিদিনই কচ্ছপ সাহেব বেলা করে ঘুম থেকে জাগেন, বেলা হবেই না বা কেনো; প্রায় রাতই তো তাকে মধ্যরাত পার করে বাড়ি ফিরতে হয়। ব্যবসা সংক্রান্ত নানান রকমের মিটিং-ফিটিং-এর আয়োজনগুলো করা হয় ডিনারকে কেন্দ্র করে। যত না ডিনার তারচে’ বেশি টকিং, যত না কাজের টকিং তারচে’ বেশি গসিপের টকিং, গসিপের ফাঁকে ফাঁকে স্বার্থসিদ্ধির কথা-এই হেনোতেনো করতে করতে রাত প্রায় কাভার করে বাড়ি ফেরা। আজও কচ্ছপ সাহেবের দেরী করে ঘুম ভাঙলে তিনি প্রতিদিনের মতো নীরব একটি ঘরেই জেগে উঠলেন, নরম আলো আর আরামে মোড়ানো ঘরটি বেশ ঠান্ডা আর অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। তিনি জানেন, বিশাল এই রুমটিতে তিনি একা হলেও পুরোপুরি একা নন, তার সামান্য নড়াচড়াও পাশের রুমে বসে তার ব্যক্তিগত কাজের ছেলেটি শুনছে, তিনি জেগে ওঠামাত্র সে ছেলে বেডটি নিয়ে হাজির হবে। তাই হলো, তিনি দিনের প্রথম হাই শেষ করবার আগেই পাশের টেবিলে ধবধবে সাদা কাপ-পিরিচে সোনালী রঙের শ্রীলঙ্কার সুভাশিত চা তাকে যেন সুপ্রভাত জানলো। সোনালী চায়ের দিকে তাকিয়ে গতকাল রাতে পরিচিত হওয়া মিস্ স্টেফানির সোনালী চুলের কথা মনে পড়লে তিনি কিছুটা আনমনে চায়ের পেয়ালা তুলে চুমক দেওয়ামাত্র দিনের প্রথম গরম পানীয় ঠোঁট পুড়িয়ে দিলে মিস স্টেফানি ধাম করে তার ভাবনা থেকে বিদায় নেয় এবং তিনি হাতের কাপ বিরক্ত হয়ে ছুঁড়ে দিলে সেটি কাজের ছেলেটির নগ্ন পায়ে আছড়ে পড়ে। কাপ আছড়ে পড়ে ভেঙে খান খান তো হয়ই না বরঞ্চ এক বিন্দু শব্দও না তুলে নতজানু হয়ে পড়ে থাকে। গরম চা ছেলেটির পায়ের ত্বকে জ্বালুনি তুললেও সে কোনো শব্দ না করে নত হয়ে মোটা কার্পেটের উষ্ণতা থেকে কাপ-পিরিচ তুলে নেয় ত্রস্ত হাতে। কচ্ছপ সাহেব কাজের ছেলেটির দিকে তাকানোর মতো বিন্দুমাত্র সময় অপচয় না করে তার আলিশান বাথরুমে গিয়ে ঢুকেন। কমোডের পাশে র্যা কে রাখা প্রতিদিনের দৈনিক, তথ্য প্রযুক্তির ভরা মৌসুমেও তিনি কোনো গেজেটে খবর পড়ে মজা পান না, প্রাতকৃত্যের সময় আয়েশ করে পত্রিকায় চোখ বুলানো তার একমাত্র পুরনো অভ্যাস, তাছাড়া তিনি ভীষণ ব্যস্ত মানুষও বটে; সারাদিন পত্রিকায় চোখ বুলানোর তেমন সময় পান না, ইম্পর্টেন্ট নিউজে চোখ বুলিয়ে এই সময় নিজেকে আপটুডেট করে নেন; লোকজনের সঙ্গে বিভিন্ন ডিলিং-এ তথ্যগুলো অনেক সময় কাজ দেয়। সুভাসিত বাথরুম, সেন্ট্রাল এসি’র আলিশান দো’তলা বাড়ি, বাড়ির সামনে টেনিস কোর্ট কাটা লন, বাড়ির দেখভাল করবার লোকজন, বাড়ি জুড়ে আরো কিছু বাড়তি আত্মিয়-অনাত্মিয় মানুষের মনোযোগ বা বাড়ির বাইরে কর্মক্ষেত্রে তিনি যে মর্যাদা পান তা তিনি সত্যি খুব উপভোগ করেন। কচ্ছপ সাহেবের এই সফলতা, লোকজনের মনোযোগ পাওয়া বা মর্যাদার যোগ্য হওয়ার জন্য তাকে কম পরিশ্রম করতে হয়নি, যত না কায়িক তারচে’ বেশি ঠাণ্ডা মাথার পরিকল্পনা করে তাকে এগিয়ে যেতে হয়েছে, ধীর পায়ে কচ্ছপের গতিতে। তাই তিনি তার পরিশ্রমলব্ধ সফলতা আর ক্ষমতা লোকজনদের জানান দেন অন্যদের প্রতি যতটা সম্ভব অবজ্ঞা দেখিয়ে।
