প্রথম রাতে বেড়াল মারা

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন শোহেইল মতাহির চৌধুরী (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৪/০৫/২০০৬ - ৩:২৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


লেখাটির উৎস হীরক লস্করের অনেক আগের একটি পোস্ট। কেন প্রথম রাতে বেড়াল মারতে হয় সেই গল্পটি কেউ উল্লেখ করতে পারেননি। তো আমি সেই গল্পটি তুলে দিচ্ছি সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা থেকে। কবিতাটির নাম মার্জারনিধন কাব্য বা গুরবে কুশতন শব-ই-আওয়াল। অনেক দীর্ঘ কবিতা। তাই পুরোটা তুলে দিচ্ছি না। প্রথমে আছে ইরান দেশের দুই যমজ তরুণীর কথা। তারা রূপে অনন্যা। বাপ দাদার প্রচুর ধন-দৌলত। সুতরাং দুই বোন স্বাধীন থাকতে চায়। কিন্তু কলংকের ভয়ে তারা বিয়ে করতে রাজি হলো। কিন্তু শর্ত দিলো কঠিন। কেমন যে শর্ত?

তখন করিল সে শর্ত সে বড়ো অদ্ভুত
সে শর্ত শুনিলে ভয় পায় যমদূত।
বলে কি না প্রতি ভোরে মিঞার গর্দনে
পঞ্চাশ পয়জার মারি রাখিবে শাসনে।
এ বড়ো তাজ্জব বাৎ বেতালা বদখদ
এ শর্ত মানিবে কে বা হয় যদি মর্দ?
দুলহা বরেতে ছিল পাড়া ছয়লাপ
শর্ত শুনি পত্রপাঠ হয়ে গেল সাফ।
সিতু মিঞা বলে সাধু এ বড়ো কৌতুক
মন দিয়া কেচ্ছা শোনো পাবে দিলে সুখ।।

শীত গেল বর্ষ গেল আসিল বাহার
ফুলে গুলে ইসফাহান হৈল গুলজার।
শীরাজ তব্রিজ আর আজরবৈজান
খুশিতে ভরপুর ভেল জমিন আসমান।
শুধু দুই ভাই নাম ফিরোজ মতীন
পেটের ধান্দায় মরে দু:খে কাটে দিন।
অবশেষে ছোটে ভাই বলে ফিরোজেরে
'কী করে বাঁচিবে বলো, কী হবে আখেরে।
তার চেয়ে জুতা ভালো চলো দুই জনে
শাদী করি পেট ভরি দু-মেয়ের সনে।'
দুআভুআ ফিরোজের মন মাঝে হয়
শাদীতে আয়েশ বটে জুতারও তো ভয়।
হদীসের লাগি ঘাঁটে কুরান পুরাণ
দীন সিতু মিঞা ভণে শুনে পূণ্যবান।।

মজলিস জৌলুস করি দুনিয়া রওশন
জোড়া শাদী হয়ে গেল খুশ ত্রিভুবন।
চলি গেলা দুই ভাই ভিন্ন হাবেলিতে
মগ্ন হৈলা মত্ত হৈলা রসের কেলিতে।
পয়জারের ভয়ে নারি করিতে বয়ান
সিতু ভণে চুপিসারে শুনে পূণ্যবান।।

তিন মাস পরে বুঝি খুদার কুদ্রতে
আচম্বিতে দু-ভায়েতে দেখা হল পথে।
কোলাকুলি গলাগলি সিনা কলিজায়
মরি মরি মেলামেলি করে দু-জনায়।

