মহাগর্জনের মহাকর্ষণ

শিক্ষানবিস এর ছবি
লিখেছেন শিক্ষানবিস (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৫/০২/২০১৫ - ৬:২১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

... অকস্মাৎ
পরিপূর্ণ স্ফীতি-মাঝে দারুণ আঘাত
বিদীর্ণ বিকীর্ণ করি চূর্ণ করে তারে
কালঝঞ্ঝাঝংকারিত দুর্যোগ-আঁধারে।
— নৈবেদ্য (৬৫), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

স্ফীতি একটা বুনো আগুন—একবার শুরু হলেই হলো, পুরো বন না জ্বালিয়ে থামবে না। আর বনটার যদি কোনো শেষ না থাকে? গুথ, স্তারোবিনস্কি এবং লিন্দে কহেন, মহাস্ফীতি'র (cosmic inflation) কারণেই নাকি আমাদের মহাবিশ্বকে অনস্তিত্বের বদলে অস্তিত্ব বেছে নিতে হয়েছে।

গত বছরের মার্চে এক মার্কিন বিজ্ঞানীদল অ্যান্টার্কটিকায় স্থাপিত অণুতরঙ্গ (মাইক্রোওয়েভ) দুরবিন বাইসেপ২ দিয়ে করা পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে দাবী করেছিলেন, মহাস্ফীতি প্রমাণিত। তারা একেবারে স্থানকালের জন্মলগ্ন থেকে আসা একটা সংকেত পর্যবেক্ষণের দাবী করেছিলেন। মহাবিশ্বের আদিলগ্নে—মহাগর্জনের (big bang) এক সেকেন্ডের শতকোটি ভাগের শতকোটি ভাগের শতকোটি ভাগের এক ভাগ সময় পর—মহাস্ফীতির মাধ্যমে সৃষ্ট মহাকর্ষতরঙ্গ তখনকার ফোটনের মধ্যে একটা সংকেত পুরে দিয়েছিল। অণুতরঙ্গরূপী ফোটনের কাঁধে ভর করে সেই সংকেতের আমাদের কাছে আসার কথা। সংকেতটা হয়ত আসলেই আছে, কিন্তু আবিষ্কারের দাবীটা শুরু থেকেই ছিল বড্ড গোলমেলে। অবশেষে এ বছরের জানুয়ারিতে এক ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদল বাইসেপ২-দলের সাথে মিলে প্লাংক উপগ্রহ আর বাইসেপ২ দুরবিনের পর্যবেক্ষণ যৌথভাবে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন: বাইসেপ২ ভুল, আদিম মহাকর্ষতরঙ্গ পাওয়া যায়নি, মহাস্ফীতি প্রমাণিত নয় (অবশ্যই অপ্রমাণিতও নয়)।

বাইসেপ২ এর পর্যবেক্ষণটা নির্ভুল হলে নিঃসন্দেহে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বলে চিহ্নিত হতো। মহাবিশ্ব কিভাবে অস্তিত্বে এসেছে তা নিয়ে এতকাল বিজ্ঞানীদেরকে কেবল অনুমানঝড়ই চালাতে হয়েছে; এটা নির্ভুল হলে প্রথমবারের মতো সেই বিজ্ঞানীরা পায়ের নিচে মাটি পেতেন। এটা অতিক্ষুদ্র জগৎ এবং অতিবৃহৎ জগৎ এর সেরা তত্ত্ব দুটি—কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও সাধারণ আপেক্ষিকতা—কে একত্রিত করতে সাহায্য করত। এবং হয়ত অন্যান্য মহাবিশ্বের অস্তিত্ব সম্পর্কে পরোক্ষভাবে হলেও কিছু জানাত। এই আবিষ্কারের উত্তরকাণ্ড যখন এত বিশাল হতে পারত, তখন সে কাণ্ড না শুনিয়েই তার চূর্ণ হওয়ার কাহিনী শোনানোটা অসৌজন্যতা।

নাটকের পটভূমি

বাইসেপ২ আর প্লাংক এর এই নাটকীয় পর্যবেক্ষণসমরের পটভূমি কী? শুরু আদি মহাবিশ্বের দুটি আপাতস্ববিরোধী বৈশিষ্ট্য দিয়ে, এই সংকেত সত্য হলে যেগুলোর সমাধান করতে পারত।

প্রথম স্ববিরোধিতাটি মহাবিশ্বের বৃহৎ-পরিসর কাঠামো নিয়ে। ১৩৭৫ (±১১) কোটি বছর আগে জন্ম নেয়ার পর থেকেই মহাবিশ্ব প্রসারিত হয়ে চলেছে। এতকাল ধরে প্রসারিত হওয়ার পরও তার স্থান সমতলই রয়ে গেছে। আমরা সাধারণত নিজেদেরকে একটা সমতল, ত্রিমাত্রিক মহাবিশ্বের—যে বিশ্বে আলো গড়পরতায় সরলরেখা বরাবর চলে—বাসিন্দা বলেই ভেবে থাকি। তবে এখানে স্ববিরোধিতা কোথায়?

স্ববিরোধিতা এইখানে যে, সাধারণ আপেক্ষিকতা অনুসারে একটি সমতল মহাবিশ্ব গঠিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। মহাবিশ্বের সিংহভাগ শক্তি যদি পদার্থ বা বিকিরণ দিয়ে গঠিত হয়—যা আমাদের ইতিহাসের অধিকাংশ সময় জুড়েই সত্য ছিল—তাহলে কখনো সামান্য অসমতলতা দেখা দিলেই মহাবিশ্বের প্রসারণের সাথে সাথে তা অনেক বাড়তে থাকবে এবং একসময় মহাবিশ্ব একদম বক্র হয়ে যাবে। শুরুতে যদি মহাবিশ্ব সামান্য একটুও বক্র হতো তাহলে বর্তমানে সে হয় মুক্ত—ঘোড়ার জিনের মতো বাঁকা—নয় বদ্ধ—গোলকপৃষ্ঠের মতো—হতো। মহাবিশ্ব যেহেতু এখনো খুব সমতল সেহেতু শুরুতে সে নিশ্চয়ই আরো অনেক বেশি সমতল ছিল যা একরকমের অবিশ্বাস্য। শুরুতে এত ব্যতিক্রমী রকমের সমতল একটা মহাবিশ্ব কিভাবে তৈরি হলো?

দ্বিতীয় আপাতস্ববিরোধিতা'র বিষয়বস্তু হচ্ছে এই যে, মহাবিশ্বকে সবদিকে দেখতে একইরকম লাগে—মহাবিশ্ব সমরূপ। এও বেশ অদ্ভুত। মহাবিশ্বের এক প্রান্তের আলো কেবল সাম্প্রতিককালে অন্য প্রান্তে পৌঁছাতে পেরেছে। এর অর্থ, অতীতে অনেক দূরে অবস্থিত দুটো জায়গা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি (পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায়, তাদের মধ্যে কোনো causal contact হয়নি।) তাহলে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে বিবর্তিত হয়ে তারা দেখতে কিভাবে একরকম হলো?