কচ্ছপ সাহেবের স্ত্রী-সন্তানরা দেশের বাইরে ছুটি কাটাতে গিয়েছে, তিনি একটি কাজের জন্য ফেঁসে আছেন; একটি টেন্ডার; কাজটি হলেই তিনিও ছুটি উপভোগের জন্য দু’একদিনের মধ্যে ইউরোপ উড়াল দেবেন। অবশ্য স্ত্রী দেশে না থাকায় এই সময়টা বেশ ব্যাচেলর মুডে আছেন। গোসল সেরে শরীরের আনাচে-কানাচে বডিস্প্রে স্প্রে করতে করতে আয়নায় নিজের সাঁতার কেটে ফিট রাখা বডির দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে জানতে চাইলেন, হাই বস! আজ আপনার প্রোগ্রাম কী?
কচ্ছপ সাহেব অফিসের উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠার জন্য লনে বেরিয়ে দেখলেন, তার বাড়িতে অফিসের জন্য নির্দিষ্ট্য করে রাখা রুমের সামনে বিভিন্ন তদবীর বা সাহায্য চাইতে আসা দর্শনার্থীর সংখ্যা কোনো মন্ত্রীর দর্শনার্থীর চেয়ে কম নয়। তার বুকের ভেতর আনন্দ গমগম করে হাসে; তবুও তিনি দাঁড়ান না; গম্ভীর মুখে সটান হেঁটে গাড়িতে উঠে বসেন। আজ এইসব হতভাগাদের কোনো সাক্ষাৎ দেবেন না, প্রতিদিন এই অভাজনগুলোর সঙ্গে কথা বললে ওরা তাকে সহজলভ্য ভেবে নেবে, তখন আর মানতে চাইবে না। তারচ’ ওরা আসুক, অপেক্ষা করুক, কয়েকদিন ঘুরে ফিরে যাক; যারা ধৈর্য্যশীল তাদের মধ্যে কারো কথা তিনি হয়ত শুনবেন কোনো একদিন...
অফিসে নিজের কেবিনে ঢুকে কচ্ছপ সাহেবের স্ত্রীর কথা মনে পড়ে, স্ত্রী বায়না করেছে; আমেরিকায় নিজেদের একটি আলিশান বাড়ির। বিষয়টি তার মনে ধরেছে কিন্তু অনেকগুলো টাকার ধাক্কা! তার নিজ গ্রামের মাদ্রাসার কথা মনে পড়ল, যেটি এক সৌদি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ডোনেশনের অর্থে তিনি বাবার নামে প্রতিষ্ঠা করার মানত করেছেন। গ্রামের সবাই জানে এই মাদ্রাসা কচ্ছপ সাহেব নিজ খরচে গ্রামের গরীব দুখী বাচ্চাগুলোর জন্য প্রতিষ্ঠা করছেন। তিনি হাসেন, ভালোই হয়েছে; একেই হয়ত বলে এক ঢিলে দুই পাখী। তার নামও হলো আবার এই ডোনেশন থেকে তার একাউন্টে যা সেভ হচ্ছে তার অংকও নি:সন্দেহে খাসা। বিনিময়ে এই সৌদি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেকে সুযোগ করে দিতে হবে এই দেশ থেকে ওদেশে নারী গৃহ শ্রমিক রপ্তানী করবার। প্রথমে কচ্ছপ সাহেব ভেবেছিলেন তেমন কঠিন কোনো কাজ নয়, এই দেশের ভুখা-নাঙ্গা মেয়েমানুষগুলো এই সুযোগ তড়বড়িয়ে লুফে নেবে, কিন্তু কাজে নেমে দেখা গেল মেয়েমানুষগুলোর পক্ষ থেকে তেমন সাড়া মেলছে না। কচ্ছপ সাহেবের কুঁচকে ওঠা ভুরুর দিকে তাকিয়ে দেশী এজেন্ট বলল, আরব দেশে বৌ-ঝিদের পাঠাতে কেউ সাহস পায় না।
কচ্ছপ সাহেবের মুখ দিয়ে প্রশ্ন ছিটকে এসেছিল, কেনো?
এজেন্ট দাঁত কেলিয়ে হেসেছিল আর কচ্ছপ সাহেব মনে মনে গালি দিয়েছিল যারা এমন সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাচ্ছে না তাদের উদ্দেশ্যে, পেটে ভাত নেই, মাথার ওপর ছাদ নেই, খালি বালের ইজ্জত আছে..
