ন্যানো - শেষ পর্ব

শঙ্কর এর ছবি
লিখেছেন শঙ্কর [অতিথি] (তারিখ: সোম, ২৭/০৭/২০০৯ - ৭:৩৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

প্রোজেক্ট হঠাত শেষ। এই সপ্তাহেই কলকাতা ফিরে যাব। তাড়াহুড়োর মধ্যে বাকীটা নামালাম। ভালো হয়নি নিজেই জানি। কিন্তু, বন্ধ করে দিলে সবাই 'সিরিজখেলাপী' বলে গাল দেবে, আর ওদিকে মুপাদাদা পেটাবে বলে মেগাধমকি দিয়ে রেখেছে। সবার কাছে, এক মাসের ছুটি চাইছি।
--------------------------------------------------------------------------
ন্যানো - ১
ন্যানো - ২
ন্যানো - ৩

'হ্যাঁ নিশ্চয়ই', ক্লাসে মাস্টারমশাই একটা সহজ প্রশ্ন করলে ছাত্র যেমন তড়বড় করে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে তেমন ভাবে জবাব দিল জেমস, '২০০৯ সালে ভারতবর্ষে এই টেকনোলজির মাধ্যমে টাটারা সব থেকে সস্তার গাড়ী বের করে। তারপর তারা ব্যাঙ্গালোরে এই টেকনোলজির মাধ্যমে বাড়ী বানাবারও চেষ্টা করে।'

এম-এর স্থির দৃষ্টির সামনে কেমন যেন কুঁকড়ে গেল জেমস, 'আমি কি কিছু ভুল বললাম স্যার?'

'ভুল নয়, তবে আমি পদার্থবি্জ্ঞানের প্রশ্ন করেছিলাম, তুমি ইতিহাসের উত্তর দিয়েছ। সাত বছরের পুরনো কারিগরীবিদ্যা নিয়ে 00 বিভাগ কাজ করে না।' গম্ভীর ভাবে জবাব দিলেন এম। বন্ডের চুপসে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেই শুরু করলেন।

ন্যানো টেকনোলজি হল, সব কিছু ছোট বানাবার কারিগরীবিদ্যা। ২০০৮ সালে মেমরী এবং প্রসেসর মিলিয়ে একটা সাধারণ সার্ভারের যে ক্ষমতা ছিল, তা এখন একটা মটরদানার সাইজের কৃস্ট্যাল চিপের মধ্যে ঢুকে গেছে। ২০১৩ সালে ন্যানোমেডিক্সের অভাবনীয় উন্নতি হওয়ার পরে জাতিসংঘ সিদ্ধান্ত নেয় এবার থেকে এস.এস.এন জাতীয় আই.ডি কার্ডের বদলে বিশ্বের প্রতিটি সদ্যোজাত শিশুর মস্তিষ্কে এই চিপ এম্বেড করে দেওয়া হবে। ওই মটরদানা সাইজের চিপের ওপর একটা সরষে দানার সাইজের ইউ.এস.বি ট্রান্সরিসীভার আল্ট্রা-গ্রীন-টুথ টেকনোলজির মাধ্যমে নিকটস্থ কম্পিউটারের সাথে বিনা তারে যোগাযোগ করতে পারবে। অপারেশন করে নয়, তার বদলে দেড় থেকে দু-মাসের প্রসূতির শরীরে ১ মি.লি. লিকুইড কৃস্ট্যাল ইনজেক্ট করে দেওয়া হবে, যা পরবর্তী ছত্রিশ ঘন্টার মধ্যে প্রসূতির জরায়ুতে প্রবেশ করে ভ্রূণের ওপর সারাজীবনের জন্য এম্বেড হয়ে যাবে। একটি কৃস্ট্যালই একটি পুরো চিপ। শিশুর যখন শরীর তৈরী হবে, তখন তার মস্তিষ্কের তলায় পিটুইটারী গ্রন্থির পাশেই এমন ভাবে অবস্থান করবে চিপটি, যেন সেও বাবা-মায়ের জিন থেকে তৈরী হওয়া একটি অংশ।