১৯৮০ সালে তরুণ ডক্টরেটোত্তর পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালান গুথ এই স্ববিরোধিতা দুটি নিয়ে ভাবতে গিয়ে এক আশ্চর্য সমাধানে উপনীত হন: কণা পদার্থবিজ্ঞানের ধারণা কাজে লাগিয়ে তিনি অনুমান করেন, হয়ত মহাবিশ্ব জন্মের ঠিক পরপর খুব কম সময়ে বেলুনের মতো করে অনেক ফুলে গিয়েছিল। গুথ এই ধারণার নাম দেন মহাজাগতিক স্ফীতি আর তত্ত্বটির নাম হয় স্ফীতিতত্ত্ব। এই ধারণায় তিনি এসেছিলেন কণা পদার্থবিজ্ঞানের প্রমিত মডেলের একটা কেন্দ্রীয় ধারণা—স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিসাম্য ভাঙন—নিয়ে ভাবতে গিয়ে। একীভূত কিছু বল (force) পরস্পরের থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর কী ঘটে তা-ই এই ধারণাটা দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়। প্রতিসাম্য বলতে বলগুলোর যুক্তাবস্থাকে বুঝানো যেতে পারে।

মহাবিশ্বের ইতিহাসে যে অন্তত একবার স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিসাম্য ভেঙেছে তার পক্ষে জোড়ালো প্রমাণ আছে। তাড়িতদুর্বল তত্ত্বানুসারে, মহাবিশ্বের দুটি মৌলিক বল—তড়িচ্চুম্বকীয় বল (তড়িৎ ও চুম্বকের বল) এবং দুর্বল নিউক্লীয় বল (পরমাণুর নিউক্লিয়াসের তেজস্ক্রিয় ভাঙন যার কারণে ঘটে)—কে বর্তমানে আলাদা দেখায় কেবল এই কারণে যে, অতীতে একসময় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল। দুর্ঘটনার আগে এই দুটি একসাথে একটি একক বল হিসেবে ছিল।

কিন্তু মহাবিশ্ব ঠাণ্ডা হতে হতে এক সেকেন্ডের এক লক্ষ ভাগের এক কোটি ভাগের এক ভাগ সময় পর তাতে একটা বড় রকমের দশা রূপান্তর ঘটে (অনেকটা পানির তরল থেকে বরফ হওয়ার মতো) যা শূন্যস্থানের প্রকৃতি পাল্টে দেয়। তখন শূন্য থাকার পরিবর্তে মহাবিশ্ব একটা পটভূমি ক্ষেত্র (field) দিয়ে পূর্ণ হয় (অনেকটা তড়িৎ ক্ষেত্রের মতো কিন্তু অত সহজে সনাক্ত করা যায় না।) হিগস ক্ষেত্র নামে পরিচিত এই ক্ষেত্র মহাবিশ্বের সর্বত্র আসন করে নেয়।

স্থানের মধ্য দিয়ে কণাদের চলাচল হিগস ক্ষেত্র দিয়ে প্রভাবিত হয়। যেসব কণা এই ক্ষেত্রের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে—যেমন, যেসব কণা দুর্বল বল দিয়ে ক্রিয়া করে—তারা ক্ষেত্রটি থেকে একরকমের বাধা পায় যা তাদেরকে ভরযুক্ত কণা হিসেবে আচরণ করতে বাধ্য করে। আর যারা কোনো মিথস্ক্রিয়া করে না—যেমন তড়িচ্চুম্বকীয় বলের বাহক, ফোটন—তারা ভরহীনই থেকে যায়। এ কারণেই আগে একীভূত থাকা তড়িচ্চুম্বকীয় বল ও দুর্বল বল প্রতিসাম্য ভাঙনের কারণে এই সময়ের পর থেকে ভিন্ন আচরণ করতে থাকে। ২০১২ সালে জেনেভা'র নিকটবর্তী লার্জ হ্যাড্রন কলাইডার (এলএইচসি) এ হিগস বোসন আবিষ্কৃত হওয়ার মাধ্যমে এই ধারণা সুপ্রমাণিত হয়েছে।

সম্ভবত গুথ চিন্তা করেছিলেন, ঠিক এইরকম একটা প্রতিসাম্য-ভাঙন হয়ত আরও আগে মহাবিশ্বে একবার ঘটেছিল। সেই ভাঙনের আগে হয়ত প্রকৃতির চারটি মৌলিক বলের তিনটিই—তড়িচ্চুম্বকীয় ও দুর্বল বলের পাশাপাশি সবল নিউক্লীয় বলও (যা নিউক্লিয়াসের ভিতর প্রোটন ও নিউট্রনকে একত্রে ধরে রাখে), কিন্তু মহাকর্ষ বল নয়—একসাথে যুক্ত ছিল। মহাবিশ্বের বয়স যখন ১০-৩৬ সেকেন্ড তখন যে এমন একটা ঘটনা ঘটে থাকতে পারে তার পক্ষে কিছু প্রমাণ আসলেই আছে। মহাবিশ্ব ঠাণ্ডা হতে থাকায় হয়ত তখনও স্থানের একটা দশান্তর ঘটেছিল এবং অন্য একটা পটভূমি ক্ষেত্র দিয়ে মহাবিশ্ব পূর্ণ হয়েছিল যে ক্ষেত্র তাড়িতদুর্বল বল ও সবল বল কে আলাদা আচরণ করতে বাধ্য করেছিল। অর্থাৎ হয়ত তাড়িতদুর্বল প্রতিসাম্য ভেঙে তড়িচ্চুম্বকীয় ও দুর্বল বল তৈরি হওয়ার আগে প্রথমে তাড়িতদুর্বল-সবল প্রতিসাম্য ভেঙে তাড়িতদুর্বল ও সবল বল তৈরি হয়েছিল।

হিগস ক্ষেত্রের মতোই এই প্রতিসাম্য-ভাঙনের কারণে প্রচণ্ড অদ্ভুত ও ভারী কণা-ক্ষেত্রের জন্ম হওয়ার কথা, কিন্তু এক্ষেত্রে কণাগুলোর ভর হতে হবে হিগস কণার চেয়েও অনেক বেশি। দুঃখের কথা হচ্ছে এই তত্ত্বের সত্যতা পরীক্ষা করতে হলে, অর্থাৎ এই ক্ষেত্র নির্মাণকারী কণা আবিষ্কার করতে হলে এলএইচসি-র চেয়েও ১০ লক্ষ কোটি গুণ শক্তিশালী একটা কণাত্বরক (যেখানে বিশাল বেগে কণায় কণায় ধাক্কা লাগানো হয়) বানাতে হবে। এমন তত্ত্বগুলোকে মহা একীভূত তত্ত্ব (grand unified theories, GUT/গাট) বলা হয়, কারণ তারা মহাবিশ্বের তিনটি অমহাকর্ষীয় বলকে একটি বলের অধীনে একত্রিত করে।

গুথ বুঝতে পেরেছিলেন, আদিম মহাবিশ্বের এমন স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিসাম্য ভাঙন প্রমিত মহাগর্জন মডেলের সব সমস্যা সমাধান করতে পারে, কিন্তু কেবল এক শর্তে। শর্তটা হলো, কিছুক্ষণের জন্য এই প্রতিসাম্য ভাঙনের জন্য দায়ী ক্ষেত্রটিকে একটা "অর্ধস্থায়ী দশায়" (metastable state) আটকে থাকতে হবে।