মুখে এজেন্টকে বললেন, মেয়ে গৃহকর্মী জোগাড় করো। এটি সরকারী চুক্তি, কর্মী না পাঠালে সরকারকে ওদেশের সরকারের কাছে ফলস্ পজিশনে পড়তে হবে।
তিনি সৌদি ব্যবসায়ীকে নিজে সরাসরি ফোন করে জানালেন, তার কাজের অগ্রগতির কথা। বললেন, খুব শিঘ্রী কর্মী পাঠাতে পারবেন। কর্মী পাঠানো শুরু করার আগেই তিনি মাদ্রাসার ডোনেশনের পুরো টাকাটি চান। সৌদি ব্যবসায়ী জানালেন, ডিল যখন ওকে তাহলে আজকালের মধ্যে ডোনেশনের টাকা তার একাউন্টে জমা হয়ে যাবে। ডোনেশনের আশ্বাস পেয়ে কচ্ছপ সাহেব সঙ্গে সঙ্গে হৃষ্টমনে স্ত্রীর ভাইবারে ফোন দিলে মধ্যরাতে ঘুম থেকে জেগে ওঠে স্ত্রী কাঁচা ঘুম ভাঙানোর জন্য তাকে খেঁকিয়ে উঠলেও তিনি তা গ্রাহ্য না করে বলেন, আমেরিকায় আমাদের একটি বাড়ি হলে কেমন হয়?
সত্যি?
সত্যি।
সোনা..
ময়না..
স্ত্রীর সঙ্গে ফোনালাপ শেষে মনের আনন্দে কচ্ছপ সাহেব নিজের টেবিলে তবলার তাল ঠুকার চেষ্টা করে না পেরে নিজের আঙুল গুটিয়ে নিলে তখন দেখা যায় কেবিনের দরজায় তার পিএস’র সদা হাস্যময় আর চতুর মুখটিকে আতংক নিয়ে উঁকি দিতে।
স্যার, মন্ত্রী সাহেবের কেবিনে হেব্বি ক্যাচাল হইতেছে..
কী ক্যাচাল?
ওই যে ওরা আইছে..কাটারাইফেল আর পিস্তল ফিস্তল লগে নিয়া..
কারা?
অপজিশন পাট্টি। আইজকার টেণ্ডারের ব্যাপারে। মন্ত্রী সাহেব গলা খাকরাইয়া সাফ বইলা দিলেন, তিনি এই বিষয়ে কিছু জানেন না; নাটবল্টু সব আপনার হাতে..
নাটবল্টু সব আমার হাতে? মন্ত্রী সাহেব ন্যাকাখোকা! ভাগের সময় তো নগদ নগদ।
এখন হেরা আপনের খোঁজে আসতেছে..
কারা?
হেই অপজিশন পাট্টি। কাটারাইফেল আর পিস্তল ফিস্তল লইয়া..
কচ্ছপ সাহেবের মুখ ফ্যাকাস ওঠে, তিনি শুকনো হয়ে ওঠা ঠোঁট চেটে দ্রুত পিএস’এর কাছে চলে আসেন, আমি অফিস থেকে চলে যাচ্ছি..
স্যার, যাইতে পারবেন না। বাইরে সব হেগোর লোক আছে। আমি নিজেই তো লুকাই আসছি আপনারে খবর দিতে।
সিকিউরিটি কোথায়?
আর সিকিউরিটি! সবতেই হেগোর লোক, হেগোরে সমঝে চলে..
আমি ওই সব পিস্তল-ফিস্তল খুব ভয় করি। নাম শুনলেই পালস্ রেট বেড়ে যায় আর দেখলে না জানি কী করি।.. কী করি বলতো হালিম?
স্যার আমারই ডর করতেছে.. আপনেরে কী বুদ্ধি দেই, সব ভয়ঙ্কর লোকজন..
এক কাজ করো..
কী বুদ্ধি স্যার?
আমি রুমে থাকি, তুমি বাইর থেকে দরজা লক্ করে দাও, আমি রুমে চুপ করে বসে থাকি।
কামটা কি ঠিক হইবে? যদি হেরা বুইঝা ফেলায়?
বুঝবে না, বুঝবে না। আগে ঝামেলা থেকে বাঁচি, তারপর দেখছি..
পিএস’কে কেবিন থেকে বেরিয়ে গিয়ে খুটখাট শব্দ করে দরজা বাহির থেকে লক্ করে দেয়। তারপরও কচ্ছপ সাহেব স্থির হয়ে বসতে পারেন না, নিজের পাওয়ারফুল কেবিনটি কিছুতে নিরাপদ মনে হয় না; সত্যি তিনি ভয় পেয়েছেন। পুলিশ বা সিকিউরিটির কারোকে যে ফোন করবে সে সাহসও হয় না, কার টাকা কে খেয়ে বসে আছে বা কার সঙ্গে কার যে লিঙ্ক রয়েছে কে জানে! বড়ো রিস্কি কন্ডিশন। তাছাড়া, এই টেণ্ডারের গোড়াতেই তো গলদ রয়েছে; ব্যাপারটি ফাঁস হলে কেলেঙ্কারীর এক শেষ অবস্থা হবে আর কে কে যে ফেঁসে যাবে! তবে সবার আগে কচ্ছপ সাহেব ফাঁসবেন সে ব্যাপারে স্বয়ং তিনি নিশ্চিত।
