আমার ছাত্রশিবির জীবন-৫

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন শোহেইল মতাহির চৌধুরী (তারিখ: শনি, ২৭/০৫/২০০৬ - ৬:১৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


প্রশ্ন করাকে অনেক সংগঠনেই দ্রোহ হিসেবে দেখা হয়। আমার প্রশ্নকেও ছাত্রশিবিরের বড় নেতারা সেভাবে দেখা শুরু করলেন। নানারকম ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্মশালার আয়োজন করা হতো। ছাত্রশিবির তখন ফুলটাইম কর্মীদের মাসোহারা দিতো। আমরা মাসোহারা না পেলেও খরচের সব টাকাই পেতাম। টাকা কোথা থেকে আসছে তার হিসাব রাখাটা জরুরি। কর্মীদের চাঁদার রশিদ তাই সযত্নে রাখা হতো। জ্যেষ্ঠ একজনকে এর কারণ জিজ্ঞেস করেছিলাম। কেন এইসব রশিদ বইয়ের মুড়ি এত যত্নে সংরক্ষণ করতে হবে। তিনি যে উত্তর দিয়েছিলেন তা হুবহু মনে নেই। তবে সারবস্তু হলো এরকম, পাকিস্তান আমলে কোনো এক সময় জামায়াতকে দায়ী করা হয়েছিলো এই বলে যে, তারা বাইরের কোনো গোষ্ঠীর কাছ থেকে টাকা পায়। তাই দিয়ে আন্দোলন চালাচ্ছে। সেই অভিযোগের বিরুদ্ধে তারা প্রমাণ হিসেবে কর্মীদের দেয়া চাঁদার হিসাব দেখিয়ে প্রমাণ করতে পেরেছিলো তারা বিদেশী টাকায় চলে না। একই অভিযোগ শিবিরের বিরুদ্ধে যেকোনো সময় উঠতে পারে। তাই চাঁদার মুড়িবইয়ের সযত্ন সংরক্ষণ।

তবে বাইরে থেকে টাকা যে আসছে তা মোটামুটি কর্মীরা জানতো। একে কেউ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেখতো না। ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের জন্য প্রয়োজনীয় একটা বিষয় ভাবতো। বেশ কয়েকবছর পর ছাত্রশিবির কর্মী ছাড়া অন্য ছাত্রদের থেকে চাঁদা তোলার জন্য খুবই চকচকে চাররঙে ছাপা রসিদ বের করে। অনেকটা লটারির টিকেটের মত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন এক সিনিয়র ভাইয়ের টেবিলের ট্রানসপারেন্ট টেবিল ক্লথের নীচে দেখি সেরকম একটি রশিদ। একশত টাকার। আমি তো দেখে অবাক। বললাম আপনি একশ' টাকা চাঁদা দিয়েছেন। তিনি বললেন, আরে না জোর করে রেখে গেছে। কবে যে এসে চায়। এত টাকা চাঁদা দেই কি করে। আমি তাকে বিজ্ঞের মত বললাম, এ টাকা নিতে কেউ আসবে না। তিনি বললেন, "তুমি কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছো। রশিদের হিসাব দিতে হবে না ঐ কর্মীকে?"। আমি বল্লাম সম্মেলন করার জন্য যথেষ্ট টাকা ওদের আছে। এই রশিদ শুধুই আই-ওয়াশ।

যাক আবার পেছনে ফিরে যাই। টাকা যে বিভিন্ন সূত্র থেকে আসতো তার অন্যধরনের একটা প্রমান আমি জানতাম। আমার এক তরুণ বয়সী মামা সৌদিআরব গেছেন চাকুরি নিয়ে। ছুটিতে দেশে এসে তিনি গল্প করছিলেন সৌদিআরবের। তখন তিনি জানালেন, অনেক বাঙালিরা সেখানে সাপ্তাহিক সভা করে টাকা তোলেন আর তা জামায়াতকে পাঠান। তো আমার মামাও সেখানে টাকা দেন। আমি বল্লাম আরে তুমি গেছো নিজের যোগাযোগে। তুমি কেন টাকা দিবে তাদেরকে। তিনি জানতে চাইলেন, তারা কিভাবে গেছে তাহলে। আমি তাকে বল্লাম, তারা সৌদি এম্বেসির ভিসা পেয়েছে আমীর আযম সাহেবের চিঠির কল্যাণে। তারা জামায়াতের কর্মী। তারা চাঁদা দিচ্ছে। তুমি কেনো দিবে। মামা ফিরে গিয়ে যখন নিশ্চিত হলেন তাদের ভিসা পাওয়ার কারণ আমিরের চিঠি, তখন তিনি চাঁদা দেয়া বন্ধ করলেন।

টাকা অবশ্য সৌদি রাজপরিবার থেকেই দেয়া হতো। ওয়াহাবী মতবাদে বলীয়ান সৌদি রাজপরিবার তখন বিশ্বব্যাপী ইসলামের জোশ ও তাকত বাড়ানোর জন্য আর্থিক সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে। যদিও পরে যখন খোদ সৌদি আরবে রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো তখন এসব অর্থ অনুদানের বিষয়ে সৌদি সরকার সাবধান হয়ে গেলো। তবে আমি যখন ছাত্র তখন ছাত্রশিবিরের টাকার কোনো অভাব ছিল না। সমস্যা দেখা দিলো যখন কিছু সদস্য ইরানের বিপ্লব দেখে অনুরূপ বিপ্লবের জন্য উতলা হয়ে উঠলেন। তখন শিবির ও তার পৃষ্ঠপোষক জামায়াতের মধ্যে সৌদি অর্থ আর ইরানের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে সমস্যা দেখা দিলো। সমস্যা থেকে বিরোধ। বিরোধ থেকে ভাঙন।

কিন্তু ভেঙে বের হয়ে যাওয়া অংশটি প্রচুর ছাত্রদের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও অর্থের অভাবে সংগঠন ধরে রাখতে পারেনি। ইরান তখন নিজের অর্থনীতিকে সাজাতে ব্যস্ত। দূর বাংলাদেশের ছাত্র-বিপ্লবীদের জন্য তারা কি আর মুদ্রা পাঠাবে। যেহেতু ছাত্রশিবিরের কর্মী, সেহেতু সবই একান-ওকান হয়ে জানতে পারতাম ভেতরের এসব কল-কব্জা। আমার শুধু খারাপ লাগতো এই ক্ষমতামুখী প্রচেষ্টার জন্য। আমি বুঝতে পারতাম না ধর্মের নামে সৃষ্ট একটি দল ধর্মকে যথাযথ অনুসরণ করার চেয়ে যেকোনো উপায়ে কেন ক্ষমতায় পেঁৗছাতে চায়? আন্দোলন করার ক্ষেত্রে কি আদর্শ বজায় রাখতে হয় না। আমি এই নিয়েও প্রশ্ন তুলি কর্মশালায়। আমাকে তখন পড়তে দেয়া হলো নবী মুহাম্মদের যুদ্ধের বিসত্দারিত বিবরণ। তখন আমি কিছুটা আশ্বসত্দ হলাম। যুদ্ধে যে কৌশল বড়, আদর্শ নয়। আমাদের নেতা তো নবী মোসত্দফা।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।