মৌলবাদ ঠেকাতে কি ধর্মের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক ছিন্ন করা দরকার?

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন শোহেইল মতাহির চৌধুরী (তারিখ: শনি, ১৯/০৮/২০০৬ - ৯:২৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:


ধর্মভিত্তিক গণতান্ত্রিক দলগুলোও এখন মানছে যে জঙ্গি-মৌলবাদী দলগুলোকে রোখা দরকার। আর যারা প্রগতিপন্থী, রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করার পক্ষে, তারা রীতিমত শ্লোগান দিচ্ছেন 'যে কোনো মূল্যে মৌলবাদকে রুখতে হবে।'

মৌলবাদের চাষাবাদ নিয়ে আমার একটি ধারাবাহিক লেখা আছে এখানে। তার শুরুতে মৌলবাদ শব্দের বুৎপত্তি নিয়ে আলোচনা করেছি। এখানে সংক্ষেপেই বলি। মৌলবাদ শব্দের সোজাসাপটা অর্থ মূল থেকে তৈরি তত্ত্ব বা মতবাদ। কোন মূল থেকে? অনেক জটিল ও গভীর আলোচনা বাদ দিয়ে সরাসরিই বলা যায়, ধর্মীয় অন্ধ-বিশ্বাস, বিজ্ঞান, যুক্তি ও প্রগতি-বিরোধী বিশ্বাসের মূল থেকে তৈরি হওয়া মতবাদই মৌলবাদ।

নিত্যনতুন আবিষ্কার ও জ্ঞানের উৎকর্ষতা দিয়ে জীবনকে ব্যাখ্যা ও সাজানোই যদি প্রগতিপন্থী মানুষের জীবন-ধর্ম হয়ে থাকে তবে পুরনো, অবাস্তব, সময়ের সাথে খাপ খায়না এমন চিন্তাধারাকে জোর করে বর্তমান পৃথিবীর মানুষের জীবনে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টার নাম মৌলবাদ।

প্রশ্ন হচ্ছে এখন যে একযোগে সবাই মৌলবাদকে রোখার আওয়াজ দিচ্ছে। বিশেষ কারাগারে জঙ্গিদের আটকে রাখছে, বিশেষ আদালতে বিচার বসাচ্ছে, নিজেদের সাথে সাথে এদের কোনো যোগসাজশ নেই বলে হলফ করছে,-এর কতটা গ্রহণযোগ্য? এ বিষয়ে তারা কতটা আন্তরিক আর কতটা ভন্ড? তার কি আসলেই মৌলবাদকে মানবসভ্যতার শত্রু মনে করে একে থামাতে চায় নাকি এক ঢিলে দুই পাখি মেরে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চায়?

এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে, আমাদেরকে দেখতে হবে যারা আওয়াজ দিচ্ছে তাদের চিন্তার সাথে মৌলবাদীর চিন্তার পার্থক্য রয়েছে কি না। কিন্তু সমস্যার গভীরে গিয়ে বিশ্লেষণ করতে যারা পছন্দ করেন তারা আরেকটি জরুরি বিষয়কে সামনে তুলে আনেন। বিষয়টি 'পলিটিক্যালি কারেক্ট' নয়। অর্থাৎ সিংহভাগ মানুষের মন রেখে লুকিয়ে ছাপিয়ে একটা সমঝোতার তৈরি সত্য নয়। এটি বড় অপ্রিয় সত্য।

তারা বলেন, মৌলবাদকে ঠেকাতে হলে ধর্মীয় বিশ্বাসকেই আঘাত করতে হবে। কেন? কি যুক্তিতে তারা এরকম একটা কথা বলতে পারেন? তাদের যুক্তি হলো, মৌলবাদের শক্তি একদিনে বাড়েনি। ধর্মের চাষ, ধর্মের ব্যবসার প্রতি প্রগতিশীল মানুষের সহানুভূতির দৃষ্টিই মৌলবাদীদের শেকড়কে শক্ত করেছে। সংসদ নির্বাচনে জনগণের ভোটপ্রার্থনার আগে দলের শীর্ষনেতারা যান দেশের বিখ্যাত মাজারগুলোয়। দুর্নীতিতে বিশ্বরেকর্ডকরা রাষ্ট্রপ্রধান, যাবতীয় ছল-চাতুরিতে যার জুড়ি মেলে না, হেলিকপ্টার নিয়ে ধর্ণা দিতেন পীরের মাজারে, গণনেত্রী হঠাৎ করে মাথায় কালো পট্টি বেঁধে গদগদ হয়ে পড়েন। রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রে ধর্মের নানা অনুষ্ঠান দিনে দিনে বাড়ছে। সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থায় এমন একটা পরিমন্ডল সৃষ্টি করা হচ্ছে যে সাধারণের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রভাব আরো জাঁকিয়ে বসছে। সেই সুযোগে, ধর্ম যেহেতু একটি নাজুক বিষয়, ধর্মীয় অন্ধ-বিশ্বাসীরের বণিক মৌলবাদীরা তাদের নখর বের করে সমাজের শরীরে আঁচড় কাটছে প্রকাশ্যে।

ভোটের বাক্সকে পুষ্ট করার জন্য তথাকথিত মধ্যপন্থী, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর যে নীতিহীন ভন্ডামি, তার সুযোগেই ধর্ম চাগিয়ে বসে এখন মেলে ধরেছে তার কুসংস্কারের চাদর। অথচ ধর্মনিরপেক্ষ (সেকু্যলার অর্থে) রাষ্ট্রে বা আধুনিক রাষ্ট্রে ধর্মকে সরিয়ে রাখার কথা ছিল এসব ক্ষেত্র থেকে। এখন আবার যদি সেই সেকু্যলারিজমই অর্জন করতে চাই আমরা, এবং তাই করা উচিত বলে মনে করেন সব রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা, তবে ধর্মের এই প্রভাব খর্ব করতে হবে। উপরের এই যুক্তিতেই তারা জোরের সাথে বলছেন যে, রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে ধর্মের খোলস খসাতে না পারলে মৌলবাদকে ঠেকানো সম্ভব নয়। আর প্রগতির চাকাকে সামনের দিকে ঘুরাতে হলে তা করা দরকার এখনই, জরুরি ভিত্তিতে।


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।