এসময় বাইরে অনেক মানুষের ধেয়ে চলার ধুড়ধাড়, হৈ-হুল্লোড় চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শোনা যায়। এয়ার কন্ডিশন রুমে বসেও কপাল সরু ঘামের রেখায় ভিজে উঠলে তিনি টিস্যু পেপার দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে ভাবেন, ওই সব হারামীগুলো যদি কেবিনে ঢুকে পিস্তল ঠেকিয়ে হুমকি ধামকি দিয়ে বসে কী করে নিজেকে সেফ করবেন? তাকে বেশি ভাবতে হয় না, অল্প সময়ে মাথায় দুর্দান্ত একটি আইডিয়া খেলে যায়; আমরা তো আগেই বলেছি, তিনি যতো না কায়িক শ্রম করেছেন ওপরে উঠবার জন্য তারচেয়ে বেশি মাথার ব্যবহার করেছেন, করেছেন দুষ্ট বুদ্ধির ব্যবহার। এবারও তেমনি একটি বুদ্ধি তার মাথায় ঘাই দিয়ে ওঠে। তিনি তার কেবিনের এটাচ বাথরুমে গিয়ে ঢুকেন। বৃটিশ আমলের তৈরী বিল্ডিং, বিভিন্ন আমলে ঘষা-মাজা করে নতুন করে তোলা হলেও কন্সট্রাকসনে কোনো বদল আসেনি, জমাদারের ব্যবহারের জন্য ঘুপচি একটি দরজা এখনো প্রত্নতাত্ত্বিক উদাহরণ স্বরূপ রয়ে গেছে, দীর্ঘদিন ব্যবহার না করায় জং ধরা কব্জা, ছিটকিনী। কচ্ছপ সাহেব জং ধরা ছিটকিনী খোলার চেষ্টা করতে করতে শুনতে পেলেন তার কেবিনের দরজা ধাক্কানোর শব্দ, অসহিষ্ণু মানুষের গলাবাজি। তিনি সে দিকে মন না দিয়ে জং ধরা ছিটকিনীর মোচড় খোলায় মন দিলেন, তার হিসাবের মাথা বেশ পরিষ্কার, পিস্তল বাহিনীকে দু’টি দরজা টপকে তার কাছে আসতে হবে আর তার সামনে এই মরচে ধরা আগল- তিনি মনোনিবেশ করেন তার লক্ষ্যে, খুট করে শব্দ তুলে ছিটকিনী ভেঙে যায়। মরচে ধরা কব্জার আগল ঠেলে তিনি খয়ে যাওয়া লোহার সিঁডির ধাপে এসে দাঁড়ান, সিঁডিটি দালানের পেছনে; এদিকে তেমন লোকজন নেই; কচ্ছপ সাহেব দেখলেন, তার সামনে মুক্তির সিঁডি একেবেঁকে নেমে গেছে! সে সিঁডি বেয়ে নিচে নামতে নামতে কচ্ছপ সাহেবের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে, বিড়বিড় করে বলেন; একেই বলে বৃটিশ ব্রেইন!
বিল্ডিং-এর পেছনে মুততে আসা দারোয়ান সমীরন ড্রেনের ওপর পাশের একটি কচু পাতা লক্ষ্য করে মুতের ধারাটি নিক্ষেপ করতে করতে পেছনে কিছু নড়াচড়ার শব্দ শুনে ঘুরে তাকালে দেখতে পায় সাদা শার্ট আর মেরুন টাই গায়ে ল্যাপ্টে বিশালাকৃতির একটি কচ্ছপ মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে। শার্ট টাই পরিহিত কচ্ছপ দেখে সমীরন যারপর নাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে, মুতের ধারার গতি কমে পায়ের ওপর পড়লেও হুঁস হয়না প্রথমে। কচ্ছপটিও সমীরনের দিকে মাথা উঁচিয়ে পিটপিট করে তাকায়, হঠাৎ সমীরন সশব্দে হেসে ওঠে; মানুষেরও যা রসিকতা; কচ্ছপকে কাপড় পরিয়ে সাহেব বানানো হয়েছে! সে গলা তুলে কারোকে ডাকতে গিয়েও ডাকে না, দ্রুত পেসাব