এই বিশাল পরিমাণ চিপের প্রয়োজন মেটাতে বরিশাল, চট্টগ্রাম, মেদিনীপুর ও ছত্তীশগড় সহ মোট বারোটি জায়গায় কারখানা বসানো হয়। চীনও সস্তায় কারখানা বানানোর প্রস্তাব দিয়েচিল, কিন্তু চীনের খেলনা, দুধ এবং ডিমের বদনাম হয়ে যাওয়ায় কোন দেশই চৈনিক চিপ নিতে রাজী হয় নি। গত দু-বছরে ভারত এবং বাংলাদেশ বিশ্বের সমস্ত দেশে এক কোটির ওপর চিপ পাঠিয়েছে এবং সেগুলো বেশ সাফল্যের সাথেই প্রসূতির শরীরে ইঞ্জেক্ট করা গিয়েছে। কিন্তু গত দু-মাসের চিপগুলোতে প্রচুর সমস্যা দেখা দিয়েছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে শিশু গর্ভের ভিতরেই মারা গেছে। তখন মায়ের জীবন নিয়েও টানাটানি, কিছু ক্ষেত্রে মনে হয়, সন্তান বিকলাঙ্গ হবে।

- 'ফ্যাক্টরিগুলোতে কোয়ালিটি কন্ট্রোল কি ঘাস কাটছে নাকি?' জিজ্ঞেস করল বন্ড।
- না, তারা দাবী করেছে ওই ওষুধগুলো তাদের কারখানায় তৈরীই হয় নি।
- মানে?
- অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, তাদের দাবী সঠিক। ভেজাল ওষুধগুলোর ব্যাচ নং ওদের সাথে মিলছে না। ঐরকম কোন কনসাইনমেন্ট ডেস্প্যাচের কোন রেকর্ডও নেই কোথাও।
- তার মানে আর কেউ অপকর্ম করছে?
- ঠিক তাই।
- আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?
- ২০০৯ সালের মে কিংবা জুন মাসে আনন্দবাজারে একটা খবর বেরিয়েছিল। কেনিয়া এবং নাইজিরিয়াতে ভারত থেকে প্রচুর ওষুধ রপ্তানী হত। একবার এক জাহাজ কনসাইনমেন্ট ভর্তি ভেজাল ওষুধ পাওয়া যায়। পুরো কনসাইনমেন্ট বাতিল হয়। ওই দুই দেশ রপ্তানীকারক কোম্পানীগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করে। পরবর্তীকালে জানা যায়, ওই জাহাজ চীনদেশ থেকে ওই কনসাইনমেন্ট নিয়ে আসে। অবশ্যই চীন সরকার পুরো ব্যাপারটাই অস্বীকার করে।
- সে তো করবেই।
- জাতিসংঘের সন্দেহ তালিকায় ভারত এবং বাংলাদেশের রপ্তানীকারক কোম্পানীগুলোর পাশাপাশি চীনও আছে। বিশেষ করে, দুর্নামের জন্য ওরা অর্ডার পায়নি, এটাও মনে রাখা দরকার। নিজের সুনাম ফেরাতে না পারুক, ওরাও আমাদের মতই খারাপ, এটা প্রমাণ করতে পারলেও ওরা কিছু বরাত পেতে পারে। না পেলেও, অন্ততপক্ষে প্রতিযোগীর বদনাম তো করা গেল।
- এক্ষেত্রে আমার কাজ কি?
- সামনের সপ্তাহে জেনেভা থেকে জাতিসংঘের একটা দল চীন যাচ্ছে অনুসন্ধান করতে। ব্রিটেনের তরফ থেকে আমি তোমার নাম পাঠাচ্ছি। বলার দরকার নেই, তোমার কাজ অন্যান্যদের থেকে একটু আলাদা। ওরা অফিসিয়াল অনুসন্ধান করবে, খুব সম্ভবতঃ কিছুই পাবে না। তুমি আরো গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান করবে এবং সম্ভব হলে যে কারখানাগুলোতে ভেজাল ওষুধ তৈরী হচ্ছে, সেগুলোকে ধ্বংস করে দিয়ে আসবে। কিন্তু একাজ খুবই সাবধানে করতে হবে। ব্রিটেনের নাম যেন কোনমতেই জড়িয়ে না যায়। এমন কি, তুমি অপকর্ম করতে গিয়ে ধরা পড়লে আমরা তোমাকে চিনিই না।
- 'সে তো বুঝতেই পারছি', বেজার মুখে বলে বন্ড।
- এই ফাইলটাতে প্রয়োজনীয় সব খবর পাবে। গুড লাক জেমস।

ফাইল হাতে বেরিয়ে এল বন্ড। মানিপেনীর সামনে এসে জিজ্ঞেস করল, 'একটা ছোট্ট প্রশ্ন ছিল?'

