ধর্মীয় মৌলবাদের চাষাবাদ-৩

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন শোহেইল মতাহির চৌধুরী (তারিখ: সোম, ১৭/০৪/২০০৬ - ৯:৫০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


মৌলবাদের উত্থানের কারণ: ধর্মনিরপেক্ষতা মতবাদের বিশ্বজয়

আগের দুটি লেখায় আমরা মৌলবাদের লেখা ও মৌলবাদীদের মূল তিনটি বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করেছি। এবার আমরা মৌলবাদের উত্থানের কারণকে সংক্ষেপে বুঝতে চেষ্টা করবো। স্বাভাবিক যুক্তিতেই বুঝা যায়, যখন কোনো ধর্ম তার অস্তিত্ব নিয়ে হুমকির মুখে পড়ে তখন সেই ধর্মের ভেতর থেকে ক্রোধান্ধ, গোঁড়া বিশ্বাসীদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে গড়ে উঠে বিভিন্ন মৌলবাদী দল। কিন্তু পৃথিবী ব্যাপী প্রায় সব ধর্মের ভেতর থেকেই এরকম মৌলবাদী দলের উত্থানই ঘটছে এখন। এ শুধু ইসলামী মৌলবাদী দলের সুইসাইড স্কোয়াডের উত্থান নয়, মৌলবাদী প্রবণতায় ভুগছে বৌদ্ধ বা হিন্দু ধর্মের মত আপাত: নিরীহ, শান্তিপ্রিয় ধর্মগুলোও। সুতরাং এটি ধরতে পারা কঠিন নয় যে আসলে 'ধর্ম' বা 'ধর্মবিশ্বাস' বিষয়টিই বর্তমান পৃথিবীতে সাধারণভাবে এক ধরনের হুমকির সম্মুখীন। কোথা থেকে সেই হুমকি এসেছে ধর্মের উপর তা খতিয়ে দেখলেই উত্তরটা পাওয়া যাবে।

পৃথিবীর বর্তমান সমাজব্যবস্থায় ধর্মকে যে অবস্থানে আমরা দেখতে পাচ্ছি তার চেয়ে অনেক শক্তিশালী অবস্থানে এটি ছিল এই কয়েক দশক আগে। ধর্মই একসময় ক্ষমতায় বসেছিল এবং ধর্মবেত্তারাই ছিলেন সমাজ, রাষ্ট্র ও সেই ধর্মের অনুসারীদের শাসক ও ত্রাতা। ক্রমশ: বিভিন্ন রাজবংশের ক্ষমতালোভী উত্তরাধিকারদের চাপে ও রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভাবনে ধর্ম শাসকের জায়গা ছেড়ে নেমে আসে পরামর্শক, উপদেশকের স্থানে। এই নতুন অসস্থানে ধর্মের আর উপাসনালয়ের ক্ষমতা চূড়ান্ত না হলেও বিপুল ছিল। সরকার ও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ধর্মের রীতি-নীতিই প্রধান ভূমিকা পালন করতো। মোল্লা-পুরোহিত-রাবি্বদের ব্যাখ্যাকে উপেক্ষা করার মত জনসমর্থন বা ক্ষমতা রাজনৈতিক দলগুলোর তখনও হয়নি। (বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, মুসলিম বা হিন্দু ধর্মীয় মতে বিবাহ নিবন্ধন ও কোর্টের কাছে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদেরকে দম্পত্তি ঘোষণার বিষয়টি নিয়ে ভাবলে ধর্মের ক্ষমতার পরিবর্তনটি সহজে ধরা যাবে।) কিন্তু ধর্ম ক্রমশ: এখন ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয় হয়ে যাচ্ছে। সংবিধান পরিবর্তন করে এরশাদ ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম বানালেও রাজপথে এখনও চিকা দেখা যায়, "আমার ধর্ম আমার কাছে, রাষ্ট্রের কি বলার আছে"। অনেক ধার্মিক লোকও মেনে নিয়েছেন যে, ধর্ম ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়ই হওয়া উচিত। কিন্তু মতের এই পরিবর্তনের সাথে সমাজে ধর্মের ক্ষমতা কমে যাচ্ছে তা নিয়ে তারাই উদ্্বিগ্ন যারা ধর্মের ক্ষমতা ব্যবহার করে ব্যক্তিগত অনেক সুবিধা পেতেন।

সমাজে ধর্মের এই ক্ষমতা কমে যাওয়ার প্রক্রিয়া বা ধর্মনিরপেক্ষতার প্রভাবটি পৃথিবীর সব দেশে এক ভাবে ঘটেনি। বিস্তৃত ব্যাখ্যায় না যেয়েও বুঝা যায়, সমাজের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে ধর্ম তার সামাজিক প্রতিপত্তি হারিয়েছে। পশ্চিমা চিনত্দা-চেতনা-ধ্যান-ধারণার জনপ্রিয়তার সাথে সাথে পৃথিবীব্যাপি দেশ-জাতি-রাষ্ট্র-জনপদগুলো ধর্মনিরপেক্ষতার মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে আর ফলে ধর্মের সাথে শাসনকার্যের দূরত্ব তৈরি হয়েছে সর্বত্র। কিছু লোক জন, অতি অবশ্যই তারা অতি ধর্মপ্রিয় ধার্মিক, ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় রীতিনীতি থেকে সরে এসে ধর্মনিরপেক্ষতার মতবাদকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করেছেন। তাদের কেউ কেউ ধর্মনিরপেক্ষতাকে রুখতে ধর্মের একটি ক্রুদ্ধ রূপ আবিষ্কার করেন, যাকে চিহ্নিত করা হয় ধর্মীয় মৌলবাদ হিসেবে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতাকে কেন একটি হুমকি হিসেবে নিলো বিভিন্ন ধর্ম-বিশ্বাসীরা। ধর্ম-নিরপেক্ষতায় তো বস্তুত: সব ধর্মকে সমান দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার করা হয়। ধর্ম-নিরপেক্ষতা হয়তো অধিক যৌক্তিক ফলে বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে রাষ্ট্রগুলোর কাছে বিশেষত: যে দেশের ভৌগলিক সীমানায় বাস করছে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা। কিন্তু লক্ষ করতে হবে যে রাষ্ট্রের এই দর্শন পরিবর্তনে ঐ জনপদের সর্বাধিক নাগরিকের ধর্মটি হারিয়েছে তার নীতিনির্ধারকে স্থান। কি পড়ানো হবে স্কুলের পাঠ্যক্রমে, নারীরা কী কী পেশায় যোগ দিতে পারবে, অমুক ধর্মের নারী কোন ধর্মের পুরুষকে বিয়ে করতে পারবে, ইত্যাদি নানা বিষয়ে মোল্লা-পুরোহিতদের ফতোয়া দেয়ার অধিকার কেড়ে নিয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলো। ফলে আরেকবার ধর্ম হয়ে পড়েছে কোণ-ঠাঁসা। (সম্প্রতি বাংলাদেশে মৌলবাদীরা ফতোয়ার মর্যাদা পুনরুদ্ধারের হুমকি দিয়েছেন।)।

ধর্মনিরপেক্ষতা তাই সব ধর্মের টার্গেট প্র্যাকটিসের ফায়ারিং রেঞ্জ। কিন্তু শুধুই ধর্মনিরপেক্ষতা? ধর্মের প্রতিপত্তি আর ক্ষমতা কমানোরর মূলে আর কী কী বিষয় কাজ করেছে বলে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছে অন্ধ ধর্মাবলম্বীদের মন ও মনন? কিসের হুমকি তাদেরকে করে তুলেছে মৌলবাদী?


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।