যখন পরিপার্শ্বের তাপমাত্রা খুব দ্রুত হিমাঙ্কের নিচে নেমে যায় কিন্তু পানি তৎক্ষণাৎ জমে বরফ হয়ে যেতে পারে না তখন বলা হয়ে থাকে পানি একটা অর্ধস্থায়ী দশায় প্রবেশ করেছে। কিছুক্ষণ পর যখন পানি অবশেষে জমাট বাঁধে—যখন দশান্তর সম্পন্ন হয়—তখন সে কিছু শক্তি নিঃসরণ করে যা সুপ্ততাপ নামে পরিচিত।

অনেকটা একইভাবে যেই ক্ষেত্র গাট দশান্তরটি ঘটিয়েছিল তা হয়ত অল্প সময়ের জন্য সমস্ত স্থানজুড়ে বিপুল পরিমাণ সুপ্তশক্তি নিজের মধ্যে জমা করে রেখেছিল। এই শক্তির সাথে ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে যে মহাবিকর্ষণের জন্ম হয়েছিল তা মহাবিশ্বকে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সূচকীয় হারে (প্রতিবারে দ্বিগুণ করে) প্রসারিত করে বিশাল আকার দিয়েছিল—এরই নাম স্ফীতি। বর্তমানে আমরা যাকে পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্ব বলি তা সে সময় মাত্র ১০-৩৬ সেকেন্ডে আগের চেয়ে আকারে ১০২৫ গুণ বড় হয়ে যেতে পারত। বেলুন ফোলালে যেমন তার পৃষ্ঠ সমতল ও সমরূপ হতে থাকে তেমনি হয়ত এই দানবীয় সম্প্রসারণ মহাবিশ্বকে প্রচণ্ড সমতল ও সমরূপ করে দিয়েছিল। তাই স্ফীতি মহাবিশ্বের দুটি আপাতস্ববিরোধিতার দুটোই সমাধান করতে পারে। আর স্বয়ং মহাগর্জনের ব্যাখ্যাও সে দিয়ে দেয়: যখন মহাবিশ্ব অর্ধস্থায়ী দশাটি থেকে বেরিয়ে আসে, অর্থাৎ পানির মতো করে তার দশান্তর ঘটে যায় এবং স্ফীতি সমাপ্ত হয়, তখন তার ভিতর জমে থাকা সুপ্তশক্তি বিমুক্ত হয়—এই মুক্তিই হলো মহাগর্জন। যেইখানে মহাস্ফীতির শেষ সেইখানেই মহাগর্জনের শুরু।

সাধারণ অর্থে ধারণাটা যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন, এখন পর্যন্ত স্ফীতি ঠিক কিভাবে ঘটেছে সে বিষয়ক কোনো একক সফল তত্ত্ব নেই। এর প্রধান কারণ মহা একীভবন বিষয়ে আমাদের অজ্ঞতা; যেমন, ঠিক কী পরিমাণ শক্তিতে মৌলিক বল তিনটি একত্রিত হতে পারে তা আমাদের জানা নেই। সরলতম স্ফীতিতত্ত্ব গুলো বর্তমান মহাবিশ্বের রূপ অনেকটাই ব্যাখ্যা করতে পারে, কিন্তু একটু আলাদা তত্ত্ব দিয়েই এমন সব মহাবিশ্ব বানিয়ে ফেলা যায় যার সাথে আমাদেরটার তেমন কোনো মিলই নেই।

আমাদের এই মুহূর্তে আসলে যা দরকার তা হলো মহাবিশ্বে আসলেই স্ফীতি ঘটেছে কি-না তা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জানার চেষ্টা এবং যদি ঘটে থাকে তাহলে পর্যবেক্ষণকৃত উপাত্ত থেকে তার বিস্তারিত প্রক্রিয়াটা বের করা। মহাকর্ষতরঙ্গ ঠিক এই সুযোগটাই করে দিতে পারে।

মহাকর্ষতরঙ্গ

আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯১৫ সালে তার আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব প্রণয়নের সময় বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার তত্ত্ব একটা অতি আকর্ষণীয় নতুন ঘটনার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। সাধারণাপেক্ষিকতায় মহাকর্ষক্ষেত্র স্থানকালের বিকৃতির ফলাফল ছাড়া আর কিছুই না। সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল একটা শক্তির উৎস—যেমন, তারার চারদিকে আবর্তনরত গ্রহ—স্থানের মধ্যে সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল বিকৃতির জন্ম দিবে এবং এই স্থানবিকৃতি উৎসটি থেকে আলোর বেগে সবদিকে প্রবাহিত হবে—এরই নাম মহাকর্ষতরঙ্গ। দুটি বস্তুর মধ্য দিয়ে যখন মহাকর্ষতরঙ্গ প্রবাহিত হয় তখন তাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব পরিবর্তিত হতে থাকে, যেহেতু তখন তারা যে স্থানে অবস্থিত সেটাই দোলে।

মহাকর্ষ তড়িচ্চুম্বকত্বের চেয়ে অনেকগুণ দুর্বল হওয়ায় মহাকর্ষতরঙ্গ সনাক্ত করা খুব কঠিন। আদৌ কোনোদিন যাবে কি-না সে নিয়ে আইনস্টাইনের সংশয় ছিল। তরঙ্গটির ভবিষ্যদ্বাণী করার দীর্ঘ ১০০ বছর পরও আজ পর্যন্ত আমরা কোনো মহাকর্ষতরঙ্গ সরাসরি সনাক্ত করতে পারিনি। সনাক্ত করার সবচেয়ে ভাল উপায় সবচেয়ে বিধ্বংসী ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করা, যেমন, দুটো কৃষ্ণবিবরের সংঘর্ষ। অনেক গবেষক মনে করেন তারা এসব বিধ্বংসী ঘটনা থেকে উদ্ভূত মহাকর্ষতরঙ্গ আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে আছেন। তবে আরো আশার কথা হচ্ছে মহাবিশ্ব আমাদেরকে মহাকর্ষতরঙ্গের আরেকটা সুলভ উৎস উপহার দিয়েছে: মহাগর্জনের ঠিক পরপর দ্রুত আন্দোলনরত কোয়ান্টাম ক্ষেত্র।

জন্মের ঠিক পরপর—স্ফীতিরও আগে—মহাবিশ্বের আকার ছিল একটা পরমাণুর চেয়েও অনেক অনেক ছোটো। সেই আকারের জগতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নীতিগুলো রাজত্ব করে। কিন্তু একইসাথে সেই ক্ষুদ্র জায়গার প্রতিটি স্থানে সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ যেহেতু অনেক বেশি ছিল সেহেতু সেটা ব্যাখ্যা করতে আপেক্ষিকতারও দরকার পড়ে। আদিম মহাবিশ্বের ধর্ম বুঝতে হলে আমাদেরকে—ঠিক যেমন গুথ বলেছেন—কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্বের (field theory) ধারণাগুলো প্রয়োগ করতে হবে যা কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও বিশেষ আপেক্ষিকতা—স্থান ও কাল একত্রিত করার তত্ত্ব—কে একত্রিত করে। কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্ব বলে, খুব ছোটো আকারের জগতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সব ক্ষেত্র ভয়ানকভাবে উঠানামা করে, অর্থাৎ আন্দোলিত হয়। মহাবিশ্বের প্রসারণ যখন স্ফীতিশক্তি দ্বারা চালিত হচ্ছিল তখন যদি অন্যসব কোয়ান্টাম ক্ষেত্র একভাবে আচরণ করে তাহলে মহাকর্ষক্ষেত্রের ভিন্ন আচরণ করার সম্ভাবনা কম; মহাকর্ষক্ষেত্রও হয়ত অন্যদের মতোই আন্দোলিত হচ্ছিল।