- বল জেমস।
- চীনদেশে মেয়ে পটাতে হলে কি করা উচিত? ওরা কি আরশোলা বেশি পছন্দ করে, না আইসক্রীম?
- "তা তো বলতে পারছি না। এক নং জেমসের এ সমস্যা ছিল না। ওর এমন একটা আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিল, মেয়েরা ওর চারিদিকে ঘিরে 'আমি পটবো, আমাকে পটাও' বলে নাচতে থাকতো।" এক নম্বর জেমসের কথা উঠলেই কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে যান মিস মানিপেনী। ওনার নিজেরও তো একটু দুর্বলতা ছিল তাঁর প্রতি। “তুমি বরঞ্চ এ কদিনের মধ্যে একটা 'পার্সোনালিটি ডেভেলপমেন্ট'-এর কোর্স করে নাও। মেয়ে পটাতে কাজে দিতে পারে। আর শোনো, ঠিক সাড়ে পাঁচটার সময় অস্ত্রাগারে মিঃ ওয়াগনার তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবেন। আর মাত্র পনের মিনিট তোমার হাতে আছে। অতএব, শিগগির রওনা দাও।”

বন্ডের অপসৃয়মান দেহটার দিকে তাকিয়ে মানিপেনী অস্ফুটস্বরে যা বললেন, পাতি বাংলায় তার মানে হল, 'বিশুদ্ধ ষাঁড়ের গোবর।'

ন্যানো - ৪

অস্ত্রাগারে বন্ডের এই প্রথম আগমন। আগমন পথের দুদিকে সজ্জিত অস্ত্র-শস্ত্র গুলো দেখতে দেখতে কেমন যেন শিরদাঁড়ায় শিরশিরানি লাগে। একটা বড় টেবিলের ওপারে বসে ছিলেন মিঃ ওয়াগনার। তার পাশে বসে হাসছিল একটি কালাপাহাড়। বন্ডকে দেখে হাসতে হাসতে এগিয়ে এল সে। করমর্দন করে বলল, 'মিঃ বন্ড। আপনি তো একদম বাচ্ছা ছেলে।' ফিরে বসের দিকে তাকিয়ে বলল সে, 'আজকাল মিঃ এম তাহলে অল্পবয়সীদেরও চান্স দিচ্ছেন স্যার।'

- 'না দিয়ে উপায় আছে? বয়স কম হলে ইন্সিওরেন্সের প্রিমিয়ামটাও তো কম লাগবে। এম-কে তো বাজেটের দিকটাও দেখতে হয়', ধীরে ধীরে গুছিয়ে বললেন মিঃ ওয়াগনার।

মিঃ ওয়াগনারের সাথে বন্ডের এই প্রথম সাক্ষাতকার। বয়স্ক ভদ্রলোক, ভীষণ ধীরে ধীরে শান্ত ভঙ্গীতে কথা বলেন। আর যন্ত্রপাতিগুলোকে এমন সাবধানে নাড়াচাড়া করেন যেন ওগুলো মিং যুগের ডিমের খোলসের ওপর আঁকা চীনা ছবি।

- এই আংটিটা দেখছেন মিঃ বন্ড। ওপরটা একদম আয়নার মত চকচক করছে।
- 'হ্যাঁ হ্যাঁ। পেছন থেকে কেউ আক্রমণ করছে কিনা দেখতে পাবো, তাই না?' কথাটা বলে ফেলে মিঃ ওয়াগনারের শীতল চাহনির দিকে তাকিয়ে ঢোঁক গিলল বন্ড।
- এই কোনায় যে সরষেদানার মত জিনিসটা দেখছেন, ওটা একটি আল্ট্রা-গ্রীন-টুথ ইউ.এস.বি ট্রান্সরিসীভার। যে কোন কম্পিউটারের তিন ফুটের মধ্যে দাঁড়ালে ও তাকে হ্যাক করে ড্রাইভের সমস্ত তথ্য আমাদের আই.টি বিভাগের একটি মেশিনে পাঠিয়ে দেবে। ওখানে আপনার নামে একটি ড্রাইভ আলাদা করে রাখা আছে। সমস্ত তথ্য সেখানে জমা হবে। আশি জি.বি. ডেটা পাঠাতে দেড়শ সেকেন্ডের বেশি সময় নেবে না এটি। মানে আপনি এক টেরাবাইট ডেটা পাঠাতে চাইলে আধঘন্টার মত দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আপনাকে মেশিনের পাশে।
- বাঃ।
- আর ডান কানে এই দুলটা পরে নিন। এটার মাধ্যমে আপনি আমাদের কাছ থেকে কোন আদেশ থাকলে শুনতে পাবেন।
- কিন্তু আমি কিছু জানাতে চাইলে, কিভাবে জানাবো?
- এম আশা করেন না, আপনার কোন আদেশ দেওয়ার থাকতে পারে।
- কিন্তু আমার তো কোন অনুরোধও তো থাকতে পারে। কিংবা মিশন খতম হলে একটা খবরতো পাঠাতে পারি।

