সত্যের পোষাক ধার নিয়ে মিথ্যার বাণিজ্য

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন শোহেইল মতাহির চৌধুরী (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৮/০৬/২০০৬ - ৮:৫৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


শিশুশিক্ষার কালে আমরা প্রথম যে আদর্শ শিক্ষা পাই তা হলো,"সদা সত্য কথা বলিবে"। কিন্তু যত বড় হতে থাকি তত আমরা বুঝতে পারি যে সত্য বড় কঠিন। সত্য স্বীকার করা কঠিন। সব পরিস্থিতিতে সত্য বলাটা নিরাপদও নয়। এমনকি খোদ গৌতম বুদ্ধও বলেছেন, "কদাপি অপ্রিয় সত্য বলিও না"। সত্য বলার শিক্ষা দিলেও আমাদের পৃথিবীটা মিথ্যার কারখানা। নানা রকম মিথ্যার বাজার পৃথিবী জুড়ে। মিথ্যাকে চেনাটাও সহজ নয়। মিথ্যা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা রূপে। মিশে আছে সত্য বা অর্ধ-সত্যের সাথে। তার মাঝ থেকে মিথ্যাকে ছেঁকে বের করা খুবই কঠিন। তা ছাড়া সত্য যেমন এক নয়, সব মিথ্যাই সবার কাছে মিথ্যা নয়। মিথ্যা, নির্জলা মিথ্যা, নির্দোষ মিথ্যা, পরিসংখ্যানের মিথ্যা, গুজব, রটনা আর রাজনৈতিক প্রচারণা বা মিডিয়ার প্রোপাগান্ডাই শুধু নয় মিথ্যার রয়েছে আরো অনেক রূপ। মিথ্যার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত রূপের কামড় থেকে বাঁচতে সত্য-মিথ্যার আবেগ-আলুলায়িত মনটাকে আরেকটু শক্ত ও বাসত্দবানুগ করা দরকার সবার।

যখন একজন উকিল আদালতে তার মক্কেলের সদচরিত্র আর পরোপকারের বর্ণনা দিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলে তখন আমরা বুঝতে পারি এসবের পেছনে টাকা কথা বলছে। কিংবা যখন সরকারী প্রতিষ্ঠান মিডিয়ায় ঢোল-বাদ্য বাজিয়ে সোনালী সোনালী স্বপ্নের বর্ণনা দিয়ে 'গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের' মাহাত্ম্য তুলে ধরে তখন অনেক নিরূপায় কর্মচারী বুঝতে পারেন তাদের জীবিকার উপর নামতে যাচ্ছে খড়গ। রিয়েল এস্টেটের মালিকরা যখন বাহারি বিজ্ঞাপনে আপনার মত চড়ুই পাখির জন্য বাবুই পাখির বাসা বানিয়ে দেয়ার অঙ্গীকার করে তখন আসলে তারা নিজেরাই নিজেদের আখের গোছাতে ব্যসত্দ। আখেরের কথা যখন এলো তখন আখেরাত নিয়ে ধর্মের আর ধর্মগ্রন্থের প্রতিশ্রম্নতির সত্য-মিথ্যার কথা উঠতেই পারে। তবে মানুষকে যে সবসময়ই মিথ্যা প্রতিশ্রম্নতির আশ্বাস দিয়ে বিভ্রানত্দ করা যায় না তার একটা বেশ মজার প্রমাণ আজানের দোয়া। যার শেষ লাইনে ঈশ্বরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়, "নিশ্চয়ই তুমি ভঙ্গ করনা অঙ্গীকার"।

মিথ্যা আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছে নানাভাবে। টেলিভিশনে যেকোনো চ্যানেলে সংবাদ শুনুন দেখবেন মিথ্যার ধারাপাত কত সসত্দা। ব্যবসায়ীরা তাদের প্রচারণায়, রাজনৈতিক নেতারা তাদের বক্তৃতায় সত্যের ময়দার দলার মধ্যে চেপে চুপে ঢুকিয়ে দিচ্ছে মিথ্যার ভেজাল পামওয়েল। ইরাক ধ্বংস হয়ে গেলো 'ওয়েপন অব মাস ডিস্টাকশন' থেকে বিশ্বকে বাঁচানোর আশ্বাস দিয়ে। পৃথিবীর বড় বড় নেতারা, টনি বেস্নয়ার আর জর্জ বুশের মত বিরাট দেশের বিরাট প্রেসিডেন্ট বিশাল প্রাইম মিনিস্টাররা যদি দিনে দুপুরে এমন মিথ্যার বাজার বসান তবে সাধারণ মানুষের উপায় কী? তাদের জীবনী গ্রন্থই তো একসময় পাঠ করবে শিশুরা। যেমন আমরা পাঠ করেছি তাদের পূর্ববর্তীদের। এসব থেকে পরিত্রাণ হয়তো নেই তবে একথাও ঠিক, মহানেতা, মহাপুরম্নষদের কথাকে অমৃতবাক্য হিসেবে বিনাপ্রশ্নে মেনে নেয়ার যুগ শেষ হয়ে আসছে। একটু সচেতন মানুষ এখন সহজেই ধরতে পারে সত্যের মূর্তির কোথায় কোথায় লুকিয়ে থাকতে পারে মিথ্যার কাদামাটি।