স্ফীতির সময়কার সূচকীয় সম্প্রসারণের সময় যেকোনো ছোটো তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আদিম কোয়ান্টাম আন্দোলনও সময়ের সাথে সাথে প্রসারিত হবে। তরঙ্গদৈর্ঘ্য যদি বেশি বড় হয়ে যায় তাহলে তরঙ্গটির একবার স্পন্দিত হওয়ার সময়ও মহাবিশ্বের তদানীন্তন বয়সের চেয়ে বেশি হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে কোয়ান্টাম আন্দোলন আসলে সাময়িকভাবে থমকে যাবে, এবং মহাবিশ্বের বয়স যখন তার একবার স্পন্দিত হওয়ার সময়ের চেয়ে বেশি হবে তখন আবার তার স্পন্দন শুরু হবে। স্ফীতির সময় এই থমকে থাকা স্পন্দনগুলোর তীব্রতা বাড়তে থাকবে, এবং এগুলোই একসময় চিরায়ত মহাকর্ষতরঙ্গে রূপলাভ করবে।

গুথ যখন স্ফীতি প্রস্তাব করছিলেন তখন রাশিয়ার দুইদল পদার্থবিজ্ঞানী, আলেক্সেই স্তারোবিনস্কি এবং ভালেরি রুবাকভ ও তাদের সহকর্মীরা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে গবেষণা করে দেখান যে, স্ফীতি সবসময়ই এ ধরণের পটভূমি মহাকর্ষতরঙ্গের জন্ম দেয় এবং এই পটভূমির শক্তি সরাসরি স্ফীতির চালক ক্ষেত্রটির শক্তির সমান। অন্য কথায়, স্ফীতি থেকে সৃষ্ট মহাকর্ষতরঙ্গ যদি সনাক্ত করা যায় তাহলে যে কেবল স্ফীতির পক্ষে নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যাবে তা-ই নয়, পাশাপাশি যে কোয়ান্টাম প্রক্রিয়াগুলো স্ফীতি ঘটিয়েছে তাদের সম্পর্কেও অনেক কিছু জানা যাবে।

মহাস্ফীতির নিশানা

বুঝলাম যে স্ফীতির একটা নিশানা আসলেই আছে, কিন্তু সেটা কি আদৌ সনাক্তকরণযোগ্য? স্ফীতি সম্ভবত এমন আকারেই ঘটেছিল যাতে কোয়ান্টাম্মহাকর্ষীয় স্পন্দন যথেষ্ট বড় হতে পারে, কিন্তু মহাকর্ষ বলটা নিজে এত দুর্বল যে তারপরও সেই স্পন্দন সনাক্ত করা প্রচণ্ড কঠিন হতে পারে।

কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। আর সাহায্যের জন্য তো মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ (CMB বা পটকিরণ) রয়েছেই। মহাগর্জনের ৩,৮০,০০০ বছর পর মহাবিশ্বের তাপমাত্রা পর্যাপ্ত পরিমাণ কমার পর সব ইলেকট্রন প্রোটনের সাথে মিলে নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন গঠন করে এবং আর কোনো মুক্ত ইলেকট্রন না থাকায় ফোটনগুলো মুক্তভাবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে—এই ফোটনগুলোকেই আমরা পটকিরণ বলি। এদিক থেকে ভাবলে, এটা মহাবিশ্বের পর্যবেক্ষণযোগ্য প্রাচীনতম আলো। পটকিরণ সৃষ্টির সময় যদি মহাকর্ষতরঙ্গ থেকে থাকে তাহলে পটকিরণের মধ্যে তার চিহ্ন রয়ে যাবে। ইলেকট্রন-প্রোটন মিলনের আগে মুক্ত ইলেকট্রনগুলো ফোটনসমুদ্রে স্নান করছিল, কিন্তু সেই ফোটনের তীব্রতা ছিল কোনো স্থানে বেশি আর কোনো স্থানে কম যার কারণ বড় আকারের মহাকর্ষতরঙ্গ। মহাকর্ষতরঙ্গের কারণে স্থান একখানে সংকুচিত আর অন্যখানে প্রসারিত হচ্ছিল এবং তার সাথে তাল মিলিয়ে ফোটনের তীব্রতাও কোথাও কম আর কোথাও বেশি ছিল। স্থানের এই বিকৃতি যদি যথেষ্ট বেশি হতো—দুর্ভাগ্য যে তা বেশি নয়—তাহলে পটকিরণে তার প্রভাব সনাক্ত করা যেত। কিন্তু মহাকর্ষতরঙ্গের আরো সূক্ষ্ণ আরেকটি প্রভাব আছে। মহাকর্ষতরঙ্গ থেকে সৃষ্ট স্থানবিকৃতির কারণে ইলেকট্রন থেকে ধাক্কা খেয়ে আসা পটকিরণের বিস্তার উল্লম্ব দিকের চেয়ে অন্য একটি দিকে বেশি হয়ে যায়। ফোটনের কোনো নির্দিষ্ট দিকে বেশিদূর আন্দোলিত হওয়ার ঘটনাকে সমবর্তন (polarization) বলে; অর্থাৎ সেক্ষেত্রে পটকিরণ হবে সমবর্তিত।

পটকিরণে এই সমবর্তনের চিহ্ন খুঁজে পেলেই যে সরাসরি আদিম মহাকর্ষতরঙ্গ প্রমাণিত হয়ে যাবে তা নয়। কারণ সমবর্তন আরো অনেক কিছুর মাধ্যমেই তৈরি হতে পারে, যেমন, পটকিরণের অন্তর্নিহিত তাপমাত্রার উঠানামার কারণে বা পটকিরণ আর আমাদের মাঝখানে থাকা অন্য কোনো বস্তুর—বিশেষ করে আমাদের ছায়াপথের ধূলির—প্রভাবে। কিন্তু আশার কথা হলো, আকাশের বিভিন্ন অংশে সমবর্তিত তরঙ্গের বিন্যাস পরীক্ষা করে মহাকর্ষতরঙ্গসৃষ্ট সমবর্তন থেকে অন্যান্য সমবর্তন আলাদা করার উপায় আছে।

মহাকর্ষতরঙ্গসৃষ্ট সমবর্তনের বিন্যাস অনেকটা নদীতে পানির পাকের মতো হওয়ার কথা। অন্যান্য উৎস থেকে তেমন মোচড়ানো বিন্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। সমবর্তনের এই দুই ধরণের স্থানিক বিন্যাসকে বলা হয় 'ই' বিন্যাস ও 'বি' বিন্যাস। 'বি' বিন্যাসটা পাকের মতো। অন্যসব বস্তু যেখানে কেবল 'ই' বিন্যাস তৈরি করে মহাকর্ষতরঙ্গ সেখানে 'ই' ও 'বি' দুই বিন্যাসের সমবর্তনই তৈরি করতে পারে।