পাক্কা তিন মিনিট চুপ করে থাকলেন মিঃ ওয়াগনার। তারপর, জেমসের বক্তব্যের যুক্তি মেনে নিয়ে ছোট্ট একটা ফোনালাপ সেরে নিলেন এম-এর সাথে। অবশেষে, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, দুজন বিশাল চেহারার গুন্ডাকে ডেকে পাঠালেন তিনি। বন্ড কিছু বোঝার আগেই, তারা তাকে একটা চেয়ারের মধ্যে ঠেসে ধরল, মুখটা হাঁ করালো এবং একটা পেছনদিকের একটা দাঁত (molar tooth) তুলে নিল। মিঃ ওয়াগনার সেখানে একটা নকল দাঁত বসিয়ে দিয়ে বললেন, 'এটার মাধ্যমে আপনি হেড অফিসের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারবেন। কথা বলা আর শোনা দুটোই চলবে এটার মাধ্যমে।'

বন্ড দাঁতের ব্যথায় কাতর হয়ে গালে হাত দিয়ে বসেছিল। সেদিকে না তাকিয়েই বলে চললেন তিনি, 'এটা আমি আপনাকে দিতে চাইনি। এমন নয় যে আপনার দাঁতের প্রতি আমার প্রচুর মায়া আছে। কিন্তু এটার দাম আপনার চার মাসের মাইনের সমান। আপনি যদি ফিরে না আসেন, অনেকগুলো টাকা গচ্চা যাবে আমার। আজকাল গ্র্যান্ট পাওয়া যে কি কঠিন হয়ে গেছে, সে এক আমিই জানি। আর আপনিও এমন জোর জবরদস্তি শুরু করলেন। যাক, ভালোয় ভালোয় সদন্ত ফিরে আসুন।'

মিঃ ওয়াগনার একটু থেমে বললেন, 'তবে একটা ভালো খবর আছে। এক্ষুনি ফোনে এম বললেন, ভারত থেকেও একজন কিছুদিন ধরে এই ব্যাপারে গোপনে অনুসন্ধান করছেন। তিনি আপনাকে প্রয়োজনীয় সাহায্য করবেন।'

- কিন্তু আমি তাকে চিনবো কি করে।
- এম বলেছেন, তাঁকে চিনতে হবে না। সময়মতো তিনিই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে নেবেন।

ন্যানো - ৫
সুইস এয়ারের বোয়িং ৯০১ মাটি ছোঁয়া মাত্র হাঁফ ছাড়লো বন্ড। এতক্ষণ আক্ষরিক অর্থেই মোটামুটি স্যান্ডুইচ হয়ে ছিল সে। একে তো মাঝখানের সীট। ডানদিকে একজন জাপানী সুমো, বাঁদিকে তার সাথে পাল্লা দিয়ে এক প্রৌঢ়া আফ্রিকান রমণী। গত বারো ঘন্টা এই দুই চর্বির পাহাড়ের মাঝে পুরো সিঁটিয়ে ছিল বন্ড।

রিসেশনের কারণে আজকাল সমস্ত এয়ারলাইন্স সব রকমের ফ্রিল বেনিফিট বন্ধ করে দিয়েছে। কাজেই টিভি বন্ধ, খাওয়া বন্ধ, এমনকি জলটা পর্যন্ত কিনে খেতে হবে। টয়লেটের দরজায় পয়সা ফেলার স্লট পর্যন্ত লাগানো আছে। পয়সা ফেললে অবশ্য সব কিছুই পাওয়া যায়। এমন কি, উদ্ভিন্নযৌবনা বিমানবালা কোলে বসে জল খাইয়ে দিতেও আপত্তি করবে না। কিন্তু বন্ডের যা দৈনিক এলাওন্স তাতে ওসব স্বপ্ন না দেখাই ভালো। গত বারো ঘন্টায় দুটো বার্গার আর তিন মগ বীয়ার ছাড়া অন্য কিছুর অর্ডার দেওয়ার সাহসই করেনি সে। তিন মগ বীয়ারের দৌলতে বাড়তি দুবার টয়লেটে যেতে হয়েছিল তাকে। পয়সার শ্রাদ্ধ।

