ব্রিটেনে উন্নয়ন সমাবেশ ও বাংলাদেশ ভাবনা

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন শোহেইল মতাহির চৌধুরী (তারিখ: রবি, ০১/০১/২০০৬ - ৫:৪৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ব্রিটেন এখন আফ্রিকার দিকে হাত বাড়িয়েছে। দৃশ্যত: এ হাত সাহায্যের। যদিও 1947 পর্যনত্দ আমাদের প্রায় দু'শ বছরের অভিজ্ঞতায় পোড়া মন তাদের উদ্দেশ্যের বিষয়ে খুব একটা সন্দেহমুক্ত হতে পারে না। কিন্তু ডিএসএ আয়োজিত তিনদিনের কনফারেন্সে আফ্রিকার উন্নয়ন নিয়েই কথা হলো বেশি। ডিএসএ মানে ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ এসোসিয়েশন। মিল্টন কিনস্ নামের শহরটিতে যেখানে ব্রিটেনের ওপেন ইউনিভার্সিটির বিশাল ক্যাম্পাস রয়েছে সেখানেই ডিএসএ 7-9 সেপ্টেম্বর আয়োজন করেছিল তাদের বার্ষিক কনফারেন্স। দেশ-বিদেশের গবেষক-ছাত্র-শিক্ষকরা তাদের গবেষণা-পত্র উপস্থাপন করলেন। সংখ্যায় বললে তিনশ' জন। কিন্তু আহত হলাম বাংলাদেশের গবেষকদের উপস্থিতির নগন্যতা দেখে। বাংলাদেশ কমনওয়েলথভুক্ত দেশ। উচ্চশিক্ষায় ইংরেজির ব্যবহার আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক শিক্ষকই তাদের ডিগ্রি অর্জন করেছেন ব্রিটেন থেকে। তারপরও উন্নয়নের আলোচনায় আমাদের এতো নগন্য উপস্থিতি বিস্ময় জাগায়।

অনেকের মনে হতে পারে এরকম সমাবেশ তো অনেক হয়। এ আর এমন কি? কিন্তু বাসত্দবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের অর্থমন্ত্রীরা যে ঝুলি নিয়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ান সে ঝুলিতে কি জন্য কতটুকু বরাদ্দ দেয়া হবে তার প্রাথমিক রূপরেখা তৈরি হয় এরকম সমাবেশে। উন্নত দেশগুলো মনগড়া কিছু করে না। তাদের দেশের পদক্ষেপের পেছনে থাকে গবেষণায় পাওয়া তথ্য। বিশেষজ্ঞদের মতামত। বৈদেশিক সাহায্যের আগামী রূপ কি হওয়া উচিত তা এরকম সমাবেশের সুধীদের পরামর্শেই তৈরি হয়। অনেকটা সেকারণেই দক্ষিণ আফ্রিকার এক মন্ত্রী হাজির হয়েছেন নিজের গবেষণাপত্র নিয়ে-কেনো তাদেরকে সাহায্য করা ব্রিটেনের অবশ্য কর্তব্য। ভারতও পিছিয়ে নেই। কিন্তু বাংলাদেশ - একেবারেই অদৃশ্য।

যারা বক্তৃতা দেবেন তাদের তালিকায় বাংলাদেশের লেখকদের নাম খোঁজা শুরম্ন করলাম। প্রবাসী ও মূল ভূখন্ডের অনেক ভারতীয় গবেষকের নাম দেখলাম। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের ওপর গবেষণায় সমান আগ্রহ দেখা গেলো আফ্রিকান ও ব্রিটিশ গবেষকদের মাঝে। পাতা ঘেঁটে বাংলাদেশের একজনের নাম চোখে পড়লো। দৃকের শহীদুল আলম। মিডিয়াতে উন্নয়নশীল দেশসমূহের ভিজু্যয়াল উপস্থাপনার ওপর তার প্রবন্ধ। দুপুরের খাবারের সময় তার সাথে দেখা। আমন্ত্রণ জানালেন তার উপস্থাপনা শুনতে। কিন্তু একই সময়ে আমার নিজেরও প্রবন্ধ উপস্থাপনা। পশ্চিমা ধ্যান_ধারণার বিশ্বায়ন ও বাংলাদেশের পানি-সম্পদ নীতির ওপর। আমাকে দেখেই উৎসাহিত হয়ে জানতে চাইলেন বাঙালি গবেষকদের উপস্থিতি কেমন? বললাম তেমন কাউকে চোখে পড়েনি। তবে সম্ভবত: বাংলাদেশের কিছু এনজিও কর্মী দর্শক-শ্রোতা হিসেবে অংশ নিচ্ছেন। শহীদুল আলম উজ্জ্বল হলুদ-কমলা রংয়ের পাঞ্জাবি পড়ে এসেছেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গীরা সবাই দেখলাম সাদা চামড়ার এবং তারা যে তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ তা তাঁদের আড্ডার ঢংয়ে বুঝা যাচ্ছিল। নিজে সু্যট পড়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু তাঁকে দেখে মনে হলো পাঞ্জাবি পড়লে খারাপ হতো না। দেশের কিছুটা আবহ এখানে ছড়ানো যেত।