কিন্তু সহস্র মিথ্যার পলিথিনে আমাদের বর্তমান সমাজ ও বিশ্ব ভরে গেলেও সত্যের প্রয়োজন একেবারে ফুরিয়ে যায়নি। মিথ্যা কাউকেই চিরকাল চালকের আসনে রাখতে সক্ষম হবে এমন আশা করাটা বোকামিই হবে। মিথ্যার পক্ষে অনেক যুক্তিই হয়তো দাঁড় করানো যায়, কিন্তু শেষ বিচারে সেগুলো অজুহাতই থেকে যায়:
1. সব মানুষই নানা রকম মিথ্যা কথা বলে।
2. মিথ্যা নানা রূপে আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে।
3. কিছুটা সময়ের জন্য হলেও মিথ্যা আমাদের জীবনের গতিকে বাধাহীন করে।
4. মিথ্যা হতে পারে খুব মজার (ক্ষেত্র বিশেষে)।
5. মিথ্যা কল্পনা ও চিনত্দা-ভাবনা আপনাকে আশ্বসত্দ করতে পারে যে আপনার জীবনটা যতটা খারাপ দেখা যাচ্ছে ততটা খারাপ না।
6. মিথ্যা আপনাকে একটা আড়াল দেয় যার পেছনে আপনি নিজেকে বা সত্যকে লুকাতে পারেন।

অস্বীকার করবো না এর সবই সত্য। কিন্তু এর অনেক কিছুই সাময়িক। আপনি যদি আপনার সফলতাকে দীর্ঘসময় ধরে রাখতে চান তবে তাকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে সত্যের উপর। কেন সত্যকে ভালবেসেই জীবনকে সাজাতে হবে, তার সুবিধার কয়েকটি কারণ হলো:

1. মার্ক টোয়েনের কথাটাই সবচে জরম্নরি। তিনি বলেছেন, "যদি আপনি সত্য বলেন তবে আপনাকে কোনোকিছুই মনে রাখার কষ্ট করতে হবে না"।
2. আপনার গাল-গল্পগুলোকে যৌক্তিক করার জন্য বিশদ কিছু আপনাকে মনে রাখতে হবে না কারণ আপনার কাহিনীগুলো সত্যি, সুতরাং এর সত্যতা প্রমাণে আপনাকে পাহাড় কাটার কষ্ট করতে হবে না।
3. আপনি যদি ন্যায় বা সত্যের পক্ষে অবস্থান নেন তবে নিজের কাজ নিয়ে পরে আপনি অনুশোচনার কষ্টে ভুগবেন না।
4. মানুষ আপনাকে অনেক বেশি বিশ্বাস করবে যা আপনাকে অনেক সহজে সফলতা এনে দেবে।
5. অন্যান্যদের সাথে আপনার ব্যক্তিত্বের সংঘাত কম হবে।

সত্য-মিথ্যার সুবিধা-অসুবিধার এই যে ফারাক তা বাসত্দবে নিশ্চয়ই এতোটা স্পষ্ট না। সত্য-মিথ্যার সংজ্ঞা ও পার্থক্য করাটাও সহজ নয়। সার্বজনীন সত্য ও সার্বজনীন মিথ্যা খুঁজে পাওয়াটাও কষ্টকর। সত্যকে তাই আবিষ্কার করতে হয় নিজের মত করেই। মিথ্যাও তাই ব্যক্তিগত বিচারে মাত্রা পায়। আদর্শ লিপির সত্য-মিথ্যার জ্ঞান ও ধারণা থেকে আসলেই আমরা অনেক অনেক দূরে সরে এসেছি। আদর্শের সত্য-মিথ্যা বিচার করার অবশ্য জোরালো কারণ নেই। তবুও আমরা তা করি।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।