এই বিন্যাসের ব্যাপারটা প্রথম পরিষ্কার হয়েছিল ১৯৯৭ সালে এবং তার পর থেকেই পটকিরণ গবেষক সম্প্রদায় আশায় দিন গুণছেন—আদিম মহাকর্ষতরঙ্গের কারণে বিভিন্ন স্থানের পটকিরণে তীব্রতার পার্থক্যের পরিমাণ সনাক্ত করার পক্ষে অনেক কম হলেও, হয়ত পটকিরণের সমবর্তন থেকে মহাকর্ষতরঙ্গের আরো সূক্ষ্ণ একটি সংকেত উদ্ধার করা যাবে। এর পরের দশকে ভূমিতে ও মহাশূন্যে বেশকিছু দুরবিন স্থাপন করা হয়েছে কেবল স্ফীতি'র এই মাপকাঠিটি আবিষ্কারের জন্য।

পটকিরণের প্রধানত দুটি রাশি পরিমাপ করা হয়: বিভিন্ন স্থানে তার তাপমাত্রার হ্রাসবৃদ্ধি এবং তার সমবর্তন। তাপমাত্রার হ্রাসবৃদ্ধি যেহেতু ইতিমধ্যেই অনেক সূক্ষ্ণভাবে মাপা হয়ে গেছে সেহেতু বিজ্ঞানীরা সমবর্তনের ফলাফল একটি অনুপাত হিসেবে প্রকাশ করেন: সম্ভাব্য মহাকর্ষতরঙ্গসৃষ্ট সমবর্তন সংকেতের মান এবং তাপমাত্রা-হ্রাসবৃদ্ধির মান এর অনুপাত। এই অনুপাতকেই বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রগুলোতে 'r' বর্ণটি দিয়ে চিহ্নিত করা হয়।

একবিংশ শতকের নবতরঙ্গ

এখন পর্যন্ত পটকিরণের সমবর্তনের কেবল ঊর্ধ্বসীমাই নির্ধারণ করা গেছে—অর্থাৎ আমরা জানতে পেরেছি যে সংকেতটা এর চেয়ে তীব্র হতে পারে না, হলে আমরা সনাক্ত করতে পারতাম। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি'র প্লাংক উপগ্রহের ২০১৩-১৪ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, r এর মান ০—মহাকর্ষতরঙ্গ না থাকলে যা হবে—থেকে সর্বোচ্চ ০.১৩ এর মধ্যে যেকোনো সংখ্যা হতে পারে। তাই ২০১৪'র মার্চে যখন দক্ষিণ মেরুতে অবস্থিত বাইসেপ২ নামক দুরবিনের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গবেষকরা r এর মান ০.২—যার অর্থ মহাকর্ষতরঙ্গ থাকতেই হবে—দাবী করে বসেন তখন পদার্থবিজ্ঞানীরা আকাশ থেকে পড়েছিলেন। বাইসেপ২ গবেষকরা এমনকি এটাও দাবী করেছিলেন যে তাদের সংকেতটা মহাকর্ষতরঙ্গ ছাড়া অন্য কিছুর কারণে সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ।

স্ফীতির কারণে সৃষ্ট সংকেত যেমন দেখানোর কথা একে ঠিক তেমনই দেখাচ্ছিল। কিন্তু সমবর্তন পর্যবেক্ষণ করা অনেক কঠিন যে কারণে এটা একবিংশ শতকের জ্যোতির্বিজ্ঞানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় গবেষণাক্ষেত্র। পারিসাংখ্যিকভাবে বাইসেপ২ এর আবিষ্কার যথেষ্ট জোড়ালো হলেও মহাকাশে এমন অনেক দূষণকারী বস্তু আছে যাদের থেকে আসা সংকেতকে দেখতে মহাকর্ষতরঙ্গের নিশানার মতো লাগতে পারে। এসব দূষক বস্তুকে জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানে ফোরগ্রাউন্ড বা পুরোভূমি বলা হয়।

বাইসেপ২ অনেকগুলো দূষকের এসপার ওসপার করেছিলও, কিন্তু সবচেয়ে কঠিন ছিল আমাদের আকাশগঙ্গার ধূলির দূষণটুকু দূর করা। বাইসেপ২ আকাশের যে অংশটুকু পর্যবেক্ষণ করেছে সেখানে আকাশগঙ্গার ধূলির দূষণ কতটুকু তা গবেষকরা হিসাব করার চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু তাদের অনুমানটা ছিল প্রকৃতমানের অনেক কম। প্রকৃত মানটা জানা ছিল ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি'র প্লাংক উপগ্রহের। প্লাংক একটা নির্দিষ্ট স্থানে নয়, বরং আকাশের সকল দিক থেকে আসা পটকিরণের মানচিত্র তৈরিতে নিয়োজিত এবং এটা করতে গিয়ে সে আকাশগঙ্গার ধূলির একটা বিস্তৃত মানচিত্রও তৈরি করে ফেলেছে। বাইসেপ২ নিজেই ধূলির পরিমাণ নির্ণয় করতে পারেনি কারণ সে কেবল একটি কম্পাঙ্কে পর্যবেক্ষণ করেছে যেখানে পুরোভূমির দূষণ বাদ দেয়ার জন্য কয়েকটা কম্পাঙ্কের পর্যবেক্ষণ লাগে—প্লাংকের ঠিক এই ক্ষমতাটাই ছিল।

প্লাংক চূড়ান্ত ফলাফল জানানোর আগেই বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী বলেছিলেন যে, বাইসেপ২ এর সংকেতটা মহাকর্ষতরঙ্গের নয়, বরং আকাশগঙ্গার ধূলি দিয়েই তা পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায়। বাইসেপ২ এর বিজ্ঞানীরা অবশ্য অত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না। ধূলির দূষণের কথা তারা স্বীকার করেন, কিন্তু সাথে এটাও স্মরণ করিয়ে দেন যে, তাদের প্রাপ্ত ফলাফল কিছু স্ফীতি তত্ত্বের ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে এত ভালভাবে মিলে যায় যে তার কারণ কেবলই ধূলি হতে পারে না। তাদের এই স্ফীত আত্মবিশ্বাসকে সম্মান দেখিয়ে তাই একটু দেখে নেয়া যাক আদিম মহাকর্ষতরঙ্গ আসলেই পাওয়া গেলে কী হবে।

মহাকর্ষতরঙ্গের জ্ঞানভাণ্ডার

আদিম মহাকর্ষতরঙ্গের নিশানা যদি পাওয়া যায় তাহলে সরাসরি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানার পরিধি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেকগুণ বেড়ে যাবে। মহাকর্ষতরঙ্গ পদার্থের সাথে খুব কম মিথস্ক্রিয়া করার কারণে সৃষ্টির মোটামুটি শুরু থেকে প্রায় নির্বিঘ্নে আমাদের কাছে পৌঁছে যেতে পারে। বাইসেপ২-দলের দাবী যদি সঠিক হতো তাহলে প্রথমত, মহাকর্ষতরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণিত হতো এবং তার ফলে সাধারণ আপেক্ষিকতার আরেকটা ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যেত, আর দ্বিতীয়ত, আমরা মহাবিশ্বের এমন একটা সময় সম্পর্কে জানতে পারতাম যখন তার বয়স ছিল মাত্র ১০-৩৬ সেকেন্ড, যা পটকিরণ সৃষ্টি হওয়ার ১০৪৯ গুণ আগের সময়ের কথা।