শেষ করে প্যান্টের জিপার না লাগিয়ে সে ঘুরে দাঁড়ায়, কচ্ছপটি আটকাতে পারলে বেশ হয়, অনেক ছোট বেলা এরকম একটি নধর কচ্ছপ খাবার ভাগ্য হয়েছিল ওর, তারপর কত যুগ এমন চিকনাই মারা কচ্ছপ চোখে পড়ে নাই। ও আস্তে আস্তে কচ্ছপের দিকে এগোয়, সমীরনের জীপার তখনো খোলা; গরম বলে সে প্যান্টের নিচে আন্ডারওয়্যার পরে না, প্যান্টের ফাঁক দিয়ে ওর শিশ্নের আগাটিও যেন উঁকি দিয়ে কচ্ছপটি দেখে নিতে চায়। কচ্ছপও ঘাড় উঁচিয়ে সমীরনের মনোভাব বুঝতে চায়। সমীরন খালি হাতে কচ্ছপ ধরতে এগোয়, দারোয়ান হিসাবে ওর খ্যাতি আছে; ওর বাহুতে শক্তি আছে; কিন্তু চান্দিতে তেমন বুদ্ধি নাই। সমীরন কচ্ছপের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে দু’প্রানীর মধ্যে খণ্ড সময়ের জন্য ধস্তাধস্তি হয়, তারপরই সমীরন মরণ চিৎকার দিয়ে ওঠে। সে দু’হাতে মুখ খোলা জীপার দিয়ে বেরিয়ে থাকা ওর অঙ্গটি কচ্ছপের মুখ থেকে ছাড়াতে চায়; পারে না; সে লাফাতে থাকে, কচ্ছপ ওর অঙ্গটি মুখে কামড়ে ধরে ঝুলতে থাকে, সমীরন এক সময় দাঁড়ানো থেকে মাটিতে শুয়ে যায়, কচ্ছপ তখনো ওর অঙ্গটি মুখে আঁকড়ে রাখে। সমীরনের কষ বেয়ে গাঁজলা বেরোয়, ওর চিৎকার স্তিমিত হয়ে আসে, ওর শরীর নিথর হয়ে যায়, পাশে মাটিতে পড়ে থাকে ওর ছেঁড়া রক্তাক্ত শিশ্ন।
অফিসের সামনে অসংখ্য মানুষের ভিড়, বিভিন্ন পত্রিকা, টিভি’র সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার আরো নানা কিছিমের লোকজন অফিসের সামনে জড়ো হয়েছে, সবার অলক্ষ্যে শার্ট টাই পরিহিত কচ্ছপ ধীর গতিতে রাস্তার দিকে এগোয়। পায়ের দিকে কেউ তাকাচ্ছে না, সবাই অন্য দিকে তাকিয়ে আছে; মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়কে নাকি কারা জিম্মি করেছে। গেট দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে কচ্ছপটি ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পেছনে তাকিয়ে পিএস হালিমের ভাষায় ভাবে, তোগো হোগা দিয়্যা যদি বাঁশ না ঢুকাই...তোগোরে এমন কামড় দিমু, এক্কেরে যারে কয় কচ্ছপের কামড়..


মন্তব্য

রকিবুল ইসলাম কমল এর ছবি

অ্যাঁ

অতিথি লেখক এর ছবি

শয়তানী হাসি

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

কচ্ছমরফসিস? চিন্তিত

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারণ ! ! ! শেয়ার করার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ।

ব্লগারাদিত্য

রানা মেহের এর ছবি

আরে! কতদিন পর লিখলেন আপু।

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

শামীম রুনা এর ছবি

হ্যাঁ রানা। পৃথিবীতে সব কিছুই ছেড়ে যায়, লেখা যায় না। তুমিও ভাল লিখো কিন্তু।

_________________________________________________________
খাতার দিকে তাকিয়ে দেখি,এক পৃথিবী লিখবো বলে-একটা পাতাও শেষ করিনি। ( জয় গোস্মামী)

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।