ক্লান্তদেহে গেস্ট হাউসে পৌঁছে অবশ্য নিশ্চিন্ত হল সে। জাতিসংঘের অনুসন্ধানকারীদলের জন্য যথাসম্ভব আরাম এবং বিলাসের চেষ্টা করেছিল কোম্পানীটি। পাঁচতারা অতিথিশালার ঘরে ঢুকে এই প্রথম নিজেকে জেমস বন্ড মনে হল রবার্ট বেকারের। বাথটাবের ঠান্ডা জলে আধঘন্টা শুয়ে শুয়ে একটা চীনা মেয়েকে সিনাতে লাগিয়ে সারারাত কাটাবার স্বপ্ন দেখল সে। তারপর স্নান সেরে পোশাক পরে চটপট ডিনারের জন্য তৈরী হয়ে নিল।

ডিনার টেবিলে মনে হল, বন্ডের স্বপ্ন সফল হতে যাচ্ছে। অতিথিদের বিলাসের ব্যাপারে কোন কার্পণ্য করেনি কোম্পানীটি। প্রত্যেকের জন্য একটি চৈনিক সুন্দরীর ব্যবস্থা ছিল। খাওয়া-দাওয়ার পর সিনিয়র অফিসারেরা তাঁদের পদাধিকারবলে একেক জন একেকটি সুন্দরী চীনাবালা হাতে জড়িয়ে নিজের নিজের ঘরে ঢুকে পড়লেন। বন্ডের কপালে জুটলো একটি চীনাখালা। শেষ মুহুর্তে বন্ডের নাম লিস্টে ঢুকে যাওয়ায়, রাজকন্যা কিছু কম পড়েছিল। মহিলা পেন্সন নিতে এসেছিলেন। সবাই মিলে বোঝাল, এই সুযোগে কিছু কামিয়ে নাও। উনিও রাজী হয়ে গেলেন।

ঘরে ঢুকে ভ্যানিটি ব্যাগ বের করে একটা প্রেসারের ওষুধ আর একটা ঘুমের ওষুধ গলাধঃকরণ করে পিসিমা জিজ্ঞেস করলেন, 'তা হ্যাঁগা ভালমানুষের পো, তোমার আবার নাকের ডাক শুনলে ঘুমের ব্যাঘাত হয় না তো?' কোন অসুবিধা নেই শুনে, উনি নিশ্চিন্তে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন। বন্ডের বাকি রাত কাটলো সোফায় শুয়ে নাসিকা গর্জন শুনতে শুনতে।

প্রাতরাশের পরেই কারখানা পরিদর্শনের কথা ছিল। একটা বিশাল বিল্ডিং। মাঝখানটা একটু ফাঁকা। চারপাশে একতলা, দোতলা করে বারোতলা পর্যন্ত ব্যালকনি। যে কোন ব্যালকনি থেকেই মাঝের ফাঁকা জায়গাটা দেখা যায়। ওই খানেই আছে, এই কারখানার হৃতপিন্ড - মেন সার্ভার। একটু পুরনো দিনের, অপ্টিক্যাল প্রসেসর দিয়ে চলে, মানে সি.পি.ইউ ইত্যাদির মধ্যে কথাবার্তা ইলেক্ট্রনের মাধ্যমে হয় না, আলোর মাধ্যমে চলে। ২০০৭-এ ইন্টেল প্রথম এই প্রসেসর বানায়। এখন অবশ্য এগুলো পুরনো কারিগরীবিদ্যা। কিন্তু এটা আজ পর্যন্ত কোন গন্ডগোল করেনি বলে কর্তৃপক্ষ এটাকে আর বদলায় নি।

দলের সাথে ঘুরতে ঘুরতে হঠাত বন্ডের মনে হল, কে যেন তাকে ডাকছে। একটু পরে বুঝলো, তার সেই দামী দাঁতের থেকে কথা বেরোচ্ছে, 'সামনের তিন নং ঘরটা খুলে দেখ।' ভালো ছেলের মত বন্ড সেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, 'এই ঘরটা একটু খুলে দেখা যাবে?'