বাইসেপ২ এর তথ্য সঠিক হলে আমরা মহাবিশ্ব সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারতাম। প্রথমত, বাইসেপ২-দল সংকেতটার শক্তি (r এর মান) যত হওয়ার দাবী করেছিল তা সত্য হওয়ার অর্থ হতো, স্ফীতি যে শক্তিতে ঘটেছে তাতে তিনটি অমহাকর্ষীয় বলই মহা একীভূত তত্ত্বানুসারে একত্রীত হয়ে একটা বল গঠন করতে পারে—কিন্তু কেবল এক শর্তে: যদি প্রকৃতিতে সে সময় আরেকটা প্রতিসাম্যের অস্তিত্ব থাকে যার নাম মহাপ্রতিসাম্য (supersymmetry)। আর মহাপ্রতিসাম্য থাকলে আরো অনেক নতুন মৌলকণার অস্তিত্ব থাকার কথা যার অনেকগুলো ২০১৫ সালে যখন এলএইচসি আরো অনেক বেশি শক্তিতে কাজ শুরু করবে তখন সনাক্ত করা যাবে। সুতরাং বাইসেপ২ নির্ভুল হলে ২০১৫ হতো কণা পদার্থবিজ্ঞানীদের জন্য আরেকটা মহাউত্তেজনার বছর—হিগস আবিষ্কারের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।

তবে স্ফীতিসৃষ্ট মহাকর্ষতরঙ্গ আবিষ্কারের আরেকটা প্রভাব আছে যা বুঝার জন্য অত অনুমানের আশ্রয় নিতে হয় না। আগে যেমনটা বলা হয়েছে, স্ফীতির সময় যখন মহাকর্ষক্ষেত্রে অবস্থিত আদিম কোয়ান্টাম আন্দোলনগুলো বিবর্ধিত হয়েছিল তখনই এই মহাকর্ষতরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু এর অর্থ হচ্ছে, মহাকর্ষকেও কোয়ান্টাম তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করতে হবে।

এটা এই কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, এখন পর্যন্ত মহাকর্ষের কোনো সুসংজ্ঞায়িত কোয়ান্টাম তত্ত্ব নেই; ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আকারের জগতে পদার্থ ও শক্তির আচরণ যেসব সূত্র নিয়ন্ত্রণ করে তা দিয়ে মহাকর্ষ ব্যাখ্যা করা এখন পর্যন্ত অসম্ভব। এযাবৎ সবচেয়ে কাছাকাছি পৌঁছেছে সম্ভবত তারতত্ত্ব (string theory), কিন্তু এটা সঠিক কি-না বর্তমানে তা জানার কোনো উপায় নেই এবং এমনকি এটা দিয়ে মহাকর্ষের একটা সুসংগত, পূর্ণাঙ্গ কোয়ান্টাম তত্ত্ব দাঁড় করানো যাবে কি-না তাও নিশ্চিত নয়। আরো ভয়ের কথা হচ্ছে, প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিস এর বিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসন মনে করেন, মহাকর্ষের সকল কোয়ান্টাম তত্ত্বে মহাকর্ষ বল বহনকারী যে কণার—অর্থাৎ গ্র্যাভিটনের—অস্তিত্ব ধরে নেয়া হয় তা সনাক্ত করার যোগ্য কোনো যন্ত্র বানানো সম্ভব না, কারণ তেমন যেকোনো যন্ত্রকে এত বড় ও ঘন হতে হবে যে তা নিজের ভারে ধ্বসে পড়ে নিজেই একটা কৃষ্ণবিবরে পরিণত হবে। এ হিসেবে বলতে হয়, মহাকর্ষ আদৌ কোয়ান্টাম তত্ত্ব দিয়ে বর্ণনা করা যায় কি-না সে বিষয়ে কোনোদিনই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না।

ডাইসনের যুক্তি ঠিক হলে সরাসরি গ্র্যাভিটন আবিষ্কারের মাধ্যমে কোয়ান্টাম্মহাকর্ষ প্রমাণের চিন্তা বাদ দিতে হবে, কিন্তু তারপরও অন্য উপায়ে পরোক্ষভাবে তা প্রমাণ করা যেতে পারে এবং স্ফীতি থেকে আসা মহাকর্ষতরঙ্গ তেমনই একটা উপায়। তবে তাতেও একটা সমস্যা আছে। স্ফীতি থেকে আসা মহাকর্ষতরঙ্গ যদি পাওয়া যায় তাহলে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ব্যবহার করে এই তরঙ্গের উৎপত্তি হিসাব করা যাবে। কিন্তু, চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের যেকোনো ঘটনাকেই তো কোয়ান্টাম বলবিদ্যা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়, এমনকি একটা ক্রিকেট বলের গতিকেও। সীমান্তের দিকে ধাবমান একটা ক্রিকেট বল দিয়ে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা প্রমাণ করা যায় না, কারণ কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অস্তিত্ব না থাকলেও এই বলের গতি একইরকম হতো। কোয়ান্টাম ব্যাখ্যা থাকলেই হবে না, দেখাতে হবে সেই ব্যাখ্যাটাই একমাত্র ব্যাখ্যা কি-না। চাইলে স্ফীতিসৃষ্ট মহাকর্ষতরঙ্গ কোয়ান্টাম তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে, কিন্তু শুধু তা তে চলবে না, প্রমাণ করতে হবে যে, কোয়ান্টাম স্পন্দনই মহাকর্ষতরঙ্গটা সৃষ্টির একমাত্র উপায়।

সম্প্রতি—গত বছরের সেপ্টেম্বরে—অ্যারিজোনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের লরেন্স ক্রাউস আর ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি'র নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ফ্র্যাংক উইলচেক মিলে ঠিক এই প্রমাণটাই করে দেখিয়েছেন। একাজে তারা ব্যবহার করেছেন পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে মৌলিক কৌশলগুলোর একটি যার নাম মাত্রিক বিশ্লেষণ, যাতে ভর-স্থান-কাল এই তিনটি রাশির এককের মাধ্যমে সবকিছু বিশ্লেষণ করা হয়। তারা দেখিয়েছেন, স্ফীতির মাধ্যমে মহাকর্ষতরঙ্গের একটি দৈবপটভূমি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা প্লাংক ধ্রুবকের বর্গের সমানুপাতিক। অথচ, প্লাংক ধ্রুবক একটি পুরোপুরি কোয়ান্টাম রাশি যা দিয়ে কোয়ান্টামজগতের ঘটনাগুলোর তীব্রতা নির্ধারিত হয়। তার মানে স্ফীতিসৃষ্ট মহাকর্ষতরঙ্গ যদি পাওয়া যায় তাহলে মহাস্ফীতি যেমন প্রমাণিত হবে, তেমনি মহাকর্ষকে কোয়ান্টাম তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করাও আবশ্যক হয়ে দাঁড়াবে।

বহুবিশ্ব

মহাবিশ্বের সৃষ্টি বিষয়ক সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্নটি—অনস্তিত্বের বদলে অস্তিত্ব কেন?—নিয়ে ভাবতে শুরু করলেই পদার্থবিজ্ঞান তার গণ্ডি পেরিয়ে অধিবিদ্যার (metaphysics) জগতে প্রবেশ করতে শুরু করে, আর "অধিবিদ" বিজ্ঞানীদের জন্য একটা গালি বৈ কিছু নয়। কিন্তু মহাকর্ষতরঙ্গ আবিষ্কারের মাধ্যমে মহাস্ফীতি নিশ্চিত করা গেলে অধিপদার্থবিদরাও পায়ের তলে মাটি খুঁজে পাবেন।

