কালিকা সংবাদ

শঙ্কর এর ছবি
লিখেছেন শঙ্কর [অতিথি] (তারিখ: সোম, ২৯/০৬/২০০৯ - ২:৪২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অন্ধকার বনচ্ছায়ে সরস্বতী তীরে
... ... মহর্ষি কহিলেন, 'বতসগণ,
ব্রহ্মবিদ্যা কহি, কর অবধান।'

আশ্রম বালকেরা নির্বাক হইল। মহর্ষির এই আশ্রম নিয়মানুবর্তিতার জন্য দিগবিদিকে প্রসিদ্ধ। দেশ-বিদেশ হইতে রাজা, মন্ত্রী, সেনাপতি, শ্রেষ্ঠী এবং অন্যান্য অভিজাত বংশের সন্তানেরা শিক্ষালাভের জন্য এখানে আসে। মহর্ষির বহু বতসরের নিরলস প্রচেষ্টায় আজ এই আশ্রম ভারতশ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা অর্জন করিয়াছে। কয়েক শত ছাত্র এবং কয়েক সহস্র গোধনের অধিকারী এই আশ্রমের মূল চালিকা শক্তিই হল এই কঠিন কঠোর নিয়ম।

মহর্ষির সম্মুখভাগ আলোকিত করে অধিষ্ঠান করিতেছে ভারতের ভাবী রাজন্যবর্গ। বিভিন্ন দেশের ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠদের বংশধরেরা আসিয়াছে শিক্ষালাভের আশায়। মহর্ষির বামভাগে অবস্থান করিতেছে বণিক সম্প্রদায়ের ভবিষ্যত প্রজন্ম। এই দুই প্রকার ছাত্ররা এখানে মুদ্রা এবং গোধনের বিনিময়ে শিক্ষালাভ করে। এদের পশ্চাতে কিঞ্চিত দূরে উপবেশন করে এদের ভৃত্যবর্গ। পুর্ববর্তীকালে শুদ্রদের শিক্ষালাভ নিষিদ্ধ ছিল। মহর্ষিই প্রথম উদারতার সাথে তাহাদের আশ্রমপ্রবেশের অনুমতি দিয়েছেন। ইহাতে ছাত্রসংখ্যারও শ্রীবৃদ্ধি হইয়াছে। অভিজাতনন্দনেরা তো স্বহস্তে নিজকর্ম করিতে অভ্যস্ত নহে। গুরুকুলে ভৃত্যবর্গের অনুমোদন নিঃসন্দেহে মহর্ষির দূরদৃষ্টি এবং বাস্তব বুদ্ধির প্রতিফলন। মহর্ষির দক্ষিণভাগে উপবেশন করে ব্রাহ্মণতনয়েরা।

প্রথম প্রহরের পরেই সাধারণতঃ ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যপুত্রেরা শয্যাত্যাগ করে। মুদ্রা এবং গোধনের বিনিময়ে এই সুবিধাটুকু তাহারা পাইয়া থাকে। তাহাদের প্রাতঃকালীন কর্মগুলি, যেমন আশ্রম পরিষ্কার, পরিধেয় প্রক্ষালন এগুলি ভৃত্যেরাই করিয়া দেয়। ইহা ব্যতীত, তাহাদের মনোরঞ্জনার্থে আরও বিভিন্ন প্রকার কর্মই তাহারা সম্পাদন করিয়া থাকে। এমনকি, কখনো কখনো কয়েকটি নিষ্ক-র বিনিময়ে স্থানীয় শবরদের নিকট হইতে গোপনে সুরাসংগ্রহের দায়িত্বও তাহাদের। ধরা পড়িলে চরম শাস্তি ভোগ করিতে হয় তাহাদিগকেই (রাজপুত্ররা তো আর দোষ করে না)। মহর্ষির আশ্রমে অত্যন্ত কঠোর ভাবে নিয়ম প্রয়োগ হয়।