- হঠাত।
- না আমরা তো দেখতেই এসেছি। একটা র‌্যান্ডম চেক করে দেখিই না।

একটু গাঁইগুঁই করে সিকিওরিটির লোকেরা মেনে নিতে বাধ্য হল। কারণ, বেশি না না করলে পুরো টিমই বিগড়ে যেতে পারে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে যতো রাজ্যের নোংরা আর দুর্গন্ধ। দলের নেতা যেভাবে বন্ডের দিকে তাকালেন, বাংলা জানলে সে নিশ্চয়ই বলতো, 'মা ধরণী, দ্বিধা হও।'

দ্বিতীয় বার যখন দাঁতমশাই পাঁচ নং ঘরটা খুলে দেখার অনুরোধ করলেন আর বন্ড দ্বিধাভরে সেটাও দেখতে চাইলো, দলনেতা নিজেই তাতে আপত্তি করে উঠলেন, 'থাক থাক, দেখলাম তো একটা।'

তিনটে তলা দেখতে দেখতেই সবার খিদে পেয়ে গেল। লাঞ্চে যাবার আগে সবাই একবার সেই পুরনো কম্পিউটারটা দেখতে এল। চারধারে সব কর্মচারীরা মৌমাছির মত ব্যস্ত। কিছু শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের লোকও নজরে পড়ল। বন্ড সবার থেকে আলাদা হয়ে একা একাই ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সকালের লজ্জাকর ঘটনাটা সে এখনও ভুলতে পারেনি।

একটা রোগা কালো শুঁটকো লোক যখন হঠাত তার সামনে এসে পুরো বত্রিশটি মুলো বের করে দিল, সে একটু সরে যাবারই চেষ্টা করল। এখনও তার মনে পরে না, সরে যেতে গিয়ে তার নিজের পায়ের ধাক্কাতেই এসিডের বোতলটা পড়ে গেল, নাকি ওই লোকটা ইচ্ছে করেই এসিডের বোতলটা ফেলে দিল। কিন্তু, তার সঙ্গে সঙ্গে, 'এসিড, এসিড' বলে যে রকম চিতকারটা সে জুড়ে দিল, তাতে সবাই ছুটে এল। বন্ড হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সবাই মিলে এসিডটা মুছে ফেলে দিল বটে, কিন্তু জাতিসংঘের নেতা, তার দিকে বেশ কড়া চোখে তাকালেন।

মনের দুঃখে লাঞ্চের পর সারাদিনটা বন্ড একা একা একটা ফাঁকা জায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ওই কালো সজনের ডাঁটাটাকে সে কোথায় যেন আগে দেখেছে। কিছুতেই মনে আসছে না।

ন্যানো - ৬
ডিনার টাইমে একটা মেয়েকে পটাতে পারল বন্ড। নাম মিয়াওঁ চেং। সেও বৃদ্ধ সঙ্গী নিয়ে খুশি ছিল না। ইশারায় জানিয়ে দিল যে রাত একটু বেশি হলেই সে চলে আসবে। বুড়ি পিসি আজকেও এসে ঘুমিয়ে পড়ল। আর অপেক্ষা করতে করতে কখন যে বন্ড ঘুমিয়ে পরেছিল, নিজেও জানেনা।

ঘুম ভাঙ্গলো একটা বিকট চিতকারে।
- ব্যাটা অনড্বান, অপদার্থ অকালকুষ্মান্ড, বরাহনন্দন, কুম্ভীরসূত, অজাকুমার, রাসভতনয়। পড়ে পড়ে ঘুমোবার জন্য এসেছ? শিগগির বেরিয়ে হলে গিয়ে ডানদিক থেকে তিন নম্বর কম্পিউটারটার সব ডেটা পাঠিয়ে দাও।

তাড়াতাড়ি ধড়াচূড়ো পরে বেরোল বন্ড। হল ঘরে যাওয়ার রাস্তাটা এখন ফাঁকা। সর্পিল গতিতে তিন নম্বর মেশিনের পেছনে গিয়ে বসল সে। তারপর, আংটিটা তুলে মেশিনের গায়ে ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে রইল। প্রায় আধঘন্টা হয়ে যাবার পর যখন মনে হল, সব ডেটা চলে গেচে, ফিরে আসার চেষ্টা করল বন্ড। আর তখনই মাথায় বাড়ি খেয়ে অজ্ঞান। অজ্ঞান হওয়ার আগে শুধু শুনতে পেল, 'মিয়াওঁ ঘরে ঢুকে খালি ঘর দেখেই সিকিওরিটিকে যোগাযোগ করল ...'