আগেই বলা হয়েছে, স্ফীতিচালক ক্ষেত্রটি তার দশান্তরের সময় বিপুল পরিমাণ শক্তি জমা রাখে ও পরে তা বিমুক্ত করে। হিসাব করে দেখা গেছে, এই ক্ষেত্রের বৈশিষ্ট্য এমনই যে তার কারণে স্ফীতি একবার শুরু হলে আর থামবে না, মহাবিশ্ব অসীম-অনন্ত স্থানকাল অবধি স্ফীত হতে থাকবে; গুথ একে তুলনা করেছেন একটা বুনো আগুনের সাথে যা একবার শুরু হলে পুরো বন না জ্বালিয়ে থামে না। কিন্তু, সকল স্থানে এমনটা ঘটলে আমাদের মতো একটা মহাবিশ্বের জন্মই সম্ভব না, কারণ সেক্ষেত্রে অতিপ্রসারণের কারণে পদার্থ, বিকিরণ সবকিছু পাতলা হতে হতে নাই হয়ে যাবে এবং দ্রুত প্রসরমান শূন্যস্থান ছাড়া আর কিছুরই অস্তিত্ব থাকবে না।

স্বস্তির কথা হচ্ছে, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দ্রেই লিন্দে এই বিপর্যয় থেকে উদ্ধারের উপায় খুঁজে পেয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, সমগ্র বিশ্বের একটা ছোটো স্থান যদি যথেষ্ট প্রসারিত হওয়ার পর নিজের দশান্তর ঘটিয়ে মহাগর্জন করে উঠতে পারে তাহলে সেই স্থানটুকুকেই দেখতে আমাদের মহাবিশ্বের মতো লাগবে। বাকি জায়গায় স্ফীতি চলতেই থাকবে, এবং এখানে সেখানে ছোটো ছোটো কিছু জায়গাতে দশান্তর সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যমে একেকটা "বীজ" উপ্ত হতে থাকবে। এরকম প্রতিটি বীজ থেকে শক্তির মুক্তি ঘটার মাধ্যমে একটি করে মহাগর্জনশীল মহাবিশ্বের জন্ম হতে থাকবে এবং তাদের একটির সাথে আরেকটির কোনো যোগাযোগ থাকবে না।

এই "অনন্তস্ফীতি" যদি সত্য হয়, তাহলে আমরা আরো অনেক বড় একটা বহুবিশ্বের (multiverse) অংশ যা হয়ত অসীম এবং যেখানে হয়ত অসংখ্য পরস্পর বিচ্ছিন্ন মহাবিশ্ব আছে। উপরন্তু, স্ফীতি যে দশান্তর দিয়ে শেষ হয় তার পরিণতি একেক বার একেক রকম হতে পারে বিধায় একেক মহাবিশ্বে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম একেক রকম হতে পারে।

সেক্ষেত্রে আমাদের মহাবিশ্বের মৌলিক ধ্রুবক গুলোকে আর অত বিস্ময়কর লাগবে না, কারণ সেগুলো হবে সম্ভাব্য অনেক সেট ধ্রুবকের কেবল একটি। ধ্রুবকগুলোর মান এমন না হয়ে অন্যরকম হলে সেই মান পরিমাপ করতে পারে এমন কোনো বুদ্ধিমান জীবের—আমাদের—আবির্ভাবই ঘটত না। নৃকেন্দ্রিক নীতি নামে পরিচিত এই ধারণাটা অনেকেরই পছন্দ না এবং এটা পদার্থবিজ্ঞানে অনেক সমস্যারও সৃষ্টি করে। অনেকে অকাট যুক্তি ও পরীক্ষণ এর উপর প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান থেকে পদার্থবিজ্ঞান কতটা সরে গেছে তা বুঝানোর জন্য বহুবিশ্ব ও নৃকেন্দ্রিক নীতি কেই উদাহরণ হিসেবে হাজির করেন।


ছবি: মহাস্ফীতি, মহাকর্ষতরঙ্গ, 'বি' সমবর্তন এবং বাইসেপ২ এর (ভুল) আবিষ্কার নিয়ে একটা চমৎকার রেখাচিত্র। (ক্লিক করলে বড় হয়ে আসবে।)

বিদীর্ণ বিকীর্ণ হয়ে চূর্ণ

কিন্তু দুঃখের কথা যে মহাকর্ষতরঙ্গ প্রাপ্তি, মহাস্ফীতি প্রমাণ, কোয়ান্টাম্মহাকর্ষ ব্যাখ্যা, বহুবিশ্ব কল্পনা কোনোটাই আপাতত আমাদের ভাগ্যে জুটছে না। বাইসেপ২-দলের আশায় গুড়েবালি। লরেন্স ক্রাউস ২০১৪'র অক্টোবরে প্রকাশিত এই প্রবন্ধে বলেছিলেন প্লাংকের অগ্রগতি যেমন দেখা যাচ্ছে তাতে সম্ভবত বাইসেপ২ এর ভাগ্য নির্ধারণের জন্য আর এক বছরের বেশি অপেক্ষা করতে হবে না। আসলে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে এক বছরেরও অনেক কম সময়। ক্রাউস যখন লিখছেন তখনই বাইসেপ২ ও প্লাংক বিজ্ঞানীরা একজোট হয়ে কাজ করার পরিকল্পনা করছিলেন এবং অচিরেই দুটি দুরবিনের উপাত্তের যৌথ বিশ্লেষণ শুরু হয়। এরই ফলস্বরূপ এ বছরের ৩০শে জানুয়ারি প্লাংক ও বাইসেপ২ এর পক্ষ থেকে একটা যৌথ বিবৃতি দেয়া হয় যাতে সবাই অকপটে স্বীকার করে নেন যে, "আদিম মহাকর্ষতরঙ্গের কোনো সন্তোষজনক প্রমাণ পাওয়া যায়নি।"

পাওয়া যায়নি সেই আকাশগঙ্গার ধূলির কারণে। এই ধূলির সাথে কিন্তু পৃথিবীর ধূলির কোনো সম্পর্ক নেই। মহাশূন্যে একটু ভারী যৌগ থাকলেই তাকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে ধূলি বলা হয়। এই ধূলি অণুতরঙ্গ বিকিরণ (পটকিরণ নয় কিন্তু) করে, যে বিকিরণটা আবার আকাশগঙ্গার চৌম্বক ক্ষেত্রের কারণে সমবর্তিত হয়ে যায়। ধূলি আর চৌম্বকক্ষেত্রের যোগসাজশে সৃষ্ট এই সংকেতকে দেখতে পটকিরণের 'বি' সমবর্তনের মতো লাগতে পারে। এ থেকে মুক্তির উপায় দুটো: হয় আকাশের এমন দিকে তাকাতে হবে যেদিকে ধূলি সবচেয়ে কম, নয় ধূলিদূষণটা পর্যবেক্ষণ থেকে সফলভাবে বাদ দিতে হবে। বাইসেপ২ এমন দিকেই তাক করা হয়েছিল যেদিকে ধূলি সবচেয়ে কম, কিন্তু যতটা কম হওয়া দরকার ছিল ততটা নয়।