স্নান, দ্বিপ্রাহরিক আরতি এবং মধ্যাহ্নভোজনের পরই এই শিষ্যবৃন্দ মহর্ষির কাছে দিবসের প্রথম পাঠলাভ করে। মহর্ষির পাঠদানের বিশেষত্ব হইল মহর্ষি অতীব দুরূহ নীতিবাক্যসমূহ অতি সহজ গল্পের মাধ্যমে বলে থাকেন। অধিকাংশ গল্পেরই অবশ্য মূলনীতি হল ব্রাহ্মণদিগকে দক্ষিণা দান করা এবং তাহাদের রক্ষা করাই হইল বৈশ্য এবং ক্ষত্রিয়বংশজাতদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। কৈশোর হইতে বারংবার এই ঋষিবাক্য মস্তিষ্কে প্রবেশ করাইয়া দিতে পারিলেই ভবিষ্যতে ব্রাহ্মণসমাজ আরো সুরক্ষিত থাকিবে। মহর্ষির সুখ্যাতি বংশ হইতে বংশান্তরে প্রবাহিত হইবে। সন্ধ্যারতির পর মহর্ষি ইতিহাস এবং পুরাণের কাহিনী বলিয়া থাকেন। কাহিনীর আকর্ষণে এবং অন্ধকারের সুযোগে তখন ভৃত্যেরা তাহাদের প্রভুদের নিকটবর্তী হইয়া উপবেশন করে। মহর্ষি উদার চিত্তে তখন তাহাদের ক্ষমা করে দেন।

ব্রাহ্মণ হইতে ব্রাহ্মণের কোন রকম দান বা দক্ষিণা গ্রহণ নিষিদ্ধ। কাজেই ব্রাহ্মণতনয়েরা রিক্তহস্তেই আসে। উপযুক্ত বয়স হইলে তাহারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্থলে একটি গুরুকুল স্থাপন করিবার অভিপ্রায় রাখে। সেই জন্য তাহাদের প্রচুর শ্রম করিতে হয়। আশ্রমের সমস্ত কর্ম তাহারা নিজহস্তে সম্পাদন করিয়া থাকে। ভবিষ্যতে আশ্রম পরিচালনা করিতে তাহাদের কোন অসুবিধা হইবে না, মহর্ষির এই আশা। সূর্য়োদয়ের প্রাক্কালে গাত্রোত্থানপুর্বক আশ্রম পরিষ্কার এবং গোমাতাদিগের পরিমার্জন করিয়া মহর্ষির কাছে তাহারা পাঠাভ্যাস করে। এই সময় মহর্ষি তাহাদের পুরাণ-কাহিনীর গূঢ় ব্যাখ্যা বর্ণনা করেন। যে গোপন ব্যাখ্যার বলে বলীয়ান হয়ে ব্রাহ্মণরা এখনও বর্ণশ্রেষ্ঠ।

গত সপ্তাহে মহর্ষি বিন্ধ্যজয়ের কাহিনী বর্ণনা করেছিলেন। উন্নতশির বিন্ধ্য অতিক্রম করিয়া সুর্যদেব কিছুতেই পরিক্রমণ করিতে পারিতেছিলেন না। অতঃপর ঋষি অগস্ত্য যাত্রা করিলেন দাক্ষিণাত্যের দিকে। পথে বিন্ধ্যাচলের সহিত সাক্ষাত। স্বয়ং গুরুদেবকে দর্শন করিয়া বিন্ধ্য নতমস্তক হইল। অগস্ত্য বলিলেন, 'আমার প্রস্থান পর্যন্ত এই রকমই থাক।' অগস্ত্যও ফিরিলেন না, বিন্ধ্যও মস্তক উত্তোলন করিতে পারে না। সুর্যদেব নিশ্চিন্তে তাঁর দৈনন্দিন পরিক্রমা শেষ করেন। পরবর্তী প্রভাতে, মহর্ষি এই কাহিনীর ব্যাখ্যা করিলেন। আর্য সভ্যতার কিরণ কিছুতেই দুরূহ বিন্ধ্য অতিক্রম করিতে পারিতেছিল না। ঋষি অগস্ত্য সেই পাহাড়ী পথ আবিষ্কার করিয়াছিলেন। অতঃপর সেই পথ দিয়ে আর্য সভ্যতার রশ্মি দাক্ষিণাত্যে প্রবেশ করিল। কিন্তু, দাক্ষিণাত্য ভ্রমণ কালে অগস্ত্য জানিলেন, দ্রাবিড় সভ্যতা সমৃদ্ধতর। ঋষি সমস্ত জীবন ধরিয়া আগ্রহের সহিত সেই সভ্যতার সুধা পান করিলেন, আর ফিরিলেন না। সত্য ইতিহাস মুষ্টিমেয় কয়েকজনের জানা দরকার। কিন্তু বিশ্বশ্রেষ্ঠ আর্য সভ্যতার এতো বড় পরাজয়ের কাহিনীতো সর্বসাধারণের জন্য নহে।