'তোমার মাথায় টাক নাই কেন?'
শুধায় ফিরোজ ভাই
মানিয়া তাজ্জব উত্তরে মতীন
'টাক কেন, বলো তাই?'
কাঁচু মাচু হয়ে পুছিল ফিরোজ
'জোরে কি মারে না চটি?'
'আরে দুত্তোর হিম্মত কাহার
আমি কি তেমন বটি?
বাখানিয়া বলি শোনো কান পেতে
তরতিব তাহারে কয়
আজব দুনিয়া আজব চিড়িয়া
মামেলা ঝামেলাময়।
তাই বসিলাম তলওয়ার হাতে
বীবী দিলা খানা আনি
কোর্মা পোলাও তন্দুরী মুরগী
ঢাকাই বাখরখানী।
খানা আইল যেই বীবীর পেয়ারা
বিড়াল আসিল সাথে
যেই না করিল মরমিয়া "ম্যাঁও"
খাপটা না তুল্যা হাতে,-
খুল্যা তলওয়ার এক কোপে কাট্যা
ফালাইনু কল্লাডারে
তাজ্জব বীবী আক্কেল গুড়ুম
জবাবে রা-টি না কাড়ে।
গুসসা কৈরা কই এ সব না সই
মেজাজ বহুৎ কড়া
বরদাস্ত নাই বিলকুল আমার
তবিয়ৎ আগুনে গড়া।
তারপর কার ঘাড়ে দুইডা মাথা
করিবে যে তেড়িমেড়ি?'
সিতু মিঞা কয় নিশ্চয় নিশ্চয়
বাঘিনী পরিল বেড়ি।

'ক্যাবাৎ' 'ক্যাবাৎ' বলি হাওয়া করি ভর
চলিলা ফিরোজ মিঞা পৌঁছি গেলা ঘর।
মিলেছে দাওয়াই আর আন্দেশা তো নাই
খুদার কুদ্রতে ছিল তালেবর ভাই।
তার পর শোনো কেচ্ছা শোনো সাধুজন
ঠাস্যা দিল সেই দাওয়া পুলকিত মন।
সে রাতে খানার ওক্তে খুল্যা তলওয়ার
কাট্যা না ফালাইল মিঞা কল্লা বিলি্লডার
চক্ষু দুইডা রাঙ্গা কর্যা হুংকারিয়া কয়
'তবিয়ৎ আবার বুরা গর্বড় না সয়।
হুশিয়ার হয়ে থেকে নয় সর্বনাশ।'
সিতু মিঞা শুনে কয়, 'শাবাশ, শাবাশ'।।

হায়রে বিধির লেখা, হায় রে কিস্মৎ
জহর হইয়া গেল যা ছিল শর্বৎ।
ভোর না হইতে বীবী লয়ে পয়জার
মিঞার বুকেতে চড়ি কানে ধরি তার।
দমাদম মারে জুতা দাড়ি ছিঁড়ে কয়
'তবিয়ৎ তোমার বুরা, বরদাস্ত না হয়?
মেজাজ চড়েছে তব হয়েছ বজ্জাৎ?
শাবুদ করিব তোমা শুনে লও বাৎ।
আজ হৈতে বেড়ে গেল রেশন তোমার
পঞ্চাশ হৈতে হৈল একশো পয়জার।'

এত বলি মারে কিল মারে কানে টান
'ইয়াল্লা' ফুকারে সিতু, ভাগো পূণ্যবান।।
কোথায় পাগড়ি গেল কোথায় পাজামা
হোঁচট খাইয়া পড়ে কভুদেয় হামা।
খুন ঝরে সর্ব অঙ্গে ছিঁড়ে গেছে দাড়ি
ফিরোজ পৌঁছিল শেষে মতীনের বাড়ি।
কাঁদিয়া কহিল 'ভাইয়া কী দিলি দাওয়াই
লাগাইনু কামে এবে জান যায় তাই।'
বর্ণিল তাবৎ বাৎ, মতীন শুনিল
আদর করিয়া ভায়ে কোলে তুলি নিল।

বুলাইয়া হাত মাথে বুলাইয়া দেহ
'বিড়াল মেরেছ' কয়, নাই তো সন্দেহ।
ব্যাকরণে তবু, দাদা, কৈলা ভুল খাঁটি
বিলকুল বরবাদ সব গুড় হৈল মাটি।
আসল এলেমে তুমি করো নি খেয়াল
শাদীর পয়লা রাতে বধিবে বিড়াল।'

বাণীরে বন্দিয়া বান্দা বান্ধিল বয়ান
দীন সিতু মিঞা ভনে শুনে পূণ্যবান।।

শাদীর পয়লা রাতে মারিবে বিড়াল
না হলে বর্বাদ সব, তাবৎ পয়মাল।।

এই হলো প্রথম রাতে বেড়াল মারার কাহিনী। তো এই প্রয়োজনীয় বেড়াল মারা সম্পর্কিত যে কোনো চুটকির জন্য এই ধারাবাহিক চলতে থাকবে।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।