আগেই যেমনটা বলেছি, ধূলি থেকে আসা বিকিরণ আসলে কতটুকু বাইসেপ২-দলের তা জানার কোনো উপায় ছিল না। একাধিক কম্পাঙ্কে পর্যবেক্ষণ করায় তা মাপার ক্ষমতা ছিল একমাত্র প্লাংক উপগ্রহের। প্লাংকের পর্যবেক্ষণের ফলাফল তখনো বের হয়নি, কিন্তু বাইসেপ২-দলের আর তর সইছিল না। তাই তারা সবচেয়ে সোজা এবং অবৈজ্ঞানিক রাস্তাটা ধরেন, ধূলি পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে পর্যবেক্ষণে যে 'বি' সমবর্তন দেখছেন তার দায়ভার পুরোটাই মহাকর্ষতরঙ্গের ঘাড়ে চাপিয়ে দেন। ধূলির অবদান পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে তাকে এতটা অপমান করার সাজাও তাদের পেতে হলো।

তারপরও স্বীকার করতেই হবে, প্লাংক, বাইসেপ২, এলএইচসি বা নির্মাণাধীন অন্যান্য যন্ত্র দিয়ে স্ফীতি ও মহা একীভূত তত্ত্ব প্রমাণের ভালো সম্ভাবনা আছে। হয়ত দেখা যাবে, আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টির জন্য স্ফীতির যে দশান্তরের দরকার পড়ে তা লিন্দের অনন্তস্ফীতিকে সমর্থন করছে। সেক্ষেত্রে অন্য কোনো মহাবিশ্ব কোনোদিন পর্যবেক্ষণ করতে না পারলেও আমরা তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত থাকব, ঠিক যেমন বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পরমাণু সরাসরি দেখার কথা ভাবা না গেলেও তার অস্তিত্ব নিয়ে কোনো বিজ্ঞানী সন্দেহ পোষণ করত না।


ছবি: প্লাংক উপগ্রহের দুরবিন দিয়ে তোলা আকাশের একটা অংশের অণুতরঙ্গ (microwave) ছবি। ছবিটি দুই দিকেই ৬০ ডিগ্রি লম্বা (তুলনার জন্য ভাবুন, পৃথিবীর আকাশে চাঁদ মোটামুটি ০.৫ ডিগ্রি জায়গা দখল করে।) রঙ দিয়ে আকাশগঙ্গার ধূলি থেকে নিঃসৃত বিকিরণের তীব্রতা বুঝানো হচ্ছে: নীল মানে কম, লাল মানে বেশি। আর সাদাসাদা আঁকাবাঁকা রেখাগুলো দিয়ে আকাশগঙ্গার চৌম্বক ক্ষেত্রের বলরেখা বুঝানো হয়েছে। মাঝখানে সাদা রেখা দিয়ে যে অঞ্চলটুকু চিহ্নিত করা আছে বাইসেপ২ সেটুকুই পর্যবেক্ষণ করেছিল। দেখা যাচ্ছে সেখানে ধূলিদূষণ তুলনামূলক কম, কিন্তু যত কম হলে মহাকর্ষতরঙ্গসৃষ্ট সমবর্তন পাওয়া সম্ভব হতো তত কম নয়।


ইহা বহুলাংশে সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান (অক্টোবর ২০১৪) সাময়িকীতে লরেন্স ক্রাউস এর লেখা A Beacon from the Big Bang প্রবন্ধটির ছায়াবলম্বনে লিখিত। কিন্তু সেই প্রবন্ধ প্রকাশের পরে যা কিছু ঘটেছে তার উপর ভিত্তি করে আমি কিছু সংযোজন-বিয়োজন-পুনর্বিন্যাস করেছি। ভূমিকা ও "বিদীর্ণ বিকীর্ণ হয়ে চূর্ণ" অনুচ্ছেদ দুটিতে সব প্রায় আমারই কথা।

আরো জানতে চাইলে:
১) মহাস্ফীতি নিয়ে সামান্য টেনিক্যাল কিন্তু সহজবোধ্য একটা ভূমিকা
২) বাইসেপ২ এর আবিষ্কার ভুল দেখিয়ে ESA'র অফিসিয়াল বিবৃতি: Planck: Gravitational Waves Remain Elusive.
৩) বাইসেপ২ এর ভুল দেখানো পেপারটা: A Joint Analysis of BICEP2/Keck Array and Planck Data.
৪) মহাস্ফীতি নিয়ে লেখা গুথ এর জনপ্রিয়গ্রন্থ The Inflationary Universe.
৫) যারা সাধারণাপেক্ষিকতা গাণিতিকভাবে বুঝেন তারা মহাস্ফীতি নিয়ে এই লেকচার-নোট টা পড়তে পারেন।
৬) আরো পণ্ডিতম্মন্যদের জন্য লিন্দে'র বই: Particle Physics and Inflationary Cosmology,
৭) এবং জামাল নজরুল ইসলাম এর An Introduction to Mathematical Cosmology বইয়ের ৯ম অধ্যায়।


মন্তব্য

মাসুদ সজীব এর ছবি

পাঁচতারা। আশা করি ধারাবাহিক ভাবে চলবে হাসি

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

শিক্ষানবিস এর ছবি

ধন্যবাদ। আরো আসবে ভবিষ্যতে...

আরিফুল হোসেন তুহিন এর ছবি

মুহাম্মদ, চমৎকার লিখেছিস। তবে সাথে কিছু অরিজিন্যাল লিটারেচারের রেফারেন্স জুড়ে দিলে ভালো হত, যদি কেউ আরো বেশী পড়তে চায়, তাদের জন্যে।

এই রিভিউটি বেশ প্রাঞ্জল মনে হয়েছে আমার কাছে --

Livio, M. & Kamionkowski, M. Commentary: BICEP2’s B modes: Big Bang or dust? Physics Today 67, 8–10 (2014).

এছাড়াও আরো টেকনিক্যাল রিভিউ এর জন্যে --

Mortonson, M. & Seljak, U. A joint analysis of Planck and BICEP2 B modes including dust polarization uncertainty. arXiv (2014). doi:10.1088/1475-7516/2014/10/035

শিক্ষানবিস এর ছবি

হ্যাঁ, দরকার ছিল কিছু সূত্র দেয়া। কয়েকটা যোগ করলাম।

দিগন্ত এর ছবি

সুন্দর লেখা। এমনিতে গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ পর্যবেক্ষণ না করা গেলে বাইনারি পালসারে তা পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেই ভিত্তিতে ১৯৯৩ সালে নোবেল পুরষ্কারও দেওয়া হয়েছে।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

শিক্ষানবিস এর ছবি

হ্যাঁ, ১৯৯৩ সালে রাসেল হাল্‌স ও জোসেফ টেইলর নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন পালসারজোট আবিষ্কারের জন্য এবং সেটা পরোক্ষভাবে মহাকর্ষতরঙ্গের অস্তিত্ব জানায় শুনেছি। অবশ্য ঠিক কী ভাবে মহাকর্ষতরঙ্গের পক্ষে সেটা প্রমাণ হাজির করেছিল জানি না, দেখতে হবে।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

হাততালি পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

শিক্ষানবিস এর ছবি

ধন্যবাদ...

ফাহিম হাসান এর ছবি

দারুণ চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

তথ্যবহুল এবং চমৎকার একটি লেখনি ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।