পরের দিন সকালে জাতিসংঘের সবাই যখন জানলো ব্রিটিশ ছেলেটি চলে গেছে, কেউ মাথা ঘামালো না। নেতা ভদ্রলোকতো খুশিই হলেন, ঝামেলাটা বিদায় হয়েছে। বন্ড সারাদিন সেই নোংরা ঘরটাতে বন্দী হয়ে রইল, যেটা তার কতথায় খুলতে হয়েছিল। সন্ধ্যেবেলা সবাই চলে গেলে পর বন্ডের বিচার শুরু হল।

বিচার না বলে শাস্তিদানপর্ব বলাই ভালো। আর সেটাকে দৃষ্টান্তমুলক করার জন্য হলঘরকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। অপ্টিক্যাল কম্পিউটারের সামনে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে বন্ড। পাশেই একটা লেজার জেনারেটর। কিভাবে লেজার রশ্মি বন্ডের শরীর এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেবে তার ডেমোটা দেখানো হল সবাইকে। তকনই বন্ডের দাঁত কথা বলে উঠলো, 'তোমার জামার দ্বিতীয় বোতামটায় লেজার তাক করা হবে। আংটিটা ওখানে রেখে দিও। আর, সামনের কম্পিউটারের যেখানে লাল আলোটা জ্বলচে, তার নীচের ফুটোটা দেখ। প্রতিফলিত রশ্মি যেন ওই ফুটো দিয়ে ঢুকে যায়। আমি 'এবার' বলা মাত্র আংটিটা বোতামের সামনে নিয়ে এস। একটু ভুল হলেই মরেচ।'

সেই কালা নেংটি লোকটাই লেজ়ারটা চালাবে। বন্ড এদিক-ওদিক তাকালো, কিন্তু কে যে তাকে সাবদান করে দিল, কিচু বুজতে পারলো না। হটাত শুনলো 'এবার' আর রিফ্লেক্স একশনে হাত উঠে গেল বুকের ওপর। আলোটা ঠিক জায়গাতেই ফেলতে পেরেছিল নিশ্চয়ই, কারণ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সব আলো নিভে গেল, আর কে যেন বন্ডের দড়ি-দড়া খুলে ওকে টানতে লাগলো। বন্ড এটুকু বুঝলো পালাতে হবে আর সে হাতের টানের দিকেই দৌড় লাগালো।

দৌড়তে দৌড়তে একটা টানেলের মধ্যে এসে পড়লো ওরা। টানেলের মাথায় গেট, সঙ্গী লোকটি পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে বের হতে না হতেই শুরু হল বিস্ফোরণ। কোনমতে সামনের জঙ্গলটা পেরিয়ে ওরা একটা খালের ধারে এসে পড়ল। সেকানে সঙ্গীর সাম্পানটা বাঁধা ছিল। ওটায় চড়ে বসল ওরা। এতোক্ষণে চাঁদের আলোয় এসে গেছে ওরা। বন্ড দেখল, সেই কালো শুঁটকো চেহারার লোকটিই সাম্পান চালাচ্ছে।
- যাক, যমের মুক থেকে ফিরে এসেছ ভায়া।
- আপনি, কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম আপনি ওদেরই লোক।
- সবাই তা না ভাবলে কি তোমাকে নিয়ে এভাবে বেরিয়ে আসতে পারি?
- তাহলে কাল সকালে ওভাবে এসিড ফেলে আমাকে বে-ইজ্জত করলেন কেন?
- না হলে, সবাই থতমত খেয়ে ছুটে না এলে, আমিও পাহারাদারের পকেট মেরে ওই গেটের চাবিটা বাগাতে পারতাম না।
- আপনিই কি আমাকে নির্দেশ দিতেন?
- এই বিদেশ-বিভুঁয়ে আর কে ছিল তোমার সাথে?
- কিন্তু আমিতো দেখলাম আপনি লেজার বীম সেট করছিলেন। কথা বললেন কি করে? আপনার মুখ তো নড়ছিল না।
- ভেন্ট্রিলোকুইজম শুনেছ?
- আর ওটা যে কম্পিউটারকে ধ্বংস করে দেবেন জানলেন কি করে?
- পুরনো ম্যানুয়াল পরে।
হঠাত বন্ডের মনে পড়ে গেল, 'পরশু সকালে ওভাবে বে-ইজ্জত করার কারণটা দয়া করে বলবেন কি?'
- নিশ্চয়ই বলব। প্রথম ঘরটা সবাইকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য। দ্বিতীয় ঘরটাতেই তো আমার RFX (RDX-এর নতুন ভার্সন) গুলো রাখা ছিল। ওটা যাতে কেউ খুলতে না চায় তাই ওই ভাবে আগেরবারের ধোঁকাটা দিতে হল।
- আর মাঝরাতের ওই বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি কথাগুলো না বললেও বোধ হয় চলতো।

ঘনাদা উত্তর দেওয়া আগেই বন্ডের মোবাইল বেজে উটলো।
- 'হাই বব, ফিলিপ বলছি।'
- আরে ফিলিপ। কি খবর বল।
- জব্বর খবর ইয়ার। মনে আছে ছয়মাস আগে ম্যাকডোনাল্ডের ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। আজ রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমরা চারজনেই চান্স পেয়েছি। ডেলিভারী বয়ের কাজ। তুই কখন আসছিস?


