ব্লগ সমাজঃ গড়ে উঠছে চোখের সামনে

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন শোহেইল মতাহির চৌধুরী (তারিখ: শনি, ০৩/০৬/২০০৬ - ১০:২৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


চোখের সামনে একটি সমাজ গড়ে উঠছে। একে বলা যায় ব্লগ সমাজ। পৃথিবীজুড়ে ইন্টারনেটে অনেক ব্লগ সাইট আছে। সবক'টিতে সমাজ গড়ে উঠায় ভঙ্গি নিশ্চয়ই এক নয়। বাঁধ ভাঙার আওয়াজে আমরা চোখের সামনে একটি সমাজ গড়ে উঠতে দেখছি। এর কিছু বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতাকে ধরে রাখতেই এই লেখা। নিশ্চয়ই এরকম ওয়েব বা ইন্টারনেট ভিত্তিক সমাজ নিয়েও সমাজ বিজ্ঞান একসময় প্রচন্ড আগ্রহী হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে এই লেখাটি হয়তো একটি পাইওনিয়ার লেখা হিসেবে বিবেচিত হবে। হাসি
(তবে এটি পূর্ণাঙ্গ লেখা নয়। এতে আরো নানা তথ্য যোগ করে হালনাগাদ করে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়া হবে। আপনাদের চোখে পড়া বৈশিষ্ট্য বা বাড়তি ব্যাখ্যাও দিন, যুক্ত করি।)

1. প্রথমে আসি ব্লগটির বৈশিষ্ট্য নিয়ে। ব্লগটির মূল বৈশিষ্ট্য এটি বাংলা ভাষাভাষিদের জন্য। কিন্তু সদস্য বিচার করলে দেখা যায় মূলত: বাংলাদেশের বাঙালিরাই এই ব্লগ সমাজের সদস্য। এক্ষেত্রে উল্লেখ করতে হয় বিবিসি বাংলা রেডিওর অধিকাংশ শ্রোতাও বাংলাদেশের অধিবাসী।

2. ইন্টারনেট যেহেতু ভিত্তি তাই এই ব্লগ সাইটের ভূগোল পৃথিবী জোড়া। ইউরোপ, আমেরিকা-কানাডা, অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড ও সিংগাপুর-মালয়েশিয়ায় বসবাসরত তরুণ বাঙালিরাই মূলত: এই ব্লগের সদস্য। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীরাতো আছেনই। বাংলাদেশের মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের তরুণদের আধিক্য দেখতে পাই। তবে এটুকু আমার অনুমান। সম্পূর্ণ তথ্য আমার কাছে নেই।

3. কম্পিউটার ব্যবহারে দক্ষ ও যাদের ইন্টারনেট এ্যাকসেস আছে তারাই এই সমাজে শামিল হচ্ছেন, স্বাভাবিক কারণেই। কিন্তু বাংলা টাইপ করতে পারার দক্ষতা/আগ্রহও একটি নিয়ামক। কারণ মূলত: কম্পিউটার ব্যবহারকারীরা ইংরেজি টাইপ করাতেই অভ্যস্ত। তাছাড়া লেখালেখির প্রতি উৎসাহীদের সংখ্যাই বেশি। বন্ধুত্ব করতে আগ্রহীরা চ্যাট সাইটে, টাইপে অদক্ষরা ভয়েস চ্যাট সাইটে যেতে বাধ্য হবেন সঙ্গত কারণেই।

4. ব্যবহারীরা মূলত: তরম্নণ প্রজন্ম। বয়স 15-45 এর মধ্যে। তবে পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। 40 জন সর্বোচ্চ ব্লগারের মধ্যে মাত্র 3 জন নারী। তাও তাদের অবস্থান 20 বা তারও পরে।

5. অনেকেই স্বনামে লেখেন। একাধিক আইডি আছে সিংহভাগের। তবে আইডি'র পেছনের মানুষটির পরিচিতি জানার বিষয়ে আগ্রহ ও কৌতুহল সবার মধ্যে দেখা যায়। যদিও এটি ভাচর্ুয়াল রিয়েলিটি তবু সবাই সবার বাড়ির ঠিকানা জানতে পারলেই যেন আশ্বস্ত হয় (আইপি ট্রাকার দিয়ে লেখকদের পরিচয় চিহ্নিত করার আবদার তুলেন অনেকেই)। এতে বুঝা যায় বাঙালির চরিত্র-বৈশিষ্ট্য ও অ-নাগরিকসুলভ মূল্যবোধ নিয়েই এই ভাচর্ুয়াল সমাজের সদস্যদের আচার-আচরণ নির্ধারিত হচ্ছে। মডারেটরের ভূমিকাও সেইসব মূল্যবোধ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ইংরেজি ব্লগগুলোতে বা বিশ্বব্যাপী ব্লগগুলোতে যেমন মূল্যবোধের কোনো বাধা দিয়ে লেখককে বাধাগ্রস্ত করা হয় না এখানে তেমন নয়। অনেক পাঠক মাঝে মধ্যে এও দাবী করেন যে এটা একটা পারিবারিক ব্লগ, এখানে তারা পরিবারের সদস্যদের সহ আসেন সুতরাং এখানে সব ধরনের লেখা দেয়া উচিত নয়। অর্থাৎ সদস্যদের বাস্তব জীবনের গন্ডিকে ছাড়িয়ে যায়নি নতুন এই ব্লগ সমাজের মূল্যবোধ।)

