আল্লাহর কসম গেইটলক

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন শোহেইল মতাহির চৌধুরী (তারিখ: বিষ্যুদ, ২০/০৭/২০০৬ - ৬:১৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


'কেউ কথা রাখে না' কোনো সুনীলিয় দু:খবিলাস না। একথা মনে করার কোনো কারণও নেই যে এই দীর্ঘশ্বাস শুধু প্রস্থানরত প্রেমিক/প্রেমিকাকে স্মরণ করেই। সুনীলের দীর্ঘশ্বাসটা বাঙালি তরুণ/তরুণীর বুকের ভেতর এসে লাগে, 'তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি, ... কেউ কথা রাখে না।' অত:পর তোজাম্মেল হক বকুল ব্যাখ্যা সহ বুঝিয়ে দেন যে কথা রাখেনি সে অতি অবশ্যই জোৎস্না। তার কথায় সারাদেশের মানুষ যে সায় দিয়েছে তার প্রমাণ হচ্ছে গানটি সুপার-ডুপার হিট। আপনারা ভুলে গেলেও আমি ভুলিনি 'বেদের মেয়ে জ্যোস্না আমায় কথা দিয়েছে... আসি আসি বলে জ্যোস্না ফাঁকি দিয়েছে'। (ব্র্যাকেটে বলে রাখি মূলত: যাত্রাপালার এই গানটির সুরে একটি বিখ্যাত হিন্দি গানে সুর দিয়েছেন শচীন কর্তা। মনে করে দেখুন মনে পড়ে কি না)। বিভ্রান্ত পাঠক নিশ্চয়ই এতক্ষণে আমার উপর বিরক্ত। তারা নিশ্চয়ই মন্তব্যের তূণ ছুঁড়তে প্রস্তুতি নিচ্ছেন যে এখানে আমার মূল কথাটি কী? আমার কথা খুবই পরিষ্কার। যদিও খান আতা বলেছেন, 'দিন যায় কথা থাকে', যদিও বকুল জ্যোস্নার কাঁধেই দোষ চাপিয়েছেন তবু সুনীলর সাথেই আমি গলা মেলাবো, কেউ কথা রাখে না।

বৈষ্ণব-বোষ্টুমি না, মামাবাড়ির মাঝি নাদের আলি না, বরুণা না, এমনকি পিঠে হাত দিয়ে আশ্বাস দেয়া বাবাও না। কেউ কথা রাখে না। কথা যে শুধু রাজনৈতিক নেতারা রাখে না, দেশের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা রাখেন না, তা না। কথা আসলে, বলতে গেলে কোনো বাবাই রাখেন না। বাবা বলতে আমি ঠিক কোনো কামেল বা ভন্ড পীরবাবাকে বুঝাচ্ছি না। বাবা বলতে বাবা সায়গলকে জোর করেও স্মরণ করছি না। এই বাবা আসলে মৎকৃত একটি শব্দসংক্ষেপ। বিস্তৃত করলে দাঁড়ালে বাঙালি বা বাংলাদেশি। আমরা সবাই বাবা। সব বাবারাই সুনীলিয় বাবার মত পিঠে হাত রেখে প্রতিশ্রুতি দেন, দেখিস একদিন আমরাও। কিন্তু কিছুই দেখা হয়না আমাদের।

সামনে নির্বাচন। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা প্রতিশ্রম্নতির ফুলঝুড়ি ছুটাচ্ছেন সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক দলের মেনিফেস্টো দেখে লোকে ভোট দেয়না পৃথিবীর কোনো দেশেই। এ শুধু সুশীল সমাজের কাপের মধ্যে চা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার কারণ ঘটায়। কথা কেউ রাখে না। সে যদি কসম খেয়েও বলে। তার প্রমাণ ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ বাস সার্ভিস। বিআরটিসি যখন বেশ জনপ্রিয় তখন ঐ রুটে এলো একসারি প্রাইভেট মালিকানার বিরতিহীন বাস সার্ভিস। উদ্দেশ্য পথিমধ্যে কোনো বিরতি দেয়া হবে না, যাত্রীরা পৌঁছে যাবেন গন্তব্যে দ্রুত। কিন্তু পথের মধ্যের লোকদেরও স্ট্যাটাস আছে। তারাও এই নতুন চালু ধামাকায় উঠতে চায়। সুতরাং বিরতিহীনের চলার পথে বিরতির সার্ভিস চালু হয়। দূরপাল্লার যাত্রীরা বিরক্ত হন বাসমালিকদের এই নাফরমানিতে। সুতরাং কথা রাখার নতুন কথা নিয়ে আসে 'সম্পূর্ণ বিরতিহীন' সার্ভিস। নিশ্চিন্তমনে যারা চড়ে বসেন তাতে তারা অচিরে আবিষ্কার করেন সম্পূর্ণ আর অসম্পূর্ণের মধ্যে পার্থক্য মাত্র স্বরবর্ণের প্রথম বর্ণ। 'সম্পূর্ণ বিরতিহীন' সার্ভিসের অসম্পূর্ণতা ধরা পড়ে নিরীহ যাত্রীর চোখে। হীন বিরতিতেই তাদের যাত্রাপথ পূর্ণ হতে থাকে। সুতরাং কথাকে নতুন মালায় সাজিয়ে আবার আসেন বাস-মালিকরা। তাদের নতুন দেয়া কথার নাম 'গেইট লক'। অর্থাৎ যাত্রীদের ভেতরে ঢুকিয়ে সদর দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। খোলা হবে গন্তব্যে গিয়ে। চড়ে বসেন যাত্রীরা আবার আশা বুকে বেঁধে। কিন্তু সপ্তাহও ঘুরতে পারে না সেসব বাস আবিষ্কার করে ফেলে কথা না রাখার কায়দা। যাত্রীরা অকস্মাৎ আবিষ্কার করেন যে বাসের গেট লকড্ থাকার কথা তার দরজায় কোনো লক মানে তালাই নেই। গেইট লকের প্রশ্নই ওঠে না। এসব মিথ্যা প্রতিশ্রুতির কারণে যাত্রীদের বিরক্তি চরমে পেঁৗছায়। তাদেরকে আশ্বস্ত করতে আসে নতুন সমাধান। 'আল্লাহর কসম গেইট লক'।

দুর্ভাগ্যের দেশে বড় প্রয়োজনীয় আল্লাহর নাম লটকে থাকে বাসের গেটে কসম-প্রতিশ্রুতি সহ। এমন কথার বিরুদ্ধে তো কথায় কথায় প্রতিবাদ প্রতিরোধ করা যায় না। আমি বলছি না ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের বাস কখনও উত্তেজিত জনতা পোড়ায় নি। কিন্তু কথা না রাখার কথা নিয়ে এমন কোনো ক্ষেপে ওঠার খবর আমি কখনও শুনিনি, কসম করেই কইলাম।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।