বাংলাদেশি গবেষকের আকাল হলেও আলোচনায় বাংলাদেশ একেবারে অনুপস্থিত ছিল না। ভারতীয় গবেষকরাসহ অনেক আলোচক বাংলাদেশ প্রসঙ্গ টেনেছেন। ভিনদেশি দুয়েকজন গবেষকও বাংলাদেশের উন্নয়ন চেষ্টার ওপর গবেষণা-পত্র উপস্থাপনা করেছেন। অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এক গবেষক ছিলেন এদের মধ্যে। বাংলাদেশের ভূমিহীন দরিদ্রদের অর্থোপার্জনের বিকল্প এক পদ্ধতির কথা বললেন তিনি। ভারতীয় বংশোদ্ভুত উমা কোঠারি বললেন বাংলাদেশের যুবকদের ভাগ্যোন্নয়নে বিদেশ পাড়ি জমানো দু:সাহসিকতার কথা। কিভাবে তারা ইউরোপের নানা দেশ ঘুরে ব্রিটেনে আসছে। উমা নিজে সেসব যুবকদের সাথে স্পেনের রাসত্দায় ফেরি করেছেন কয়েকমাস। মুগ্ধ হয়েছেন তাদের বিদেশি ভাষার দক্ষতায় আর জীবনমুখিতায়।

জ্ঞান আর উন্নয়ন গবেষণার এসব পাঠ যে ব্রিটিশ সরকারের সাহায্যের নীতিমালায় স্থান পায় তার আরেক প্রমাণ হলো দ্বিতীয দিনের শেষ অধিবেশনে আনত্দজর্াতিক উন্নয়ন মন্ত্রীর অংশগ্রহণ। মন্ত্রী হিলারি বেন আসলেন, শুনলেন সমাবেশের সারকথা, জানালেন তার সরকারের পরিকল্পনা। এরকম সুযোগগুলো বাংলাদেশ কাজে লাগায় না নিজের চোখে তা দেখে ভীষণ কষ্ট হতে লাগলো।