6. অল্প কয়েকজন নিজ নামে খ্যাত লেখক/সাংবাদিক এখানে পোস্ট করেন। যদিও এখানে ভালো মানের লেখা ও লেখকের কোনো কমতি নেই তবু অনেক সদস্যের ধারণা খুব ভালো লেখক হলে তাদের এখানে সময় নষ্ট করার কথা নয়। (অথচ বিবিসি'র মত বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিক-সম্পাদকরাও ব্লগিং করে থাকেন। কারণ ব্লগে প্রকাশিত সংবাদের দায়-দায়িত্ব নিতে হয় না। আইনের বিভিন্ন জটিলতার জন্য যেসব সংবাদ পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করা যায় না তা তারা ব্লগেও প্রকাশ করে থাকেন। এখানে এ প্রবণতা এখনও শুরু হয়নি।)

অন্যান্য স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যঃ অন্যান্য ব্লগ সাইটের সাথে এই ব্লগের উল্লেখযোগ্য কিছু পার্থক্য রয়েছে।
1. এখানে ব্যক্তিগত পাতা ছাড়াও একটি কমন পাতায় সামপ্রতিক লেখা ও মতামতগুলো এমন ভাবে দেখানো থাকে যে এখানে ব্লগারদের মধ্যে যোগাযোগটা খুব বেশি হয়। আড্ডা জমে মন্তব্যের সুবিধা নিয়ে। বিকল্প চ্যাটিং হয় প্রচুর।

2. লগইন করা ব্লগারদের তালিকা অনলাইনে দেখা যায় বলে এই ব্লগ কমিউনিটির মধ্যে চ্যাটিং কমিউনিটির বৈশিষ্ট্যও দেখা যায়।

3. বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে সদস্যরা নিজেদের মধ্যে ইমেইল বা মেসেঞ্জার এ্যাড্রেস চালাচালি করে আড্ডা দিয়ে থাকে বা যোগাযোগ রক্ষা করে।

4. এখান থেকে পরিচিত হওয়া কয়েকজন আবার আলাদা করে ইয়াহুতে গিয়ে গ্রুপও করেছেন। আবার ইয়াহুতে আলাদা একটি গ্রুপের সদস্য এমন লোকজনও এখানে এসে মিলিত হন, লেখা পোস্ট করেন।

5. অন্য কোনো সাইটে নিয়মিত লেখেন বা ইংরেজি বা বাংলায় অন্য সাইটে ব্লগ আছেন এমন কিছু সদস্যও এখানে আছেন। এখান থেকে লেখে নিয়ে ইয়াহু গ্রুপের মাধ্যমে অনলাইন পত্রিকায় ছাপানোর নজিরও আছে। আবার এখানকার সদস্যদের নিয়ে নতুন অনলাইন পত্রিকা ধরনের কিছু প্রকাশের উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে।

গ্রুপ ডাইনামিক্স: একটা আলাদা সমাজ হিসেবে গড়ে উঠার নানা বৈশিষ্ট্য এ কয়েকমাসের মধ্যে ফুটে উঠেছে।
1. সবচে' বেশি উলেস্নখ করার মত ঘটনা হচ্ছে প্রাপ্তি নামে একটি মেয়ের চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহের জন্য সদস্যদের মধ্যে একজোট হয়ে কাজ করা।

2. ব্লগের আরো নানা ঘটনায় সদস্যদের যুথবদ্ধ হওয়ার উদাহরণ দেখা গেছে। মাসুদা ভাট্টির একটি লেখা প্রত্যাহার করার কারণে সাইটে লেখা বন্ধ রাখার মতো প্রতীকি প্রতিবাদ ও সংগঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটাক্ষ করায় জনৈক ব্লগারের বিরুদ্ধে উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক ব্লগার একই ছবি ব্যবহার করে অসংখ্য পোস্ট করেন। এরকম ভিন্ন ভিন্ন দুটি প্রতিবাদ চলার সময় প্রতিবাদী ব্লগাররা লোগো আকারে যে ছবিগুলো ব্যবহার করেন তার মধ্যে রয়েছে বেসবল ব্যাট হাতে একটি শিম্পাঞ্জির ছবি,ও একটি ছাগলের মাথার ছবি।

3. ব্লগ সম্পর্কিত নয় এমন কারণেও এরকম প্রতিবাদ আয়োজন করতে দেখা গেছে। চট্টগ্রামে খেলার মাঠে সাংবাদিকদের উপর পুলিশি আক্রমণের প্রতিবাদ জানাতে পুলিশ ও কুকুরের ছবিযুক্ত একটি লোগো ব্যবহার করে নিন্দা প্রকাশ করেছেন কিছু ব্লগার।

4. প্রতিবাদ ছাড়াও বিশেষ দিন উদযাপনেও ব্লগারদেরকে একজোট হতে দেখা গেছে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একই ছবি ব্যবহার করেও কিছু ব্লগার পোস্ট করেন। তাছাড়া মা' দিবস, আন্তর্জাতিক নারী দিবস ইত্যাদি ক্ষেত্রে একই ছবি/লোগো ব্যবহার না করলেও এই উপলক্ষে অনেকে আলাদা পোস্ট করেছেন।

5. ভাচর্ুয়াল রিয়েলিটির বাইরে ব্লগের এই পরিচয়কে নিয়েও যাওয়া হয়েছে। প্রাপ্তিকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসা ঢাকাবাসী ব্লগাররা মিলিত হচ্ছেন। বিদেশেও ভ্রমণের সুবিধার্থে অনেকে এরকম মুখোমুখি হচ্ছেন।

6. ব্লগকে ঘিরে অনেকের অনেক ধরনের আকাঙ্খার জন্ম হয়েছে। তারা এই ফোরামকে নিজের মত করে চালিত করতে বা ব্যবহার করতে চান। তবে এই অবস্থানের সূত্র থেকে অন্য কোনো পর্যায়ের আলাদা কোনো সংগঠন, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে কিনা তা জানার জন্য আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।