যেমন গত পরশ্ব মহর্ষি সমুদ্রমন্থনের ব্যাখ্যা শোনাচ্ছিলেন। তাহার পূর্বদিন সায়ংকালে তিনি সমুদ্রমন্থনের কাহিনী বর্ণনা করিয়াছিলেন। মন্দার পর্বতকে মন্থন-দন্ড করিয়া অনন্তনাগকে মন্থনরজ্জু হিসাবে ব্যবহার করিয়া দেব-দানবের সমুদ্রমন্থন। মন্থনের ফলে সমুদ্র থেকে আবির্ভাব হল ঐরাবত, চন্দ্র, ধান্যহস্তে লক্ষ্মী এবং সর্বশেষে অমৃত হস্তে ধণ্বন্তরী। অতঃপর প্রবল আকর্ষণের কারণে অনন্তনাগের মুখ হইতে বিষ নির্গত হইল। অসুররা ছিল সর্পের মুখভাগে। তাহাদের অধিকাংশই সেই বিষে নির্মূল হল। প্রভাতকালে তিনি এই কাহিনীর গূঢ় ব্যাখ্যা করিলেন। ভারত আবিষ্কারের অভিযানে স্থানীয় অসুর আর দেবপুত্র আর্যরা একসাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই বিশাল বাহিনীকে দূর হইতে একমাত্র অনন্তনাগের সাথেই তুলনা করা যাইতে পারে। পথে আর্যদের প্রথম হস্তীদর্শন হল। এই বিরাটকায় প্রাণীটির সাথে এযাবত তাহাদের কোন পরিচয় হয় নাই। তারপর তাহারা শিখিল চান্দ্রবিদ্যা - পূর্ণিমা, অমাবস্যা, তিথি ইত্যাদি। ধীরে ধীরে মন্দার পর্বতকে কেন্দ্র করিয়া বাহিনী অগ্রসর হইল। তাহারা জানিল কৃষিবিদ্যা। তাহার পরেই বংগদেশে আগমন এবং মড়কের প্রাদুর্ভাব। বাহিনীর সন্মুখের অধিকাংশ অসুর তাহাতেই মৃত্যুবরণ করিল। ভাগ্যবলে ধণ্বন্তরী নামে একজন স্থানীয় ব্যক্তির সাথে আলাপ হইল। সে কবিরাজীতে সিদ্ধহস্ত। তাহার চিকিতসা এবং পরামর্শে কোনমতে বাকীরা বাঁচিল।