সমাবেশস্থলে বিভিন্ন বিশ্বখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা আয়োজন করেছে বই প্রদর্শনীর। বিনামূল্যে তারা তাদের বিখ্যাত জার্নালগুলোর কপি দিচ্ছে আর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে তাতে লেখার। সেসব কাগজ উল্টে-পাল্টে আরো কিছু ছোট ছোট জিনিস চোখে পড়লো। এশিয়ান এ্যাফেয়ার্সের জুলাই সংখ্যায় নিউ এজ পত্রিকার ডেপুটি এডিটর সৈয়দ বদরম্নল আহসানের একটি লেখা ছাপা হয়েছে। বিষয় হচ্ছে 1971 সালের পর বাংলাদেশের অগ্রগতি কতটুকু। একই সংখ্যায় বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির ওপর লেখা আলী রিয়াজের বইয়ের ওপর রিভিউ বেরিয়েছে। আরেক অধ্যাপক নায়লা কবির (আইডিএসে কর্মরত) -তার একটা বই দেখলাম প্রদর্শনীতে শোভা পাচ্ছে। মনের কষ্ট কিছুটা লাঘব হলো। কিন্তু তারপরও মনে হতে লাগলো আমাদের যোগ্যতা এর চেয়েও বেশি। চেষ্টার অভাবটাই পিছিয়ে দিচ্ছে আমাদেরকে বিশ্বের জ্ঞানসভা থেকে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কত বাঘা বাঘা শিক্ষক আছেন। তারা যদি আরেকটু গবেষণা ও লেখালেখিতে মন দিতেন। তাহলে হয়তো বিদেশিদের কাছ থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুলভাল কথা শুনতে হতো না। এই প্রদর্শনীতেই বিশ্বখ্যাত সেইজ প্রকাশনীর দক্ষিণ এশিয়ার ওপর তাদের প্রকাশিত বিভিন্ন বইয়ের তালিকা দেখলাম। দক্ষিণ এশিয়ার অল্প কয়েকটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থানতো বেশ শক্তপোক্ত। কিন্তু সেইজের প্রকাশিত শ'খানেক বইয়ের মধ্যে অনেক বাঙালি লেখকের নাম থাকলেও তারা কেউ বাংলাদেশের নন। আর বাংলাদেশের ওপর একমাত্র বইটির লেখকও বাংলাদেশের কেউ নন। ভারতের পাইওনিয়ার পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক হিরন্ময় কার্লেকার। বইটির নাম অবশ্য ভয়ংকর: 'বাংলাদেশ-পরবর্তী আফগানিসত্দান'। আমরা যদি আমাদের দেশ নিয়ে না লেখি বিশ্ব তো আর বসে থাকবে না। পাকিসত্দানেরও প্রায় একই অবস্থা। পাকিসত্দানের নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও গণতন্ত্র বিষয়ক বইটি লিখেছেন দিলিস্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের নাম চোখে পড়লো। বুক ভরে উঠতো যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কারো নাম দেখতাম। মনে পড়লো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে মাঝে মাঝে চিকা মারা দেখা যেতো - প্রাচ্যের অঙ্ফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মনে পড়ে হাসি পেলো। অঙ্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় যদি এই তুলনার কথা জানতো!

পশ্চিমা ধ্যান-ধারণার বিশ্বায়ন বাংলাদেশের উন্নয়ন নীতি প্রণয়নে কি অশুভ প্রভাব ফেলছে সে বিষয়ে আমার উপস্থাপনা ছিল একদম শেষের দিকে। উপস্থাপনা শেষে শুরম্ন হলো নানা দিক থেকে প্রশ্ন। সে পালা শেষ করে যখন আমরা ডিনার টেবিলে এসে খাবার নিয়ে বসলাম তখন লিভারপুল ইউনিভার্সিটির মার্টিন প্রাউজ এসে ধরলো। মার্টিনও আমার মতো ডিএফআইডি'র স্পন্সরে এই কনফারেন্সে এসেছে। গবেষণা-পোস্টারের একটি প্রতিযোগিতা আয়োজন করেছিল ডিএসএ। সেরা পাঁচজনকে পুরষ্কৃত করেছে ডিএফআইডি। আমি ছাড়া লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দু'জন, অঙ্ফোর্ডের ভারতীয় ছাত্রী দিব্যা ও মার্টিন এ পুরষ্কার পেয়েছে। মার্টিন বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক খবর রাখে। ওর ইচ্ছা বাংলাদেশের ওপর একটা গবেষণা করার। তার নানা প্রশ্নের জবাব দিয়ে গেলাম খাবারের ফাঁকে ফাঁকে। শেষে ও বললো, বাংলাদেশে এরকম আনত্দর্জাতিক কনফারেন্স হলে ওকে খবর দিতে। ও অবশ্যই যাবে। বললাম, আয়োজন হলে ওকে অবশ্যই জানাবো। মনে মনে বললাম, কবে জানাতে পারবো তা কিন্তু জানি না।

*এই লেখাটি দৈনিক প্রথম আলোর উপসম্পাদকীয়তে ছাপা হয়েছিল।


মন্তব্য

মোঃ মাহবুবুর রহমান এর ছবি

জনাব, আপনাকে ধন্যবাদ এত সুন্দর একটি আর্টিকেল লেখার জন্য। আপনার মত আমার খুব আক্ষেপ জাগে যে, আমাদের এতগুলো পাবলিক ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি এবং বিশাল সংখ্যক মেধাবী ছাত্র ও শিক্ষক থাকা সত্বেও আমাদের এরকম নিস্কৃয়তা অথবা অলসতা সত্যিই লজ্জা জনক।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।