মন্তব্য

মূলত পাঠক এর ছবি

হুমকি দিলে যদি এমন লেখা পড়তে পাওয়া যায় তো আগাম দশটা হুমকি দিয়ে রাখলাম। এইটা আপনার ভালো হয়নি'র নমুনা?

শুধু গল্পের গঠন আর রসের প্রশংসাই নয়, এর মধ্যে আরো অনেক চমৎকার জিনিস চোখে পড়লো। ব্যাঙ্গালোরে রিয়েল এস্টেটের হাইপ নিয়ে ব্যঙ্গ, নো-ফ্রিল এয়ারলাইন্সের বাড়াবাড়ি, গুগাবাবার রেফারেন্স, এমন কি রানার কবিতায় যেমন 'একে যে ভোরের আকাশ পাঠাবে সহানুভূতির চিঠি' রয়েছে সেইরকম চৈনিক থিমের সাথে মিলিয়ে উপমা দেওয়া দেখে ('যন্ত্রপাতিগুলোকে এমন সাবধানে নাডা়চাডা় করেন যেন ওগুলো মিং যুগের ডিমের খোলসের ওপর আঁকা চীনা ছবি') মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। গুগল করে তার ছবিও দেখে নিলাম এইখানে

একমাস লেখা পাবো না জেনে মোটেও ভাল্লাগ্লো না। ট্রাভেল করার সময় বিমানখালাদের অবলোকন করতে করতে প্লট ভাবতে থাকুন যাতে ফিরে এসেই অনেকগুলো গল্প লিখে ফেলতে পারেন। শুভ যাত্রা।

জাহিদ হোসেন এর ছবি

কিছু মনে করবেন না, আমি কিন্তু একটু আশাহত হয়েছি। সময়ের স্বল্পতার কারণে আপনি হয়তো তড়িঘড়ি করে শেষ করতে চেয়েছিলেন লেখাটিকে। কাহিনীটিতে বন্ড সাহেব গোটা জায়গাটিই দখল করে ফেলেছে, দাস বাবুর কপালে বেশী জোটেনি। আরো একটু রসিয়ে রসিয়ে গল্পটিকে বয়ান করলে ভালো লাগতো আমার কাছে।
যাই হোক-আপনার কাছে থেকে আমার আরো অনেক ভালো ভালো লেখা পাবো এই বিশ্বাস আমাদের সবার আছে। হ্যাভ আ সেফ ট্রিপ!
_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

_____________________________
যতদূর গেলে পলায়ন হয়, ততদূর কেউ আর পারেনা যেতে।

গৌরীশ রায় [অতিথি] এর ছবি

বলছেন তাড়া লিখা ।

আমার কাছে খুবই ভাল লাগল ।

দময়ন্তী এর ছবি

হুমমমম
---------------------------------------
"নিভন্ত এই চুল্লিতে মা
একটু আগুন দে
আরেকটু কাল বেঁচেই থাকি
বাঁচার আনন্দে৷'

-----------------------------------------------------
"চিলেকোঠার দরজা ভাঙা, পাল্লা উধাও
রোদ ঢুকেছে চোরের মত, গঞ্জনা দাও'

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

ঘনাদার জন্যে হতাশা।
... আর লেখাটা পড়ে মনে হলো এটা একটা মুভির জন্যে বেশ মানানসই। কল্পনার দৌড় আছে আপনার, মানতেই হবে। ---------------------------------------------------------------------------
- আমি ভালোবাসি মেঘ। যে মেঘেরা উড়ে যায় এই ওখানে- ওই সেখানে।সত্যি, কী বিস্ময়কর ওই মেঘদল !!!

বইখাতা এর ছবি

আমি কিন্তু একটু হতাশ হলাম।
আপনি সবকিছু নিয়ে থিতু হয়ে আরেকটা জমজমাট গল্প দিন। অপেক্ষায় রইলাম।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।