ওই কৃষ্ণবর্ণ প্রেতরূপ অসুরদের সাথেই অধিষ্ঠান করিতেন মহাদেব। মড়কের বিষ হইতে তিনিও পরিত্রাণ পান নাই। ধন্বন্তরীর চিকিতসাতে তিনি প্রাণ ফিরে পেলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁহার কন্ঠে সংক্রমণ হইয়াছিল। তিনি মৃত্যুমুখ থেকে প্রত্যাবর্তন করিলে পর মহর্ষির প্রপিতামহ তাঁহার নতুন নামকরণ করেন মৃত্যুঞ্জয়। কিন্তু নীলকন্ঠ হইবার পরও তাঁহার কপালে আরও দূর্দশা ছিল। আর্য-অনার্যদের লড়াই তখনও শেষ হয় নাই। বহু জায়গায় অনার্যরা পরাজয় বরণ করিলেও বিভিন্ন এলাকায় চোরাগোপ্তা হানা তখনও অব্যাহত। তাম্রলিপ্ত এলাকায় এক সাঁওতাল নারীবাহিনীর এই রকম এক আক্রমণে শিব মৃত্যুবরণ করেন। মধ্যরাত্রে যুদ্ধজয়ের আনন্দে সুরাপানে বিহবল হইয়া বিজিত আর্যদের মুন্ডমালা পরিধান করিয়া শ্বেতকান্তি শিবের ওপরে নৃত্যরতা সেই কৃষ্ণবর্ণা রমণীকে দেখিয়া তাহার সঙ্গীদেরও নাকি ভীতিবশতঃ নেত্র উন্মোচন করিবার সাহস অবলুপ্ত হইয়াছিল। অনার্যদের মধ্যে তখনই তাহার পূজা শুরু হয়। আজ কয়েক পুরুষ আর্য-অনার্য মিলনের পরেও অনার্যদের মাঝে তাহার পূজা এখনও প্রচলিত।

অদ্য প্রভাত হইতেই মহর্ষির মন ভারাক্রান্ত। সুর্যবন্দনার পরে মহর্ষি সবে আহ্নিক সমাপন করিয়াছেন, তখনই রাজদূতের অকস্মাত আগমন। মহর্ষির নিকটে বর্তমান রাজা একটি অনুরোধ রাখিয়াছেন। আর্য-অনার্যদের বন্ধন আরও দৃঢ় করিবার জন্য তিনি আর্যাবর্তে ওই কৃষ্ণবর্ণার পূজা প্রচলন করিতে চান। এর আগেও কয়েকবার নৃপতির এই অনুরোধ মহর্ষি প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। কিন্তু এবার মহর্ষিরও মনে হইতেছে, অনুরোধ মানিয়া লওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। শত হোক, আশ্রমের শ্রীবৃদ্ধি এবং রক্ষার কার্যে রাজার সহিত বিতন্ডা সুবুদ্ধির পরিচায়ক নহে। মহর্ষি দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া শুরু করিলেন, 'বতসগণ, আজ আমি তোমাদের এক নতুন দেবীর কাহিনী শোনাব। তাঁর নাম হল দেবী কালিকা। ইনি ...'


মন্তব্য

বিপ্লব রহমান এর ছবি

লেখাটি খুব খুব ভালো। কিন্তু এটি রম্যরচনা! কস্কি মমিন!


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

শাহেনশাহ সিমন এর ছবি

আমিও বিপ্লব ভাইয়ের মত আউড়াইলাম!

_________________
ঝাউবনে লুকোনো যায় না

শঙ্কর [অতিথি] এর ছবি

থাঙ্কু। এবং হ্যাঁ, এটা পুরোই কল্পিত রম্য রচনা।

নুড়ি এর ছবি

সময় নিয়ে পড়ব। আশা করি ভালই লাগবে।

হিমু এর ছবি

শঙ্করদা, এইবার লংঅন বরাবর চার ...



হাঁটুপানির জলদস্যু আলো দিয়ে লিখি

শঙ্কর [অতিথি] এর ছবি

অভিজ্ঞ লেখকদের মন্তব্যগুলোও বাউন্ডারীর দিকে দৌড়োয়। ধন্যবাদ হিমুভাই।

দময়ন্তী এর ছবি

চলুক
আপনার মাত্রাজ্ঞান ঈর্ষণীয় শঙ্কর৷ একদম ঠিক জায়গায় থেমে গেছেন৷
কালিদাস রায় মনে পড়ল ---- "মানুষই দেবতা গড়ে, তাহারই কৃপার পরে করে দেবমহিমা নির্ভর'

আপনার জুনিয়ার পি সি সরকারকে নিয়ে লেখা গল্পটাও দারুণ লেগেছিল৷ তখন তাড়াহুড়োয় আর লগ অন করা হয় নি৷

-----------------------------------------------
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে৷'

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

শঙ্কর [অতিথি] এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ দময়ন্তী। সবে হাত-পাকানো শুরু করেছি। উতসাহ পেলে বেশ ভালই লাগে।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

গুল্লি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।