বন্ধুরা সব যায় কোথায়?

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন শোহেইল মতাহির চৌধুরী (তারিখ: মঙ্গল, ১১/০৭/২০০৬ - ৩:৫৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে নতুন নতুন বন্ধু আমরা পাই। স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, কর্মক্ষেত্রে। প্রতিবারই মনে হয় আগের বন্ধুগুলো গেছে যাক, এই নতুন বন্ধুগুলোকে আর হারাতে দেব না। কিন্তু নানা ব্যসত্দতায়, কিংবা অলসতায় নতুন পাওয়া বন্ধুগুলোর সাথেও একসময় বাঁধন আলগা হয়ে আসে। অনেকেই তাদের হারিয়ে যায়। প্রিয় প্রিয় বন্ধুদের সাথে যোগাযোগটা হারিয়ে ফেলি। একসময় যাদের ছাড়া জীবনের একটি ঘন্টাও কল্পনা করা যেত না সেইসব বন্ধুরা আড়ালে চলে যায়, হারিয়ে যায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একটি স্মরণীয় বাণী পড়েছিলাম। "পৃথিবীর সবচে সুখী ব্যক্তি সে, যার জীবনের প্রথম বন্ধু এখনও তার বন্ধু"। সাথে সাথে আমার মনে পড়ে নান্টুর কথা। মীর মোহাম্মদ আলী নান্টু। আমার প্রথম বন্ধু। স্কুলে পাওয়া বন্ধু। জীবনের প্রথম প্রাথমিক স্কুলে নান্টুকে ফেলে রেখে এসেছি। কোনো যোগাযোগ রাখিনি। তারপর অনত্দত: আরো গোটা তিনেক স্কুলে পড়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটিতে নানাবাড়িতে গিয়ে খুঁজে বের করি নান্টুকে। নান্টু সম্ভবত: স্কুলের গন্ডি পেরোতে পারেনি। পারিবারিক দোকানটাতেই বসে। তবে এলাকার সাইনবোর্ডগুলো ওই লেখে। ওর দোকানে আড্ডা দিয়ে দিয়েই ছুটিটা কাটিয়ে দেই।

প্রাইমারি স্কুলে এসে আমি ভর্তি হয়েছিলাম ক্লাস ফোরে। নান্টুই প্রথমদিন ক্লাসে জায়গা করে দিয়েছিল ওর পাশে বেঞ্চিতে বসার। খুব সুন্দর হাতের লেখা ছিল নান্টুর। গোল গোল করে অনেকগুলো 'ম' অক্ষর দিয়ে ও যখন ওর নাম লিখতো মীর মোহাম্মদ আলী নান্টু, তখন মুগ্ধতায় আমি নির্বাক হয়ে যেতাম। কতবার নিজের নাম বদলে মীর মোহাম্মদ আলী করতে চেয়েছি।

নান্টুর সাথে আমার বন্ধুটা আবার জোড়া লেগে যায়। ঢাকায় আসে একসময় ও। ভোঁ ভোঁ বেকার। আমি সচিবালয়ের আমলা। তাতেও কোনো অসুবিধা হয় না। আমরা সময় ও সুযোগ মিলিয়ে অন্যান্য বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেই। অর্নেট ভিজু্যয়ালে ম্যানেজারের পদে সেলিম জোর করে বসিয়ে দেয় ওকে। কয়েকমাসের মধ্যে পুরো ঢাকা শহরে নান্টু সব নাট্যশিল্পী, পরিচালক, প্রযোজকদের কাছে এক প্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়ে উঠে।

চলে এলাম লন্ডন। ফিল্ড ওয়ার্কে ঢাকা ফিরে গিয়েও নান্টুর সাথে যোগাযোগ হলো। ভালোই ছিল অর্নেট ভিজু্যয়ালে, কে বা কারা বুদ্ধি দিল, নিজে হাউজ করার অলীক স্বপ্ন দেখে অর্নেট থেকে বের হয়ে গেল। আবার যথারীতি বেকার। মাঝে মাঝে মোবাইলে মিস কল দিতো। কখনও কল ব্যাক করতাম, কখনও না। দুজনই ঢাকা শহরে, তবু দেখা হয় না। হয়তো কিছুটা এড়িয়েই যেতাম। বেকার বলে কি? টাকা ধার চাইতে পারে সেই আশংকায়?

একদিন ভোরে সেলিম ফোন করে জরুরি যেতে বললো সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালে। অনেকদিন দেখা হয়নি নান্টুর সাথে। দেখি একটা মাইক্রোবাসের মধ্যে কফিনে শুয়ে আছে নান্টু। এখনি গাড়ি রওয়ানা দেবে ওর বাড়ির উদ্দেশ্যে। আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। অনেক মোটা হয়ে গিয়েছিলো নান্টু। আগের রাতে হার্ট এ্যাটাকে সোহরাওয়ার্দিতে ভর্তি হয়েছিল। গভীর রাতে আমাকে মোবাইলে মিসকল দিয়েছিল। অনেক রাত বলে আমি কলব্যাক করিনি। মীর মোহাম্মদ আলী নান্টু। আমার সমবয়সী আমার বন্ধু। লাশ হয়ে শুয়ে আছে কফিনে। আমি ওর লাশের দিকে বোবা হয়ে তাকিয়ে ছিলাম, কাঁদতে পারিনি। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়েছে। বন্ধুর সাথে ভীষণ অবন্ধুসুলভ আচরণ আমি করেছি। আমার মত ওর বাকী বন্ধুরাও কি অবহেলা করেছে। বেকার ছিলো বলেই কি? সেই অভিমানেই কি এই বয়সে চলে গেলো? এত তাড়াতাড়ি।

নান্টুর লাশ নিয়ে মাইক্রোটা সোহরাওয়ার্দি হাসপাতাল চত্বর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। আমি ওর কোনো স্মৃতি মনে করতে পারি না। আমার মনে পড়ে সেই কথাটাইঃ "পৃথিবীর সবচে সুখী ব্যক্তি সে, যার জীবনের প্রথম বন্ধু এখনও তার বন্ধু"।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।