আমার ছাত্রশিবির জীবন -৮

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন শোহেইল মতাহির চৌধুরী (তারিখ: মঙ্গল, ০৪/০৭/২০০৬ - ১০:৩৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


স্কুলের বক্তৃতায় আমি যখন স্কুল ছাত্রদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণকে নিন্দা করি তখন অনেকেই আমাকে বাহবা দেন। নামাজ পড়া, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, সাহিত্যের আসর, ইসলামী বই পাঠের নামে যে কোমলমনের কিছু শিশুর মগজ ধোলাই চলছে তাও তারা বুঝতে পারেন। তারা প্রশংসা করেন আমার এই হুইসেল ব্লোইংয়ের সাহস ও বুদ্ধির। আমার সতীর্থ ছাত্রশিবিরের কর্মীরা কিন্তুআমার বক্তৃতার সাথে দ্বিমত পোষণ করে। আমার সবচে ঘনিষ্ঠ বন্ধু রকিবই সময় চেয়ে পাল্টা একটা বক্তৃতা দেয়। জামায়াত করা এক বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। তিনি আমার এই নিবুর্দ্ধিতায় খুবই আহত হন। অবশ্য দু'দিন পরেই দেখি সবাই আমাকে কেমন যেন ক্ষমা করে দিয়েছেন। তারা আমাকে ডেকে নিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করেন। তাদের সব যুক্তি আমি ফেলে দিতে পারিনা। প্রকাশ্য বিরোধিতা করা সত্ত্বেও তাদের সাথে আমার বন্ধুত্ব নষ্ট হয় না। প্রায় আগের মতই সম্পর্ক বজায় থাকে।

তখন মাত্র 13 তে পা রেখেছি। কিন্তু ভারী ভারী সব বই পাঠের কারণে আমার কথাবার্তা থেকে শিশু শিশু গন্ধ চলে গেছে। স্কুলের দলনেতা হিসেবে ঢাকা জেলার শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক হয়েছি। ক্লাসের তো ছিলামই স্কুলেরও অঘোষিত ক্যাপ্টেন আমি। ছাত্র শিবিরের বন্ধুরা আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। বরং তাদের সাথে আমার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা আরো বেড়ে যায়। যদিও এসবের অনেক আগেই স্কুলের ম্যাগাজিন 'উৎস'-এর সম্পাদক হিসেবে গাজীভাই সেলিনাকেই মনোনয়ন করেন। তবে শিবিরের কর্মী হয়েও একটু স্বাতন্ত্র বজায় রাখার জন্য আমার প্রতি এ অন্যায় করা হয়নি। পরে জেনেছিলাম গাজী ভাইয়ের সাথে সেলিনার খুবই গোপন প্রেম ছিলো, অথবা তখন তা হবো হবো করছিলো।

এসএসসি পরীক্ষা শেষে বিরাট বন্ধে নানাবাড়ি চলে আসলাম। আমার ছোটবেলায যে চা-বাগানে ছিলাম চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর তার লাগোয়া বাজারেই বাড়ি করেছেন নানা। নানাবাড়িই তখন আমার বাড়ি। সেখানে এসে দেখি, আগের স্কুলের পুরনো বন্ধুদের সাথে খুব একটা ভাবে মিলে না। কতক্ষণ আর ক্যারম বোর্ড আর তাস পিটানো যায়। ইসলামী মনোভাবের প্রাক্তন সহপাঠীদের সাথেই যোগাযোগ বাড়ে। তাদের সাহচর্যে এলাকার জামায়াতে ইসলামী সমর্থক লোকজনের সাথে যোগাযোগ হয়। তাদের সাথেই দিন কাটতে থাকে। শামসুজ্জামান নামে এক সিনিয়র ভাই কোথাও কোনো মাদ্রাসায় পড়তেন। তার সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম। একদিন বন্ধু সালাম ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, এসব জামাতের লোকের সাথে আমার কী সম্পর্ক। আমি যুৎসই উত্তর দিতে পারি না। ও আমাকে কিছু বই দেয়। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের ধর্মীয়-নেতাদের লেখা। কেন তারা মওদুদীর ইসলাম ব্যাখ্যাকে অপব্যাখ্যা বলছেন তার বিস্তৃত বর্ণনা দেয়া সেসব বইতে। পড়তে নিরুৎসাহী আমি কখনও ছিলাম না। আমি গোগ্রাসে পড়ি। কিন্তু এই দলাদলি ও কোন্দলের উর্দ্ধে আমি অন্য বিষয়গুলোও বুঝতে শুরু করেছি। ইমাম গাজ্জালি পাঠেই আমার আগ্রহ তখন বেশি। ইসলামকে ছাড়িয়ে আমি তখন সৃষ্টি-রহস্য নিয়ে আগ্রহী বেশি। মওদুদীবাদ বা ইসলামের ফেরকা ও ব্যাখ্যা নিয়ে মাথা ঘামানো বাদ দিয়েছি। আর ধর্মে তখন প্রবল আগ্রহ। এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা হয় না। নতুন কোনো এলাকায় বেড়াতে গেলে সেখানকার মসজিদে নামাজ পড়ার একটা শখও তৈরি হয়েছে।

ছাত্রশিবিরের কর্মকান্ড সম্পর্কে আমি আপত্তি প্রকাশ করলেও ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে আমার শ্রদ্ধায় ঘাটতি ছিল না। মারিফত, সুফিজম, সৃষ্টি রহস্যের নানা গোপন হাতছানি ডাকাডাকি করলেও শিবিরের একটা শিক্ষা আমার মন থেকে কিছুতেই মুছেনি। শিক্ষাটা অবশ্য কোরআনের। সেই যে বলা হয়েছে, তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা সত্যের দিকে, ন্যায়ের দিকে মানুষকে আহ্বান করবে। কৈশোরের টগবগে রক্ত। শিবির ছাড়া সেরকম নেতৃত্ব দেয়ার দল কোথাও পাইনা। তাই নানা ত্রুটি নিয়ে বিবাদ করার পরও শিবিরের প্রতি আমার অমোঘ আকর্ষণ যায় না। আমি যুক্ত হয়েই থাকি। সেই যুক্ততায় নতুন মাত্রা আসে যখন আমি ভর্তিহই কলেজে।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।